দুপুরের আকাশে সূর্যটা যখন তার সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করছিলো , সেই সময় গাছের ছায়াহীন মাটির পথ ধরে হাটছিলেন হারুন মিয়া। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে তার। মাথার ঘাম মুছছেন আর পান চিবাতে চিবাতে যাচ্ছেন। বাসায় তার বউ এই সময় বের হতে না করেছিলেন কিন্তু তিনি মানলেন না । তাকে যেতেই হবে। তার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন তাহের সাহেব । কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারতে হবে আজ। না গেলে যে বিপদ হয়ে যাবে ।
হারুন মিয়া এর পুরো নাম হারুনুর রশিদ। গ্রামের একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর হেড মাস্টার ছিলেন। অবসরে আছেন ১০ বছর হল । তিন মেয়ে এক ছেলে । বড় মেয়ে দুইটার বিয়ে হয়ে গেছে। খুব ইচ্ছে ছিল সবকয়টা ছেলে মেয়েকে অনেকদূর পর্যন্ত পড়াবেন । কিন্তু বড় মেয়ে দুইটাই তাকে হতাশ করেছে। পড়াশুনায় কোন মন ছিল না । তাই কম বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন তাদের। বিয়ে দেওয়ার পিছনে আরও একটি কারণ ছিল। দুইজনই প্রেম এ পরেছিল এলাকারই এক ছেলের উপর। তাই বড়টার বিয়ে দেওয়া হয় ওই ছেলের সাথে। প্রচুর বই পড়ুয়া হারুন মিয়ার কেন জানি মনে হয়েছিল হুমায়ুন আহমেদ এর “ শঙ্খনীল কারাগার” এর মতো তার অপর মেয়েটি মারা যাবেন। তাই দ্রুত তার ও বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় । সবচেয়ে ছোট মেয়ে ক্লাস ১০ এ পড়ে। আর ছেলেটা পড়ে এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ। এইবার লাস্ট সেমিস্টার চলছে ওর।
গ্রামের রাস্তা তাই যেখানে সেখানে পানের পিক ফেললে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু কিছুটা দুশ্চিন্তায় থাকার কারণে আজকে একটু গরমিল করে বসলেন হারুন মিয়া। পানের পিকটা গিয়ে পরল পাশদিয়ে হেটে যাওয়া মানুষটির লুঙ্গিতে।
অন্যের গরু নিজের জমির ধান খেয়ে ফেললে যেভাবে ধমক দিয়ে তাকে দূর করা হয় ঠিক সেই সুরেই বলা শুরু করলো-
“হই মিয়া ! আন্ধা নাকি ?
মাইনশেরে দেহন লাগে না!! ”
বলেই আবার চুপসে গেল বারেক । বারেক এলাকারই কৃষক । নিজেকে শুধরে নিয়ে বলল- “মাস্টার সাহেব! মাফ কইরে দিয়েন । আপনারে দেখি নাই । কিছু ভুল কইয়ে থাকলে ... ”
হাত দেখিয়ে কথা বলা থামিয়ে দিয়ে হারুন মিয়া বলা শুরু করলেন-
“বারেক, কই যাও?
ভুলটা আমার । তুমি কেন মাফ চাইছ?
চল সামনের কল চেপে দেই তুমি পা টা ধুয়ে ফেলো ”
বারেকঃ “বাজারে যাই । কিছু কাম আছিল । আপনে চিন্তা কইরেন না আমি বাজারে যাইয়া ধুয়ে নিমুনি ”
রোঁদে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া চেহারাতে ৩২ দাঁত বের করা এক অমায়িক হাসি দিল বারেক ।এইরকম খাঁটি হাসি গ্রাম ছাড়া আমাদের এই শহরে খুব একটা দেখা যায় না । শহরে সবাই দেয় মেকি হাসি । আড়ালে যেতেই আবার শুরু হয়ে যায় বাজে মন্তব্য। কিন্তু বারেক এর মুখের হাসিতে ছিল স্রধা , ভক্তি আর অনুশোচনা ।
কথা বলতে বলতে বাজারে পৌঁছে গেলেন তারা। হারুন মিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিল বারেক। মুখ থেকে পান ফেলে দিয়ে হারুন মিয়া ঢুকলেন “ তোতা ডেকরেটর” নামে এক দোকানে। তাহের সাহেবের ভাইস্তা তোতা এর দোকান । দোকান বললে ভুল হবে আসলে ডেকরেটিং এর ব্যবসা । সেখানে অপেক্ষা করছিলেন তাহের সাহেব। হারুন মিয়া তাকে দেখে একটা সালাম দিলেন। শুধু হাতটা তুললেন, মুখে কিছু বললেন না । সচরাচর এইরকম সালাম দেন না উনি।
তাহের সাহেব বললেন- “ অয়ালাইকুম!
