somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রাচীন ভারতের মানবতাবাদীরা বা ইতিহাসের প্রথম নাস্তিকগণ

১৭ ই জুলাই, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই ব্লগে আমার দুজন প্রিয় মানুষ আছেন। তাদের একজন ইতিহাস অনুরাগী, কবি, শিল্পী, জ্ঞানের বহু শাখায় নিজেকে যিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন, সেই কোমল হৃদয় মানুষটি, সন্ত ইমন জুবায়ের। অপর জন দর্শনে তাঁর গভীর জ্ঞান, সামাজিক অন্তর্দৃষ্টি, নিজ বিশ্বাসের দৃঢ়তা, ধৈর্য, আর দরদের জন্য আমাকে মুগ্ধ করে রাখেন, সেই পারভেজ আলম। এই লেখাটি তাঁদের দুজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ধন্য হব।

কিছু কিছু প্রশ্নের কিনারা কোনদিনই হবে না। যেমন ধরুন, মুরগী আর ডিমের কথা। ঠিক তেমনি, প্রথম নাস্তিক কে ছিলেন? এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই। তবে যদি নেহাতই চেপে ধরেন তাহলে হয়তো বলা যায় যে তিনি ছিলেন সেই আদিকালের হাতেগোণা কয়েকজন মানুষের একজন। দৃশ্যটি কল্পনা করুন। যখন প্রথমবারের মত কেউ একজন ভগবান, দেব-দেবী, খোদা, ঈশ্বর, বা আল্লাহর কথা তুলেছিলেন তখন তার পরিবারের কেউ ভুরু কুঁচকে ধমকে উঠেছিলেন, "গাধার মত কথা বলিস নাতো!" বলতে পারি ধর্ম যতটা প্রাচীন, মানবতাবাদ এবং নাস্তিকতাও প্রায় ততটাই প্রাচীন। কারণ, আমরা যখন থেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি অবিশ্বাসের শুরুও প্রায় তখন থেকেই।

পঁয়ত্রিশ শ বছরের পুরোনো সংস্কৃত উপাসনাগীতি ঋক্ বেদে এই লাইনগুলো পাওয়া যায়: "প্রকৃত সত্য কে জানে? কোথা হইতে আসিয়াছে এই বিশ্বজগত? এই জগত সৃষ্টির পর দেবতাগণের আগমণ হইয়াছে। কে তাহা হইলে জানে কোথা হইতে সৃজিত হইলো এই সৃষ্টি। হয়তো এই জগতের সৃষ্টি আপনা হইতেই। হয়তো তাহাও নহে-এই সুউচ্চ দেবলোক হইতে যিনি ইহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেছেন, কেবল তিনিই জানেন। অথবা হয়তো তিনিও জানেন না।"

বাইবেলের আদিগ্রন্থ লিপিবদ্ধ হওয়ার প্রায় ৫০০ বছর আগে একজন ভারতীয় দার্শনিকের মুখে এই সাহসী উচ্চারণ শুনে বিস্মিত না হয়ে আমাদের উপায় থাকে না। এর কয়েকশ বছর পরে দক্ষিণ এশিয়ায় এই একই ধরণের সংশয় সংহত হয়ে রূপ নেয় সম্ভবতঃ পৃথিবীর প্রথম মানবতাবাদী এবং নাস্তিক্যবাদী চিন্তাধারায়: লোকায়ত এবং চার্বাক দর্শনে। খুব কাছাকাছি চিন্তাধারার এই দু দল দার্শনিক তাদের এই অভিনব চিন্তার ডালপালা বিস্তার শুরু করেছিলেন খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের যথাক্রমে গোড়ার দিকে আর মাঝামাঝি।

