আমাদের সমাজে এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যে কোন না কোন ধান্ধার পেছনে ঘুরছে না। উঠতি বয়সের তরুণ থেকে শুরু করে বয়সী কর্মজীবি মানুষ, সবাই একটার পর একটা ধান্ধায় সমস- জীবন পার করে দিচ্ছে। নিজের ধান্ধা ছাড়া অন্য কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করার সময় কারো নেই। সবার মুখে একই কথা ”ভাই আমি খুবই ব্যস্ত, আমার কোন সময় নেই।”
আসুন একটি বার চিন্তা করি কোন ধান্ধার পেছনে আমরা পাগলের মত ছুটে চলেছি। আর কি নিয়েই বা সমাজের তরুণ বৃদ্ধ সবাই এত ব্যস-। এখনকার দিনে তরুণদের একমাত্র ধান্ধা হচ্ছে যত বেশী পারা যায় ফূর্তি করা, আনন্দে থাকা, জীবনের স্বাদ উপভোগ করা। সবার মধ্যে একই চিন্তা কিভাবে একটা অ্যাফেয়ার করা যায়। একটা বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড(girl friend) খুবই প্রয়োজন- ”তা না হলে জীবনটাই বৃথা” এরকম একটা মানসিকতা সবার মধ্যে। হলিউড বলিউড সংস্কৃতির তীব্র আগ্রাসন তাদের চিন্তার জগতকে এতটাই দখল করে নিয়েছে যে এসব ছাড়া অন্য কোন কিছু তারা ভাবতেই পারে না। বিয়ের আগে প্রেম, সেক্স(sex) এগুলো এখনকার দিনে ফ্যাশন(fashion)। লেকের পাড়ে, পার্কে, লাইব্রেরীর বারান্দায় সর্বত্র যুগলদের সদাসর্বদা ব্যাপক উপস্তিতি এখন আর কারোরই চোখ এড়ায় না। আজকাল ছেলে মেয়ে সম্পর্ক শুধু ’নির্দোষ প্রেম’ কিংবা বিয়ের সম্পর্ক নয়। এসব ক্ষেত্রে এমন অনেক কিছুই ঘটে যা এখন ওপেন সিক্রেট। ছেলেরা একটা মেয়ে খুঁজছে সর্বত্র, সর্বক্ষন। কলেজ(college), বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দি ছবি, মিউজিক ভিডিও, সিনে ম্যাগাজিন কিংবা সাইবারক্যাফেতে ডাউনলোড করা পর্নোছবি সব কিছুতেই ছেলেদের একটাই ধান্ধা- একটা মেয়ে। ছেলেদের এই ধান্ধা পূরনের জন্য সমস- নগর জুড়ে চলছে আরো নানা আয়োজনে কনসার্ট, মীনাবাজার ফ্যাশন শো, সুন্দরী প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।
বারে গিয়ে দামী বিদেশী মদ, বিয়ার ইত্যাদি সম্ভব না হলেও অন-তপক্ষে ’ডাইল’ এর ফিলিংস নেয়া বর্তমান প্রজন্মের অনেক তরুনের কাছে আরেকটি ধান্ধা। আর এই ধান্ধার পেছনে ছুটতে গিয়ে সে চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। শেষ পর্যন- তাদের ঠাঁই হচ্ছে জেলখানায় কিংবা কোন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের বিছানায়।
