‘ভানুমতির খেল’ নামে বাংলায় একটি কথা আছে। যার অর্থ হলো অতি ধুরন্ধর বা কর্মকুশল ওস্তাত যখন কোন কঠিন কাজ সুচারুভাবে করিয়ে নেন তখন সেটাকে এক কথায় ‘ভানুমতির খেল’ বলে প্রকাশ করে বাঙালী বাগ্মী লোকেরা। এই ‘ভানুমতি’ নামটির পেছনের ইতিহাসও কিন্তু চমকপ্রদ। ‘একই অঙ্গে কত রূপ’--এর ভানুমতিরা মহাভারত, পুরাণ ও অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থে আবির্ভূত হয়েছেন।
মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর ছেলে দূর্যোধনের বউয়ের নাম ভানুমতি। কনিষ্ট পাণ্ডব সহদেবের স্ত্রীর নামও ভানুমতি। চন্দ্রবংশের রাজা কৃতবীর্যের কন্যার নামও ভানুমতি। ব্রহ্মার পুত্র অঙ্গিরসের কন্যার নামও ভানুমতী। আবার ভোজরাজের কন্যা ও মহারাজ বিক্রমাদিত্যের স্ত্রীর নামও ভানুমতি। অর্থাৎ ভানুমতিরা পুরাণ ইতিহাসে ‘নানা অঙ্গে নানান রূপে নানা খেল’ দেখিয়ে ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছেন।
যাহোক এই ভানুমতির কিচ্ছা বলার কারণ হলো নব্য সুলতান এরদোগানও ‘এশিয়া ও ইউরোপের সন্ধিস্থানে’ বসে বিশ্বে ভানুমতির খেল দেখিয়ে দু-দশক ধরে টিকে আছেন সাড়ম্বরভাবেই।
একদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে নিত্য ঠোকাঠুকি, অন্যদিকে নানান বিষয়ে আঁতাত; একদিকে মুসলিম বিশ্বের তথাকথিত মেসিয়া, অন্যদিকে ঈসরাইলসহ ন্যাটো জোটের সাথে সখ্য ও মধ্যপ্রাচ্যে দাদাগিরি; একদিকে রাশিয়ার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাধাদান, অন্যদিকে অর্থনৈতিক ও সামরিক কোলাকুলি; একদিকে ফ্রান্সের পণ্যবর্জনসহ আর্মেনিয়া, গ্রীস ও উত্তর আফ্রিকাতে মুখোমুখি অবস্থান, অন্যদিকে মাঁখোর সাথে সামারিক-বেসামরিক নানা খাতে মাখামাখি। মানে ভানুমতির মতো নানা বিভঙ্গে তা ধরা দিচ্ছে কী অত্যাশ্চর্য উপায়ে! আর এ কারণে সাবেক বিশ্ববিধাতা ডোনাল্ট ট্রাম্পের মতো ইগোটিস্ট লোকও এরদোগানকে বলেছিলেন ‘হেল অব অ্যা লিডার, টাফ ম্যান’।
২
তুরস্কের বিস্ময়কর উত্থান বলার কারণ হচ্ছে এরদোগান জমানায় (২০০২-বর্তমান) তুরস্ক কিছু সেক্টরে বাস্তবেই বিস্ময়কর উল্লম্ফন ঘটেছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সামরিক খাত, অবকাঠামো নির্মাণ খাত, কৃষি খাত, হালকা প্রকৌশল খাত, পর্যটন খাত ও শিল্প-বিনোদন খাত বা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে।
বিশেষ করে সামরিক খাতের বাড়-বাড়ন্ত পশ্চিমা বিশ্বকেও তুরস্কের ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। একটি দেশ যখন ৭০ ভাগ অস্ত্র আমদানীকারক দেশের কাতার থেকে অন্যতম অস্ত্র রপ্তানীকারক (বিশ্বে ১৪ তম, ২০২১) দেশের কাতারে উন্নিত হয়, তখন তথাকথিত অস্ত্র ব্যবসায়ী বিশ্ব মোড়লদের ভালো না লাগারই কথা। আর যার ফলেই আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি এরদোগান তথা তুরস্কের বিপক্ষে নানারকম অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা। যে দেশ দু-দশক আগেও প্রায় সব ধরনের