১৯৯০ সাল, মা বাবা আমাকে মাদ্রাসায় পাঠালেন মাওলানা হওয়ার জন্য। তখন এলাকায় ইসলামী আদর্শ বহুমুখী মাদ্রাসা নামে একটা মাদ্রাসা কেবল চরমোনাইর পীরের মুরিদরা স্থাপন করছে।
আমার বাপেও তার মুরিদ ছিলো সেখান থেকে শুনেছে বংশে একজন হাফেজ বা মাওলানা থাকলে বংশের ৭০-জন বিনা হিসাবে বেহেস্তে যাবে। সুতরাং উনার বংশের সত্তুর জনকে বেহেস্তে নেওয়ার জন্য একটা চান্স তো নেয়াই যায়।
আমি ভর্তি হয়ে গেলাম আদর্শ বহুমুখী মাদ্রাসায়। ভালই পড়ছিলাম। পাঞ্জাবী ও টুপি পড়তাম,সাথে একটা টিনের সুটকেস ছিলো। তাতে তালা দিয়ে কোমরের তাগা’র সাথে রশি দিয়ে চাবি ঝুলিয়ে রাখতাম। শুক্কুরবার রোদের মধ্যে বসে কাদা মাটি দিয়া কুলুপ বানাইতাম। মাঝে মধ্যে ওয়াজ-মাহাফেলে গজল টজলও গাইতাম। কিন্তু হুজুরের বেতের বাড়ির আঘাতটা সহ্য হয়নি বলে শুরু হইলো মাদ্রাসা পালানো।
বাড়ীতে বাপে ছিলে সাক্ষাৎ আজরাইল । হুজুরের বেধরক পিটানি আর বাপের মাইরের মাঝে আমি ছিলাম মাইনকা চিপায়। বাড়ী থেকে আসতাম, কখনো ‘রিমিঝিম সিনেমা’ আর কখনো ‘আখি সিনেমার’ সামনে দাড়িয়ে পোস্টার দেখতাম কিংবা কখনো ৫০ পয়শা দিয়ে সাম্পানে নদী পার হয় পোর্ট জেটিতে পালিয়ে সময় কাটিয়ে মাদ্রাসা ছুটি হলে বাড়ী যেতাম।
তারপর দেয়া হলো বোডিংয়ে! রাত দিন বোডিংয়ে থাকা লাগবে। শুরু হলো আর এক আযাবের জীবন। খুব ভোরে উঠা লাগবে, যেদিন উঠে ফযরের নামাজ ধরতে পারতাম না সেদিন পিটিয়ে পাছা লাল করে দেয়া হতো। শিশু মনের সেই দগদগে ঘাঁ এখনো মনে পড়লে শিউরে উঠি।
একদিন জেদ ধরলাম আমি, আর মাদ্রাসাযও যাবো না আর পড়ালেখাও করবো না, সকালে এক জামা কাপড়ে পালান দিলাম। একদম নিরুদ্দেশে যাত্রা করে গাজী রকেটে গিয়ে উঠলাম। কিন্তু ধরা খেয়ে গেলাম পাশের বাড়ির টুলি আপার জামাইয়ের কাছে। উনি তখন বিআাইডব্লিউতে চাকরি করতেন। পোস্টিং ছিলো রকেট ঘাটে। বাবাকে লোক মারফত খবর দিলেন, আমাকে রকেট থেকে ধরে নিয়ে গেলো আসামীর মতো, সাথে উত্তম মাধ্যমের বর্ননা দিলাম না।
আমার দাদি বলতেন, ওস্তাদের মাইর যেখানে যেখানে লাগে সে জায়গাটুকু বেহেস্তে যায়। অতো অল্প বয়সে অমন অমানুষিক এবং বেধড়ক পিটুনিতে আমার হাফেজ মাওলানা হবার শখ আর বেহেস্তে যাবার শিশুকালের স্বপ্ন একেবারে নাই হয়ে যায়। তার চেয়ে ঢালীর বাড়ির বাগানে ঘুঘু পাখীর বাসা থেকে ঘুঘুর বাচ্চা ধরা, বিলে মাছ ধরা, পাড়ার ছেলেদের সাথে ডাংগুলি খেলা, ছৈলা আর কেওড়া গাছে উঠে ছৈলা-কেওড়া পেড়ে খাওয়া, কিংবা সমিতির পুকুর পাড়ে দাড়িয়াবান্ধা খেলেই ছিলো আমার বেহেস্ত।
মা তার ভাইকে মানে আমার মামাকে দিয়ে কেঁদে কেটে আমার বাপকে জোর সুপারিশ করালেন আমাকে যেন আবার স্কুলে দেয়। আমার বাপে সেই কথা রেখেছিলেন।
আমি ১৯৯১ সালের জুন মাসে আবার পোর্ট স্কুলে যাওয়া শুরু করি।
ছবিঃ অন্তর্জাল
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০২৩ দুপুর ২:০৯