somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১০:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হৃদয় ব্যাকুল করা হিম বাতাস, চিড় ধরাচ্ছে অস্তিত্বে...
২০০৯ সাল, নিকুঞ্জ-২ এ ১৩ নম্বর রোডে থাকি, আমি আর রেজা​ দুইটা মানুষ শুধু। সময় এবং মানুষের অভাবে খাওয়াদাওয়া লাটে উঠেছে, বাড়ি থেকে ঢাকা ফেরার দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে চার-পাঁচ কেজি ওজন কমে বেহাল দশা হয় আমাদের। হাড্ডিসার অবস্থায় আবার যখন বাড়ি ফিরি মা-বাবা চিন্তিত মুখে তাকান, জিজ্ঞেস করেন- "খাওয়াদাওয়ার কি অবস্থা বাবা?" আমি ম্লান চোখে ফ্যালফ্যল করে তাকিয়ে থাকি। অবস্থা বেগতিক বুঝে একদিন মা ফোনে বললেন, "একটা মানুষ পাঠাচ্ছি ঢাকা, বাসায় থাকবে, রান্নাবান্না করবে।" আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। দিন ঘনিয়ে আসল। তাকে কিভাবে পাঠাবে, কেমনে পৌঁছাবে বাসায় এসব নিয়ে মহাজট পাকানো অবস্থা। মানুষ তো আর পার্সেল না যে কুরিয়ার মারফত পৌঁছে যাবে। বন্ধু নিটোল​ তখন কক্সবাজার থেকে ঢাকা আসবে- সমাধান পেয়ে গেলাম আমরা। নাইটকোচ ঢাকা পৌঁছে ভোরে। সেদিন আর ভোরে পৌঁছাল না, জ্যামে আটকা পড়ে আটটার মত বেজে গেল প্রায়। আমিও অপেক্ষায়- দেখা যাক কেমন মানুষ পাঠাল বাসা থেকে। সকাল বেলা কলিং বেজে উঠলে দরজা খুললাম। ওমা, এ কে? বন্ধু নিটোল এর সাথে সাথে যে এসে ঢুকল সে তো একটা বাচ্চা, বড়জোর ১২ হবে বয়স। ঢুকল ওরা বাসায়, জিজ্ঞেস করলাম, "কি নাম তোর?" তড়িৎ উত্তর দিল ও, "আব্দুল আমীন"। বিদেশী ব্লন্ড-দের মত না হলেও অদ্ভুত সোনালী চুলের রং ওর। ধবধবে সাদা গায়ের রং, শিশুতোষ দুষ্টামী খেলে বেড়ায় দুই চোখে। আমি আর রেজা আদর করে বন ডাকতাম 'বন জোভি'। আরও কত নাম- তার মধ্যে কিভাবে জানি 'ফুতিয়া' নামটা স্থায়ী হয়ে গেল।
বাসায় বন্ধু-বান্ধবের আনাগোনা লেগেই থাকে। রেসি, রাফি, রাসিফ, জামি ভাই, রহিম ভাই থেকে শুরু করে বাড়ির দারোয়ান বাচ্চু মিয়া- সবার স্নেহের একদম সেন্টার অফ গ্রাভিটিতে কাটতে লাগল ফুতিয়া'র দিন। রান্নাবান্না'র অ-আ-ক-খ ও জানেনা এই বাচ্চা। সমাধানের নামে কী উটকো ঝামেলা পাঠিয়ে দিল বাসা থেকে এই চিন্তায় ক্ষুধা পেটে নিয়ে রাগও উঠে মাঝে মাঝে। স্বেচ্ছায় তাকে রান্না শিখাবার মহান দায়িত্ব নিয়ে নিলেন দারোয়ান বাচ্চু মিয়া। কয়েকদিনের মধ্যেই ভীষণ চটপটে ছেলেটা দেখি আমাদের ভাত, ডাল, আলু ভাজি, মুরগীর মাংস রান্না করে খাওয়াতে লাগল। ছুটিতে আমাদের সাথে বাসায় যায়, আবার আমাদের সাথে চলে আসে ঢাকা। মাঝে মাঝে অবাক হতাম, কত সহজেই এমন বাচ্চা একটা মানুষ বাবা-মা'কে প্রায় সাড়ে চারশ কিলোমিটার দূরে ফেলে দিব্যি থেকে যাচ্ছে আমাদের সাথে! মাস কাটল, বছর কাটল। নিকুঞ্জের বাসা ছেড়ে আমরা গেলাম লেক সিটি, সেখান থেকে উত্তরা, ছায়াসঙ্গী হয়ে লেগে থাকল ফুতিয়া।