হারুন মিয়া বসো ”
ফ্যানের নিচে বসে সাদা পাঞ্জাবীর বুকের বোতাম কয়টা খুলে বসলেন হারুন মিয়া।
তাহের সাহেবঃ “ তাইলে ঠিক করছ বিক্রি কইরেই দিবা। আর করলে আমার কাছেই করবা আমি জানি ।তাই তোমারে খবর দিয়েই নিয়ে আইলাম”
(তাহের সাহেবের মুখে ব্যবসায়িক হাসি)
হারুন মিয়াঃ “হ। আর তো কুন উপায় নাই । পোলাটারে তো পাশ করাইতে হইব। আপনে তো জানেন কি কষ্ট কইরে পোলাটা আমার পড়ালেখা করছে। এই শেষ সময়ে আইসে তো ছাইড়ে দিতে পারি না”
তাহের সাহেবঃ “হ। তা ঠিকই কইছ । তুমিও তো কম কষ্ট করোনাই মিয়া। যা জমিজমা একটু ছিল বেইচা দিছ। এখন শুধু থাকলো তোমার বালিজুরির ক্ষেতের উত্তর দিকের ওই সেগুন গাছ কয়টা”
হারুন মিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তবে মনে একটা আশা এইটাই হয়তো তার শেষ দীর্ঘ নিঃশ্বাস। কতবার যে ক্রেডিট এর টাকা দেওয়ার সময় এই রকম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই। হারুন মিয়ার ছেলের নাম আকাশ । ছোট থেকেই গ্রামে বড় হয়েছে। লেখাপড়ায় গ্রামের সেরা ছাত্র । সবাই বলে দেশের স্বাধীনতার পর নাকি আকাশের মতো ভালো ছাত্র আর জন্মে এই গ্রামে। স্বাধীনতার আগে একজন ছিলেন । মোতাহের হোসেন তরফদার। সেই সময়ে এই গ্রামে লেখাপড়া করে পশ্চিম পাকিস্তানের একজন নামকরা উকিল হতে পেরেছিলেন। পরে স্বাধীনতার পরও আর দেশে আসেন নাই।
আকাশ সেই রকমই একজন ছাত্র। তুখোড় মেধা। এস. এস. সি এবং এইচ.এস. সি গ্রামে থেকেই পাশ করেছে। ভুল হয়ে গেছে ভার্সিটি তে ভর্তি হওয়ার জন্য ঢাকায় কোচিং করতে না যাওয়ায়। পরে কোথাও ভর্তি হতে পারল না। মন ভেঙ্গে গেল আকাশের। বাবাকে জানলো জেলা সদর এ গিয়ে কোন কলেজে অনার্স এ ভর্তি হবে। হারুন মিয়া বুঝতে পারলেন ছেলের মনের কথা, লুকায়িত স্বপ্ন । ছোটবেলা থেকেই ছেলের উচ্চাশা ছিল নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে। হঠাৎ করে এই বাধাহীন ছুটে চলা স্বপ্নে এইভাবে বাধা পরলে মেনে নিতে পারবে না ও।
একদিন ডেকে বললেন- “ যা বাপ , ঢাকায় যা । দেখ অনেক বেসরকারি ভার্সিটি আছে। ভালো কইরে খুঁজ নিয়ে একটাতে ভর্তি হ । তরে একবার ঢাকায় যাইতে বারন কইরে যে ভুল করছি আমি আর সেই ভুল করতে চাই না। তুই কালকেই ঢাকায় যা”
এর পর থেকে ঢাকায় আকাশ । পড়ালেখায় কঠোর পরিশ্রম করার পাশাপাশি টিউশনি করায় । ডিপার্টমেন্ট এ ফার্স্ট । স্যারদের প্রিয় মুখ। কিন্তু সহপাঠীদের মধ্যে মোটেও প্রিয় মুখ হতে পারে নাই আকাশ। ক্লাসের পরে, সন্ধ্যায় , ক্যান্টিনে কোথাও আড্ডায় পাওয়া যায় না আকাশকে। ক্লাস শেষেই টিউশনির জন্য দৌড় দেয় আকাশ। গিটার এর প্রতি একটা চরম দুর্বলতা আছে আকাশের। বন্ধুদের গিটার বাজিয়ে গান করতে দেখে শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আকাশ। কিছুই করার নেই। ছুটতে হবে টাকার পিছনে। ঢালতে হবে ভার্সিটিতে। ক্রেডিট ফি নেওয়ার সময় হা করে থাকে ভার্সিটি টাকা খাওয়ার জন্য। টাকা খাইয়ে পেট ভরাতে পারলেই পাওয়া যাবে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ।
নিজের টিউশনির টাকা আর বাসা থেকে টাকা এনে ক্রেডিট ফি দেয় আকাশ। যেদিন হারুন মিয়া টাকা পাঠান সেইদিন ফোনে তিনি প্রচুর হাসাহাসি করেন। তিনি চান যাতে ছেলে বুঝতে না পারে যে টাকা পাঠাতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু লাভ হয় না । আকাশ ঠিকই বুঝতে পারে এই টাকা পাঠাতে তার বাবার কি কষ্ট হচ্ছে ।
