somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক চোখ নষ্ট বৃদ্ধা আর তার রাজকুমারী মেয়ে

১১ ই জানুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ১২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(আমার ঠিক মনে নাই) বিষ্ণুর তৃতীয় বা চতুর্থ অবতার হলেন বরাহ। বরাহ মানে শূয়োর। তা তিনি শুয়োর হিসাবে মর্ত্যে এসেছেন। তার কাজ হল কোন একটা দৈত্য মেরে দুনিয়ার শান্তি ফিরিয়ে আনা। সেটা তিনি সুচারুভাবেই সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু কাজ শেষ হবার পরও দেখা গেল তিনি স্বর্গে ফিরে আসছেন না। স্বর্গ জুড়ে তোলপাড়? কই?? বিষ্ণু কই???

স্বর্গ থেকে দেবদূত গেল। খোজ লাগানোর পর তাকে আবিষ্কার করা হল নদীর তীরে। প্রখর রৌদ্রের ভিতর কাদা মেখে সারা শরীরে তিনি শুয়ে শুয়ে আলস্য করছেন। দেবদূত গিয়ে বলল, " চলেন। স্বর্গে হাহাকার পড়ে গিয়েছে"

বরাহ বললেন, " আমি কিছুতেই ফিরে যাব না। এইখানেই ভালো আছি।"



যার একটু ইচ্ছেয় বহু কিছু হয়। মহা পরাক্রমশালী একজন দেবতা শেষ পর্যন্ত তার স্থান খুজে পেয়েছেন একপাল শুয়োরের মাঝে।



১.

আমার ভবঘুরে শ্রেনীর প্রতি আলাদা মমতা আছে। মমতার একটি অংশ বরাদ্দ শ্রমজীবি মানুষদের জন্যও। সম্ভবত খুব কাছ থেকে এদের দেখিনি বলেই মমতা এত গাঢ়।থিসিসের কাজে গিয়েছি মানিকগঞ্জের একটা গ্রামে।সুহাদ, আলামিন আর আমি। সেখানে আমাদের তিনজনের কাজ একটা জরিপ চালানো। মানুষ একদিন কয় লিটার পানি ব্যাবহার করে সেটা বের করাই জরিপের মুখ্য উদ্দেশ্য। সুহাদ বেচারা প্রশ্ন করে। আমি আর আলামিন সাথে থাকছি ব্যাস এইটুকুই। উনিশ বছরের এক তরুনীকে যখন সুহাদ প্রশ্ন করে আপনি টয়লেটে কয় লিটার পানি ব্যাবহার করেন তখন সেটা একটা দেখার মতই বিষয় হয়।



দৈবচয়নের ভিত্তিতে আমরা বিভিন্ন ঘরে যাচ্ছি। শেষের দিকে মনে হল একজন নিম্ন আয়ের পরিবারকেও জিজ্ঞেস করি। সাথের স্থানীয় গাইডকে বললাম এই রকম একটা ঘরে নিয়ে যেতে।



নদীর একেবারের পাড় ঘেষে ঘর। ঘরে কোন পুরুষ নাই। একজন বৃদ্ধা মহিলা আছেন। একচোখে বোধহয় ছানি পড়ে গেছে। দৃষ্টিগ্রাহ্য যে সে একচোখে দেখে না। পেশা তার মাটি কাটা। দিন মুজুরের কাজ করেছে সারাটি জীবন ধরে, তার সারা যৌবনে। এখন আর শক্ত সমর্থ না। এখন জীবন চলছে পরের বাড়িতে ছোট-খাটো কাজ করে আর ছাগল পেলে। মাসে তার আয় হাজার দুয়েকের মত। ছোট একটা ছনের ঘর।সেখানে একটা চৌকি পর্যন্ত নাই। অনুমান করলাম চাটাই ( মাদুর বলা যায় না কিছুতেই) পেতে রাতে থাকে। ঘরের পাশে কিছু ফলের গাছ লাগিয়েছে। সেখান থেকেও কিছু আয় হয়। প্রশ্নোত্তরের এক পর্যায়ে বৃদ্ধার মেয়ে এল পাশের বাড়ি থেকে। পিড়ি পেতে দিল যেন আমরা বসতে পারি।





গল্পের আরেকটা ভূমিকা শেষ হল।



২.



