‘দোস্ত, তোরা তো চন্দ্রে ও মঙ্গল-ফঙ্গলে রকেট-মকেট পাঠায়ে একাকার করে দিয়েছিস। ওদিকে শাহরিয়াররা তো গোটা বিশ্বে ভিক্ষুক-মিক্ষুক পাঠায়ে ভজগট অবস্থা’--আমার ইজ্ঞিতপূর্ণ কথা মনীশ প্রথমে বুঝতে পারেনি। একটু খোলাসা করে বলতেই বিরাট অট্টহাসিতে ভূকম্পন তোলার দশা। প্রতিউত্তরে হাসতে হাসতে বলে--’শালে, ইয়ে কাব হোগা! এরপর আরো নানাবিষয় নিয়ে হাসাহাসি-কাশাকাশি। দুজনেই এ সময় শাহরিয়ার-খলিলদের উপস্থিতি মিস করছিলাম। তাদের গোরা চেহারা, শক্তপোক্ত দশাসই শরীর আর জাত্যাভিমানীর ‘হোগা’য় থুক্কু ঠুনকো আস্তরণে হাতুড়ির করাঘাত করা যেত।
২
একটি সম্ভাবনাময় জাতি অদূরদর্শীতা, উন্নয়নগত অপরিকল্পনা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপচিন্তার দ্বারা যে খাদের কিনারে যেতে পারে তা ‘পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্রটি বিশ্ব ইতিহাসে একটি ‘কেসস্টাডি’ হতে পারে।
অথচ ৮০’র দশকেও পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় (৩৫০ ডলার-১৯৮২) ভারতের (২৭৫ ডলার) প্রায় দেড়গুণ ও বাংলাদেশের (২০৯ ডলার) প্রায় দ্বিগুণ ছিল। এখন ঠিক তার অপোজিট। ৯০’র দশকে যখন বাংলাদেশ তো দূর কী বাত, ভারতও বিশালাকার অবকাঠামো নির্মাণে দ্বিধান্বিত ছিল, তখনই পাকিস্তানে বিলিয়ন ডলার ক্রেডিটে বিরাট বিরাট ৪/৬ লেনের মোটরওয়ে নির্মাণ করে। লাহোর টু ইসলামাবাদ, করাচী টু হায়দারাবাদ ঝাঁ চকচকে রাস্তা। তারবেলার মত হস্তিকায় হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্ট। শান-সৈকতে ভরপুর জৌলুসপূর্ণ নগরী করাচী। বড় বড় গার্ডেনসহ গোছানো নগরী লাহোর। বিশ্বের অন্যতম পরিকল্পিত রাজধানী শহর ইসলামাবাদ। আরো কত শত উন্নয়ন…আহ!!!
এরপর গত ৩০ বছরে কি এমন ঘটল যে একটি দেশের এ হাল! কারণ একটাই--তা আগের প্যারাতেই লেখা হয়েছে। বিলিয়ন ডলার ক্রেডিট। শুধু ক্রেডিটের আগে ‘অপরিকল্পিত ও অস্বচ্ছ উপায়ে’ কথাটি জুড়ে দিতে হবে। আর এই অপরিকল্পনার মাঝেই লুকিয়ে আছে যত প্রকার ইতরামী অর্থাৎ দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও লুটপাট। আর এগুলোর ফলে দেশের নৈতিক ভিত্তিটা ভঙ্গুর হয়ে যায়। সামন্তবাদী প্রভুরা অন্যায়গুলো এমনভাবে জায়েজ করে নিয়েছে যে অন্যায়কে আর কেউ অন্যায় মনে করে না। ‘ফিলথি মিলিটারি এস্টাব্লিশমেন্ট’-এর সাথে ‘কানিং অ্যান্ড রোটেন ব্যুরোক্রেসি-সিভিল সোসাইটি’ মিলে একটি ‘ভিসাস সার্কেল’ গড়ে তুলেছে। এতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদাগুলোর ক্রমাগত অবনমন দেশের প্রকৃত উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে খাদের কিনারে পৌঁছে দিয়েছে। আর মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে জোব্বাওয়ালা জঙ্গীবাদ। সেটাও ঐ এস্টাব্লিশমেন্টদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদেই হাইড্রার মতো বহুমাথা নিয়ে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে।
আর এসবই ঘটেছে পাকি এস্টাব্লিশমেন্টের ‘ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মানসিকতা’র ফলে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই। ‘আমিই বা আমরাই ভগবান’। ‘আমরা ছাড়া আর কেউ এত এত উন্নয়ন করতে পারবে না’। ‘বিশালাকার উন্নয়নে একটু আধটু লুটপাট তো হবেই’। ‘আমরা ছাড়া আর দেশ নিয়ে ভাবার কে আছে’?