বয়সের সাথে সাথে আমাদের ধান্ধাও পাল্টায়। শিক্ষা জীবনের শেষে যুবকদের মাথায় ঢোকে ক্যারিয়ারের(career) ধান্ধা। এখন তার মাথায় একটাই চিন্তা কিভাবে কাকে ধরে, ঘুষ দিয়ে কিংবা তোষামোদ করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। রাতদিন পত্রিকার পাতায় অথবা বিভিন্ন ওয়েব সাইটে চাকরির বিজ্ঞাপন খোঁজা নিয়ে সে ব্যস-। সহসাই সে বুঝতে পারে চাকরীর বাজারে তার প্রতিদ্বন্দীর সংখ্যা অনেক, তাই তাকে জ্যাক ধরতে হবে। শুরু হয় ‘মামা’ খোঁজার ধান্ধা। একটা ভাল চাকরির জন্যে সে সবকিছু করতে রাজী। এমনকি নিজেকে বিক্রি করতেও তার মনে কোন বাধা নেই।
একটা চাকরি পাবার পর তার চিন্তা এর চেয়ে ভাল চাকরি কিভাবে পাওয়া যায় অথবা কিভাবে বসকে(boss) খুশী করে তাড়াতাড়ি প্রমোশন(promotion) পাওয়া যায়। আর বসকে খুশী করার উপায় হচ্ছে নয়টা থেকে নয়টা গাধার মত খাটা আর বসের সব ইচ্ছা পূরন করা। বস তার কাছে দেবতার মত, বসকে কিছুতেই অসন-ষ্ট করা যাবে না। সারাক্ষন বসের প্রশংসা করতে হবে। boss is always right। বসের সামান্য অনুরোধই তার জন্য হুকুম। স্যারের প্রিয় পাত্র হবার জন্য প্রত্যেক অফিসে যেন প্রতিযোগীতা চলছে। সবার মাথায় একটাই ধান্ধা কিভাবে আরো উপরে উঠা যায়। দুনিয়ার অন্য কোন কিছু নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? এই চাকরিটাই যেন তার জীবন। তার ধারনা এই চাকরিই তার জীবনের সফলতা ব্যর্থতার একমাত্র মাপকাঠি। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে যদি তার চাকরিটা মোটামুটি স্হায়ী হয়ে যায় আর এর মধ্যে দুএকটা প্রমোশনও জুটে যায় তাহলে সে যথেষ্ট আস্থার সাথে বিয়ের বাজারে দরদাম শুরু করতে পারে।
অপরদিকে যারা চাকরির ধান্ধায় অন্যদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারে না তাদের ধান্ধা হচ্ছে যেকোন ভাবে হোক দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমানো। বিদেশে যাবার ধান্ধা মাথায় ঢুকলে শুরু হয় বিভিন্ন বিদেশী কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ যাওয়া এবং সেই সঙ্গে আমেরিকা, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশের বিভিন্ন নামী বেনামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটার পর একটা এপ্লিকেশন পাঠানো। এর মধ্যে চলতে থাকে স্পোকেন ইংলিশ( spoken English) কোর্স কিংবা SAT/TOEFL/IELTS এ ভাল স্কোর করার প্রানপন চেষ্টা। দেশ ছেড়ে বেরিয়ে যাবার ধান্ধার পেছনে খরচ হতে থাকে লাখ লাখ টাকা। অনেক সময় সে এতটাই মরিয়া হয়ে উঠে যে জাল পাসপোট এবং অবৈধ পথে বিদেশে যাবার মত বিপদজ্জনক পথ বেছে নিতেও সে পিছপা হয় না।
