ও অ্যা যাইবেন নি, মিঠাছরা, বারোইয়ারহাট, বড় দারগোহাট, সিতাকুন্ড কচি স্বরে ডেকে চলেছে জামাল নামের এগারো বছরের এক শিশু। এভাবে চিৎকার করে গণপরিবহনে যাত্রী ডাকার দৃশ্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু যখন সে আওয়াজটা হয় কোন কচি শিশুর মুখে তখন থমকে যেতে হয়। কখনো হেলপার আবার কখনো পত্রিকা হাতে কিংবা কখনো কখনো হোটেল-রেস্টুরেন্টে সেবক হিসেবে দেখা মিলছে দশ-বারো বছর বয়সী শিশুকিশোরদের। শুধু তাই নয়, নগরীতে সাম্প্রতিক সময়ে অহরহ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ যেমন- নির্মাণ কাজ, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, ট্যানারি ও বিভিন্ন ওয়ার্কশপে আশঙ্কাজনক হারে দিনদিন বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। গত নির্বাচনে ২০১৬ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের অঙ্গীকার করেছিল বর্তমান সরকার। অথচ কিছুতেই এসব শিশুশ্রম থামানো যাচ্ছে না। ফলে বিফলে যাচ্ছে শিশুশ্রম নিরসনে সরকারি উদ্যোগ। সচেতনমহল ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, মানবিক কারণেই নারী ও শিশু শ্রমিকদের প্রতি নজর দিতে হবে। না হয় সরকারের মধ্যম আয়ের দেশের স্বপ্ন এবং মানব উন্নয়ন সূচকের অগ্রগতি অধরাই থেকে যাবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর বিভিন্ন রুটের গণপরিবহনের হেলপার হিসেবে কাজ করছে অসংখ্য শিশু। সিটি সার্ভিসের বিভিন্ন পরিবহনে কম পারিশ্রমিকে সহজে পাওয়া যায় বলে চালক ও মালিক দু’পক্ষেরই পছন্দ শিশু হেলপার। আবার রাস্তাঘাটে কিংবা বাস ও রেল স্টেশনে পত্রিকা হকারি করে বেড়াচ্ছেন এমন শিশুর সংখ্যাও কম নয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ষোলশহর রেল স্টেশন, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, দুই নাম্বার গেইট, জিইসি এলাকায় শিশুদের পত্রিকা হাতে হকারি করতেও দেখা যায়।
এ প্রসঙ্গে লেখক ও শিক্ষাবিদ আনোয়ারা আলম আজাদীকে বলেন, দারিদ্রতা ও জীবিকার তাগিদে মূলত ছিন্নমূল পরিবার এবং বস্তি এলাকার শিশুরাই এ ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। আর পরিবহন খাত হচ্ছে শিশুশ্রমের জন্য চিহ্নিত ৪৭ টি খাতের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এর পরেও পরিবহন মালিকরা স্বল্প খরচে সর্বোচ্চ শ্রম পাওয়ায় শিশুদের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, শ্রম আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় শিশুদের এখনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ থামছে না। আমাদের দেশে শিশুশ্রম হয়তো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু এটাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। দারিদ্রতার কারণে পরিবারগুলো তাদের শিশুকে স্কুলের পরিবর্তে আয় করার জন্য বাধ্য করছে। সেজন্য দারিদ্রতা নিরসন প্রকল্প জোরদার করার পাশাপাশি জাতীয় শিশুনীতি ও শিশু আইন বাস্তবায়নে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শিশুশ্রম জরিপে বলা হয়েছে, দেশে কোনো না কোনোভাবে শ্রমের সাথে যুক্ত রয়েছে এমন শিশুর সংখ্যা ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে। এ ছাড়া শিশুরা আরো কিছু বিচিত্র কাজেও নিয়োজিত। এর মধ্যে রয়েছে হকারি, ডাস্টবিনে ময়লা কুড়ানো, কুলি, রিকশা শ্রমিক, যৌনব্যবসা, ফুল বিক্রেতা, মাদক বাহক ও বিক্রেতা প্রভৃতি। আর এসব শিশু শ্রমিকের প্রায় ৫০ ভাগই তাদের পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস। আবার শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা শিশুর সংখ্যা ১৩ লাখ। অন্যদিকে শিশুদের নিয়ে কাজ করা কিছু বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, দেশে শ্রমে নিয়োজিত বহু শিশুর বয়স ১৪ বছরেরও অনেক নিচে। সে হিসেবে দেশে ৭৪ লাখের বেশি শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত। এদিকে ২০০৬ সালের ১১ অক্টোবর প্রণীত বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে, যে কোন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের বয়স ১৪ বছরের নিচে হওয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গত ২০১১ সালে এসব শিশুদের সংখ্যা নিয়ে জরিপ করা এবং তাদের অবস্থা পরিবর্তনে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কোন ফল পাওয়া যায়নি। আর যাদের নিয়ে এত উদ্যোগ, তারাও এসব বিষয়ে কিছু জানে না।
‘শ্রম আইনের ৩৯ এর (১) এবং (২) ধারায় বলা আছে- সরকার সময় সময়ে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঝুকিপূর্ণ কাজের তালিকা ঘোষণা করিবে। এবং সরকার কর্তৃক ঘোষিত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কোন কিশোরকে নিয়োগ করা যাইবে না।’ এক্ষেত্রে সরকার এখনো ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের খাতগুলো চিহ্নিত পর্যন্ত করতে পারেনি। তবে বিভিন্ন সংস্থা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে মোটর ওয়ার্কশপ, ওয়েল্ডিং, ব্যাটারি ফ্যাক্টরি, ট্যানারি, গ্লাস কারখানা, রিকশা চালানো, মাদক বাহক, রাস্তাঘাটে পান, বিড়ি-সিগারেট বিক্রয়, বাস-ট্রাকের হেলপার, নির্মাণ শ্রমিক, ইট ভাঙা, বাস ও রেল স্টেশনের কুলি, গৃহ শিশুশ্রম, জাহাজ শিল্প, চিংড়ি হ্যাচারি, শুঁটকি তৈরি, লবণ কারখানা, কৃষিকাজ, বেডিং স্টোরের শ্রমিক ইত্যাদি খাতকে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু জীবিকার তাগিদে এসব পেশায় নিয়োজিত হওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই বলে জানান শিশু শ্রমিকরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-নিউ মার্কেট রুটে চলাচলকারী ৩ নং সিটি সার্ভিসের হেলপার আমজাদ (১৩ বছর) বলেন, ঘরে মা আর দুই বোন আছে। আমি ছাড়া সংসার চালানোর জন্য আর কেউ নেই। বাধ্য হয়ে তাই মোটর লাইনে নেমেছি। নিজের এই বয়সে এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হওয়া যে আইন বিরোধী সে বিষয়ে জানে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আমজাদ বলেন, পেটে ভাত না থাকলে আইন দিয়ে কি হবে? সরকার তো আর ঘরে চাল-ডাল এনে দিবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুনর্বাসন না করে শিশুশ্রম বন্ধের কথা বলে কার্যত কোন পরিবর্তন আসবে না। পরিবারের সদস্যদের মাঝে এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সরকার কিংবা আমরা যত কিছুই বলিনা কেন আসলে এসব শিশুদের সংগঠিত করার জন্য কোন উদ্যোগ নেই। সবকিছুর আগে এদেরকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৪