দার্জিলিং ভারতের পশ্চিম বঙ্গে অবস্থিত। দার্জিলিং তার অনাবিল প্রকৃতিক সৌন্দর্য এবং মনোরম জলবায়ুর জন্য ছুটি কাটানোর জন্য জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। যারা নিজেদের সামর্থের কথা চিন্তা করে ইকনোমি ট্যুর দেয়ার কথা ভাবছেন তাদের জন্য কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য এই লেখা।
দার্জিলিং ভ্রমন করার জন্য খুব ভালো সময় মার্চ এবং এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত তবে এখন প্রায় সারা বছরই টুরিষ্টদের পদচারনায় মুখরিত থাকে দার্জিলিং।
আমি ফেমিলি (তিন বাচ্চা এবং বউ) নিয়ে ২ এপ্রিল ২০২৩ইং রাত ০৮ টায় ঢাকার কল্যানপুর থেকে শ্যামলী এন আর বাসে রওনা করলাম। রাতে বাস বগুড়ায় ফুড ভিলেজে যাত্রাবিরতির জন্য দাড়ায়। আর ঐ সময় যেহেতু রমজান মাস ছিলো তাই সেহেরির জন্য রংপুরের মডার্ন মোড়ের একটা রেষ্টুরেন্টে দাড়িয়েছিলো। (খারারের মান অত্যন্ত জঘন্য)। আমার ভিসায় চ্যাংড়াবান্ধা পোর্ট এনডোর্স করা ছিলো তাই লালমনির হাট জেলার বুড়িমারি সীমান্ত দিয়ে বর্ডার পাড় হবো। বুড়িমারির ওপাশে কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা।
বাস বুড়িমারি ভোর ছয়টায় পৌছলে ওখানে শ্যামলি পরিবহনের ওয়েটিং রুম আছে। চাইলে রিফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নিয়ে দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে নিতে পারেন। কারন বর্ডার সকাল নয়টার আগে ওপেন হয় না। নাস্তা খাবার জন্য পাশেই বুড়ির হোটেল আছে, এটাই এখানের একমাত্র ভালো রেস্টুরেন্ট। অন্যগুলো তোমন একটা ভালো না।
দুই দেশের বর্ডারের ইমিগ্রেশনের সকল কাজ শেষ করে ওপারে যখন পৌছালাম তখন প্রায় ১১টা বাজে। ওপারে ইমিগ্রেশন পয়েন্টের সাথেই অনেক মানি একচেঞ্জ আছে ওখান থেকে ভারতিয় রুপি নিয়ে নিলাম। এবার চ্যাংড়াবান্ধ্যা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত আবার বাসে যেতে হবে। সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টার মতো।
শিলিগুড়িতে যখন পৌছালাম তখন ঘড়িতে প্রায় দুইটা বাজে। শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার গোল্ডেন প্লাজার সামনে নামিয়ে দিলো। ওখান থেকে একটা অটো নিয়ে গেলাম জংশনে। ওখানে গেলেই অনেক বাটপার আপনাকে ডাকাডাকি টানাটানি শুরু করবে। আপনাকে গাড়ি দিয়ে পুরো দার্জিলিং ঘোড়ানোর গপ্পো শুনাবে। আমার আগের অভিজ্ঞতা ছিলো তারপরও খপ্পরে পড়লাম। দুই বাটপার মিষ্টি কথা বলে জংশনের ভিতরে নিয়ে গিয়ে আমারে প্যাকেজ ধরায়া দিলো। যাই হোক জংশনের ওখানে কিছু হোটেল আছে বাচ্চাদের ভাত খাওয়ালাম । রেষ্টুরেন্ট গুলো আমাদের ঢাকার ফুটপাতের ছাপড়া ভাতের দোকানের চাইতেও খারাপ। কেউ ভুলেও ওখানে খাবেন না।