বয়স যখন পঁয়ত্রিশের কোঠা পেরোয় আর সংসার জীবন শুরু হয় তখন তার ধান্ধাও পাল্টে যায়। এখন তার আসল ধান্ধা কিভাবে ধন সম্পদ আরো বাড়ানো যায়। এজন্য বৈধ অবৈধ যে কোন পন্তা অবলম্বন করতে সে রাজী। সে চিন্তা করতে থাকে তার যখন ৬৫ বছর বয়স হবে তখন সে কতটা প্রতিষ্ঠিত থাকবে আর তার সন্তানদের জন্য কত বেশী সম্পদ রেখে যেতে পারবে। এখন এটাই তার একমাত্র ধান্ধা। সে দিনরাত পরিশ্রম করে যাতে করে আরো বেশী টাকা উপার্জন করা যায় এবং ভবিষ্যতের সকল ঝুঁকি ও বিপদাপদ থেকে পরিবারকে রক্ষা করা যায়। নামী কোম্পানীর শেয়ার কেনা(share business), ব্যাংকে উচ্চহার সুদে ডিপোজিট একাউন্ট খোলা, জমি কেনা, ব্যাংকলোন নিয়ে এপার্টমেন্ট কেনা, বিভিন্ন ব্যবসায় টাকা খাটানো ইত্যাদি সব উপায়েই সে চেষ্টা করতে থাকে যাতে করে সে আরো বেশী সম্পদশালী হতে পারে। এর কোন শেষ নেই। তার আরও চাই, আরও! তার একটা ধান্ধা পুরন হলে তাকে আরেকটা ধান্ধার নেশায় পেয়ে বসে। টাকাই হচ্ছে তার চুড়ান্ত ধান্ধা। তার সমস- অসি-ত্ব জুড়ে টাকার চিন্তা। যেন এটা একটা ড্রাগ যা ছাড়া সে বাঁচতে পারে না। তার প্রাপ্ত্যহিক জীবনের প্রতিটি কর্মকান্ড একমাত্র অর্থনৈতিক লাভ ক্ষতি ধারা নিয়ন্ত্রিত হয় । অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতিই কোন কাজে তার সংযুক্তি অসংযুক্তি নির্ধারন করে দেয় । লাভ হলে সে যে কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করে বা কথা বলে আর লাভের সম্ভাবনা না থাকলে তা করে না। তার সমস- চিন্তা, কথা ও কাজের পেছনে একটাই উদ্দেশ্য টাকা উপার্জন। একটাই তার মাপকাঠি - আর্থিক লাভক্ষতি। আর নিজের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে নিজেকে সফল প্রমান করার জন্য ক্রমাগত চাপ তো আছেই। যতটাকা আর সম্পদ, তত ‘সম্মান’ ‘গুরুত্ব’ ‘স্ট্যাটাস’(status) আর নিরাপত্তা। প্রচুর ধন সম্পদ মানেই হচ্ছে অধিক সম্মান , অধিক সুখ্যাতি , অধিক সি-তিশীলতা এবং অধিক নিরাপত্তা ।
আপনিও কি এই চিন্তাশূন্য সমাজের অংশ?
আমাদের জীবনের সমস- সময় ব্যয় হচ্ছে শুধুমাত্র আমাদের ধান্ধাগুলো পূরনের কাজে, যুবক বৃদ্ধ, ধনী গরীব সবাই এমন একটা কালচারের(culture) দাস হয়ে পড়েছি যা আমাদেরকে ব্যস- রাখছে বস-গত এবং ইন্দ্রিয় সুখ লাভের সার্বক্ষনিক চেষ্টার মধ্যে। আমাদের মধ্যে যে যত বেশী সম্পদ উপার্জন এবং ফুর্তি করতে পেরেছে তাকে তত বেশী সফল বলে মনে করা হচ্ছে। কিন- প্রকৃতপক্ষে আমরা যারা এই ধান্ধা কালচারের মধ্যে পুরোপুরি ডুবে আছি তারা কিন- খুব বেশী চিন্তা ভাবনা করে এটা গ্রহন করিনি। জীবনে সফলতার এই ধারনাকে আমরা অন্ধভাবে গ্রহন করেছি। কখনও প্রশ্ন করিনি এই ধারণাটি কি ঠিক না ভুল? বরং আমরা সমাজে আগে থেকেই যে সব ধান্ধা প্রচলিত আছে সে গুলোকে অন্ধভাবে অনুকরন করছি মাত্র। আমরা সব সময় সমাজের বাকী লোকদের সাথে নিজেকে তুলনা করি এবং তাদের সাথে ধন সম্পদ উপার্জন আর ভোগ বিলাসের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই। কিন- কখনও জানতেও চেষ্টা করিনা আমাদেও সমাজের লোকদের এই চিন্তা আর কাজগুলো কতটা যুক্তিযুক্ত?
