২০১০ সাল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর কুণ্ডু স্যারের পাক্কা দেড় ঘন্টার লেকচার শেষ করে ঝিম ধরা মাথায় দুপুরের খাবারের জন্য শের-এ-বাংলা হলের দিকে ফিরছি। সাইলেন্ট করে রাখা নোকিয়া ১৬১৬ মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে দেখি একত্রিশটা মিসকল। ভীষণ অবাক ও একইসাথে উদ্বিগ্নও হলাম। +৯১১৫... দিয়ে শুরু অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন। মোবাইল নম্বর যে নয় তা +৯১ কোড দেখে বুঝতে পারছি। ভাবছি টিএনটি বা র্যাংগসটেল বা ঢাকা ফোন ইত্যাদি ভুঁইফোঁড়ের মতো ল্যান্ডফোনের যে কোম্পনীগুলো ইদানিং বাজারে ঢুকেছে এদেরই কারো নাম্বার হবে হয়ত।
তড়িঘড়ি করে দুরুদুরু বুকে ফোন দিলাম। শোনাচ্ছে আপনার পর্যাপ্ত টাকা নেই। বিপদ যখন আসে চারপাশ থেকেই আসে। ব্যালেন্স চেক করে দেখি ১১ টাকা। এত টাকা থাকা সত্ত্বেও টাকা নেই। খচ্চর মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলোর উদ্দেশ্যে একটা নাদুসনুদুস গালি দিলাম মনে মনে। আবার ফোন দেই। একই কথা বলে পর্যাপ্ত টাকা নেই। অদ্ভুত সমস্যা তো!
তাড়াতাড়ি করে বশির মামার দোকান থেকে বিশটাকার ফ্লেক্সিলোড দিয়ে আবার ফোন দিলাম। রিং হচ্ছে...। একটু পরেই রিসিভ হয়ে অপরিষ্কারভাবে একটি মেয়ের কান্নার শব্দ শুরুতেই। ভড়কে গেলাম। সাথে কিছুটা আতঙ্কিতও!
ফোনের ওপাশ থেকে কান্নার দমকের সাথে কয়েক সেকেন্ড পরে একটি অতি পরিচিত কন্ঠে, ‘আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও অয়ন দা। আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে’।
-সুসি, তুমি দেশে কবে ফিরলে? কাঁদছ কেন? বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এসব কী আবোলতাবোল বলছ? একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম ঘটনার আকস্মিকতায়।
-হ্যাঁ, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। ডিসেম্বরের ১০ তারিখে। আর আমি কোলকাতা থেকে বল...।
যাহ্, লাইনটা কেটে গেল। দুই মিনিটের মাথায় কেটে গেছে। তারমানে এটা ভারতের নাম্বার আর সুসি কোলকাতা থেকে ফোন দিয়ে কাঁদাকাটি করছে। +৯১ কোড দেখে আগেই বুঝা উচিত ছিল।
ভীষণ, ভীষণ রকম অবাক হলাম। কারণ ও কিছুদিন আগে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে কোলকাতায় ওর আত্মীয়দের বাসায় বেড়াতে গেছে। সেখান থেকে দিল্লী ও হায়দারাবাদও যাওয়ার কথা। ভারতের ওসব জায়গায় ওর আত্মীয়স্বজন রয়েছে। দেশে ফিরে আন্ডারগ্রাড ভর্তি প্রস্তুতির জন্য ঢাকায় আসার কথা। আর এখন এসব কী শুনছি? সুসির ভাই অনিকেতও কিছু জানায় নি আমাকে। এত অল্প বয়সে ওর বিয়ে দিচ্ছে কেন? আর হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্তই-বা কেন? নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল।
ইতিমধ্যে আবার আমার ফোন কোঁ কোঁ করে উঠল। সেই নাম্বার থেকেই। ফোন রিসিভ করার সাথেই সুসির কান্না আর আকুতি।
-‘আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, অয়ন দা’
- ‘সুসি, সুসি মাই ডিয়ার। প্লিজ, এভাবে কেঁদো না। হঠাৎ কি হল তোমার? আর বিয়েই বা কেন দিচ্ছে?’
