
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি স্থায়ী ও গভীর সমস্যার নাম পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমরা গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ দেখতে পাইনি, বরং রাজনীতি ক্রমে একটি পরিবার-কেন্দ্রিক ক্ষমতার খেলায় রূপ নিয়েছে। যেখানে দল, মত, কর্মী, এমনকি জনগণের স্বার্থের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক পরিবারের স্বার্থ।
পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির শিকড়
পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি মূলত তখন জন্ম নেয় যখন রাজনীতিকে পেশাদারিত্ব বা যোগ্যতার বদলে বংশগত অধিকার হিসেবে দেখা হয়। স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় থাকা দলগুলোতে নেতৃত্বের ধারা স্বজনদের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, প্রার্থী মনোনয়ন, পদ বণ্টন—সব কিছুতেই ‘আমার লোক’ বা ‘আমার পরিবার’ অগ্রাধিকার পায়।
জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা হারানো
যে রাজনীতি জনগণের ভোট ও আস্থার উপর দাঁড়ানোর কথা, তা পরিণত হয় উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সিংহাসনে। এতে জনগণ ক্রমে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে যায়। ভোট হয়ে ওঠে আনুষ্ঠানিকতা, আর ক্ষমতা চলে যায় কিছু অভিজাত পরিবারের হাতে।
এর ফলে যা ঘটে
1. দলের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতার অবমূল্যায়ন – কর্মীরা যতই যোগ্য হোক, যদি পরিবারের বাইরে হয় তবে পদ পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
2. দুর্নীতি ও লুটপাট বৃদ্ধি – ক্ষমতা যখন বংশানুক্রমে ঘোরে, তখন দায়বদ্ধতার অভাব থাকে; ফলাফল হিসেবে দুর্নীতি বাড়ে।
3. গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ধ্বংস – মুক্ত মত, সমালোচনা, ও জবাবদিহিতা ধীরে ধীরে বিলীন হয়।
4. প্রজন্মের রাজনীতি থেকে বিমুখতা – তরুণরা রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নিতে নিরুৎসাহিত হয়।
উদাহরণ
বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলই দীর্ঘদিন ধরে প্রায় একই পরিবারের হাতে নিয়ন্ত্রিত। দলের সভাপতি, মহাসচিব, শীর্ষ নেতারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই বংশ থেকে আসায় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা কমে গেছে, আর দলীয় গণতন্ত্র প্রায় অনুপস্থিত।
সমাধান কী হতে পারে?
দলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা: প্রত্যেক দলে অভ্যন্তরীণ নির্বাচন বাধ্যতামূলক করা।
যোগ্যতা ও অবদানের ভিত্তিতে পদায়ন: রাজনীতিতে অবদানের রেকর্ড ও নেতৃত্বের দক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া।
যুব নেতৃত্ব গড়ে তোলা: তরুণ প্রজন্মকে প্রকৃত রাজনৈতিক চর্চার সুযোগ দেওয়া।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা: সমালোচনা গ্রহণ করা, মতের ভিন্নতাকে সম্মান করা, এবং জনগণের স্বার্থকে প্রথমে রাখা।
শেষ কথা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি একটি দুষ্ট চক্র—যেখানে একবার প্রবেশ করলে জনগণ, গণতন্ত্র, এবং মেধাবী নেতৃত্ব ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। এই চক্র ভাঙতে হলে প্রথমে দলগুলোকে নিজেদের সংস্কার করতে হবে, এরপর জনগণকে ভোট ও মত প্রকাশে আরও সচেতন ও দৃঢ় হতে হবে।
গণতন্ত্র তখনই টিকে থাকবে, যখন নেতৃত্ব জন্ম নেবে জনগণের আস্থা থেকে, বংশগত অধিকারের মাধ্যমে নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