লোকায়ত আর চার্বাক শব্দদুটোর উৎপত্তি নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে কিন্ত শেষ পর্যন্ত তার কোন মিমাংসা হয়নি। তবে উইকিপিডিয়াতে যা আছে তাই তুলে দিচ্ছি। লোকায়ত শব্দটির মূল ভাব হলো যা বিশ্বে বিদ্যমান। চার্বাক শব্দটি এসেছে চারু বা সুন্দর এবং বাক বা কথা থেকে, অর্থাৎ যারা সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসবেত্তারা লোকায়ত আর চার্বাকদের বিশেষ করে উল্লেখ করেছেন সত্য উন্মোচন এবং বিশ্লেষণী চিন্তার প্রতি তাদের ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টার জন্য। তাদের দর্শনের যে দিকটি সবচাইতে উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে তাদের অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সামাজিক সাহস আর এর প্রমাণ রয়ে গেছে তাদের শত্রু ও প্রতিদ্বন্দীদের বিভিন্ন লেখার মধ্যে। প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যবাহী অস্তিবাদী চিন্তাধারার বহু দার্শনিককেই তারা তাদের দর্শন দিয়ে খেপিয়ে তুলেছেন এমন প্রমাণ রয়েছে এই অস্তিবাদীদের লেখায়।

তিনহাজার বছর আগে লোকায়ত আর চার্বাকেরা চারপাশের জগতের দিকে খোলাচোখে তাকিয়ে দেখেছিলেন আর এমন এক উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন যা আমরা আজও সত্য বলে স্বীকার করতে বাধ্য। আজ পর্যন্ত কেউ প্রমাণ করতে পারেননি যে তারা কোন অলৌকিক কিছু দর্শন করেছেন। কোন নারী বা পুরুষ মৃত্যুর পর জীবন ফিরে পেয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন নি। কোন ঈশ্বর আজ পর্যন্ত আবির্ভুত হয়ে তার সৃষ্টির কোন কিছু আমাদের সামনে ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। আর যারা আমাদেরকে বিশ্বাস করানোর জন্য ধমক-ধামক দিচ্ছেন, অনুনয়-বিনয় করছেন যাতে আমরা তাদের অবিশ্বাস্য সব রূপকথায় বিশ্বাস করি, চোখ বন্ধ করি, তাদের রয়েছে নিজেদের আখের গোছানোর ধান্দা।

দেখতে পাচ্ছি এই মানবতাবাদীরা, এই শব্দটি আবিষ্কার হওয়ার অনেক আগেই, তাদের পারিপার্শ্বিক সমাজের আধিদৈবিক ধর্মগুলোর মূল বিশ্বাসগুলোকে বুদ্ধি দিয়ে যৌক্তিকভাবে ধসিয়ে দিতে পেরেছিলেন। অদৃশ্যে বিশ্বাস করার চাইতে বরং তারা শিখিয়েছিলেন পরকাল নয় এই জগতের শুভত্বের জন্য সদাচার আর ন্যায়পরায়নতার অনুশীলন। তারা ঘোষণা করেছিলেন, মৃত্যুর পর অনন্তজীবন বলে কিছু নেই। কাজেই সবার সাথে সহৃদয় ব্যবহার কর, পরকালের জন্য নয়, আজ, এখনই। তারা এই সাহসী উচ্চারণ এত হাজার বছর আগে করতে পেরেছিলেন:

এই দেহত্যাগ করে যদি কেউ পরলোক গমন করেন,
তাহলে তারা আবার ফিরে আসেন না কেন,
তাদের স্বজনের প্রেমের আকাঙ্খায় উদ্বেলিত হয়ে
নিজেদের জীবিকা সংস্থানের জন্য ব্রাম্হণগণ প্রবর্তন করেছে
মৃতদের জন্য সুপ্রচুর সমারোহ আর লৌকিকতার--
আর অন্য কোথাও কোন ফল নেই।
অতএব জীবিত প্রাণীকূলের প্রতি সদ্ব্যবহারের জন্য
অবশ্যই আমাদের চার্বাকের মতবাদের শরণে ধাবিত হতে হবে।

