১
'কালো-কালো পিঁপড়েদের সারিবদ্ধ-চলন পর্যবেক্ষণে হাঁপিয়ে উঠা বেশ দুষ্কর' - পার্নেল ষ্ট্রিটের ছোট এক আইরিশ কফিশপ সংলগ্ন ফুটপাতের উপর মাঝারি আকারের এক পাথরের চাকতির উপর বসে জুন মাসের উষ্ণ ইউরোপীয়ান রোদ আর পাশের পাকিস্তানী মুদি দোকান হতে নিঃসৃত ফতে’আলীর হালকা ফিউশন শুনতে শুনতে এই কথাটাই ভাবলো ছেলেটি। বামপাশের ক্যাকটাসগুলোর পাশে ঐ পোলিশ কসাইখানার ধূসর দেয়ালে নিরন্তরভাবেই চলছে এই পিঁপড়ে-চলন-কথন। অন্যদের অতিক্রম করার সময় কি একগ্রতার সাথেই না তারা মোলাকাত করছে পরস্পরের সাথে! বিনিময় করছে কুশলাদি! জেনে নিচ্ছে পথের হদিস! আচ্ছা, ওদের ভাষাটা কি? নিজের দেশের পিঁপড়েরাও কি তবে ঐ একই ভাষায়......? হঠাৎ জানতে ইচ্ছে হলো ছেলেটির। ধূসর রঙের ছোট্ট এক পিঁপড়াকে সে অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ করছে। সুবিন্যস্ততার অভাব আছে ওটার চলনে। কিছুটা স্বেচ্ছাচারী, কিছুটা স্বাধীনচেতাও বটে! ফলশ্রুতিতে কিঞ্চিত উত্তেজনা আর চাঞ্চল্য ছিটিয়ে দিয়েছে সে শৃঙ্খলাবদ্ধ বাদবাকিদের ভেতর। তৎসত্ত্বেও অনাগ্রহী ওটার সাথে মাথা ছোঁয়াতেই হচ্ছে সম্মোহিত বাকিদের। বেপরোয়া ওটাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণাও করছে না। পারলে হয়তো করতো। কে জানে! দমিয়ে রেখেছে হয়তো অবদমিত ক্রোধ! হাহ্, পিঁপড়ের আবার সুপার-ইগো! যাই হোক, এত এত কালোদের ভিড়ে ঐ ধূসর হতচ্ছাড়াটাকে অনুসরণ করা যদিও বেশ সহজ হওয়ার কথা, কিন্তু বাদ সেধেছে ঐ ধূসর দেয়ালটা। হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন পিঁপড়েটা নেই ওখানে! তাই সে মনস্থির করলো, ঐ শূন্যস্থানটাকেই সে লক্ষ করবে, শূন্যকেই অনুসরণ করবে, আর উপভোগ করবে অন্য পিঁপড়েগুলোর শূন্যের সাথে মোলাকাত। বাহ্! বেশ কিছু ঘটনা একসাথে পর্যবেক্ষণ! বিধাতাসুলভ এক কুটিল হাসির দ্যুতি ছড়িয়ে পড়লো তার মুখে।
উইকএণ্ডের অলস আইরিশ বিকেল। গ্রীষ্মকালীন সুদূর-সন্ধ্যার অপেক্ষায় ক্লান্ত মধ্যবয়স্ক ওরা একটু পরেই ঢোকা শুরু করবে পাব’গুলোতে। শুরু হবে সামাজিকতা। আড্ডা হবে। হবে মৃদু-কথন। ওদের কথার কোন শেষ নেই! সাথে থাকতেই পারে হালকা পাতলা কেল্টিক ইন্সট্রুমেন্ট অথবা ধীরলয় জুকবক্স। তবে এই মুহূর্তে লোকালয় তেমন সরগরম নয়। ছেলেটির সামনে দিয়েই ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে বেশ কিছু নর-নারী আর হঠাৎ হঠাৎ রাজপথ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে বেশ কিছু চক্চকে আউডি-ভলভো-বিএমডাব্লিউ। বেশ টাকা আছে এদের! সম্মোহিতভাবে নতুনত্বের ছোঁয়া পেতে চায়!