আমি শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং এবং দার্জিলিংয়ে দুই দিন সকল স্পট ঘুড়ে দেখার জন্য জীপ ভাড়া করে ছিলাম। আমার খরচ পড়েছিলো ৬৫০০/- রুপি। ফেমিলি বাচ্চারা সাথে থাকায় আমি শেয়ারিংয়ে গেলাম না । শেয়ারিং জিপে গেলে জনপ্রতি ২৫০/- রুপিতে যাওয়া যায়। ভাবলাম একটু রিল্যাক্স করি। সেটাই আমার জন্য সমস্য হয়ে দাড়ালো। শিলিগুড়ি থেকে জীপ ছাড়ার পর চল্লিশ মিনিটের মতো চলার পর চালক একটা নির্জন রাস্তায় জীপ দাড় করিয়ে দিয়ে বলছে আমাকে ওরা কম টাকা দিয়েছে এই টাকায় আমার লস হবে। আপনি আরো এক হাজার না দিলে এখানে নেমে যান আমি আর যাবো না। আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম সাথে বউ বাচ্চারাও । কি আর করার আমি যে মাইনকা চিপায় সেটা ভেবে তার কন্ডিশনে রাজি হলাম।
এখানে বলে রাখি ঐদিন জি-টুয়েন্টির মিটিং থাকায় কার্শিয়াংয়ের রাস্তাটা বন্ধ ছিলো। আমরা মিরিখের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। এদিক দিয়ে রাস্তা একটু বেশি তাই চু্িক্ত করার সময় ৩০০০/- রুপিতে ঠিক করেছিলাম কিন্ত শিলিগুড়ির দালালগুলো ১০০০/- টাকা কমিশন কেটে ড্রাইভারকে ২০০০/- রুপি দিয়েছিলো। সুতরাং প্রিয় পাঠক আপনারা এই বিষয়টি মাথায় রাখবেন। তা না হলে ব্লাকমেইলের শিকার হবেন।
মিরিখের রাস্তাটা ঐদিন প্রায় পুরোটাই আমি মেঘে ঢাকা পেয়েছিলাম । প্রচন্ড ফগ । গাড়ির হেড লাইট জালিয়ে আস্তে আস্তে চলতে হয়েছে। চেয়েছিলাম মিরিখে আধা ঘন্টা দাড়াবো সেটা আর হলোনা। কারন মন মেজাজ হেব্বি খারাপ হয়ে আছে মাজ রাস্তার ক্যাচালের জন্য। যাই হোক মিরিখের রাস্তা ধরে গাড়ী চলতে চলতে নেপালের যে ট্রানজিট রাস্তার মোড় ওখানে গাড়ি দাড় করালাম। একটা রেষ্টুরেন্টে ডুকে মমো খেলাম। অনেক ঠান্ডা লাগা শুরু করায় কাপড়ের দোকান থেকে বাচ্চাদের জন্য তিনটা মাফলার কিনলাম। তার পর প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ দার্জিলিংয়ে হোটেলে এসে পৌছালাম। হোটেলের ম্যানেজার আমার আগের থেকেই আমার পরিচিত ছিলো তাই ফোনে বুকিং করে রেখেছিলাম।
দার্জিলিংয়ের এবার যে সব স্পটে বৌ-বাচ্চা সমেত ঘুরছি তার সংক্ষিপ্ত বর্ননা লেখার চেষ্টা করি এবারঃ
জাপানীজ ট্যাম্পেল বা পিচ প্যাগেডাঃ মল এরিয়া থেক ১০/১৫ মিনিটের মতো লাগে এখানে পৌছাতে। জানলাম ১৯৯২ সালে জাপানের এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলে বুদ্ধের দাড়ানো, শায়িত এবং ধ্যানে মগ্ন মূর্তি দেখতে পেলাম সাথে চারদিকে অনবদ্য প্রকৃতিক সৌন্দর্য্য। এখানে সকাল বিকাল দুইবার এখানে প্রার্থনা হয় জানলাম।
রক গার্ডেনঃ পাহাড় কেটে খুবই সুন্দর রাস্তা করা বাট অনেক বিপদজ্জনক বাাঁক নিয়ে একবার উপরে একবার নিচে নামতে হয়। যাদের হাইট ফোবিয়া আছে তারা এই স্পট পরিহার করার পরামর্শ থাকবে। আমি মাঝে মাঝে ভয় পচ্ছিলাম কিন্তু বাচ্চারা বেশ উপভোগ করছিলো। অনেক উপরের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্না আর ছোট ছোট স্টিলের সেতু দিয়ে এক সিড়ি থেকে আরেক সিড়ি সংযুক্ত করেছে। বেশ সুন্দর যায়গা। এই যায়গাটা দার্জিলিং শহর থেকে অনেক নিচে অবস্থিত তাই পাহাড়ি খাড়া পথে নিচে নামতে হয়। আশপাশে চায়ের দোকান ‘মমো’র দোকান আছে । আমারা সবাই মমো খেলাম পেট ভরে। দারুন মজা লেগেছে।
