২০০৯ সাল। রাজশাহীর হেতেম খাঁ। ছুটিতে দীর্ঘ জার্নি শেষে আপার বাসায় সকালবেলা উপস্থিত। গিয়েই দেখি আপার অক্টাজেনারিয়ান শ্বশুর দেশের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মুরুব্বির সাথে আমার চমৎকার সম্পর্ক। নানারকম মজার গল্পের ভান্ডার এই ওল্ড ম্যান। ধার্মিক ও অধ্যাত্মিক মানুষ। নিজের খেয়ে জিন-ভূতের বোতলবন্দী জাতীয় কাজবারও অতীতে করতেন কথিত আছে। এখন তিনকাল পেরিয়ে এই বয়সে এগুলো করেন না তবে ‘তেনারা’ নাকি উনার আশেপাশেই থাকেন।
উনাকে কিছুতেই গ্রামের বাড়ি থেকে রাজশাহীতে আনা যায় না। উনি বিভিন্নরকম অজুহাতে সেটা রোধ করেন। শুধু ফিস্ফিসিয়ে নাতিদের বলেন-- না যাওয়াই সবার জন্য মঙ্গল রে পাগলা। তো নাতিদের বিরাট কচলাকচলিতে উনি বহুদিন বাদে রাজশাহীতে গতকালই এসেছেন বেশ কিছুদিন থাকবেন মনস্থ করে। কিন্তু একদিন পরেই অস্বাভাবিক ঘটনার ঘনঘটায় উনার রাজশাহী থেকে এই অকাল-প্রস্থান সকলকে কিংকর্তব্যবিমুড় রেখে।
ঘটনা বলি। তিনতলা বাসার দু-তলাতে আপারা থাকেন। তিন তলায় এক ডাক্তার পরিবার থাকে। অন্ধকার রাত। পাশেই কবরস্থান থাকায় এমনিতে ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করে। সেদিন রাত দুইটার দিকে হঠাৎ ছাদের দরজাতে দড়াম দড়াম করে থাবা পড়ছে বেশ জোরে সোরে। মনে হচ্ছে কেউ মৌনমুখে দরজায় করাঘাত করে দরজা খুলে দেওয়ার আহবান করছে। বেশ কয়েকবার এরকম শব্দের পর আপা-দুলাভাই ঘটনা দেখার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে দেখেন তিনতলার ডাক্তার সাহেবও বের হয়েছেন কি ঘটছে দেখার জন্য। থেমে থেমে দরজায় মানুষের জোরে জোরে থাবা দেওয়ার মতো শব্দ চলতেই আছে। সকলে মিলে উপরে গেলেও ছাদের দরজা খোলার সাহস পায় না। শব্দ অবিরত চলছে। ছাদের দরজাটা আবার ইঞ্চি দেড়েক ফাঁকা নিচের দিকে। দুলাভাই সিঁড়ি থেকে লাইটের আলো ফেলে নিচ দিয়ে তাকিয়ে কোনো দাঁড়ানো মানুষের পায়ের উপস্থিতিও পাচ্ছেন না। শব্দ চলতেই আছে। সকলেই আতঙ্কগ্রস্ত। দরজা না খুলে সবাই নিচে নেমে এসেছে। ওল্ডম্যান অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুয়ে হালকা গোঙানীর মতো আওয়াজ করছে। বাসার কারো কথার কোনো জবাব দিচ্ছে না। ইতোমধ্যে পাশের একটু দূরের বাসার মানুষও জেগে উঠেছে শব্দ পেয়ে। ছাদে কেউ আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে জানায়-- কাউকে দেখছেন না তারা। ছাদ ফাঁকা। এর ফলে সকলের ভীতি আরো বেড়ে যায়। সারারাত ঘুম হয় না। এভাবে বিরতি দিয়ে দিয়ে থাবার শব্দ ফজরের আজানের পর থেমে যায়।
আর সকাল বেলায় বৃদ্ধ বেশ কিছুদিন থাকার জন্য আসলেও কিছুতেই আর থাকবেন না রাজশাহীতে। ঐ দিনই রাজশাহী ত্যাগ করেন কোনো কারণ না জানিয়েই।
আমি এই বিষয়ে পরে উনাকে জিজ্ঞেস করলে উনি মৃদু হেসে জানান ‘শহর পছন্দ নয় তেনাদের’।
মনে প্রশ্ন জাগেঃ শহুরে দুপেয়ে ভূতের তাণ্ডবে কি গ্রামের ভূতেরা ভীত হয়ে শহর মাড়াতে ভয় পায় এখন?