কিন্তু চার্বাক আর লোকায়ত লক্ষ্য শুধুমাত্র একরকমের বায়বীয় "সদাচরণ" ছাড়িয়ে আরো বহুদূর বিস্তৃত হয়েছিল। চারপাশে অভুক্ত মানুষকে রেখে দেবতাদের উদ্দেশে নিবেদিত পঞ্চব্যন্জন আর দুর্মূল্য আহারাদির ভোগ দেয়ার তীব্র বিরোধী ছিলেন তারা:

মৃতের উদ্দেশে উৎসর্গ করা পশুবলি যদি
সশরীরে স্বর্গলাভ করে,
তবে বলিদাতা সরাসরি তার নিজের পিতাকে কেন বলি দেয় না?
... যদি আমাদের দেয়া উৎসর্গে দেবলোকবাসীগণ সন্তুষ্ট হন
তাহলে এই ধরণীতে কেন ভোজ্যবস্তু তুলে দেয়া হচ্ছে না
যারা গৃহোপরি দণ্ডায়মান তাদের সন্তুষ্ট করতে ?

চার্বাক দর্শনের মূল গ্রন্থ বৃহষ্পতি সূত্র কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে কিন্তু তা রক্ষিত আছে চার্বাকদের বিরুদ্ধে ধর্মরক্ষক টিকাভাষ্যকারদের বিষোদ্গারপূর্ণ লেখায়। বৃহষ্পতি সূত্র শুধু সামাজিক ন্যায়বিচারের কথাই বলেনি, এটি হিন্দু পুরোহিততন্ত্র, এমন কি বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধেও সরব। এসব কারণে বিশ শতকের অনেককাল পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবেও বৃহষ্পতি সূত্র অনেকের অস্বস্তির কারণ হয়েছে। এমন কি দলিত, অস্পৃশ্যদের জয়গান করা গান্ধী, যিনি অনেকসময় নিম্নসমাজের কথা ভুলে ধনী ব্রাম্হণদের আনুকূল্য লাভের জন্য দহরম মহরম করে বেড়াতেন, তিনিও চার্বাকের মেসেজ "চতুর্বর্ণ, শ্রেণী, বা পুরোহিততন্ত্রের কোন কাজেই কোন ফললাভ হয় না," নিয়ে বিশেষ স্বস্তিতে ছিলেন না। এতে করে আমাদের মনে এই বিশ্বাস জন্মে যে মহাভারতে বর্ণিত সেই কাহিনী যেখানে কোন সেনাশাসকের কঠোর সমালোচনা করায় এক চার্বাককে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল, তাতে সত্যের স্পর্শ আছে।

দুঃখের বিষয়, আজকের ভারতীয়দের মনে চার্বাকদের সম্পর্কে রয়েছে ভুল ধারণা যে তারা শুধু "খাও, দাও, ফূর্তি কর"র নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। চার্বাক নামটি আজ শুধু ভারতীয় স্বচ্ছল জীবনের প্রতীক ঘৃতপক্ব তৈলাক্ত উপাদেয় খাদ্যের অনুষঙ্গী হয়ে গেছে। (স্মর্তব্য, ঋণং কৃত্তাং ঘৃতং পিবেত বা ঋণ করে হলেও ঘি খাও)। এই ভ্রান্ত ধারণার মূলে রয়েছে চার্বাক বিশ্বাস যে, মহার্ঘ, উপাদেয় খাদ্য মন্দিরের দেবতা, পুরুতদের না খাইয়ে সাধারণ মানুষকেই খাওয়ানো উচিত। ঠিক একই ভাবে পাশ্চাত্যবাসীদের মনেও আজ প্রাচীন প্রতীচ্য মানবতবাদী দর্শন এপিকিউরিয়ানদের সম্পর্কেও একই রকম অজ্ঞতাপ্রসূত ভ্রান্ত ধারণা স্থান নিয়েছে। ভারতের লোকায়তের কয়েকশ বছর পরে প্রাচীন গ্রীসে এপিকিউরিয়ানদের উথ্থান হয়েছিল। এর পরের পর্বে লিখবো তাদের কথা।

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩৮
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×