একবার ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম-এর একটি সেমিনারে যোগ দিয়েছি। সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা শুনছে। বিমোহিত। আলোড়িত। সম্মোহিত। যারা তাঁর কোনো সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন তাঁরা নিশ্চয় জানেন এটা। সেখানে তিনি ভবিষ্যৎ লিডারশিপ নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল এরকরম, ‘প্রত্যেকটি বিষয়ের বা প্রত্যেকেরই একটি মিশন থাকা উচিত, যা ভিশন দ্বারা চালিত হবে, সেই ভিশনটি আবার ইনোভেশন দ্বারা চালিত হবে; আর সেই ইনোভেশন বা উদ্ভাবনটি হবে ‘গবেষণা ও উন্নয়ন’ (R & D) এর মাধ্যমে।’
অর্থাৎ আমরা যা কিছুই করি না কেন তার প্রত্যেকটি কাজই হচ্ছে এক একটি মিশন। আর মিশনগুলো অবশ্যই একটি সুনির্দিষ্ট ভিশন বা দূরদর্শী চিন্তা-চেতনার দ্বারা পরিচালিত হবে। আর সেই চিন্তা-চেতনাগুলো আবার যোগান দিতে হবে ইনোভেশন বা নয়া নয়া উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করে। কারণ এভার-চেইঞ্জিং বিশ্বে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আইডিয়া জেনারেইট হচ্ছে। আবার সেগুলো অতি দ্রুত সময়ের সাথে সাথে অবসলিট হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। আর সেজন্য সেই উদ্ভাবনী চিন্তা-ভাবনাগুলোকে প্রতিনিয়ত ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভালপমেন্ট’ বা গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে শাণিত করতে হবে যেন কোনোভাবেই কাউন্টারপার্টদের থেকে পিছিয়ে না পড়ি। কী দুর্দান্ত চিন্তাধারা! আর উনি নিজে এভাবেই দক্ষিণ ভারতের ছোট্ট একটি অজপাড়াগাঁও থেকে উঠে এসে সর্বোচ্চ সন্মানিত আসনে আসীন হতে পেরেছিলেন চিন্তার ও কর্মের স্বচ্ছতার দ্বারা।
ঠিক একইভাবে আমরা যে এখন পশ্চিমাবিশ্বে ভারতীয় বংশোদ্ভূত হস্তিকায় সিইও-দের (সুন্দর পিচাই-Google, সত্য নাদেলা-Microsoft, অরবিন্দ কৃষ্ণা-IBM, সান্তুনু নারায়ণ-Adobe, সঞ্জয় মেহরত্রা-Micron, নিকেশ অরোরা-Palo Alto, অনিরূদ্ধ দেবঘন-Cadence, লক্ষণ নরসীমাও-Starbucks, বসন্ত নরসীমাও-Novertis) দেখি তার বীজ অনেক আগেই বপন করা হয়েছে সেখানে। যার ফল এখন ভারতে ও ভারতের বাইরে তারা ভোগ করছে। আমরা বাংলাদেশীরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি…?
২
শিরোনামে আমি কয়েকটি বিশ্বখ্যাত ভারতীয় আইটি ফার্মের নাম উল্লেখ করেছি। আমরা যদি দেখি-- ভারতের টপ টেন আইটি ফার্মের সম্মিলিত কর্মী সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। আর ১-হাজার থেকে ৫-হাজার কর্মী ফার্মের সংখ্যাও অসংখ্য। অর্থাৎ ভারত হাই এন্ড প্রযুক্তিভিত্তিক এই ইনফোটেক শিল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে যা পশ্চিমা বিশ্বকেও তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের এমন কোনো বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান নেই যাদের ‘R & D’ অফিস ভারতে নেই। উচ্চ প্রযুক্তিতে দক্ষ লক্ষ লক্ষ এসব কর্মী বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ভারতের অর্থনীতিতে যোগান দিচ্ছে ফি বছর। ভারতের এসব আইটি ফার্মের ২০২১-২২ অর্থবছরে সম্মিলিত রপ্তানি প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন ডলার+। অবিশ্বাস্য একটি সংখ্যা!!!
আর আমরা এখনও এক (১) বিলিয়ন (২০২১-২২ অর্থবছরে ৯৫২ মিলিয়ন ডলার) ডলারও অতিক্রম করতে পারি নি। অথচ ২০১৫ সালে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি সফটওয়্যার খাতে রপ্তানির টাকা পকেটে পুরবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন সেই লক্ষ্য পূরণ হলো না?
ঠিক একইভাবে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ৫০ বিলিয়ন ডলারের আরএমজি+ পণ্য রপ্তানী করবে। সেই লক্ষ্য অনেকাংশে পূরুণ হলেও আইটি খাতের লক্ষ্য কেন পূরণ হলো না তা কি কর্তা ব্যক্তিরা খুঁজে দেখেছে। আমরা সেটাই এখন দেখার চেষ্টা করব, কেন এ বিপর্যয়?