এ ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং বস'কেন্দ্রিক অন্ধ সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে পাশবিক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে । যখন ধন সম্পদ আন্দ-উপভোগ প্রত্যেকের জীবনের সাফল্যের মানদন্ড,তখন কেন আমরা সমাজে চলমান বিশৃঙ্খলা দেখে বিস্মিত হই ? দূনীতি, চাঁদাবাজি ,মাস্টানি , ধর্ষণ (rape), এসিড নিক্ষেপ,খুন ,ছিনতাই ইত্যাদি এ সমাজ ব্যবস্থার স্বাভাবিক পরিণতি । এসব সমস্যার মূল কারন হচ্ছে সমাজে চলমান জীবন সর্ম্পকে ভূল চিন্তা ভাবনা ।
মানুষ সারা জীবন ধরে শুধুমাত্র বস-গত ও ইন্দ্রিয় সুখের জন্য একটার পর একটা ধান্ধার পেছনে ছুটে চলবে, একজন বিবেকবান মানুষের কাছে এটা কখনই গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। পশুদের মধ্যেও জৈবিক চাহিদা এবং প্রবৃত্তি রয়েছে, বেঁচে থাকার জন্য তাদেরকেও খাদ্য ও পানীয় গ্রহন করতে হয়। তারাও সন্তান জন্ম দেয় এবং বিরুপ পরিসি'তিতে নিরাপত্তার সন্ধান করে। কিন' তার পরও পশু এবং মানুষের মাঝে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। প্রাণীরা নিজের অবস্তাকে উন্নত করার জন্য চিন্তা করতে পারে না। তাই আমরা দেখি মানুষের চেয়ে অনেক বড় এবং শক্তিশালী প্রানীদেরকেও মানুষ বশ মানায় এবং নিজের কাজেও ব্যবহার করে। ফলে মানুষই পৃথিবীকে শাসন করে, বড় বড় প্রানীরা নয়। মানুষের মধ্যে একটি বিশেষ গুন থাকার কারনেই মানুষ এটা করতে পারে আর তা হলো তার নিজেকে ও তার চারপাশের জগৎকে নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা।
মানুষ পশুর চেয়ে আলাদা । খাওযা দাওয়া এবং যৌন-সর্ম্পকই তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয় । মানুষের চিন্তা করার সামর্থ্য রয়েছে । মানুষকে অবশ্যই এই ক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে এবং তার চারপাশের জগৎ, তার নিজের জীবন এবং অসি-ত্ব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে হবে। শুধুমাত্র খাওয়া দাওয়া ভোগ বিলাস আর সন্তান জন্ম দিয়ে পশুর মত সমস- জীবন কাটিয়ে দেয়া মানুষের কাজ হতে পারে না। তাকে অবশ্যই জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান লাভ করতে হবে। সে কিভাবে কোথা থেকে এই পৃথিবীতে এসেছে? তার জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? এই জীবনের পরে কি ঘটবে?
এবার থামুন এবং চিন্তা করুন
“আমি কোথা হতে এসেছি?”, “আমি এখানে কেন?”, “আমার গন্তব্য কোথায়?”- প্রত্যেক মানুষের জন্যই এ তিনটি অতন্ত্য- মৌলিক প্রশ্ন। অতীতে আমরা এখানে ছিলাম না, বর্তমানে আমরা এখানে আছি এবং শীঘ্রই আমাদের এ জীবনের অবসান হবে। আমরা প্রত্যেকেই একটি নির্দিষ্ট দিনে জন্মগ্রহণ করেছি এবং একটি নির্দিষ্ট দিনে মৃত্যু বরণ করবো। জন্মে যে জীবনের শুরু, মৃত্যুতে তার পরিসমাপ্তি। আমরা প্রত্যেকেই জীবনের এই মূল সত্যটা সম্পর্কে জ্ঞাত- অথচ আমাদের মাঝে খুব কম সংখ্যকই এ ব্যাপারে চিন্তা করে। এমন একটি সমাজে আমাদের বসবাস যেখানে এ প্রশ্নগুলোকে বোকামিসুলভ চিন্তাধারার ফলশ্রুতি মনে করা হয় এবং ঠিক সমভাবেই এগুলোকে ‘ফ্যাশনেবল’ বা ’স্মার্ট’(smart) বিবেচনা করা হয় না। এ সমাজ আমাদেরকে প্রতিনিয়ত সম্পূর্ণরুপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে অর্থাৎ কিভাবে প্রচুর ধন সম্পদের অধিকারী হওয়া যায় সে চিন্তায় ব্যস- রাখে। ’কমপক্ষে ৫০-৬০ বছর বাঁচব’- এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজের প্রত্যেকেই নিজেদের জীবন সাজানোয় বিভোর। ফলস্বরুপ আমরা প্রত্যেকেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি, পরিকল্পনা এবং সমন্বয় সাধনের কাজে নিজেদেরকে পুরোপুরি ব্যস- রেখেছি।
