বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় কোনো দেশই পুরোপুরি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, বিশেষত যখন দেশটি ভূকৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী, চীনের অংশীদার, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাণিজ্যিক অংশীদার এবং মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার নির্ভর অর্থনীতির একটি দেশ। ফলে বড় শক্তিগুলোর স্বার্থের টানাপোড়েনে বাংলাদেশ প্রায়শই তাদের কৌশলগত হিসাবের অংশ হয়ে পড়ে। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব—বাংলাদেশ কি আসলেই বিদেশি শক্তির ক্রীড়নক, নাকি ভবিষ্যতে আরও স্বাধীনভাবে চলতে পারবে?
________________________________________
১. গ্লোবাল পলিটিক্সে বাংলাদেশের অবস্থান
(ক) ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা
বাংলাদেশ এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে বড় শক্তিগুলোর স্বার্থ জড়িত—
• ভারত: বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী, যার সঙ্গে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে।
• চীন: দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব মোকাবিলা করতে চায় এবং বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে কাছে টানতে চায়।
• যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ: গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বাণিজ্যের কারণে বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখে।
• মধ্যপ্রাচ্য: বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য প্রধান কর্মসংস্থান কেন্দ্র এবং ইসলামী বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ।
এই শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে বাংলাদেশ প্রায়শই তাদের স্বার্থের খেলায় জড়িয়ে পড়ে।
২. বিদেশি শক্তির প্রভাব: বাংলাদেশ ক্রীড়নক নাকি কৌশলী রাষ্ট্র?
(ক) ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
• নদীর পানি বণ্টন: তিস্তা চুক্তি এখনও ঝুলে আছে, ভারতের একতরফা সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের পানির নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
• সীমান্ত হত্যা: বিএসএফের গুলিতে প্রায়ই বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়, যা দুই দেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
• বাণিজ্যিক প্রভাব: ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বিশাল। ভারতীয় পণ্য সহজে বাংলাদেশে ঢুকতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে নানা বাধার সম্মুখীন হয়।
(খ) চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য
• বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI): চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে ঋণের বোঝা বাড়াতে পারে।
• সামরিক সহযোগিতা: বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কিনছে, যা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
(গ) যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক চাপ
• মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যু: পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত সমালোচনা করে এবং নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেয়।
• বাণিজ্য নির্ভরতা: বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প পশ্চিমা বাজারের ওপর নির্ভরশীল, যা একপ্রকার নিয়ন্ত্রণমূলক সম্পর্ক তৈরি করে।
(ঘ) মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম বাজার ও রেমিট্যান্স নির্ভরতা
• বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত, তাই দেশটি সৌদি আরব, কাতার, ওমানের মতো দেশের রাজনৈতিক চাপে পড়ে।
• যখনই মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক সংকট দেখা দেয়, বাংলাদেশি শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩. বাংলাদেশ কি শুধুই ক্রীড়নক, নাকি নিজস্ব কৌশল গ্রহণ করছে?
(ক) বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতি (Balanced Foreign Policy)
বাংলাদেশ সব শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে—
• ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করছে।
• যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেও রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করেছে।
• মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে শ্রম বাজার রক্ষা করছে।
(খ) অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকল্প বাজার
• রপ্তানির নতুন বাজার খোঁজা হচ্ছে, যাতে পশ্চিমা নির্ভরতা কমানো যায়।
• দেশীয় শিল্প ও প্রযুক্তির বিকাশে জোর দেওয়া হচ্ছে।
• অবকাঠামো উন্নয়ন ও জ্বালানি খাতের বৈচিত্র্যকরণ হচ্ছে।
(গ) সামরিক শক্তি ও প্রতিরক্ষা নীতি
• বাংলাদেশ নৌ ও বিমান বাহিনী শক্তিশালী করছে।
• নিজস্ব সামরিক প্রযুক্তি উন্নয়নে কাজ করছে, যাতে আমদানি নির্ভরতা কমে।
৪. বাংলাদেশ কীভাবে বিদেশি প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারে?
(ক) অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা গড়ে তোলা
• একক দেশ বা অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বহুমুখী বাণিজ্যনীতি গ্রহণ করতে হবে।
• দেশীয় উৎপাদন ও রপ্তানি খাতকে শক্তিশালী করতে হবে।
• বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে, তবে দীর্ঘমেয়াদে ঋণের ফাঁদে পড়া যাবে না।
(খ) রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা
• গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা কমানোর জন্য স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে।
• বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গঠন করতে হবে।
(গ) শক্তিশালী কূটনীতি ও সামরিক উন্নয়ন
• চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
• সামরিক ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে বিদেশি শক্তিগুলোর ওপর নির্ভরতা কমে।
বিদেশি শক্তিগুলোর প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়, তবে বাংলাদেশ কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। বাংলাদেশ এখনো বড় শক্তিগুলোর ক্রীড়নক হয়ে থাকলেও ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে আরও শক্তিশালী হলে এই প্রভাব কমতে পারে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—
বাংলাদেশ কি সত্যিই ভবিষ্যতে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে পারবে, নাকি চিরকাল বড় শক্তিগুলোর ক্রীড়নক হয়েই থাকবে?
আপনার মতামত কী?
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ১০:৪৩