৩
কারণ একটাই দক্ষ জনশক্তি ও চৌকশ উদ্যোগতার অভাব। আর এটি না হওয়ার কারণ হচ্ছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাগাড়ে পরিণত হওয়া বা করা এবং সেখানে টিচিং-লার্নিং ও গবেষণা-উদ্ভাবন নিয়ে কারো কোনো ভিশন না থাকা।
গত সাত বছরের ব্লগিং-এ আমি বেশ কিছু লেখা লিখেছি বাংলাদেশের ‘উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা’র হালহকিকত নিয়ে। সেখানে দেখানোর চেষ্টাই ছিল উদ্ভাবনী চিন্তাধারায় দেশের কংকালসার অবস্থার কথা! আর এটা যে দেশের সাসটেইনেবল উন্নতির চরম অন্তরায় তা দেশের তথাকথিত মহান দেশপ্রেমিকদের অনুধাবন করতে না পারা (নাকি ধান্ধার রাজনীতিতে নিজেদের অধঃপতন কিংবা বিবেকহীনতা)। যখন দেশের শত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাৎসরিক মাত্র ১৫২ কোটি টাকা (২০২২-২৩ অর্থবছর) বরাদ্দ থাকবে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য তখন সে দেশ থেকে উদ্ভাবনী চিন্তা তো দূরে থাক পশ্চাদপদ চিন্তাধারাও উৎপাদন জটিল থেকে জটিল হতে বাধ্য।
একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে-ভারতের বোম্বাই আইটি গবেষণা ও উন্নয়নে ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যয় করেছে ৩২৯ কোটি রুপি (প্রায় ৪১০ কোটি টাকা)। এর মধ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩২৫ কোটির মতো, বাকি টাকা বেসরকারি বা ইন্ডাস্ট্রি খাত থেকে পেয়েছে।
এখন বাংলাদেশের অবস্থা ভাবুন। দেশের সর্ব্বোচ্চ টেকনিক্যাল ইউনি বুয়েটের গবেষণা ব্যয় ২ কোটি টাকার সামান্য বেশি। আর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাবি’র ১০ টাকায় চা-সিঙ্গারা-সমুচাখোর ৫০ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর জন্য গবেষণা বরাদ্দ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাত্র ১৫ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের বড় একটি অংশ আবার বছর শেষে অব্যবহ্নত থাকে। কী বিচিত্র এ বিদ্যাপিঠ সেলুকাস!!
৪
তাই গবেষণা ও উন্নয়ন এবং টিচিং-লার্নিং এর এই করুন চেহারা, শিক্ষকদের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রভাবিত না করতে পারা ইত্যাদির ফলে আমরা দেখতে পাই দেশের সর্ব্বোচ্চ বিদ্যাপিঠগুলো থেকে হাইলি টেকনিক্যাল (কম্পিউটার বিজ্ঞান, জেনেটিক্স, ক্যামিকেল-ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি ইত্যাদি) বিষয়ে পড়াশুনা করে, হয় ব্যাংকের উচ্চপদের ক্যাশিয়ার নয় বিসিএস দিয়ে উচ্চপদের স্যুটেট-বুটেট কেরানি হওয়ার জন্য বছরের পর বছর উদায়ান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এর মধ্যে নগণ্য সংখ্যাক ক্যাশিয়ার কিংবা কেরানীগিরির নব্য জমিদারি জব বাগাতে পারলেও বাকিরা ততদিনে ডিমোটিভেটেট, ডিমোরালাইজড, ডিসহার্টেন্ড ও ডিসকোয়ালিফাইড (বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক) হয়ে হতাশার জীবন-যাপনের চিরকালীন সঙ্গী।
আবার কেউবা গাজা বা বাবা খেয়ে দাদা সেজে রাস্তায় নাতিদের ঠেক দিয়ে জীবন যাপন করছে। কারণ যে সময়ে তরুন প্রজন্মের স্কিল ডেভালপমেন্ট করার দরকার, সেময়ে আমরা ‘উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা’ কিংবা ‘ওবামার দাদার বাড়ি কেনিয়া’ মুখস্ত করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ--পরিবার, সামাজিক তথা জাতীয় চাপে। এটাই এখন হাকিকত বাংলাদেশের!!!
