পরশু অর্থ কুড়াল বা কুঠার আর পরশুরাম ছিলেন ত্রেতা যুগের রাজা কুঠারধারী রাম, যাকে বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার বিবেচনা করা হয়। আর ‘পরশুরামের কুঠার’ প্রবাদের অর্থ হলো ‘সর্বসংহারি অস্ত্র’ যা লক্ষ্য ভেদে অব্যর্থ ও সেই সাথে ধ্বংসাত্মক।
পৌরাণিক কাহিনি মতে, ভোজকট বা ভজকটের রাজ্যের (‘ভজকট’ সাধারণত ‘বিশৃঙ্খল অবস্থা’ বুঝাতে ব্যবহার হয়; এটা কী সেই…?) রাজা গাধির কন্যা সত্যবতির পুত্র ভৃগু। এই ভৃগুর নাতি জমদগ্নির সাথে বিয়ে হয় ক্ষত্রিয়বংশের বিদর্ভরাজ প্রসেনজিতের কন্যা রেণুকার। এই দম্পতির পাঁচসন্তানের একজন হলো পরশুরাম।
একদিন ভোরবেলা নদীতে গোসল করতে গিয়ে রেণুকা দেখতে পান সর্গের অপ্সরাদের নিয়ে মহারাজ চিত্ররথ নদীতে জলকেলি-কামকেলি করছেন। রেণুকা সে দৃশ্য দেখে নিজেও কামাতুরা হয়ে পড়লে তা স্বামী জমদগ্নি জানতে পেরে স্ত্রীর এই অধোপতনে তাঁর পাঁচ ছেলেকে মাতৃবধের নির্দেশ দেন। কিন্তু অন্য চারছেলে রাজী না হলেও পরশুরাম পিতার আদেশ মেনে মাতৃহন্তারক হিসেবে নাম লেখান। কিন্তু মাতৃহত্যা মহাপাপ, ফলে যে পরশু বা কুঠারের আঘাতে তা সম্পন্ন করেছিলেন তা তাঁর অঙ্গের সাথেই লেগে যায়। যাহোক শেষে পিতার কাছে ‘বর’ চেয়ে মায়ের জীবন ফিরে এনেছিলেন সেই পরশুরাম। কিন্তু তাঁর পিতা জমদগ্নিকে ক্ষত্রীয়রাজ কীর্তবীর্য খুন করলে পরশুরাম প্রতিশোধের নেশায় ক্ষত্রিয়দের ২১বার নিকাশ করেন দুনিয়া থেকে তাঁর সেই বিখ্যাত পরশু তথা কুঠার দ্বারা (বর্তমানে মার্ভেলের ‘থর’র মতো মারদাঙ্গা সিনেমা বানানো যেতে পারে এই দুর্দান্ত কাহিনি নিয়ে মনে হয়)। যাহোক, এই ভীষণ হন্তারক কুঠারের জন্য ‘কেউ প্রতিশোধ নিতে চাইলে’ এই পরশুরামের কুঠারের সাথে তুলনা করা হয়।
২
এবার খুচরা প্যাচাল বাদ দিয়ে মূল কথায় আসা যাক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল (ষষ্ঠ আদমশুমারি) ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। ২০১১ সালের পঞ্চম জনশুমারিতে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৯৮ লাখ। অর্থাৎ গত ১১ বছরে দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে ১ কোটি ৫৪ লাখ। অর্থাৎ প্রতি বছরে ১৪ লাখ করে।
কিন্তু জনসংখ্যাবিদেরা বলছেন, দেশে প্রতিবছর ৩২ থেকে ৩৩ লাখ নতুন শিশু জন্ম নেয়। এক বছরে শিশুসহ প্রায় আট লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এসব হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যার সঙ্গে প্রতিবছর ২৪ থেকে ২৫ লাখ মানুষ যুক্ত হয়। যা যুক্তিযুক্ত। এদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের পোয়াবারো হলেও সংখ্যালঘুদের ‘শনির দশা’ শেষ হবার নয় তা যে সরকারই ক্ষমতাই থাকুক। (২৪ জুলাই, প্রথম আলো)