পাশেই পরে থাকা ক্যাকটাসের কাঁটাগুলো আঙুল দিয়ে খোঁচাতে-খোঁচাতে ছেলেটি দৃষ্টি প্রসারিত করলো সামনের রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা এক দালানের উপর। বিকেলের রৌদ্রোজ্জ্বল এই পরিবেশে দৃষ্টিগোচর হলো বেশ বড় বড় কিছু নিষ্ক্রিয় নিয়ন লাইট আর পানসে সাইনবোর্ড। দালানটা বেশ পুরানো হলেও চাকচিক্যময় আমেজ নিয়ে আসা হয়েছে। আশপাশটা কেমন মধ্যযুগীয় অন্ধকারাচ্ছন্নতায় আচ্ছন্ন হলেও সামনের দিকটা ঘষে-মেজে বেশ একবিংশ শতাব্দী-শতাব্দী ভাব। ভালোই লাগে এইসব! সম্মোহিতভাবে নতুনত্বের ছোঁয়া পেতে চাইলেও অবচেতনভাবেই আদিম ঐতিহ্যকে কিছুটা হলেও ধরে রাখতে চায় এরা। বেশ রক্ষণশীল! যত যাই হোক, রাতে নিশ্চয়ই আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠবে জায়গাটা। আর দালানের সামনে পাথরের পেভম্যান্টের উপর জটলা পাকিয়েছে যেই কিশোর-কিশোরী-তরুণ-তরুণীরা, ওরাও কি থাকবে রাতঅব্দি? জীবনটাকে বড় উপভোগ করে ওরা বুঝি? জটলা পাকিয়েছে, সোরগোল করছে। একসাথে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছে। আঙুল তুলে বিভিন্ন রঙের পোষ্টারগুলো দেখাচ্ছে আর জোরে জোরে চিন্তা করছে। রবিন উইলিয়ামসের প্রাণ-খোলা হাসির সামনে দাঁড়িয়ে ছবিও তুললো দু’একজন। দেখতে ইন্টেলেকচুয়াল একটা মেয়ে অবশ্য একাকী দাঁড়িয়ে আছে মিশেল ফাইফারের রহস্যময় এক হাসির নিচে। বন্ধুদের অনর্থক সোরগোল পছন্দ হচ্ছে না বোধহয়! পদার্থবিদ নাকি? ল্যাবের সাদা এ্যাপ্রনে বেশ মানাবে ওকে!
হ্যাঁ, কফিশপ সংলগ্ন ফুটপাতের উপর মাঝারি আকারের এক পাথরের চাকতির উপর বসে ক্ষণে ক্ষণে স্বেচ্ছাচারী ও স্বাধীনচেতা এক ধূসর-পিঁপড়া পর্যবেক্ষণরত ছেলেটির সামনের রাস্তার ওপাশের দালানটা এক ম্যুভি থিয়েটার বটে!
তবে এটাই শেষ কথা নয়। উষ্ণ ইউরোপীয়ান রোদ পোয়ানো আর অনিচ্ছাসত্ত্বেও পাশের মুদি দোকান হতে নিঃসৃত ফতে’আলীর হালকা ফিউশন শ্রবণরত ছেলেটি অপেক্ষমাণও বটে। ছেলেটি অপেক্ষমাণ মেয়েটির জন্য।
২
প্রায় একমাস আগের এক বৃষ্টিমুখর সকালে এক দলগত গবেষণামূলক কর্মে কর্মরত ছেলেটির সামনে টেবিলের ওপাশে মিষ্টি অভিবাদন জানিয়ে বসেছিলো যেই মেয়েটি, যাকে দেখেও না দেখার ভান করে পুনরায় কর্মে মনোযোগী হওয়ার বৃথা চেষ্টা চালিয়েছিলো যেই ছেলেটি, তার ঠিক পরের সপ্তাহেই সব সম্ভ্যাবতার সূত্র ভেঙ্গে দিয়ে সেই মেয়েটিই চলে এসেছিলো সেই ছেলেটির ঠিক পাশেই। পরের তিনটি সপ্তাহ কোন এক অজানা কারণে এক অদ্ভুত মূর্ছনায় কেটেছে ছেলেটির প্রতিটি মুহূর্ত। বেড়ে গিয়েছিলো কর্মস্পৃহা! দলের অন্যান্য কানাডিয়ান, পোলিশ, আইরিশ, ভারতীয়রা কি বুঝে মুচকি হাসত কে জানে! মাত্র একমাসের ঐ গবেষণা-কর্মে দলের দু’জনের দক্ষতার আকস্মিক উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির ব্যাপারটা ওরাও হয়তো ভালোই উপভোগ করতো! লাঞ্চ-ব্রেকের আধ-ঘন্টা থেকে দশ মিনিট এদিক-ওদিক হয়ে গেলেও কঠোর-নির্দয় সেই রাশভারী গ্রুপ-লিডার কানাডিয়ান মেয়েটি খুব সহজেই মেনে নিত ওদের কৈফিয়ত, মুচকি হেসে! আধ-ঘন্টায় কি হয়? সময় কোন দিক দিয়ে যায়! কত কথা! কত কথা! ফ্রয়েড থেকে শুরু করে লালন! সাইকোলজী থেকে শুরু করে ফিজিক্স! স্পেনের কোন এক গ্রামের কোন এক মাতাল বাবার কথা তার মনোবিজ্ঞানী মেয়ের কাছে শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে যেত ছেলেটি। বলে ফেলতো নিজের অনেক কথা, নিজের অজান্তেই। প্রাণখোলা ঐ হাসি, রহস্যময় ঐ শারীরিক ঘ্রাণ, অনেক কথা বলতে চাওয়া ঐ ঠোঁট ওকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো অনেক দূরে। ছেলেটির নিজ-রাজ্য হতে নির্বাসনে। সেই রাজ্য, যেখানে রাজত্ব করে এক মহা-পরাক্রমশালী জান্তব রাজা। নিজেকে বিলিয়ে দিতে কুন্ঠাহীন যে, নানাবিধ প্রজাদের বিচরণে যার দ্বিমত নেই, কিন্তু যার বিশাল রাজ্যের মহা-নিভৃতে বিরাজমান গোপন-কোঠরে অনুপ্রবেশকারী কারও অস্তিত্ব ঘুণাক্ষরেও টের পেলে যেই রাজত্ব হয়ে যায় খান-খান। পরে হুমকির মুখে।
নীল-সবুজ ঐ চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একদিন সবিস্ময়ে উপলব্ধি করেছিলো ছেলেটি, যে এক মহা-শক্তিশালী গঙ্গোরিডাই হস্তিবাহিনীর আক্রমণ আসছে! ওর সেই ছোট্ট গোপন-কুঠুরি এখন মারাত্মক আশঙ্কার মুখে!