- ‘তোমার-আমার সম্পর্কটা মা জেনে ফেলায় অনেকদিন থেকেই মনে হয় চোখে চোখে রাখছিল। আমার এইচএসসি পরীক্ষার পর বেড়ানোর নাম করে কলকাতাতে এনেছে। আর আগেই একজনের সাথে বিয়েও ঠিক করে ফেলেছে। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। আমি আর পড়াশুনা করতে পারব না অয়ন দা।’ বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
কী বলব কিছু বুঝে উঠতে না পেরেও আশ্বাস দিলাম? বুঝালাম সব ঠিক হয়ে যাবে। জানালো এটা ওর এক কাজিনের ফোন নাম্বার।
হলের রুমে ফিরলাম। বিছানার উপরে পড়ে থাকা নীলক্ষেত থেকে কেনা গতরাতে পড়া শেষ করা এরিক সেগালের ‘লাভ স্টোরি’ বইটার দিকে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকালাম। অলিভারের মতো আমিও কি আমার জেনিকে চিরতরে হারাতে চলেছি? মনের গহীন কোণে বিউগলের করুণ সুর বেজে উঠল।
টেনশনে আইওটির উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসেও গেলাম না। কী করব? কী করা উচিত আমার? মস্তিষ্ক ব্লাংক হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। অথচ সুসির সাথে আমার সম্পর্কটা যে এতটা গভীরে চলে গেছে আমি নিজেও তা অনুধাবন করতে পারি নি। ভালোবাসা কি এমনি হয় নাকি! বুকটা শুন্য মনে হচ্ছে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি! মনে হচ্ছে কেউ আমার কাছ থেকে আমার সবচেয়ে দামি জিনিসটি ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? যেটাকে আমি বুকে লালন করছি সযতনে বছরের পর বছর নিজের অজান্তেই।
আসলে আমার আর সুসি ওরফে সুস্মিতা রায় চৌধুরীর ভালোবাসাটাও একটু অদ্ভুত প্রকৃতির। ও প্রায় লুকিয়ে লুকিয়ে ওর মা'র নাম্বার থেকে আমাকে ফোন দিত। বেস্ট ফ্রেন্ড অনিকেতের ছোটবোন। দিনাজপুর শহরের নিউটাউনে দুজনেরই বাড়ি।ওরা থাকত মহিলাসংঘ খেলার মাঠের পূর্বদিকে আমরা পশ্চিমদিকে। ফলে বন্ধু অনিকেতের বাসায় সেই পিচ্চিকাল থেকেই অবাধ যাতায়াত। ওদের বাসায় গেলে কাকিমা আমাকে উনার নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করতেন। সুসি’র বাবা নারায়ণ রায় চৌধুরী রাশভারী মানুষ। বিশাল ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। আমার সাথে খুব একটা দেখা হত না।
মিষ্টি সুসিটা ছোটকাল থেকেই অয়ন দা বলতে পাগল। কারণ নানাকিসিমের সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্ট চালনাতে আমি তখন থেকেই এক্সপার্ট ছিলাম। আর আমার প্রধান কাস্টমার মানে এই বিদ্যা জাহির করার দর্শকদের মধ্যে সুসি ছিল অন্যতম। যেমন গ্লাসের মধ্যে পয়সা হারিয়ে ফেলা কিংবা পয়সা গলিয়ে ফেলা। হাতে আগুন ধরানো। চুম্বক, ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট ইত্যাদির সাহায্যে নানারকম খেলা দেখাতাম ওদের। আর এগুলোর গূঢ় রহস্য ওদের যখন ব্যাখ্যাসহ বলে দিতাম তখন পিচ্চিগুলো বিস্ফারিত চোখে তা গিলত। তখন থেকেই সুসিটা আমার একনিষ্ঠ ও শর্তহীন ভক্ত।
এরপর আমার এসএসসিতে দুর্দান্ত রেজাল্ট, গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে কাজাকস্তান যাওয়া ও বুয়েটে সিএসই তে ভর্তি পাড়াতে কিছুটা হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। এই সব কিছুই হয়ত ছোট্ট সুসির মনে দাগ কেটেছে। এবং ওকে আমার প্রতি টেনেছে। যদিও তা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাই নি।