২
২০১৫ সাল। গ্রামের বাড়িতে তুলকালাম। আট বছরের ভাতিজাকে ভূতে ধরেছে। শুনে একটু হাসিই পেল। এই পিচ্চি পোলাপানকে আবার কীভাবে ভূতে ধরবে? ভাবলাম বিশাল বাড়িতে একা একা থাকে। নানা কাজে ভাইয়াও হয়ত সময় পায় না। ভাবীও ‘ বোঝে না সে বোঝে না’ সিরিয়াল দেখতে গিয়ে বাচ্চার দেখভাল করার ব্যাপারটা হয়ত বুঝতে পারছে না। এতেই হয়ত একাকীত্বের কারণে নার্ভাস ব্রেকডাউন ঘটেছে পিচ্চির। কিন্তু ঘটনা শুনার পর আমার আক্কেলগুড়ুম। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচালে ঘুরপাক খেতে শুরু করলাম।
পিচ্চি ভাতিজা বিড়ালের বাচ্চাকে দেখার জন্য দু তলাতে গিয়েছে সন্ধ্যার সময়। যেহেতু উপর তলায় এখন আর মানুষ থাকে না ফলে একটু গা ছমছমে ভাব আমাদেরও আছে। তো পিচ্চি গিয়েই চিৎকার দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলছে-- একজন মানুষ বিশাল সাদা ঘোড়ার পিঠে চেপে টগবগ টগবগ করতে করতে তাকে ধাওয়া দিয়েছে। নেমেই নিচের ঘরে টিভি দেখারত ভাইয়া-ভাবীকে ভীষণ আতঙ্কিত অবস্থায় বলছে সাদা ঘোড়ার কাহিনি। বলতে বলতে মুখ দিয়ে ফেনা তুলে গোঙাতে গোঙাতে অজ্ঞান। ভাইয়া কিছুটা আঁচ করতে পেরে ছেলেকে কাঁধে নিয়ে প্রায় হাফ কিলোমটার দূরে একজনের (সম্পর্কে ভাবী হয়, উনার জীন-ভূতের কাজকারবার আছে, মাঝে মাঝে হাত উঠে মানে মেয়ে হয়েও পুরুষ কন্ঠে কথা বল শুরু করে হাত পাকাতে পাকাতে ইত্যাদি আজব সব কাণ্ড) কাছে নিয়ে চলছে।
কিন্তু অতি আশ্চর্যজনকভাবে সেই ভাবীর বিকট চিৎকার দিয়ে হাত উঠেছে একই সময়ে। এবং উনিও ভয়ঙ্করভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে আমাদের বাড়ির দিকেই আসছে। মাঝামাঝি জায়গায় মসজিদ। মসজিদের পাশেই একজনের বাসায় বসে উনি ভাতিজাকে বিভিন্নরকম কথা জিজ্ঞেস করতে শুরু করেন। আর মারাত্নক ব্যাপার হচ্ছে এখন যখন পিচ্চি ভাতিজা কথা শুরু করেছে তখন তার গলার স্বর অন্যরকম ও অবশ্যই পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতো।
মনে প্রশ্ন জাগেঃ পিচ্চির এই ঘটনা মহিলা সাথে সাথে কীভাবে টের পেলেন প্রায় হাফ কিলোমিটার দূর থেকে? আর গলার স্বর পরিবর্তনের হকিকত কি?