পদ্মজা নাইডু হিমালিয়ান জুওলজিক্যাল পার্কঃ এটা দার্জিলিংয়ের চিড়িয়াখানা নামে পরিচিত। পদ্মজা নাইডু হলো সরোজিনী নাইডুর মেয়ে। এটি ১৯৫৮ সালে চালু করা হয়। প্রায় ৭০০০ ফুট উচ্চতায় চিড়িয়াখানাটি অবস্থিত। চিড়িয়াখানাটিতে পাহাড়ি অঞ্চলের প্রানীদের সংরক্ষনের ব্যবস্থার কথা থাকলেও কিছু আধমরা ছাগল প্রজাতির পাহাড়ি হরিন ছাড়া উল্লেখ করার মতো কিছু দেখলাম না। তবে একটা স্বাস্থ্যবান রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখতে পেলাম খুব একটিভ। বেচারা খাচার সামনে এসে এমাথা থেকে ওমাথা শুধু আসা যাওয়া করছে। আমি মনে মনে ভাবছিলাম- বেচারার মুখের সামনে এতো খাবার বেচারা খেতে পারছেনা তাই ছটফট করছে। সব কিছুই বেশ ঝকঝকে তকতকে করে রাখা আছে। এখানে একসাথে আরো আছে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট এবং মিউজিয়াম। এভারেষ্ট বিজয়ী অনেকের পোষাক-আসাক, জুতো-জামা এবং ঐতিহাসিক বিজয় মুহুর্তেও ছবির সাথে দিন-ক্ষন কোন দেশের অরিজিন তা লেখা আছে। আমি আমদের দেশের মুসা ইব্রাহীমের কিছু আছে কিনা তা খুজতেছিলাম কিন্তু কিছু পাইলাম না।
টাইগার হিলঃ দার্জিলিয়ের পর্যটকদের প্রধান আকর্ষন থাকে টাইগার হিলে গিয়ে সুর্যদয় দেখা। সকালের প্রথম আলো এসে কাঞ্চনজক্সগার চুড়ায় এসে পড়ে তখন কাঞ্চনজঙ্ঘার অন্য এক রুপ দেখা যায়। আমি এর আগের বার এসে ওখানে গিয়েছিলাম। ভোর চার টার সময় উঠে রওনা দিতে হয়। এবার বাচ্চারা সাথে থাকায় ভোরের বদলে শেষ দিন সকাল নয়টার সময় গেলাম। পথের দুই পাশে পাইনট্রির বাগান সত্যি অনবদ্য। বেশ ঝকঝকে রোদ আর পরিস্কার আকাশ পেয়েছিলাম তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা খুব সুন্দর ভাবে দেখেছি। আাকাশ পরিষ্কার থাকায় দুরের কার্শিয়াং শহর আর সর্পিল আকাবাকা রাস্তা দেখলাম যা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। সি লেভেল থেকে ৮১০০ ফুট উচ্চতায় এই ভিউ পয়েন্টটি অবস্থিত।
বাতাসিয়া লুপঃ এবার বাতাসিয়া লুপে গিয়ে দেখি টয় ট্রেন দাড়িয়ে আছে। ১৯৮৭ সালের যুদ্ধে নিহত গোর্খা সেনাদের স্মরনে নির্মিত কালো রংয়ের একটি শহীদ স্তম্ভ রয়েছে এখানে। এটা এখন ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ যা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬৭০০ ফুট উচ্চতায়। আকাশ পরিস্কার থাকলে এখান থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। খানিক পর হুইসেল বাজিয়ে বাতাসিয়া লুপ প্রদক্ষিন করে টয় ট্রেন ছুটে চলে গেলো । বাচচারা দারুন এক্সাইটেড। টয় ট্রেনে জয় রাইড নিতে হলে আগে থেকে টিকিট কেটে রাখতে হয়। আমি জানতাম না তাই ওদের চড়াতে পারিনি। আপনারা গেলে এটা মাথায় রাখবেন। অনেক ফেরিওয়ালা নেপালি মেয়ে দেখলাম তারা পশমি শাল, উলের টুপি-মাফলার এগুলো বিক্রি করে। তবে এগুলো খুবই নিম্মামানের। এখান থেকে এগুলো না কেনার পরামর্শ থাকবে।
