somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজো প্রতীক্ষায় জোড়া তালগাছেরা

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




বড় পুকুরের পশ্চিম পাড়ে জোড়া তালগাছের নিচে দৌড়ে এসে দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছে নুরু। পুকুর পাড়ের জোড়া তালগাছের ধারটা নুরুর খুব প্রিয় জায়গা। চৈত্র মাসের দুপুর। তাল গাছের মাথায় পাতাগুলো মাঝে মাঝে শনশন করে উঠছে । দুর থেকে কুহুরবে ঘুঘুর ডাক শোনা যায়। চারিদিকে খা খা রোদ্দুর। এই ভর দুপুরে ওদিকের পথে তেমন লোকজনও চলাচল করে না।

ঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে বসেছিলো মিনু। পুকুরের ওপার থেকেই মিনুকে হাত ইশারা করে ডাকলো নুরু। মিনুর বয়স বারো তেরো হবে। এখনো প্রাইমারী স্কুলে পড়ে। ক্লাশ ফাইভে এই দুই বছর ধরে সে আছে। নুরু গতবার ফাইভে বার্ষিক পরীক্ষায় পাশ করেও হাইস্কুলে ভর্তি হতে পারেনি।

পা টিপে টিপে মিনু জোড়া তালগাছের তলায় এসে দেখে নুরুর লুঙ্গির কাছায় এতোগুলা কুল বরই।
-কিরে নুরু? এতোগুলো কুল কোথায় পেয়েছিস?
-ঢালিদের বাগান থেকে পেড়ে এনেছি। খাবি? অনেক মিষ্টি। আর একটু হলেই বজ্জাত ঢালি'র হাতে ধরা পড়ে যেতাম।
-তোকে না কতোবার ঢালি কাকু ধরে মেরেছে। তারপরও ঐ বাগানে চুরি করতে যাস।
- কি করবো বল, আজ দুপুরেও মা ভাত রাঁধেনি, আমার খুব খিদে পেয়েছিলো।
মিনু কুল বড়ইয়ের লোভ সামলাতে না পেরে নুরুর হাত থেকে ছোঁ মেরে দুটো বরই নিয়ে এক দৌড়ে ঘরের দাওয়ায় মাদুরের উপর গিয়ে বসলো।
নুরুদের বাবা দারোয়ানের চাকরি করে নদীর ওপারে বন্দরের অফিসে। চার ছেলে দুই মেয়ে সহ আট জনের অভবের সংসার। প্রায় প্রতিদিন নুন দিয়ে আটা জ্বাল দিয়ে সবাইকে খেতে হয়। মিনু ও একদিন খেয়েছিল ওদের ঘরে গিয়ে। শুধু রাতের বেলা ভাত রান্না হয় নুরুদের ঘরে। মোটা চালের সের ছয় টাকা। ভাত রান্নার পর ফ্যানটুকুও সবাই ভাগাভাগি করে খায়। এজন্য নুরুর ভাত রান্নার সময় মা চালের মধ্যে পানি একটু বেশি করেই দেয়। তবে নুরুর জন্য তার মায়ের আলাদা একটা টান আছে। এক মগ ফ্যানের সাথে নুন দিয় এক চামচ ভাতও মিশিয়ে নুরুকে তার দেয় তার মা।

মিনুর মা'কে মিনুর বাবার কড়া আদেশ- কখনো নুরুদের ঘরে মেয়ে যেন না যায়। ওর মা একটা ব্যাবাইজ্জা(ঝগড়াটে)। মাগি সারা পাড়া মাড়িয়ে বেড়ায়। বিলাই কুকুরের মতো কতোগুলো বাচ্চা পয়দা করছে। বলি, খাওয়াতে পারবিনা যখন এতো আদম পয়দা করার দরকার কি?
নুরুর বাবার নাম আহাম্মদ মিয়া। আহম্মদ মিয়া ছেলেকে দূরের স্কুলে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু পড়ালেখা করতে অনেক খরচ আছে। কে দেবে সেই খরচ। কাগজ কেনো কালি কেনো, দোয়াত কলম কেনা, এত টাকা পয়সা সে পাবে কোথায়।
ও পাড়ার মান্নান বয়াতির একটা পরিত্যাক্ত ছাড়াবাড়িতে বড়সড় একটা ঝুপড়ি ঘর তুলে সেখানে বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে দিন পার করছে আহম্মদ মিয়া।