উপরের ঐ প্যারাটির সাথে আর কোনো শাসকের কি মিল খুঁজে পাচ্ছেন? নিশ্চয় পেয়েছেন। হ্যাঁ, আমি এই জাতীয় ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ বা উন্নয়নের গুরু আইয়ুব খানের কথা বলছি (হতাশ হলেন মনে হচ্ছে?)। এই ধরনের উন্নয়নের গুরু একজনই ছিলেন তা উনি। উনিই বাঙ্গালী ও পাকিদের এই অত্যাশ্চর্য ‘উন্নয়ন মডেল’ শিখিয়েছেন। এই অষ্টমাশ্চর্য উন্নয়নের জাতির পিতা আইয়ুব খান। ৬০’র দশকের সেই উন্নয়ন মডেলই ৮০ ও ৯০’তে পাকিরা পুনরায় অনুসরণ করেছিল দ্বিধাহীন চিত্তে। আর তার সুফল(?) পাচ্ছে এখন!!!
আচ্ছা, এ ধরনের ‘গুরু আইয়ুবীয় উন্নয়ন মডেল’ কি বিশ্বের অন্য কোনো দেশে অনুসরণ করা হচ্ছে? কবি কি নিরব…?
৩
একদা প্রথম আলোর কলামে অর্থনীতিবিদ মহিউদ্দিন আহমেদ লিখেছিলেন, "এ দেশে উন্নয়নের ঢোল বাজানো শুরু হয় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমল থেকে। তাঁর আমলে দেশের চাকচিক্য কিছুটা বেড়েছিল, সন্দেহ নেই। তিনি আগারগাঁওয়ে সংসদ ভবনসহ একটা বড়সড় কমপ্লেক্স গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। কুর্মিটোলার নতুন বিমানবন্দরের কাজে হাত দেন। এখন যেটা ময়মনসিংহ রোড, যা কিনা ঢাকা শহরের ধমনি, এটাও তাঁর সময়ে করা। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন তাঁর শাসনামলের। যমুনা সেতু আর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চিন্তাও আসে তখন। আমরা এখন এসবের অনেক কিছু নেড়েচেড়ে খাচ্ছি।
কিন্তু আইয়ুব খান যা করেছেন, তাতে আমরা খুব খুশি ছিলাম না। আমাদের অভিযোগ ছিল, আমাদের পাট বেচা টাকার অল্প অংশই আমাদের এ অঞ্চলে খরচ হয়। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বেশির ভাগ খরচ হয় পশ্চিম পাকিস্তানের (এখন পাকিস্তান) উন্নয়নে। এই বৈষম্য, এই প্রতারণা দিয়ে উন্নয়নের ঢোল বেশি দিন বাজানো যায়নি। ১৯৬৮ সালে সারা দেশে আইয়ুব খানের ‘উন্নয়ন দশক’ উদ্যাপিত হলো। কিন্তু দেখা গেল, ভেতরটা ফাঁপা। কিন্তু ‘উন্নয়ন’ শব্দটি শাসকদের খুব পছন্দ। এর ধারাবাহিকতায় ‘উন্নয়ন’ আমাদের রাজনীতিতে টেকসই হয়ে গেছে।"
আপনাদের কি মনে হয় ‘আইয়ুবীয় উন্নয়ন মডেল’ উত্তম নাকি শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খ্যদ্যসহ দেশের মৌলিক উন্নয়নের মাধ্যমে জাতির আত্মীক উন্নয়ন দরকার?
সবশেষে শ্রদ্ধেয় ব্লগার আহমেদ জী এস’র একটি কথা দিয়ে শেষ করছি, “যেখানে রাষ্ট্রীয়, আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিমন্ডলে একছত্র ভাবে রাজনীতিবিদগণ এবং তাদের বশংবদ সুবিধাবাদীরাই আমাদের রাজনীতিতে ইদানিং কালের ছলচাতুরী ঢুকিয়ে তারই ছত্রছায়ায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছেন ? যেখানে জনগণ হয়েছে অপাংতেয় এবং তাদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকারটি হয়েছে ডাষ্টবিনে নিক্ষিপ্ত? এই তথাকথিত দেশপ্রেমের ধ্বজাধারীরা যে মেকী মানসিকতা তৈরী করে দিয়েছে আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের মূহুর্তে তা থেকে আমাদের মুক্তি নেই মৃত্যু পর্যন্ত”।
********************************************************
@আখেনাটেন-অক্টোবর/২০২৩
ছবি: এআই জেনারেটেট
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:০৫