দারিদ্রতা বড় ভয়ানক, বাবার চোখে সন্তানকে রিকশা বানিয়ে দেয়- ওই রিকশায় ভর দিয়ে যত টাকা পাওয়া যায় সেটাই সুখ। ফুতিয়ার বাবাও ব্যতিক্রম ছিলনা, ছেলে কেমন আছে তার চেয়ে যখন কত উপার্জন করছে তার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে গেল আমাদের দেওয়া হাজার দুইএক টাকা নস্যি মনে হল তার। নিজজ্ঞানে হোক আর বাবার তাগিদেই হোক আরও কিছু বেশি কামানোর তাগিদে এক ছুটিতে আমাদের সাথে বাসায় গিয়ে আর ফিরে আসলনা ফুতিয়া। দু;খ ভারাক্রান্ত মনে মেনে নিলাম আমরা। যোগাযোগ কেটে গেলনা তবুও। বলতে গেলে ও-ই রেখে দিল যোগাযোগ। আমি আর রেজা-কে বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন দিয়ে কিছুদিন পরপর আপডেট দিয়ে যেতে লাগল ও। "অনি ভাই, আমি তো সাতকানিয়ায় বাস থামেনা? ঐ যে মিডওয়ে ইন হোটেলটা আছেনা? ঐটাতে আছি।" আমি জিজ্ঞেস করি "কি করস ওইখানে?" সেই পুরনো সুরে তড়িৎ উত্তর দেয়, "বয় এরি ভাই।" অকারণে-অসময়ে ফোন দিয়ে শুধু একটা কথাই তার, "ভাই বাসাত হত্তে আইবান? বেশি ফেট ফুরের অনরাল্লা? সাইত মনে হদ্দে..." (ভাই, বাসায় কখন আসবেন? খুব প্রান কাঁদে আপনাদের জন্য, দেখতে ইচ্ছা করে ভাই...)

যত বার কক্সবাজার যাই দেখা হয় ওর সাথে। একদিন দেখি আমার বাসার নিচেই দাঁড়িয়ে আছে ও, পাশে একটা রিকশা। আমি অবাক, " ওমা, তুই রিকশা চালাস নাকি?"- ও হাসে; বলে, "কোথায় যাবেন চলেন, নামাই দিই।" ওর রিকশায় উঠতে মন সায় দেয় না। পকেটে টাকা পয়সা কিছু থাকলে দিয়ে বলি "কিছু খেয়ে নিস"। গতবারের ছুটিতে দেখি বাসায় গিয়ে দেখি বাসার সামনে মোড়ে রিকশায় বসে আছে ও, মাথায় ইয়া বড় ব্যান্ডেজ। আমার বড়​ ভাই পাশে দাঁড়ানো ছিল, উনিই বললেন "শয়তান হইসে ও, কোথায় মারামারি করে মাথা ফাটায় আসছে। আমি ব্যান্ডেজ করায় দিলাম।" ফুতিয়া দেখি হাসে, আমাকে বলে "কই যাবেন আপনি"। আমি বললাম "বীচে"। সেদিন জোর করেই রিকশায় তুলল। হালকা ভারী বিভিন্ন উপদেশ দিতে দিতে একসময় বীচে পৌঁছে গেলাম আমরা। পকেটে যা ছিল দিয়ে বললাম, "পারলে রিকশা চালাইস না, অন্য কিছু কর। কিছু লাগলে জানাইস আমারে। আর শয়তানী বাদ দে, এরপর এইসব শুনলে মাথার যেই সাইড ঠিক আছে ঐটা আমি ফাটাইয়া দিব কিন্তু...।" "না, না, আর হবেনা"- বলে কোনমতে বিদায় নিল ও। আমি হাঁটা লাগালাম- বালুতট বেয়ে...

যান্ত্রিক শহুরে জীবনে খোলা বাতাসের বড় অভাব। তবে আজ ভিন্নতা আছে, আজকের বাতাস বড় সামুদ্রিক। শরীর নামের তরীটাতে উদাসী বাতাস মেখে, পিঙ্ক-ফ্লয়েডীয় পাল চড়িয়ে দিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে হেলে দুলে তীরে ভিড়ালাম কোনভাবে। রাজ্যের আলস্য চোখে নিয়ে ছ'তলা ডিঙ্গিয়ে বাসায় ঢুকলাম অবশেষে......তখনি ফোনটা বেজে উঠল, আম্মা ফোন দিয়েছেন। কুশল বিনিময় হল, হালকা পাতলা পারিবারিক আলাপ। হঠাৎ ঠান্ডাগলায় বললেন, "ফুতিয়া মারা গেছে বাবা......কারেন্টে লাগসে..." আমার আশেপাশে ততক্ষণে অসংখ্য কাঁচ, ঠুং-ঠাং, ঠিশ- ঠাশ বিচিত্র শব্দ তুলে ভেঙ্গে যাচ্ছে, ছিঁড়ে-ফুঁড়ে যাচ্ছে সত্ত্বা। সাথে হৃদয় ব্যাকুল করা হিম বাতাস- চিড় ধরাচ্ছে অস্তিত্বে...
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×