সুসি নিজেও মেধাবী। সুসির ভাই মানে আমার বন্ধু অনিকেতও নর্থ-সাউথে অর্থনীতিতে ভর্তি হয়েছে। যদিও সুদর্শন অনিকেত বরাবরই আমার চেয়ে মেধাবী ছিল। কিন্তু বেচারা ইন্টারমিডিয়েটে উঠে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হুজুরের মেয়ের সাথে প্রেম করতে গিয়ে পড়ালেখার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। মেয়েটি আমাদের সাথেই কলেজে একই সাথে পড়ত। ওদের প্রেমের স্টার্টিংএ আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু হুজুর জানতে পেরে মেয়ের জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেয়। এতে অনিকেত জীবন নিয়ে কিছুটা অগোছালো হয়ে পড়ে। এ জন্য আমার কিছুটা অপরাধবোধও আছে। ওদের জুটিটা আজকে অটুট থাকলে আমিই সবচেয়ে খুশি হতাম।
অনিকেত ঢাকায় থাকাতে সুসি ওর কাছে ফোন দিত। আর অনিকেত বসুন্ধরা থেকে বেশিরভাগ সময়ই আমার হল-এ এসে শুয়ে বসে থাকত। ফলে সুসি ওর দাদার সাথে কথা বলার পর আমার সাথেও হাবিজাবি নানাবিষয় নিয়ে আলাপে রত হত। টিনেজ মেয়েরা যা বলে। আজ তাদের ক্লাসে অমুক মেয়ে এটা করেছে। তমুক স্যার ওদের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ছিল এইসব। আমিও অমনোযোগী শ্রোতা হিসেবে এইগুলো শুনতাম আর হা হুঁকারি দিতাম। কারণ তখন আমার শুধুই উন্নত দেশের প্রথমসারির ইউনিতে পোস্ট-গ্রাজুয়েশনের চিন্তা।
বছরখানেক যাওয়ার পর অনিকেত একদিন এসে বলে ও আর পড়াশুনা করবে না। বাড়িতে গিয়ে বাবার ব্যবসা দেখবে। অনেক বুঝিয়েও কাজ হয় নি। অনিকেতের জন্য ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়। অসাধারণ মেধাবী বন্ধু এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিল।
এরপর সুসি সরাসরি আমাকে ফোন দিতে শুরু করে। তবে কখনই সে কিংবা আমি ভালোবাসা জাতীয় কোন কিছু নিয়ে কথা বলতাম না। কিন্তু আমি আমার নিজের ভেতর কিছু একটা টের পাচ্ছিলাম। শেষে এমন হল যে সুসি দুদিন ফোন না করলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তাম। সেটা যে এতদূর গড়িয়েছে আমি নিজেও টের পাই নি। যদিও আমি ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কখনই ওকে ফোন দেই নি।
সুসির মনে কী চলত জানি না? হয়ত টিনেজ বয়সের সেই উদ্দাম ভালোবাসার চোরা স্রোত তার হৃদয়েও আছাড় খেত। এভাবেই দিনের পর দিন কথা চলতেই থাকে তথাকথিত প্রেমিক-প্রেমিকার মতো বাক্যালাপ ছাড়াও। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দুজনেই টের পেতাম এক অমোঘ বাঁধভাঙা জোয়ার। সেই জোয়ার দুকূল উছলে মাঠ-ঘাট ভাসিয়ে নিয়ে যেত। যেন ভাঙনেই সুখ! আমরাও সুখের ভেলায় ভাসতে ভাসতে ভবিষ্যতের স্বর্গ রচনা করতাম অজানা আবেগে। সঙ্গোপনে। নিরুদ্বেগে।
এভাবেই সুসি এইচএসসি পরীক্ষা দিল। আমিও আন্ডারগ্রাডের শেষ ধাপে। এরপরই সুসির কলকাতা-দিল্লী বেড়াতে যাওয়া ও সেই কান্না জড়িত ফোন।
২
সুসির অনিন্দ্য সুন্দর নিষ্পাপ মুখটি চকিতে মনে পড়ছে। বার বার একটি প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছে, আমি কি পৃথিবীর সবচাইতে মহার্ঘ সম্পদটি হাতছাড়া করতে যাচ্ছি? কোনো কি উপায় নেই? কী হবে, যদি আমার না সে হয়? এক বুক হতাশা ঘিরে ধরার উপক্রম হয়েছে।
অনেক ভেবে শেষে সুসি’র দাদা মানে আমার বুজম বন্ধু অনিকেত রায় চৌধুরীকে ফোন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
অনিকেতকে ফোন দেওয়ার সাথে সাথে সে বলল, ‘জানি তুই কী বলবি?’। যেন ও আমার ফোনের অপেক্ষায় করছিল।
-কেন হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত?
