somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপারেশন 'অকার্যকর বাংলাদেশ': মাহমুদুর রহমান

০৪ ঠা মার্চ, ২০০৯ সকাল ৯:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অপারেশন 'অকার্যকর বাংলাদেশ':
মাহমুদুর রহমান

শুধু বাংলাদেশের নয়, সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে সেনাকর্মকর্তাদের নারকীয়তম হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানার বিডিআর সদর দফতরে। আমি সামরিক বিশেষজ্ঞ নই। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বিভিন্ন অভিযান, অভ্যুত্থান, পাল্টা-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশে কতজন সেনাকর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, সেই তথ্য জানা নেই। তবে যারা এ সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করেন, তাদের মধ্যে দুই-একজনের কাছ থেকে জেনেছি, মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ৫৫ জন সেনাকর্মকর্তা শহীদ হয়েছিলেন। আর ২৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে সেনাবাহিনীর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী যে ছয়জন নিখোঁজ রয়েছেন যদি ধরে নেয়া হয় যে আর কোনো দিন তারা প্রিয়জনের কাছে ফিরে আসবেন না, তাহলে ওই অভিশপ্ত এক দিনেই আমরা ৬২ জন সেনাকর্মকর্তাকে হারিয়েছি। কেন এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড এবং কারা এর জন্য দায়ী যথাযথ তদন্তের আগে সে সম্পর্কে আগাম মন্তব্য করা শুধু কঠিনই নয়, একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ হবে। তবে বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য যে দেশী-বিদেশী চক্র বিগত প্রায় এক দশক ধরে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে কাজ করে যাচ্ছে এ দুর্ঘটনা তাদেরকে নিঃসন্দেহে উৎসাহিত করবে। বিদেশী অর্থে প্রতিপালিত আমাদের দেশের তথাকথিত অভিজাত শ্রেণী দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের অপপ্রচারে বাংলাদেশকে ক্রমাগত দুর্বল করার পর এক-এগারো বাস্তবায়ন করেছে। ১৫ কোটি প্রধানত মুসলমান জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে অকার্যকর করার যে অশুভ পরিকল্পনা ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাস্তবায়ন করা আরম্ভ হয়েছিল, তারই অবশ্যম্ভাবী ধারাবাহিকতায় দেশ আজ গভীর অস্তিত্বের সঙ্কটে পতিত হয়েছে।

ড. ফখরুদ্দীন আহমদের অসাংবিধানিক সরকার তাদের দুই বছরব্যাপী অপশাসনকালে বিদেশী শক্তির মদদে সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করেছে। মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালে যে দিন সেনাবাহিনীর একজন মেজর হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার মতো বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, সে দিন থেকেই বাংলাদেশের জনগণের কাছে তাদের সেনাবাহিনী গর্ব ও শ্রদ্ধার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ এবং পরবর্তীকালে সব জাতীয় দুর্যোগকালে জনগণের পাশে অবস্থান করায় সেনাবাহিনীর অবস্থান ক্রমান্বয়ে অধিকতর সংহত হয়েছে। পরজীবী সুশীল(?) সমাজভুক্ত পঞ্চম বাহিনী বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং স্বাধীনতা রক্ষায় সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করলেও দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশপ্রেমিক জনগণ কুচক্রীদের পেতে রাখা ফাঁদে কখনোই পা দেয়নি। বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী চিহ্নিত বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ সেনাবাহিনীর বাজেট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সৈনিকদের সামাজিক অবস্থান এমনকি তাদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে দেশে-বিদেশে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রবন্ধ রচনা করেছেন। বিস্ময়করভাবে এক-এগারো’র পরবর্তী সময়ে এই শ্রেণী আবার সেনাবাহিনীর বন্ধুও সেজেছে। এদের মধ্যেই কেউ কেউ এখন পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে জানান দিচ্ছেন, তারা নিহত বিডিআর ডিজি মেজর জেনারেল শাকিলের কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং কতবার এক সাথে আহার করেছেন। তাদের ওই সব তৎপরতার পেছনে উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জাতীয় নিরাপত্তাকে ক্রমেই দুর্বল করে ফেলা। সুশীল(?) সমাজের ভাবশিষ্য, জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার মহান দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীকে তার মূল কর্তব্য থেকে যে বিচ্যুত করেছিল, তারই সুযোগ নিয়েছে বর্তমান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশবিরোধী চক্র। ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবিশ্বাস্য বিজয় লাভ করে যে সরকার ক্ষমতাসীন হয়, তারা প্রত্যাশিতভাবেই দেশের নিরাপত্তার চেয়ে সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির স্বার্থ পূরণে অধিকতর ব্যগ্রতার পরিচয় দিচ্ছে। এই অবিমৃশ্যকারিতার সুযোগ গ্রহণ করে ২৫ ফেব্রুয়ারির কালো দিবসে বিডিআর সদর দফতরে যে পৈশাচিক এবং সরাসরি রাষ্ট্রবিরোধী পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, তা আমাদের দেশটির ভিত্তিমূলকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। এক-এগারোর পর থেকেই দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে সর্বনাশা খেলা থেকে শাসকশ্রেণীকে নিবৃত্ত করার জন্য ব্যক্তিগত সব বিপদ উপেক্ষা করে যেসব চেষ্টা করেছি, আজ দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্বীকার করতে হচ্ছে তার সবই বোধ হয় ব্যর্থ হয়েছে। পিলখানার বধ্যভূমিতে সেনাকর্মকর্তাদের প্রাণহীন দেহের সাথে যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই শায়িত অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি।