তো এরকম পরিবেশ থেকে কী আপনি বাইজুস রবিচন্দ্রন (Byju’s), শচীন বানসাল (Flipkart), ভবিশ আগারওয়াল (Ola), নিথিন কামাথ (Zerodha), ভাবিন তুরাখিয়ার (Zeta) মতো স্টার্ট আপ পাইওনিয়ারদের আশা করতে পারেন। কিংবা ইনফোসিস (Infosys), উইপ্রো (Wipro), টেকমাহিন্দ্র (TechMahindra), টিসিএসের (TCS) মতো কোম্পানি প্রতিষ্ঠার আশা করতে পারেন। বাংলা কথা হচ্ছে ‘আমাদের সিস্টেমে গলদ’। আর সিস্টেমের গলদের কারণ হচ্ছে সিস্টেমের উপর সারিতে যারা অতীতে বসে ছিলেন, এখন বসে আছেন তাদের সেই মহামতি আবদুল কালামের কথা অনুযায়ী না আছে কোনো মিশন, না আছে কোনো ভিশন, না আছে কোনো ইনোভেশন বা ক্রিয়েটিভ চিন্তাধারা। সবচেয়ে দুঃখজনক যা তা হচ্ছে না আছে ‘জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা’। এখানে ক্ষমতায় মুখ্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গোল্লায় যাক। আর এর ফলেই উচ্চশিক্ষায় তথা ‘গবেষণা ও উন্নয়ন’ খাতে বরাদ্দের এই হাল।
আবার যতটুকু বরাদ্দ হচ্ছে সেটাও আবার বানরের রুটি ভাগের মতো তথাকথিত শিক্ষাগুরুরা আদর-আপ্যায়নের জন্য কাটসাট করে ফেলছেন কিংবা কোথায়, কীসে, কেমন করে, কিভাবে গবেষণা করবেন সেটা বুঝতে বুঝতেই বছরের বছর চলে যাচ্ছে। কারণ আবারও সেই সিস্টেমে গলদ। যাদের শিক্ষাগুরু হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগ অংশই গুরু থেকে গরুতে তথা গোবরে ট্রান্সফর্মড হয়ে জাতির আগাছা (পড়ুন ছাত্রনেতা) উৎপাদনে সুদৃঢ় ভূমিকা রাখছে। গোবরমস্তিষ্কদের কাজই এখন দেশের (অপ)‘রাজনীতি’ নামক আবর্জনা (অতি সুক্ষ্ণভাবে এই অবস্থায় আনা হয়েছে!) নিয়ে জাবর কেটে সিঁড়ির উপরে উঠার ধান্ধা। উপরে উঠতে গেলে যে দু-চারটা উন্নত মানের (ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর) আন্তর্জাতিক জার্নালে কিছু একটা পাবলিশ করতে হয় সেই সংস্কৃতি কবেই পাশের জাদুঘরগুলোতে বাক্সবন্দি হয়ে নতুন প্রজন্ম তথা প্রশ্নফাঁস জেনারেশনের প্রদর্শনীর বস্তু হয়েছে লোকচক্ষুর অগোচরে কেউ জানে না (মিথ্যা-সকলেই জানে)।
একটি উদাহরণ দেই, ২০০৯-২০১৮ মেয়াদে দেশে ‘হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট (HEQEP)’ নামে একটি প্রকল্পতে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা-উন্নয়নের জন্য প্রায় ২০০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। সেই প্রকল্পের আওতায় একাডেমিক ইনোভেশন ফান্ডের মাধ্যমে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য হাজার কোটি বরাদ্দ হলেও একটিও প্যাটেন্ট (Patent) অর্জন করতে পারে নি। চিন্তা করুন, হাজার কোটি টাকা গবেষণা ব্যয়েও একটিও প্যাটেন্ট নেই। ভাবা যায়। অথচ গবেষণা হয়েছে। টাকা ঢালা হয়েছে। বাস্তবতা হল এর বেশির ভাগ টাকায় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রশাসক শ্রেণির নব্য জমিদার ও শিক্ষাগরুর বড় একটি অংশ তছরুপ করেছে। সামনে ৪০০০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প ‘Higher Education Acceleration and Transformation (HEAT)’ একনেকে পাস হয়েছে। হালুয়া-রুটির ভাগিদাররা এখনই দাঁতে ধার দেয়া শুরু করেছে। এই হচ্ছে দেশের গবেষণা ও উন্নয়নের চালচিত্র!
৫
এভাবেই আমাদের পরিবার, সমাজ ও জাতির কাঠামো শক্ত ভিত্তির উপর (নাকি চোরাবালি) দাঁড়িয়ে গেছে। নাকি তথাকথিত আত্নস্বীকৃত মহান দেশপ্রেমিক সাধুগণ কর্তৃক স্থুলভাবে তৈরি করা হয়েছে, হচ্ছে। আর এটাই এখন আমাদের টেকসই (Sustainable) উন্নয়নের চাবিকাঠি। আর এটাই এখন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের (Zen-Z & Alpha) উন্নতির সোপানের মূলমন্ত্র। আর এটাই এখন আমাদের নয়া বাংলাদেশের উন্নয়নের মাপকাঠি। এই উন্নয়নের ফলেই আমরা আকাশ থেকে কড়াইল বস্তির পাশে সিঙ্গাপুর-কানাডার ভার্চুয়াল চিত্র দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে চলেছি, তুলছি ও তুলব!!! আর এটিকেই টেকসই বা চিরস্থায়ী রূপ দিতে এখন দরকার ‘উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা’ জ্ঞানধারী এক ঝাঁক চৌকস স্যুটেট-ব্যুটেট নব্য জমিদার, যারা মহান প্রভুর গোলামীর জন্য সদা সর্বদা নিয়োজিত থাকবে;; এখানে কিসের দরকার কামাথ-বাইজুস বা বানসালদের; কিসের দরকার উইপ্রো বা ইনফোসিসের; কিসের আবার গবেষণা-উদ্ভাবন-উন্নয়ন? কী বিচিত্র এ দেশ, সেলুকাস!!!
**************************************************************
@আখেনাটেন/আগস্ট-২০২৩
ছবি: এখানে
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:৩৮