৩
তখন হয়ত ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়ি। গ্রামে প্রতিবছর মাদারের সিন্নি বলে একটি রেওয়াজ চালু ছিল। গ্রামের কবরস্থানের মাঝে এক বিশাল বটগাছ। সেই বটগাছে নাকি মাদার পীর বাস করে। তাঁর জন্যই এই সিন্নি মানে খানাপিনা। জন্মের পর থেকেই এটি দেখে আসছি।
বছরের একটি বিশেষ দিনে এই আয়োজন। সাধারণত কার্তিক মাসে। এই সকল কুসংস্কার গ্রামের অনেকেই মানতে চায় না। অনেকে আবার নিছক মজা মনে করে ভুরিভোজে যোগ দেয়। গোটা গ্রাম দেখেছি যেন উৎসব লেগে যায়।
গ্রামে তখন ছিলেন মাদারের বুড়ি নামে একজন অশীতিপর বৃদ্ধা। ইনিই হচ্ছেন বংশপরম্পরায় এর ঠিকাদার। বৃদ্ধা ভূত-প্রেতের কবিরাজিও করেন। তবে বিনা পয়সায়। এলাকায় উনার যথেষ্ট সুনাম।
ইতোমধ্যে গ্রামে কিছু শিক্ষিত জেনারেশন এই ধরনের কাজকর্মকে ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করেছেন।
ঘটনার দিন বিশাল পিতলের পাতিলে রান্নাবান্না চলছে। সেখানেই গ্রামের নানা মানুষ নানারকম হাসি মশকরায় রত। কেউ এর হাসির ছলে বিরোধিতা করছে। কেউ এর স্টোন্স সাপোর্টার। মাদারের বুড়ির বাড়ি সেই রান্নাস্থল থেকে শ দুয়েক গজ দূরে। রান্না চলাকালীন সময় মাদারের বুড়ি ঝিম মেরে অন্ধকার ঘরে বসে থাকে একা। সে সময় উনার সাথে কেউ কথা বলে না। আদিভৌতিক ব্যাপার স্যাপার। আমরা বাচ্চাকাচ্ছারা রান্নাস্থলে দৌড়ঝাঁপে ব্যস্ত।
হঠাৎ রান্নাস্থলে গ্রামের কিছু ত্যাড়া লোক বুড়ির এই আজগবি মাদার পীর নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে। এবং এই ধরণের ভণ্ডামী আমাদের করা উচিত নয় বলে ঘোষণা করে। একটু সোরগোল এ নিয়ে। কারণ পক্ষে বিপক্ষে মতামত দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে বুড়িকে কেউ একজন চ্যালেঞ্জ করে বসেছে এর উদ্দেশ্যে নিয়ে।
তখন সন্ধ্যারাত। দূর থেকে এক ভয়ঙ্কর চিৎকার। কয়েক সেকেন্ড পরেই সেই মাদারের বুড়ি হাত পাকাতে পাকাতে চিৎকার করে দৌড়ে আসছে রান্নাস্থলে। এসেই ভয়ঙ্কর পুরুষালী কন্ঠে সেই ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘তুই প্রমাণ দেখতে চাস, দেখ তাহলে”। বলেই মাদারের বুড়ি তাঁর ডান হাতটি বাহু পর্যন্ত ফুটন্ত পোলাও এর পাতিলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে হাতা দিয়ে নাড়া দেওয়ার মতো করে নেড়ে দিতে থাকে কয়েক সেকেন্ড।
ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত সকলে বিস্ময়ে বিমূড় হয়ে গেছে। আর আমরা ছোটরা এই দৃশ্য দেখে মিলিসেকেন্ডের ব্যবধানে নেংটি ইঁদুর স্টাইলে লেজ তুলে খিঁচে দৌড় নিজ নিজ বাড়িতে।
মনে প্রশ্ন জাগেঃ ঘটনার সবচাইতে অলৌকিক দিকগুলো হল-
১। সেই ব্যক্তির টিটকারী ও বুড়ির হুঙ্কার একই সাথে। যদিও তাদের দূরত্বের কারণে একজনের কথা আরেকজনের শোনা অসম্ভব ও অবাস্তব।
২। ঐ বয়েলিং হতে থাকা গরম পোলাও এর মধ্যে হাত দিয়ে নাড়া দেওয়ার পরেও বুড়ির হাতে পরের দিন কোনো প্রকার পোড়া বা ফোস্কা পড়ার চিহ্ন না থাকা।
পুনশ্চঃ অক্টাজেনারিয়ান নশ্বর দুনিয়াকে বিদায় জানিয়েছেন ২০১৪-তে, থাবাও মইচে মনে কয়...। মাদারের বুড়ি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন ২০০৩-এ। এখন সেই গাছও নেই, বুড়িও নেই, সিন্নিও নেই, তবে এই নয়া ভাবী কিন্তু রয়েছেন শিক্ষিত জেনারেশনকে কিছু বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পেন্ডুলামে ঝুল খাওয়াতে...আমরাও খাচ্চি, তাই এ বিষয়ে কাভা ভাইয়ের আহব্বানে পোস্টও দিচ্চি...আপনারাও খান দেকি...আর কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থাকলে সেটাও আওয়াজ দ্যান।
*****************************************************************************
@আখেনাটেন/আগস্ট-২০২০