আবার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এক প্রকাশনায় দেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটি হিসেবে তুলা ধরা হয়। উল্লেখ্য জনসংখ্যা নিয়ে দেশে পরিসংখ্যান ব্যুরো ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর দুটো দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। দুটো পূত পবিত্র দেশীয় প্রতিষ্ঠানের দুইরকম তথ্য ও জনসংখ্যাবিদ নামক বিশেষ শ্রেণির গাড়লদের তথ্যে কী এবার ‘ভজকট’ ব্যাপার মনে হচ্ছে। যদি মনে না হয়, তাহলে ধরা নেয়া যায়, আপনিই ভোজকট রাজ্যের মহারাজ গাধির সত্যিকারের প্রপৌত্র তথা প্রজা। এবং ইন্দ্রের বর পেয়ে আপনারই কোন এক সু-দক্ষ কুঠারবিদ সন্তানের হাতে গড়ে উঠা পরিসংখ্যান কিংবা পরশুরামের কুঠার তথা ‘পরশু’ চালায়ে দেশ মাতৃকা’র ‘মহাসেবক’র ভূমিকায় আসীন কী? তবে আশার কথা হচ্ছে, পরশুরাম যেমন তার মাতৃবধের পর পুনরায় ‘বর’ পেয়ে মা’কে পুনর্জীবিত করেছেন। এ দেশও বারংবার কোনো এক অদৃশ্য ‘বর’ পেয়ে এসব লঙ্কাকান্ডকে থোড়াই পরোয়া করেছে; যদিও লাভের গুড়ের ভাগিদার হিসেবে ‘বিশেষ শ্রেণি’রা ক্রেডিট নেওয়ার চেষ্টা করেছে নিষ্কর্মার দল হওয়া সত্ত্বেও।
দুর্দিনে এখন ‘পরিসংখ্যান’ বাবার মিথের উপর ‘মাথাপিছু ডলার চড়ানো শূলে জনগণের শেষ সময়ের পাওনা লেংচিয়ে বেঁচে থাকা। শত প্রতিকূলতায় টিকে থাকা। সামনে আসছে কী আরো দুর্দিন? খাম্বা বাবার উত্তরসূরী রেন্টাল বাবার আশির্বাদে অন্ধকারঃ দ্যা বিদ্যুৎ বাবা ইতোমধ্যে দিনের বেশির ভাগ সময় উধাও; তেল বাবার দোয়ায় তেলের ডিব্বা খুলে রেশন বাবা চালু; শিক্ষা নামের ঠাকুর মশাই এখন কলাচোরের ভূমিকায় খাটের তলা থেকে মাঝে সাঝে উঁকি দেয়; স্বাস্থ্য নিজেই মরণ জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে চিৎপটাং; নির্বাচন বাবা নির্বাসনে গিয়ে জলকেলি-কামকেলিতে নিজেই কামাতুরা হয়ে পড়েছেন-কী করবেন, কী ভাববেন নিজেও বুঝতে পারছেন না; ‘জনগণের বন্ধুরা উন্নয়ন নামক লাঠি হাতে ‘জনগণের যম’, স্যুটেট-বুটেট কেরানিরা নব্য জমিদার সেজে খাজনার খড়গ হাতে নয়া হিসাব কষছেন’, আর আমজনতা হলো ইন্দ্রের রাজ্যে বর পাওয়া আশির্বাদপুষ্ট নয়া সেবকদল, যাঁদের প্রধান কাজই এখন খেয়ে-না খেয়ে স্যোসাল মিডিয়াতে বুঁদ হয়ে নর্তন কুর্দন করা-শুনা-দেখা। ভালো তো ভালো না। মাথাপিছু বিরাট আয় নিয়ে মুদ্রাস্ফিতির ‘চিপাই’ পড়ে দেশী বোন-ব্রাদারদের কাঁচাবাজার-পাকাবাজারে সপ্তাহান্তে নজর দেওয়ার মাজার জোর কমে গেছে। সব শাআঁলা ইউক্রেন ও রাশিয়ার দোষ। মরুকগে…আপনি বাঁচলে বাপের নাম…?
পরিসংখ্যান নামক পরশুরামের কুঠারের আঘাতে দেশী ক্ষত্রিয়দের একাংশ নিকাশ না হয়েও গায়েব হয়ে গেলেও রাষ্ট্র নামক বিমূর্ত আত্মার অট্টহাসিতে ‘মাথাপিছু’ আরো কিছু ডলার যোগে আনন্দে শামিল হওয়া যেতেই পারে। এসবই এখন আমজনতার ঘুরান্টি মাথা বেশিই বোঝে কী? সাবধান বাবার ডিজিটাল সাবধান? ডিজিটালি প্যাঁদানোর জন্য আম’দের…উপর? তবে যাদের বুঝার দরকার সেইসব ‘কালো হোঁতকা বেড়াল’ ও তাঁদের প্রভুদের মাছ-মাংসের যোগান কিন্তু ঠিক থাকা চাই, আছেও তাই…ভজকট রাজ্যের এটিই সবচেয়ে ইতিবাচক দিক…? এখন গায়েবীরা কুঠারের আঘাতে বিনাশ হয়ে আবার ‘বর’ পেয়ে নতুন জীবনে পদার্পণ করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকায় উত্তম। সাথে নচিকেতার সাথে গাওয়া যেতে পারে,
“অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন
শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন।
জীবন প্রসব করে চলাই জীবন,
শুধু যোগ বিয়োগের খেলাই জীবন!!!
**************************************************************
@আখেনাটেন-২০২২
ছবি: লেখক। রৌদ্রস্নাত মিসিং ম্যান।