যা বলছিলাম। বুড়ির মেয়ে এসে পিড়ি পেতে দিল। কিন্তু আমরা কেউ বসলাম না। চারজন আছি। চারজনের বসার জায়গা সেখানে নাই।সুহাদ খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করা শুরু করল। আর আমি দু'চোখ ভরে দেখছিবুড়ির মেয়েটাকে।

গ্রীষ্মের দুপুরে আমরা গায়ের পথে হেটেছি ঘন্টা পাচেকের মত। গরমে অতিষ্ঠ। হেটে হেটে পা দুটো ক্লান্ত। ঠিক এইসময় এই মেয়ের উপস্থিতি যেন হঠাৎ করেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হওয়া। ইচ্ছে করেই তার নাম লিখছি না। মেয়েটার বয়স কত হবে? হুমমম... আঠারো বা সতেরো।

একটু আগেইসে গোসল করেছে। নাহ! গোসল করি আমরা, সে যা করেছে সেটা যেন গোসলের চেয়ে বেশী। বিবর্ন গাছকে বর্ষা যেভাবে সবুজ করে তার গোসলের সাথে সেটার গভীর মিল। মাথায় কাল কুচকুচে চুল। কুচকুচে কালো চোখের মণি আর গভীর সাদা চোখ। এইরকম চোখ খুব বিরল।



যৌবন তার দেহে প্রস্ফুটিত। চলনে একটু ধীর। কথাবার্তায় গ্রীষ্মের মাঝে শীতল বায়ু। ধীরে প্রবাহিত কিন্তু যেন শান্তি নিয়ে আসে। গায়ের রঙ কাল। এই কাল তার সৌন্দর্যকে যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। নীল রঙের একটা জামা পড়ে আছে। কোন কারুকার্য নাই তাতে। আর এতেই মনে হচ্ছে উজ্জ্বল শুভ্র সে। তার আচরনে যে আভিজাত্য সেটা কেউ তৈরী করতে পারে না, জন্ম থেকেই নিয়ে আসতে হয়।



আমি সেই উঠানে দাঁড়িয়ে আছি স্থানুর মত। মনের ভিতর ইচ্ছেরা করছে ছুটোছুটি। থেকে যেতে ইচ্ছে করছে এখানে। এদের পাশে ছোট একটা কুড়েঘর তৈরী করব। ছাগল পালব আমিও দু'চারটা।সকালে পালা মুরুগিগুলো আর কবুতরগুলোকে কিছু ধান খেতে দিয়ে বের হয়ে যাব মাটি কাটতে বা কোন ফসলের ক্ষেতে কামলা খাটতে। বিকেলে ফিরে এসে সামনের নদীটির ঠান্ডা পানিতে দিব বড় দুইটা বা তিনটা ডুব। একটু সাতরিয়ে এসে ছাগলগুলোকে ঘরে নিয়ে আসব। মুরগিগুলো গুনে গুনে তুলব ঘরে। কবুতরগুলোকে দিব শেষ বিকেলের খাবার।



আর তার কোন একটা উপকারে আসার প্রানপনে চেষ্টা করব। সকালে তার ছাগলগুলোকে আমার সাথে নিয়ে নিব। বিকালে আমার গুলোর সাথে সেগুলোকে ফিরিয়ে আনব। তাকে অনুরোধ করব আমার জন্য দুপুরের রান্নাটা করে দিতে।



এই যে দুশ্চিন্তাহীন মুক্ত জীবন, কোন একটা উদ্দেশ্য সফল করার জন্য যেখানে প্রানপণে খাটতে হয় না। এইখানে নিম্নস্তরের (!) জীবনে যে সুখ লুকিয়ে তার খোজ আমি এতদিন পাইনি। আমার মনে হচ্ছিল গহীন বনে অনেক হিংস্র জীব-জন্তুর পাহারায় যে গুপ্তধন থাকে বা প্রশান্ত মহাসাগরের কোন একটা নির্জন দ্বীপে ষোড়শ শতকের কোন জলদস্যুর গুপ্তধন আমার সামনে উন্মোচিত। শুধু দুই হাত ভরে তুলে নেয়া।



কিন্তু আমি একটা গাধা। আমার নাকের সামনে একটা মূলা ঝুলে আছে। সেই মূলাটা ধরার জন্য আমি শহরে ফিরে এসেছি। কিন্তু আমার জীববে সবচেয়ে গাঢ় ভালোবাসা রেখে এসেছি সে বাড়ির ঊঠানে, সেই সদ্য যৌবনা নারীর জন্য আর তার রাজকীয় জীবনটার জন্য। মুর্খ আমি সেই জীবনের একজন হতে পারলাম না।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ১২:৪৯
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭



ছবি সৌজন্য-https://www.tbsnews.net/bangla




ছবি- মঞ্চে তখন গান চলছে, মধু হই হই আরে বিষ খাওয়াইলা.......... চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গান।

প্রতি বছরের মত এবার অনুষ্ঠিত হল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪। গত ২৪/০৪/২৪... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

×