আকাশ লাস্ট সেমিস্টার এর ক্রেডিট ফি এর জন্য বাবার কাছে টাকা চেয়ে ফোন দিল।মনে একটা সঙ্কা, আনন্দ, কষ্ট সবকিছু মিলিয়ে একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিলো আকাশের। এমন অনুভূতি আকাশের হয়নি কখনও। মনে হচ্ছিলো অধরা স্বপ্নগুলো শুধু হাত বাড়িয়ে ধরাটা বাকি । কিছুদিন পরেই সব কষ্ট শেষ ।
আকাশঃ “আব্বা, টাকা কি জোগাড় হয়ে গেছে? ”
হারুন মিয়াঃ “হ বাপ , হইছে। তুই চিন্তা করিস না রবিবার তো হরতাল আমি সোমবার গাছ গুলান বিক্রি কইরে মঙ্গলবার এই টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করতাছি। তোর তাহের চাচার কাছে বিক্রি কইরে দিলাম । হে তোর কথা শুইনে যা দাম চাইছি তাতেই কিনে নিলো । হা হা হা ... ”
আকাশঃ ( জীবনে প্রথমবার বাবার কথার সাথে সামান্য হেসে দিল আকাশ ) “ ঠিক আছে আব্বা, আমি রাখি”
হারুন মিয়াঃ “হ । রাইখে দে । আমি তরে জানামুনি”
আকাশ সালাম দিয়ে ফোন রেখে দিল। পড়তে বসতে চাইলো কিন্তু আজকে পড়ায় মন বসছে না আকাশের । কি রকম একটা সঙ্কা কাজ করা শুরু করলো মনে। সেইটা ভুলার জন্য ভবিষ্যৎ নিয়ে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করলো আকাশ। তাতেও কোন লাভ হল না।
রবিবার সারাদেশে হরতাল। তাই শনিবার রাত থেকেই দেশে গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। গ্রামে কিছু হবে বলে মনে হয় না । নিশ্চিন্তেই ঘুমাতে গেল সবাই ।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন হারুন মিয়া। নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে হাঁটেন। কিন্তু আজ সকালে তাকে ডেকে তুলল এলাকার মানুষ।
: “মাস্টার সাব
ও মাস্টার সাব
উঠেন উঠেন ”
হারুন মিয়ার রাতে ঘুম হয় নি । তাই ডাকতেই উঠে পরলেন ।
: “কি হইছে?”
: “রাইতে আপনের ক্ষেতের গাছ গুলান কিছু জোয়ান পুলাপাইন আইসে কাইটে নিয়ে গেছে। পরে শুনি ওরা হরতাল করনের জন্যে গাছ কাটছে । মেইন রোড আটকাইব বইলে নিয়ে গেছে”
আরেকজন বলা শুরু করলোঃ “চলেন আমগোর লগে। যা পাই নিয়ে আসি ।
আল্লাহ্! কি যে একটা ভুল হইয়া গেল । আমরা মনে করছিলাম তাহের সাবের লোকজন আইসে গাছ কাইটে নিতাছে। ইশ রে!! একটুও বুঝবার পারি নাই”
হারুন মিয়া উঠানে রাখা গামছাটা গায়ে দিয়ে ছুটে চললেন তাদের সাথে । মনে মনে একটা আশা কাজ করছে যেহেতু আজকে হরতাল আর সকালেই যাচ্ছি তাতে পাওয়া যাবে কিছু ।
যখন দুশ্চিন্তায় আশেপাশের সব কিছু ঘোলা হয়ে আসছিলো হারুন মিয়ার , পা দুটো কোন এক অলৌকিক শক্তির বলে থামছে না তখনও কানে ভেসে আসছিলো যে রাতে মেইন রোডে নাকি মারামারি হয়েছে, বাস ভাঙছে দুইটা ।
সি এন জি , মোটরসাইকেল ও পুড়িয়েছে দুর্বৃত্তরা ।
মেইন রোডে পৌঁছে হারুন মিয়া দেখলেন অনেক ভিড়। মানুষ, পুলিশ ,কিছু সাংবাদিক ও আছে। পরে শুনতে পেলেন গাছ কেটে রোড আটকানো হয়েছিলো। কিন্তু রাতে হরতাল সমর্থকরা গাছ গুলায় আগুন দেয় । বাস পোড়ায় , সি এন জি , মোটরসাইকেল যা পেয়েছে নিজের সম্পত্তি মনে করে পুড়িয়েছে।
এখন সব আগুন নিভানো হয়েছে। শুধু একটা টায়ার থেকে ঘন ধোঁয়া বের হচ্ছে। গাছের কাঠ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
এখানে আগুন নিভলেও আগুন কিন্তু কিছু জায়গায় ঠিকই জ্বলছে। জ্বলছে দাউ দাউ করে। আকাশের স্বপ্ন, তার পরিবারের স্বপ্ন সব জ্বলে যাচ্ছিল সেই আগুনে। সেই আগুনের উত্তাপে হারুন মিয়ার চোখের জল শুকিয়ে গেলেও আকাশ কেঁদেছে অনেক। আর্থিক কষ্ট, স্বপ্নের মৃত্যুর দুঃখকে সঙ্গী করেই আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে হবে ওর ,করতে হবে আরও অপেক্ষা।