অস্ত্র আমদানী করত, সে দেশ এখন নিজস্ব প্রযুক্তিতে হাইটেক পণ্য যেমন, যুদ্ধ জাহাজ, কমব্যাট ড্রোন, ভারী যুদ্ধযান, ট্যাংক, মিসাইল, সাবমেরিন, ট্রেইনার জেটসহ নানা ধরনের অস্ত্রপাতি নিজস্ব প্রযুক্তিতে শুধু উৎপাদনই নয় রপ্তানীও করছে। বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে কমব্যাট ড্রোন রপ্তানী করছে। Tarbo Jet ইঞ্জিন নির্মাণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। নিজেরাই কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণ করছে। স্যাটেলাইট লঞ্চিং প্যাড নির্মাণেও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বিশ্বের গুটিকয়েক দেশের কাতারে সামীল হতে যাচ্ছে। ফিফথ জেন ফাইটার জেট নির্মাণের মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ তুরস্কের সামরিক সরঞ্জামের বড় ক্রেতা। অচিরেই হয়ত চীনকে হটিয়ে তুরস্ক সে স্থান দখল করবে--ট্রেন্ড দেখে তাই মনে হচ্ছে।
অবকাঠামো খাতে তুরস্ককে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছেন নব্য সুলতান। বিশ্বের টপ ২৫০ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৪০টি কোম্পানী নিয়ে তুরস্কের অবস্থান এখন চীন, যুক্তরাষ্ট্রের পরেই মানে তৃতীয়। রাশিয়া, বলকান অঞ্চল, মধ্যপাচ্য, সেন্ট্রাল এশিয়া, এমনকি ভারতেও তাদের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দাপিয়ে কাজ করছে। নিজ দেশে বৃহদাকার ব্রিজ, টানেল, এয়ারপোর্ট ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে অত্যন্ত দক্ষতা সহকারে ও দ্রুততম সময়ে। সবচেয়ে বড় যে ব্যাপার তা হচ্ছে সর্ব বিষের ওঝা আমলা তন্ত্র-মন্ত্রের রেডটেপিজম, লাগামহীন দুর্নীতি ও মেনিমুখো নেতাদের দৌরাত্ম্য-----যা ‘সোনার বাংলাদেশের প্যাটেন্ট’ করা----- না থাকায় প্রতিটি মেগা প্রজেক্টের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে সমাপ্তকরণ।
হাইস্পিড রেল লাইন নির্মাণে তারা এখন ইউরোপে স্পেনের পরেই অবস্থান করছে। নিজেরাই লোকোমোটিভ নির্মাণ করছে। বিশ্বের দীর্ঘতম সাসপেনশন ব্রিজ নির্মাণ করে দার্দানালিস প্রণালীতে ইউরোপ ও এশিয়ার নয়া সংযোগ স্থাপন করছে। রাশিয়ার সর্বোচ্চ ইমারত ছাড়াও বেশির ভাগ উঁচু বিল্ডিংগুলো তুরস্কের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের দ্বারা নির্মিত। ভারতে টানেল নির্মাণে প্রযুক্তি সেবা দিচ্ছে, বৃহদাকার জাহাজ নির্মাণ করতে চুক্তি করছে, পুনেতে মেট্রো ট্রেন নির্মাণ করছে। পাকিস্তানে সাবমেরিন আধুনিকায়নে সাহায্য, ফ্রিগেট নির্মাণ, কম্ব্যট হেলিকপ্টার সরবরাহ, ড্রোন টেক হস্তান্তরসহ নানামুখী অবকাঠামো নির্মাণ করছে। আফ্রিকাতে অবকাঠামো নির্মাণে এখন চীনের সাথে পাল্লা দিচ্ছে। আর সফট পাওয়ারের এই বাড় বাড়ন্তই আফ্রিকার পশ্চিমা মোড়ল ফ্রান্সের চক্ষুশুল হয়েছে। ফলেই এরদোগানের সাথে দা-কুমড়া সম্পর্ক নানা ইস্যুতে।
৩