-হঠাৎ নয়। অনেক আগে থেকেই এটা ঠিক ছিল। এইচএসসি পরীক্ষার আগে যখন মা জানতে পারে তখন থেকেই নজরদারীর মধ্যে ছিল। পরীক্ষার জন্য কিছু বলা হয় নি। তখনই বাবা কলকাতাতে গিয়ে মোটামুটি একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
এখানে বলে রাখা ভালো, সুসির বাবার কলকাতার অভিজাত সল্টলেকেও একটি বাড়ি আছে। এবং সুসির বেশির ভাগ আত্মীয়-স্বজনেরা ভারতেই থাকে। অনেকেই দেশভাগের সময় বাংলাদেশ থেকে ওদেশে গিয়ে সেটেল হয়েছে। আর সুসির বাবা হিলি বন্দর দিয়ে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা করায় নিয়মিতই কলকাতাতে যাতায়াত করে।
- এত অল্প বয়সে বিয়ে। আমি তো চিন্তাই করতে পারছি না। ও ভালো স্টুডেন্ট। অনেক দূর যেতে পারত। তুইও এটা মেনে নিলি।
-না, আমি বাবাকে বুঝিয়েছি। আরো কিছু সময় ভাবনা চিন্তা করতে। তবে...
একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার উদ্দেশ্যে অনিকেত কঠিন একটি প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘কেন এই কাজটা তুই করলি? বন্ধুত্বের প্রতিদান বন্ধুরা এভাবেই দেয় বুঝি। ’
আমি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলাম। পুকুরে অক্সিজেনের অভাবে মাছেরা যেমন পানিতে গাস্পিং করে আমিও এই প্রশ্নে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়েও পুকুরের পানিতে মাছেদের মতোই অক্সিজেনের তীব্র অভাব বোধ করলাম।
উত্তর দেওয়ার জন্য কোনো শব্দ খুঁজে পেলাম না। এখন মনে হচ্ছে ফোনটা করাই ভুল হয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে লাইন কেটে দিয়ে অনলাইনে দিনাজপুরগামী একতা এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট কাটার জন্য লগ ইন করলাম।
দিনাজপুর পৌঁছেই অনিকেতকে ডেকে নেই। ওকে বুঝাই এত অল্প বয়সে ওর বিয়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। তোর বাবাকে এ নিয়ে বুঝানো উচিত। অনিকেত প্রতিউত্তরে জানাল অনেক বুঝিয়েছে। কোনো লাভ হয় নি, হবেও না। সে নিজেও সুসি’র এত পিচ্চি অবস্থায় বিয়ের পক্ষে নয়। কিন্তু আমার সাথে সম্পর্কটা ওর বিশ্বাসে দারুণ একটা আঘাত হিসেবে এসেছে।
ওর পরিবার নাকি ওকেই দুষছে এ জন্য। ওর অসম্ভব রুপবতী ও বুদ্ধিমতী বোন এবং সুদর্শন ও মেধাবী অত্যন্ত কাছের বন্ধুটি এভাবে ওকে ধোঁকা দিবে তা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
আমি মারাত্মক সাহসী একটি সিদ্ধান্ত নিলাম। অনিকেতকে সাথে নিয়ে ওর বাবার কাছে যাওয়ার। নিজের ভুল স্বীকার করে বুঝানোর জন্য। গেলাম। এবং চুড়ান্তরকম অপমান করে আমাকে বাসা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হল। আর ভবিষ্যতে যেন ওমুখো না হই সে হুমকিও দেওয়া হল। অনিকেতের অবস্থা কি হয়েছে জানি না? কারণ এর পরদিন থেকে অনিকেতের ফোনে তাকে আর পাই নি। সে আর বাসা থেকে বের হয় না। কোনোভাবেই কিছু করতে পারছি না।