মানুষের কিছু মৌলিক বাস-বতা আছে যেগুলোকে সে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারে না। সে নিজের আকার আকৃতি কিংবা লিঙ্গ নির্ধারন করতে পারে না। সে অক্সিজেন, খাদ্য, পানীয় ছাড়া বাঁচতে পারে না। তার জীবন ও মৃত্যুর উপরও তার বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রন নেই। একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তে সে মৃত্যুবরণ করে। প্রতিনিয়ত তার জীবনের শেষ দিন, শেষ মুহূর্তটির দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে। সে এই সময়টিকে এগিয়েও আনতে পারে না, পিছিয়েও দিতে পারে না। এসব অনস্বীকার্য বাস-বতা একটা বিষয়কেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে, তা হলো মানুষ নিজেকে নিজে সৃষ্টি করতে পারে না বরং মানুষ নিজেই অন্যের দ্বারা সৃষ্ট এবং এমনভাবে তাকে ডিজাইন করা হয়েছে যা সে কিছুতেই পরিবর্তন করতে পারে না।
ইসলাম মানুষকে তার জীবনের এই মৌলিক প্রশ্নাবলী নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার তাগিদ দেয়। পবিত্র কোরআনের শত শত আয়াতে মানুষকে তার চারপাশের বাস-ব দুনিয়াকে মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষন করার জন্য উপদেশ দেয়া হয়েছে।বিশ্বজগত তথা সূর্য, গ্রহনক্ষত্র, দিনরাত্রির আবর্তন, প্রানীকুল, বৃক্ষরাজি, বিভিন্ন বর্নের মানুষ ও তাদের মুখের ভাষা ইত্যাদি হাজারো বিষয় নিয়ে চিন্তা গবেষনা করে এদের মধ্যকার জটিল সুনিপুন ব্যবস্তাপনাকে বিবেচনা করে আল্লাহ মানুষকে চরম সত্যে উপনীত হবার জন্য আহবান করেছেন। কোরআনের আয়াতের পর আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মানুষকে মূক, বধির ও অন্ধের মত নিজের চারপাশের ঘটমান বাস-বতাকে উপেক্ষা না করার জন্য সতর্ক করে দিয়েছেন।
“নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিনরাত্রির আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে সেই সব মানুষদের জন্য যারা বোঝে।” (আল কোরআন-৩:১৯০)
“এবং তার নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে আকাশ ও পৃথিবী, তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র; অবশ্যই এসবকিছুই নিদর্শন সেই সব লোকদের জন্য যারা জানে।” (আল কোরআন-৩০:২২)
ইসলাম(islam) পৌরানিক কল্পকাহিনী কিংবা মানুষের চিন্তাপ্রসূত কুসংস্কারের উপর গড়ে উঠা কোন জীবন ব্যবস্তা নয়। অনুমান অথবা অন্ধ ধারনানির্ভর তত্ত্বের কোন স্থান ইসলামে নেই। মহান স্রষ্টা আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তার সর্বশেষ পয়গম্বর হিসাবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুয়্যতের সুনির্দিষ্ট বুদ্ধিগ্রাহ্য (rational) সুনিশ্চিত প্রমানসহই ইসলামকে জীবন ব্যবস্তা হিসাবে মানব জাতির কাছে উপস্তাপন করা হয়েছে।