‘Ease of Doing Business Index (2020)’ র্যাঙ্কিং-এ তুরস্ক ১৯০ দেশের মধ্যে ৩৩ তম। বাংলাদেশ ১৬৮ তম। পার্থক্যটা কটকট করে চোখে লাগে। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে--প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিমান বন্দর ‘ইস্তানবুল এয়ারপোর্ট’ নির্মাণের প্রথম ধাপ মাত্র ৪২ মাসে শেষ করেছে নানারকম চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও। আবার এপারপোর্ট থেকে শহরের কেন্দ্রে ৩৭ কিমি ‘মেট্রো ট্রেন’ লাইন নির্মাণ ২০১৯ সালে শুরু করে অবিশ্বাস্য গতিতে কাজ করে ২০২২ সালের শুরুতেই শেষ করছে এই করোনাকালেও। অথচ আমাদের পদ্মা সেতু ও রেল সংযোগ, মেট্রো-৬ লাইন শুরু হয়েছে ২০১৫ সালে…। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। অজুহাত আর অজুহাত = নেতা, আমলা ও ঠিকাদারের মুখে চওড়া হাসি। ব্যয় আকাশ ফুঁড়ে…।
ফলাফল--২০১৮/২০১৯/২০২০/২০২১/২০২২/২০২৩/২০২৪/২০২৫…খোদা মালুম…।
স্বাস্থ্য খাতে ইউরোপের এখন অন্যতম অগ্রসর দেশ তুর্কিরা। গত ১০ বছরে প্রায় ৩০ হাজার নতুন বেড নির্মাণ করেছে। সিটি হসপিটাল নামের এসব ২০০০-৫০০০ বেডের বৃহদাকার অত্যাধুনিক হাসপাতালগুলো এত দ্রুততম সময়ে নির্মাণ বিস্ময় সৃষ্টি করার মতোই। শুধু নির্মাণেই নয়, তারা সেখানে নিজস্ব প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতিও সরবরাহ করছে। যে গুটিকয়েক দেশ কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন নিজেই তৈরি করেছে, তুরস্ক তাদের মধ্যে একটি। গত ডিসেম্বরে ইমার্জেন্সি ব্যবহারের জন্য ‘তুর্কভ্যাক’ নামের সেই ভ্যাক্সিন উন্মুক্ত করেছে।
ব্রেন ড্রেন যেন না নয় সেজন্য প্যাকেজ ঘোষণা করে গবেষকদের দেশে থাকতে ও বিদেশ থেকে আনতে নানা তৎপরতা নিয়েছে। গবেষণা ও উদ্ভাবনে ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। দু-দশক আগেও যেখানে হাতে গোণা কিছু শিক্ষার্থী তুরস্কে পড়াশুনা করতে যেত, সেখানে এখন লাখের উপর শিক্ষার্থী নানারকম বৃত্তি ও নিজ খরচে পড়াশুনা করছে। তুর্কি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আওতায় ব্রিটিশ কাউন্সিলের মতো ‘ইউনুস এমরে সেন্টার’ চালু করেছে বিশ্বের দেশে দেশে। ২০০৭ সালে চালু করে এখন ৫০--র অধিক দেশে তুর্কি ভাষা ও সংস্কৃতির জ্ঞান যোগান দিচ্ছে। তার্কিক ভাষাভাষী দেশগুলোকে নিয়ে নয়া জোট গঠন করে বিশ্বকে নতুন বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে তুর্কি নয়া সুলতান।
আইটি খাতে তুরস্ক ‘ইউনিকর্ন’ স্টার্ট-আপ দাঁড় করছে। বিশেষ করে গেম ডেভালপমেন্ট শিল্পে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। বিলিয়ন ডলারে তা বিক্রি করছে। ট্যুরিজম সেক্টরে তো রীতিমত ঝড় তুলেছে। ২০০০ সালে যেখানে টপ ২০-এর মধ্যে ছিল না, সেখানে এখন বিশ্বে ৬তম অবস্থানে উঠে এসেছে। বিশ্বের টপ ভ্রমণ শহরের লিস্টে ইস্তানবুল ও আনাতালিয়া উঠে এসেছে। পঙ্গপালের মতো লোকজন মেডিটেরিনিয়ান হাওয়ায় নীল সমুদ্রের জলকেলি করতে যাচ্ছে।