এক সমুদ্র লোনাজল চোখে ধারন করে উদ্ভ্রান্তের মতো ইতিউতি ঘুরে ফিরছি। শেষে উপায় না দেখে আমার বড় ভাইকে জানালাম। অন্তত বিয়েটা যেন বন্ধ করে সে চেষ্টা করতে। কথা দিলাম আমি আর কখনই সুসি’র সাথে কথা বলার বা দেখা করার চেষ্টা করব না। সম্পর্কের এখানেই ইতি।
পরের দিন আমার সদা হাস্যোজ্জল ভাই নারায়ণ রায় চৌধুরীর সাথে কথা বলে এসে চোখমুখ লাল করে হানিফ বাসের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘রাতের টিকিট, আজকেই ঢাকা চলে যাবি। আগামী এক বছরে যেন তোকে এ দিকে না দেখি’।
আমি প্রতিবাদ করতে গেলে বাসায় বিরাট তুলকালাম কান্ড ঘটে গেল। আমাদের প্রেম। সুসির বিয়ে। আমার আগমন। বিয়ে ভাঙানোর নানামুখী উদ্যোগ। এসব কিছুই পাড়াতে কয়দিন থেকে মুখরোচক কানাঘুষা।
আমার পরহেজগার বাবা স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি হাজী লতিফুর রহমান চৌধুরী যারপরনাই বিব্রত পড়ুয়া ছোট ছেলের এইরকম বেফাজিল বেলাহাজ কাজকর্মে। যদিও উনি সুসিকে অনেক স্নেহ করেন। কিন্তু একজন হিন্দু মেয়েকে তার ছেলে ভালোবেসে কেলেঙ্কারী সৃষ্টি করবে এটা তিনি কিছুতেই মানতে পারছেন না। পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে গেছে।
তাই ঘটনার এখানেই সমাপ্তি টানার জন্য উনি আমাকে আল্টিমেটাম দিয়ে দিয়েছেন। রাতেই ঢাকা ফিরে যাও। সুসির কথা ভুলে যাও। নাহলে পিঠের ছাল তুলে ডুগডুগি বানানো হবে। বাধ্য হয়ে রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
ফোনে সুসি শুধু কাঁদে। কিছু বলে না। আর আমি ওর কান্নাতে কাঁচের টুকরোর মতো ভেঙে খানখান হতে থাকি। কোনো উপায় খুঁজে পাই না। দেশে থাকলে তবুও কিছু করা যায়। পাগলের মতো এদিক-সেদিক ঘুরি। যা জীবনে কখনই করি নি। তাই করতে শুরু করলাম। পড়াশুনা লাটে উঠল। ক্লাসে যাই না। কুইজ, এসাইনমেন্ট সব গোল্লায় গেছে। ফাইনাল টার্ম চলে গেছে। এভাবে দিন-মাস চলে যায়। অদ্ভুত এক কালো বলয় আমাকে ঘিরে ধরছে। ছাদে যাচ্ছি নিয়মিত নৌকা ভাসাতে। আমার নিজের উপর বিন্দু পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ নেই। মনে হচ্ছে অন্য কোন মানুষ আমি। সুসির কান্নার শব্দ আমাকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। আমার চিরাচরিত শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
আজ নভেম্বরের ১৬ তারিখ। আর মাত্র চব্বিশ দিন। তারপরে সব শেষ। বেঁচে থাকার মানেটা অর্থহীন মনে হচ্ছে। অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেললাম…? (চলবে...)
***অনেক আগের লেখা। কিছু অংশ অন্য কোথাও পড়ে থাকলে অবাক হবো না?
***************************************************************************
আখেনাটেন-ফেব্রুয়ারি/২০২১
ছবি: লেখক। তাজমহল, আগ্রা, ভারত।
ভালোবাসার গল্প: দ্বিঘাত সমীকরণ-২
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:৩২