যেকোনো সুশৃঙ্খল বাহিনীতেই কোনো যুক্তিতেই চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ কারণেই কথায়, কাজে ও লেখায় এক-এগারোতে জাতিসঙ্ঘের কর্মকর্তার নির্দেশে চেইন অব কমান্ড ভাঙার অব্যাহত বিরোধিতা করে এসেছি। তবে বিডিআর সৈনিকদের বিদ্রোহে চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের চেয়েও যে বিষয়টি একজন মানুষ হিসেবে আমাকে চরমভাবে হতাশ ও বিমর্ষ করেছে, তা হলো জওয়ানদের একাংশের বর্বর নৃশংসতা। প্রথমত, ডিজি’র প্রতি কোনো বিশেষ কারণে তারা ক্ষুব্ধ থাকলেও দুই দিন ধরে ৬৩ জন সেনাকর্মকর্তাকে নির্বিচারে হত্যা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্যাতন করার মতো উন্মত্ততা যে বাহিনীর সদস্য প্রদর্শন করতে পারে, তাদের পেশাদারিত্ব, প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। দ্বিতীয়ত, ডিজি’র প্রতিই বা এতটা ক্ষুব্ধ হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে যার ফলে শুধু তাকে নয়, তার স্ত্রীসহ বাসায় বেড়াতে আসা অতিথিদেরকেও হত্যা করতে হবে। তৃতীয়ত, সেনাকর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি যে বর্বরোচিত আচরণ করা হয়েছে তা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচার, নির্যাতনের স্মৃতিকেই পুনরুজ্জীবিত করেছে। আমাদের সমাজজীবনে এই যে ঘৃণ্য, পৈশাচিক মনোবৃত্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে কিংবা ঘটানো হয়েছে, তা সত্তরের দশকের পর ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকার রাস্তায় পুনর্বার দেখতে পেয়েছি। সে দিন যেভাবে প্রকাশ্যে লাঠি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে জন্তুর মতো কয়েকজন মানুষ হত্যা করা হয়েছিল, তা আমাদের চরম নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র। সেই নৃশংসতার উপযুক্ত বিচার দাবি কিংবা নিন্দা জ্ঞাপন কোনোটাই না করে দেশের বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম সেই নারকীয় কার্যকলাপকে রীতিমতো মহিমান্বিত করে প্রকারান্তরে সমর্থন প্রদান করেছিল। বর্তমান সরকারপ্রধানও অদ্যাবধি সেই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য কোনোরূপ দুঃখপ্রকাশ করেননি যদিও লাঠি-বৈঠাধারীরা সে দিন তার নির্দেশেই ঢাকায় জমায়েত হয়েছিল। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও সেই হত্যাযজ্ঞের বিচারের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে বরং তৎকালীন সরকারকে মহাজোটের আন্দোলনের ফসল হিসেবে তুলে ধরে একটি প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ডকে একধরনের বৈধতা প্রদান করেছিল। আমাদের ধর্মবিশ্বাস বলে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শয়তানের প্ররোচনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। ব্যক্তি ও সমাজজীবনে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সকল প্রকার নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধাচরণ করাও যে শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরই অংশ, এই পরম সত্যটি বিস্মৃত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