৩
তাই আজ কফিশপ সংলগ্ন ফুটপাতের উপর মাঝারি আকারের এক পাথরের চাকতির উপর বসে ক্ষণে ক্ষণে স্বেচ্ছাচারী ও স্বাধীনচেতা এক ধূসর-পিঁপড়া পর্যবেক্ষণরত সেই ছেলেটি অপেক্ষায় আছে সেই মেয়েটির। ক্রমাগত চাপে নতি স্বীকার করে তবেই সে সম্মতি দিয়েছে সেই মায়াবী লুটেরা স্প্যানিয়ার্ডকে! ছেলেটি জানে, এরা যেখানেই যায়, ধ্বংস করে দেয় সব! ইতিহাস সাক্ষী!
পাথরের পেভম্যান্টের উপর জটলা পাকানো সেই কিশোর-কিশোরী-তরুণ-তরুণীদের সোরগোলের ফাঁক দিয়ে এক চিরচেনা মায়াবী স্প্যানিয়ার্ডকে চিনতে ভুল হলো না ছেলেটির। লুটেরা! সভ্যতা-ধ্বংসকারী! কিন্তু একি? আজ আরও মোহনীয় কেন? রাস্তার এইপাশে সে ইচ্ছে করেই বসেছে অলক্ষ্যে ঐ মায়াবিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে। ধীরে পায়ে এগিয়ে আসছে। উৎকণ্ঠা কেন ওর চোখে মুখে? হয়তো টাকা নিয়ে আসতে ভুলে গেছে! কাকে খুঁজছে? ছেলেটিকেই নাকি? নিষ্পাপ মুখ? আরে নাহ্! ওটা মুখোশ! ওর আড়ালেই লুকিয়ে আছে দস্যুতা! চুপিয়ে রেখেছে কুটিলতা! এবার দাঁড়িয়ে পড়লো। সুস্পষ্ট উদ্বেগ! আরে ফোন বাজছে! হ্যাঁ, মেয়েটির হাতে সেই মুঠোফোন যেটাতে বেশ কয়েকবার টপ-আপ করে দিয়েছে ছেলেটি। ভুলে যাও ছেলে! আবেশিত হয়ো না! উত্তর দিয়ো না! তুমি যা দেখতে এসেছিলে সেটা কি সার্থক? তুমি কেন এসেছিলে? এটা কি খেলা? পিঁপড়ের রাজত্বের ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করেছো বলেই তুমি কি ঈশ্বর ভাবছো নিজেকে?
আচমকা উঠতে গিয়ে ক্যাকটাস প্রতিশোধ নিলো। দিগ্বিদিগ্জ্ঞান হারানো ছেলেটা এবার পালাচ্ছে। নীল-সবুজ ঐ মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে ক’দিন আগেই সে সবিস্ময়ে উপলব্ধি করেছিলো কিছু। সে উপলব্ধি করেছিলো এক মহা-শক্তিশালী গঙ্গোরিডাই হস্তিবাহিনীর আক্রমণ আসছে! ওর সেই ছোট্ট গোপন-কুঠুরি এখন মারাত্মক আশঙ্কার মুখে! সেটাকে বাঁচাতে হবে যে! সব দ্বার বন্ধ করতে হবে! দুর্গ! দুর্গ! পাশের চাপা রাস্তাটা দিয়ে প্রাণপণে দৌড়ুচ্ছে সে। তার সামনে এখন এক অসীম অনুর্বর ঊষর মরু আর পেছনে স্বেচ্ছাচারী ও স্বাধীনচেতা এক ধূসর-পিঁপড়ার বাঁকা হাসি।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১০ রাত ১০:১৪