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদেরকে সতর্ক করেছেন যে আমাদের এই জীবনটাই সবকিছু নয়। মৃত্যুর পর আরও একটি জীবন আছে যেখানে আমাদেরকে এই জীবনের সকল কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এটা একটা সুনিশ্চিত বিষয়। আল্লাহ্ আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে তিনি ফূর্তি আর ভোগবিলাস করে কাটিয়ে দেয়ার জন্য এই জীবন সৃষ্টি করেননি। বরং মহান স্রষ্টার উপাসনা করার জন্যই এই জীবন সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এর মানে হচ্ছে সকল মানুষের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে আসা। আজকের দিনে আমাদের পছন্দ অপছন্দ, যা আমরা করি এবং করিনা আর যে সব ধান্ধায় আমরা দিনরাত ডুবে থাকি এসবই এসেছে আমাদের সমাজের প্রচলিত চিন্তাহীন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি থেকে। আমাদের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কি হবে, আমরা যা নিয়ে ব্যস- তা আমাদেরকে বাস-বে কতটা রক্ষা করতে পারে এবং পারবে এসব নিয়ে সুস' মসি-স্কে চিন্তা ভাবনা করিনা বলেই আজকে আমরা এসব তুচ্ছ ধান্ধার পেছনে অন্ধ উন্মাদের মত ছুটে চলেছি। দাসত্ব করছি আমাদের নিজেদের খেয়াল খুশি অথবা অন্য মানুষের চিনন্তা ও ইচ্ছার। ইসলাম এসেছে মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে শুধুমাত্র আল্লাহর দাসত্বে নিয়োজিত করার জন্য। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মানুষের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন,
“আমি জিন ও মানুষ তৈরী করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য।” (আল কোরআন-৫১ঃ৫৬)
“পার্থিব জীবনতো ক্রিড়া কৌতুক ব্যতিত কিছুই নয়, যারা সাবধানতা অবলম্বন করে ( আল্লহর ব্যাপারে ) তাদের জন্য রয়েছে পরকালে উত্তম প্রতিদান। তবুও কি তোমরা বুঝবে না?” ( আলকোরআন-৬ঃ৩২)
ইসলামে যদিওবা আল্লাহর দাসত্ব করে মহান স্রষ্টার সন'ুষ্টি অর্জনকেই মানব জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তারপরেও মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং প্রবৃত্তিকে কখনও অস্বীকার করা হয়নি। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তারমধ্যে খাদ্য ও পানীয় গ্রহন করার প্রয়োজনীয়তা এবং যৌন চাহিদা ও সম্পদ লাভের আকাংখা রেখে দিয়েছেন। আর এসব মৌলিক চাহিদা এবং প্রবৃত্তি পূরন করার জন্য ইসলামে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও দিক নির্দেশনা দেয়া আছে। যেমন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,
“হে বিশ্বাসীগন, আল্লাহ তোমাদের জন্য যে উত্তম আহারাদি দিয়েছেন তা খাও এবং আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় কর যদি তোমরা শুধুমাত্র তাকেই উপাসনা করে থাক।” (আলকোরআন-২ঃ১৭২)
আল্লাহ স্বামী, স্ত্রী সম্পর্ককে এভাবে বর্ণনা করেন,
“তারা তোমাদের জন্য পরিচ্ছদ স্বরুপ আর তোমরাও তাদের জন্য।” (আলকোরআন-২ঃ১৮৭)
কিন' তাই বলে সবধরনের কামনা বাসনার যথেচ্ছ পূরনই মানবজীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না।