এখন নুরুর সময় কাটে সারাদিন এ পাড়া ও পাড়ায় ঘুরে ঘুরে। নুরুদের ঝুপড়ি ঘরের পূব দিকে ইয়া বড় একটা কাঠবাদাম গাছ আছে। মাঝে মাঝে ভোরে ঘুম থেকে উঠে মিনু কাঠ বাদাম কুড়াতে যায়। আজ সকালে গাছ তলায় নুরুর সাথে দেখা।
- হ্যারে নুরু, তোর লেখাপড়া নাই, স্কুল নাই খুব মজায় আছিস তাই নারে?
-হ্যাঁ, শোন গতকাল সমিতির পুকুরে ছিপ ফেলেছিলাম, বড় একটা কাতলা মাছ বেঁধেছিলো।
- তারপর?
- তুইতো জানিস আমার বরশি নেই। অতবড় মাছ কি শুধু তারকাটায় আটকায়। চলে গেলো। ধরে রাখতে পারলাম না। শোন, একটা গোপন কথা আছে।
-কি? বলতো দেখি।
- ঐ যে দারোগার পোলা প্রিন্স ভাইয়া আছে না? সে আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছে লুকিয়ে লুকিয়ে মিলি আপুকে দিয়ে আসতে। এই দেখ এজন্য আমাকে ১ টাকা দিয়েছে। দুটো চকচকে আধুলি।
-বলিস কি নুরু? এটা খুবই খারাপ কাজ করেছিস তুই। আমি মিলি আপুর মা'কে বলে দেবো।

নুরুর মা বকুল বিবির মাথায় একটা জটা আছে। সেই জটা দেখলে মিনুর ভয় লাগে। মিনুর মা মিনুকে প্রায়ই বলে- শোন মিনু ঐ বাদাম গাছের তলায় কখনো যাবি না।
-কেন মা?
-বুঝলি না, ঐ বাদাম গাছে জ্বীন থাকে। রাত হলে সেই জ্বীন বকুলের মাথার জটায় এসে বসে।

প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার বকুল বিবি জ্বীন হাজির করে। পুরো ঝুপড়ি অন্ধকার করে প্রায় ঘন্টা খানেক গানের সুরের মতো কতো কি বলে। তারপর জ্বীন এসে ভর করে। ঝুপড়ির বাইরে গ্রামের দুই চার জন এসে দাড়িয়ে থাকে। কারো হারানো গরুর সন্ধান পেতে, কারে হারানো গয়নার কোথায় আছে, কারো সন্তান কেন হচ্ছে না এরকম সমস্যা নিয়ে। জ্বীন ভর করার পারে আহম্মদ মিয়া এসব প্রশ্ন করে আর খুব চিকন গলায় সেই সব প্রশ্নের উত্তর দেয় বকুল বিবি।

মিনুদের ঘরের পাশেই নুরুদের ঘর হওয়ায় মিনুর বাবা-মা'ও কান পেতে শুনতো ওসব। মিনুর কোনদিনও শোনা হয়নি। অতো রাত পর্যন্ত সে কোনদিন জেগে থাকাতে পারে না।

জ্বীন চলে গেলে বকুল বিবি অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। তখন আহম্মদ মিয়া চোখেমুখে পানির ছিটা দেয়। তারপর পর জ্ঞান ফেরে। বকুল বিবি দুই টাকা চার আনা করে চ্যারাগি (ফিস) নেয়। যারা সমস্যা নিয়ে আসে তাদের কাছ থেকে। তবে বেশি টাকা নেয়া জিনের নিষেধ আছে।

নুরু এখন নিয়মিত লঞ্চঘাটে যায় প্রতিদিন ভোর হলে। টার্মিনালে বসে অপেক্ষা করে নতুন লঞ্চ ভেড়ার। নতুন লঞ্চ ঘাটে এসে ভিড়লে যাত্রীদের ব্যাগ মাথায় নিয়ে রাস্তায় দিয়ে আসে। বিনিময় পঞ্চাশ পয়সা থেকে এক টাকা করে পায়। ভালোই লাগে নুরুর। প্রতিদিন পাঁচ টাকা থেকে দশ টাকা কামাই করে নুরু। আর প্রতিদিনের সব রোজগার জমা দেয় মায়ের হাতে।
লঞ্চ এসে পুরোপুরি ঘাটে লাগার আগেই সবার আগে লাফ দিয়ে লঞ্চে উঠতে হয়। এই কাজে নুরু এখন পারদর্শী। তা না হলে অন্য ছেলেরা লঞ্চে উঠে যায়। ব্যাগ ভাগে পাওয়া যায় না।

একদিন কোন এক অশুভ ক্ষনে লাফ দিয়ে লঞ্চে উঠার সময় পা পিছলে লঞ্চ আর পল্টুনের ফাকে পড়ে গেলো নুরু। দুই দিক থেকে প্রচন্ড জোরে চাপ লেগে তলিয়ে গেলো। আর উঠতে পারলো না। আর কোনদিন ফেরা হলোনা তার প্রিয় জোড়া তালগাছটার ধারে।।



সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:২৪
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×