বিনোদন সেক্টরেও টর্নেডো বয়ে দিয়েছে। বিবিসির মতে, বিশ্বে তুরস্ক এখন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই ড্রামা সিরিয়াল রপ্তানীকারক দেশ যা থেকে দেশটি শিঘ্রী বিলিয়ন ডলার আয়ের টার্গেট করেছে। তাদের নির্মিত ডেইলি সোপগুলো ইউরোপ থেকে ল্যাটিন আম্রিকা, আফ্রিকা থেকে এশিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
৪
এত কিছুর পরেও বলতে হচ্ছে ‘অবাকপতন’--এর কথা। কারণ গদির মধু। বিশ্বে গদির মধুতে যে কয়টি দেশের রাষ্ট্রনায়কগণ লোকরঞ্জনবাদি উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের কোর প্রতিষ্ঠানগুলোর বারোটা বাজিয়ে ভেতর থেকে ‘ঠুসঠুসা’ করে দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন এই নব্য অটোমানীয় সুলতান এরদোগান। অন্যরা হলেন রাশান নব্য জার পুতিন, অমরণশীল চীনা টেরাকোঠা সম্রাট শী জিন পিং, নব্য অবতার তথা নয়া চন্দ্রগুপ্ত নরেন্দ্র দামোদার দাস মোদী। আরও কয়েকজনের মধ্যে বিশেষ একজন আছেন তবে আমাকে বোমা মারলেও উনার নাম বলব না, কারণ 'নাম বললে চাকরি থাকবে না’। উনি হাওয়ার মতো আশেপাশেই থাকেন।
ঋণ করে যথেচ্ছভাবে ঘি খেতে থাকলে শরীর হয়ত ত্যালত্যালে হবে ঘিয়ের প্রভাবে। তবে দীর্ঘ দিনের এই বদ অভ্যাসে নানারকম শারীরিক সমস্যার সূত্রপাতও শুরু হতে পারে যদি সেটাকে নিয়ন্ত্রণে না রাখা যায়। তুরস্ক ভুখান্ডার মতো চড়ামূল্যের ঘি হয়ত যথেচ্ছভাবে গিলছে না, কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে ও ধর্মীয় গোঁড়ামীর দরুন তুর্কি মুদ্রা ‘লিরা’র আশ্চর্যপতন এই লোকরঞ্জনবাদি উন্নয়নগুলোর বোঝা কাদার প্যাঁকে আটকে দেয় কিনা সেটা সময় হয়ত বলে দেবে। তবে এখনই লোকজনকে এক টুকরো রুটির জন্য লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। ধনী-গরীবের বৈষম্য বাড়ছে। মাথাপিছু আয় কমে যাচ্ছে। মানুষ কাজের সন্ধানে দিগ্বিদিক ছুটছে।
আচ্ছা, ভুগান্ডা দেশের নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক মানুষেরা কী সুখে আছে? আপনাদের কী মনে হয়? নাকি লোকরঞ্জনবাদি নব্য সুলতানের মতো ঢাকঢোলবাদি দেশি সুলতানা…? কে যেন পেছন থেকে ডাক দিলো, ‘ওহে, আখে…রুখ যা’। শুনে আমিও রুখে গেলুম। ভাব্লুম, ‘উন্নয়ন’-এর চিপায় পড়ে নব্য সুলতান-সুলতানাবাদের প্রজাদের ‘এই হচ্ছে প্রকৃত অবস্থা…পেট ফাটলেও আর মুখ ফোটে না’? কারণ কোহেকাফের দেশগুলো তে মুখ ফোটাতে গেলে শির কেটে যাওয়ার যে চমৎকার মাজেজা সেটাই ‘অবাকপতন’ এর কারণ হয় কিনা ভবিষ্যতই তা হয়ত আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে!!!
ছবি: ভারতীয় প্রগতিশীল পত্রিকা 'The Hindu' তে কার্টুনিস্ট Satwik Gade'র আঁকা। ভুখান্ডাসহ লোকরঞ্জনবাদি দেশগুলোর দুইভাগে বিভক্ত জনগণের উপর আইনের প্রয়োগের নমুনাচিত্র...হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে!
******************************************************
@আখেনাটেন:- জানুয়ারি/২০২২
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১১:০৭