আগেই উল্লেখ করেছি, প্রায় এক দশক ধরেই বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে বিদেশী দখলদার বাহিনীকে এ দেশে আমন্ত্রণের ষড়যন্ত্রের ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন চলছে। এই চক্রান্তের ধারাবাহিকতাতেই সম্ভবত ২৫ ফেব্রুয়ারিতে দেশের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান দু’টি বাহিনীকে একই সাথে ধ্বংস করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের এতজন কর্মকর্তাকে একসাথে হত্যা একটি কাকতালীয় দুর্ঘটনা কিংবা বিডিআর জওয়ানদের একাংশের বিদ্রোহের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হিসেবে বিবেচনা করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। ৬৩ জন সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মেধা ও সক্ষমতা হ্রাস করা হয়েছে। অপর দিকে যে বিডিআর স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে অতন্দ্র প্রহরীরূপে সীমান্তে বিদেশী আগ্রাসন সফলভাবে প্রতিহত করেছে, সেই প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বকেই প্রায় বিলীন করে দেয়া হয়েছে। এই রক্তাক্ত বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বিডিআর জওয়ান এবং তাদের সামরিক কমান্ডিং অফিসারদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার যে সঙ্কট সৃষ্টি হলো, সেটি কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় ও প্রজ্ঞার প্রয়োজন হবে। বিডিআর’র কমান্ড স্ট্রাকচার পুনর্গঠনের কঠিন চ্যালেঞ্জের মাত্রা অনুধাবন করে বাংলাদেশের জনগণ প্রত্যাশা করে, প্রধানমন্ত্রীসহ বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যরা তাদের বক্তব্য-বিবৃতি ও আচরণে দলীয় সঙ্কীর্ণতা পরিহার করে অধিকতর দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন। জনগণের দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীনরা তাদের রাজনৈতিক মতবাদ দ্বারাই আচ্ছন্ন হয়ে আছেন বলেই মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির এই গভীর সঙ্কটকালেও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাথে যোগাযোগের কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি। অথচ কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সাথে আলোচনাকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন। দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নেতৃদ্বয়ের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছে, তা বাংলাদেশ সরকার দেশবাসীকে আজো জানায়নি। এ দিকে বিদ্রোহী সৈনিকদের সাথে আলাপ-আলোচনার ফাঁকে সাংবাদিকদের কাছে ব্রিফিংকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বাংলাদেশ রাইফেলসকে বাঙালি জাতির গর্বরূপে বর্ণনা করেছেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের এটা এক বিষম সমস্যা। তারা অপ্রাসঙ্গিকভাবে হলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীন সত্তাকে উপেক্ষা করে সব বিষয়ে বাঙালি জাতিসত্তাকে টেনে আনবেনই। আমরা সবাই জানি, বিডিআর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনী। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং এই রাষ্ট্রে বসবাসকারী সব নাগরিকের সম্পদ। বাংলাদেশী নাগরিকদের মধ্যে বাঙালি ছাড়াও চাকমা, মার্মা, গারো, ইত্যাদি ক্ষুদ্র জাতিসত্তাও যে অন্তর্ভুক্ত, এ তথ্যটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন না বলে বিশ্বাস করা যায় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজের মাতৃভূমিকে উপেক্ষা করার এই মন্দ প্রবণতা বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে অধিকহারে সংক্রমিত হলে এত আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রটিই যে দুর্বল হয়ে পড়বে, এটি সবারই উপলব্ধি করা উচিত।

ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখে বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমে বিডিআর’র বিক্ষুব্ধ জওয়ানদের দাবিদাওয়ার বিষয়টি অধিকমাত্রায় প্রচারিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিদ্রোহের রাজনৈতিক সমাধানের দিকেই প্রধানত জোর দিয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে দরকষাকষির জন্য সাধারণত পেশাদারদের নিয়োজিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী আলোচনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মির্জা আজমকে। আমরা অবগত না হলেও আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী যুবনেতা হয়তো এই প্রকার সমস্যা সমাধানে আসলেই সিদ্ধহস্ত। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সরকারের প্রতিনিধি সমন্বয়ে যে ১৪ জন বিদ্রোহীর সাথে প্রধানমন্ত্রী ওই দিন দ্বিপ্রহরে সাক্ষাৎ দিয়েছেন, এখন বোঝা যাচ্ছে তাদের অনেকের হাতই তখন রক্তরঞ্জিত ছিল। আরো ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে তাদের মধ্যে অনেকের পরিচয়ই নাকি এখন পাওয়া যাচ্ছে না। তদুপরি বিদ্রোহীদের সাথে দরকষাকষির সময় সামরিক কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে থাকার বিষয়টির ওপর প্রধানমন্ত্রী অথবা তার নির্বাচিত প্রতিনিধিদ্বয় জোর দিয়েছিলেন কি না, সেই তথ্য সংবাদমাধ্যম অথবা সাধারণ নাগরিকদের কখনোই জানানো হয়নি। বিদ্রোহ দমনের উপায় হিসেবে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদই বা প্রধানমন্ত্রীকে কী পরামর্শ দিয়েছিলেন, সে বিষয়েও জাতি অন্ধকারেই রয়েছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে সে দেশের সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে যে, বিদ্রোহ চলাকালীন অবস্থায় কোনো কোনো মহল থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র সামরিক সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছিল। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সাথে ভারত সরকারের বিশেষ সখ্য থাকলেও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার খাতিরে আশা করব, বিডিআর বিদ্রোহে কোনো রকম ভিনদেশী সংযোগ ছিল কি না সে বিষয়টিও সরকার নিয়োজিত তদন্তকারীরা খতিয়ে দেখবেন। এক-এগারোর সরকারের ব্যক্তিবর্গ আমাদের দেশের চিহ্নিত ভারতবন্ধু এবং সেনাবাহিনীবিরোধী গোষ্ঠীকে তাদের নতুন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। সন্দেহ করা একেবারে অমূলক হবে না, সেই সুযোগ গ্রহণ করেই পঞ্চম বাহিনী বাংলাদেশের নিরাপত্তা অঙ্গনে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের পর সেনাবাহিনী এবং বিডিআর’র মধ্যে যে অবিশ্বাসের ফাটল সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রতিবেশী বৃহৎ শক্তি ‘পিস মিশনের’ নামে সেনাবাহিনী প্রেরণ করতে ইচ্ছুক। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা খবর দিয়েছে, বাংলাদেশে পিস মিশনের নামে ভারতীয় বাহিনী পাঠানোর উদ্যোগ নিচ্ছে ভারত। নয়া দিল্লির অতি উচ্চপর্যায়ের সূত্র উল্লেখ করে পত্রিকাটি জানায়, বিডিআর বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে কলকাতা-ঢাকা- কলকাতা মৈত্রী এক্সপ্রেসের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য ভারত বাংলাদেশে পিস মিশন পাঠানোর প্রস্তাব দিচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই ভারতকে করিডর প্রদান এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে তথাকথিত দক্ষিণ এশীয় টাস্কফোর্স গঠনের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল।

বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অবঃ) ফারুক খান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ দীপু মনিসহ সরকারের বেশ কয়েক জন মন্ত্রীর এ ব্যাপারে অতি উৎসাহের মাত্রা দেখে মনে হচ্ছিল, তারা বিদেশী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পদে আসীন হয়েছেন। দেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেশপ্রেমিক অংশের ত্বরিত প্রতিবাদের মুখে আপাতত সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে আসা ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে করিডর ও টাস্কফোর্স সম্পর্কিত চুক্তি সম্পাদন না করেই বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। সরকারের এই প্রচেষ্টাকে প্রথম থেকেই রাষ্ট্রবিরোধী রূপে বিবেচনা করে আমরা এর প্রতিবাদ করেছি এবং প্রতিফলে প্রত্যাশিতভাবেই সরকার ও এ দেশের ভারতপন্থীদের বিশেষ বিরাগভাজন হয়েছি। বিডিআর বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীসহ বাংলাদেশের জনগণকে বিবেচনা করতে অনুরোধ করছি, ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’ নামক রেলগাড়িটিকে নিরাপত্তা প্রদানের ধুয়া তুলে যে দেশ সেনাবাহিনী প্রেরণের প্রচ্ছন্ন হুমকি প্রদান করতে পারে, সেই দেশকে বর্তমান সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী করিডর দেয়া হলে তার নিরাপত্তার জন্য এতক্ষণে আমরা ঢাকার রাস্তায় নিশ্চিতভাবেই ভারতীয় ট্যাংকবহর দেখতে পেতাম।

এ দিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টিও বাংলাদেশের অতি নাজুক সময়ে তার সরকারের পক্ষ থেকে সর্বপ্রকার সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন। আশা করি, সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা প্রস্তাবের মধ্যে বাংলাদেশে শান্তিরক্ষার নামে ব্লু হেলমেট পাঠানোর কোনো পাঁয়তারা নেই। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় এখন এক চরম অস্থির ও অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজমান। শ্রীলঙ্কা গৃহযুদ্ধের আগুনে জ্বলছে। দীর্ঘ সাত বছর ধরে আফগানিস্তান পশ্চিমের দখলদার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সে দেশের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা দখলদারমুক্ত স্বদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান মুসলিম লিগের সভাপতি নওয়াজ শরিফ এবং তার ভাই শাহবাজ শরিফকে সুপ্রিমকোর্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করার প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষুব্ধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। আফগানিস্তান সীমান্তের কাছে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে প্রায় প্রতিদিন নির্বিচারে মার্কিন বিমান হামলায় সে দেশের নাগরিকরা নিহত হচ্ছেন। বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঘটে গেল দুই নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ। সরকার বলছে, সেই সংঘর্ষে নাকি বাইরের হাত রয়েছে। সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবীরা অবশ্য কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ব্যতিরেকেই প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে দায়ী করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন। সব মিলে সাম্রাজ্যবাদী এবং আঞ্চলিক পরাশক্তির সমন্বয়ে গঠিত যৌথ মোর্চার সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার যেন ‘সুবর্ণ সুযোগ’ উপস্থিত হয়েছে। সেনাকর্মকর্তাদের হত্যাযজ্ঞের পেছনে যদি বাইরের হাত থাকে তাহলে যারা এই ঘৃণ্য কাজটি করেছে, তাদের অবশ্যই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যও (শসয়মংপ) রয়েছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধ্বংস হলে কারা সেখান থেকে অধিক লাভবান হবে, সেটি বোঝার জন্য নিরাপত্তাবিশ্লেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিদেশী শক্তি পর্যায়ক্রমে যে উদ্দেশ্যসাধনের জন্য এক-এগারো বাস্তবায়ন করেছিল, দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণ এর প্রতিরোধে এখনো ঐক্যবদ্ধ না হলে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মতো আরো মহা বিপর্যয় জাতির জন্য অপেক্ষা করছে।

দেশবাসী, দীর্ঘ নিদ্রা হয়েছে। এবার অন্তত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির স্বাধীনতা রক্ষার্থে ১৫ কোটি জনগোষ্ঠী জেগে উঠে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। স্বাধীনতাহীনতায় প্রাণ ধারণ করার চেয়ে দেশের জনগণ, সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসারসহ সকল প্রতিরক্ষা বাহিনীর সবাই মিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আধিপত্যকামী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হওয়া শ্রেয়।

লেখকঃ সাবেক জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা এবং বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান
[email protected]

Click This Link

Click This Link

৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×