আজকের সমাজে ইসলামকে বিশেষ কিছু আচার অনুষ্ঠানের সমষ্টি বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা যে বিশ্বাস লালন করি তা আমাদের মধ্যে কোন চিন্তাভাবনা বিচার বিবেচনার মাধ্যমে আসেনি, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের অনুকরণ করছি মাত্র। ফলে সারাদিনে বা সারাসপ্তাহে দু’একবার কিছু শব্দ উচ্চারনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে আমাদের ইসলাম যার সাথে আমাদের দৈনন্দিন কার্যাবলীর কোন সম্পর্ক নেই। আল্লাহ, রাসূল(সাঃ), আখিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম, এ বিষয়গুলো আমাদের সমাজের লোকদের কাছে অনেক দূরবর্তী বিষয়। কারও কারও কাছে দূর অতীতের ইতিহাস বা গল্প মাত্র। তারা মনে করেন এগুলোকে গুরুত্ব দেয়া বা নাদেয়া যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। দৈনন্দিন সামাজিক অর্থনৈতিক কার্যাবলীর ক্ষেত্রে এসব বিষয় টেনে আনা অপ্রাসঙ্গিক। ফলে প্রতি শুক্রবারে আমরা যে দলে দলে মসজিদে যাই কিংবা লক্ষ লক্ষ মানুষ রমযানে রোযা রাখে তার কোন প্রভাব প্রতিক্রিয়া সমাজে প্রতিফলিত হয়না। অনেক ক্ষেত্রে আমরা জানিও না কিংবা প্রশ্নও করিনা বছরের পর বছর ধরে এসব আচার অনুষ্ঠান আমরা কেনইবা পালন করছি। ফলে ইসলাম আমাদের জন্য একটা পরিচিতি মাত্র। আসলে আমাদের জীবন চলে আমাদের নিজের ধান্ধার নিয়ন্ত্রনে, ইসলামের সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই।
এখন সময় এসেছে আমাদের প্রকৃত অবস্থা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার। আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করা উচিত কেন আমরা আমাদের ধান্ধাগুলোর পেছনে এরকম অন্ধ উন্মাদের মত ছুটে চলেছি। আমরা কি আমাদের জীবন ও মৃত্যুকে পাল্টে দিতে পারি? আমরা কি অমর হতে পারব? আমরা যদি আরও বেশী ধন সম্পদ জমা করি তাহলে মৃত্যুকে ঠেকাতে পারব? অবশ্যই উত্তর হচ্ছে - না। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,
“অবশ্যই প্রত্যেক আত্নাকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে।” ( আলকোরআন-৩:১৮৫)
বর্তমানে আমাদের জীবন পরকালের সাথে সম্পূর্ণরুপে সম্পর্কহীন। কিন' মৃত্যুপরবর্তী জীবন, জবাবদিহিতা এবং বিচার দিবস হচ্ছে চরম বাস-বতা। এজন্য ইসলাম ধন সম্পদ এবং আনন্দ উপভোগকে জীবনে সাফল্যের মাপকাঠি হিসাবে দেখে না। বরং আল্লাহর সন'ষ্টির সন্ধানই হচ্ছে জীবনের সাফল্যের মানদন্ড এবং আল্লাহর ইবাদতই হচ্ছে তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য- যে উদ্দেশ্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
এ মুহূর্তে আমাদের চারপাশে চলমান অন্ধ এবং চিন্তাশূন্য সংস্কৃতির পরিবর্তনের জন্যে ইসলামকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উপস্থাপন করা আমাদের উপর অবশ্য করণীয় দায়িত্ব।
ইসলাম এসেছেই মানুষকে এই অজ্ঞতা থেকে মুক্ত করতে। এটি মানুষকে তার জীবন সম্পর্কিত যাবতীয় জিজ্ঞাসার বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধান দেয় এবং একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রগতিশীল শানি-কামী সমাজের পরিপূর্ণ ব্যবস্থা প্রদান করে।
“আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের ভেতরে যা আছে তা পরিবর্তন করে।”(আলকোরআন-১৩ঃ১১)
আসুন আমরা এখন থেকেই ইসলামকে বুদ্ধি বিবেচনা ব্যবহার করে জানতে চেষ্টা করি এবং সে অনুযায়ী আমাদের জীবন ও সমাজকে পরিচালনা করতে শুরু করি। এটা আমাদের ব্যক্তিসত্ত্বার মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনবে এবং সমাজের শানি- ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,
“হে মানুষ কিসে তোমাকে তোমার মহামহিম পালনকর্তা সম্পর্কে বিভ্রান- করল?” ( আলকোরআন-৮২:৬)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