অরেঞ্জ ভ্যালি টি গার্ডেনঃ রক গার্ডেনে যাওয়া আসার রাস্তায় এই চা বাগানটি দেখা যায়। দার্জিলিংয়ে চা বাগানের অভাব নেই। তবে আমি আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলাম । এই বাগানটি এবার ঘুরে দেখবো। রক গর্ডেন থেকে ফেরার পথে ওখানে গাড়ি থামিয়ে আধ ঘন্টা ঘুরলাম। ছবি তুললাম। আমার মনে হয়েছে এখান থেকে পুরো দার্জিলিং শহরটা এক পলকে দেখা যায় । কিছু ক্ষন দাড়ালেই দেখা যায় সারি সারি মেঘ আপনার হাতের কাছে। এখানে একটা অর্গানিক চা বিক্রয় কেন্দ্র দেখলাম। চায়ের দাম একদম কম না। আমি ৫০০ গ্রাম গ্রিন টি কিনলাম। কেনার আগে টেষ্ট করে দেখার ব্যবস্থাও আছে। অনেক চা বাগানের স্পট গুলোর মধ্যে আমার কাছে এই স্পটটি সেরা মনে হয়েছে।
ঘুম মনোষ্ট্রিঃ এটিও একটি বৌদ্ধ মঠ। বাতাসিয়া লুপের পাশেই এই মঠটি। ঘুম শহরের প্রধান তিনটা মঠের মধ্যে এটি অন্যতম। বৌদ্ধদের তিব্বতীয় শাখা বলা যায়। আমি ভিতরে গেলাম বাচ্চারা মাঠেই ছোটাছুটি করেছে। এখানেও বিরাট এক বৌদ্ধ মুর্তি দেখলাম । ছবি তুললাম । বেশি সময় ছিলোনা হাতে। ১৫/২০ মিনিটের মতো ছিলাম।
আমি মোট তিন রাত তিন দিন ছিলাম। আরো কিছু খুচরা স্পট ঘুরেছি হেটে হেটে সেগুলোর বিস্তারিত বর্ননা দিলে লেখা আরো বড়ো হয়ে যায়্। যেমনঃ তেনজিং রক- এটা চিড়িয়া খানার পাশেই। চিড়িয়াখানা ঘোরা হলে নিচে নামলেই তেনজিং রক। আকাশ পরিস্কার থাকলে এখানে দাড়িয়ে সাউথ সিকিমের অংশ দেখা যায়। এটাও ট্যাক্সি ওয়ালারা একটা স্পট হিসাবে ধরে আপনাকে স্পটের সংখ্যা বাড়িয়ে বলবে। তারপর মল রোড়, মলের পিছনে সেন্ট এন্ড্রু চার্জ, সেন্ট জেভিয়ার স্কুল, ক্যবল কার, হিলকার্ট রোড, চকবাজার, গ্লেনারিজের ইংলিশ ব্রেকফাষ্ট কিংবা কেভেন্টার্সে বসে কফি খাওয়া। চক বাজারের কাছেই একটা মসজিদ দেখলাম। ‘আঞ্জুমান ইসালামিয়া জামে মসজিদ’ এটিই একমাত্র জামে মসজিদ এখানকার ।
এগুলো বিস্তারিত লিখলে লেখা বড়ো হয়ে যায়। এবার প্রায় প্রতিরাতেই ‘মহাকাল রেষ্টুরেন্টে’ খেয়েছি। সকালে একদিন গ্লেনারিজে আর একদিন যে হোটেলে ছিলাম সেখানকার ডাইনিংয়ে খেয়েছি। দুপুরে প্রতিদিন বিভিন্ন স্পট থেকে ‘মমো’ খেয়ে চালিয়ে দিয়েছি। বাচ্চারা ক্যান্ডি, চকলেট, আচার চিপস খেয়েছে স্পটে স্পটে ।
দার্জিলিংয়ে এবার পানির সমস্য দেখলাম খুব বেশি। মাঝারি ও ছোট হোটেল গুলোতে ঠিক মতো গোসল করার পানিও থাকেনা শুনলাম। আমি তিন বেলা বোতলের খারাব পানি কিনে খেয়েছি।
আজকের লেখা এ পর্যন্তই।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০২৩ বিকাল ৫:২১