বিশ্বজিৎ চৌধুরীর 'নার্গিস' অবলম্বনে রচিত বিদ্রোহী কবি নজরুলের সুদীর্ঘ ও চরম নাটকীয় প্রেম কাহিনীর সংকলিত সংস্করণ-
"একজন কবি ও নারী"
(২ পর্বের ধারাবাহিকের আজ ১ম পর্ব)
ভারতবর্ষে কাজী নজরুল ইসলামের কবি প্রতিভা একসময় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করেন।বাঁশিতে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুটে।কবিতায় মজলুমদের জয়গান।অল্পতেই বিখ্যাত হয়ে উঠলেন।
একসময় কবি বেড়াতে গেলেন কুমিল্লার দৌলতপুরে।সৈয়দা খাতুন নামের এক কিশোরীর সঙ্গে কবির সখ্যতা গড়ে উঠে।ভালোবেসে যার নাম দিলেন-নার্গিস।কোন এক চৈত্রের দুপুরে নার্গিসের কাছে প্রশ্ন করলেন,'কেন তুমি আমার ঘুম কেড়ে নিলে?'
নার্গিস ভাষা হারাল।শিউরে উঠে শরীর।মায়াকাড়া দৃষ্টিতে নার্গিসের দিকে তাকাল নজরুল।আচমকা ঝড় বয়ে গেল যেন বুকের ভেতর।প্রেমিক কবি হঠাত্ নার্গিসের হাত ধরে বলল,'দেশ-বিদেশ পাড়ি দিয়ে আমি ক্লান্ত,তুমি আমার নোঙর হবে?'এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে সরে গেল নার্গিস।চোখে চোখে কথা হল।যেন বলছে,আমি তোমাতেই মরেছি।
কিছুদিন কেটে গেল।নার্গিসের দেখা নেই।জ্বরের ঘোরে ক্লান্ত নার্গিসকে দেখতে ছুঁটে গেলেন কবি।লোকজন কলঙ্ক রটাতে পারে সে ভয়ে নার্গিস কবিকে শাসাল।অপরাধী হয়ে অসহায় কবি বলল,'নিজেকে অনেক শাসন করি,কিন্তু বিশ্বাস করো,তোমাকে না দেখে আমার যে দুদণ্ড কাটতে চায় না নার্গিস।'
কবিকে থামিয়ে দেয় নার্গিস।কাতর কণ্ঠে বলে উঠে,তুমি চলে যাও,পারো তো ভুলে যাও আমাকে।
ব্যথিত নজরুল নিরুত্তর তাকিয়ে থাকে।তারপর ঝড়ের বেগে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।
কবিকে ফিরিয়ে দিয়ে নার্গিসের অস্বস্তি দানা বাধে।অস্থিরতায় ভারি হয়ে আসে চারপাশ।যেন তুফান বইছে।অথচ দেখছে না কেউ।
কবির জন্যে মন উতলা হয়ে উঠে।সামাজিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পড়ন্ত বিকেলে ছুঁটে যায় কবির কাছে।দেখল,ঝাঁক বেঁধে যে পাখির উড়ে বেড়ানোর শখ সে বসে আছে গাবগাছের নিচে।একটু হেসে নার্গিসের দিকে তাকাল কবি।যেন কিছুই হয় নি।সব ঠিকটাক চলছে।কবির মনের কথা পড়তে পারে নার্গিস।লোকলজ্জা ভুলে বুকের কাঁপনকে বাড়তে না দিয়ে নিঃসংকোচে কবির পাশে বসে পড়ল।চোখে জল।নার্গিসকে অবাক করে দিয়ে পিঠে হাত রাখল নজরুল।যেন অভয় দিতে চাইলেন।কবির হাত মুঠোয় ভরতে ইচ্ছে করে নার্গিসের।বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় অনন্ত প্রহর।
কবির তরফ থেকে নার্গিসের মামার কাছে বিয়ের প্রস্তাব গেল।দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা চেপে রেখে তাতে সাঁয় দিলেন কনের মা।
বিয়েটাও ঠিক হয়ে গেল যেন।৩ আষাঢ়,১৩২৮ বাংলা।চারপাশে ধুমধাম আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হল।যতটা না কনের বাড়িতে রঙ লেগেছে তারচেয়েও বেশি মামার বাড়িতে আয়োজন ও উৎসাহের মাত্রা বেড়ে গেল দ্বিগুন।শামিয়ানা টাঙানো হল।গায়ক বাদ্যযন্ত্রীদের খবর দেওয়া হল।হ্যাজাক বাতির আলোয় চোখ যেন ঝলসে যায়।পাড়া-প্রতিবেশী ও আমন্ত্রিত অতিথিদের হৈ হুল্লোড় ও পুঁথিগানে জমে উঠে বিয়ে বাড়ি।
তবে আকদের সময় কনের আত্মীয়দের কিছু শর্তে গোলযোগ লেগে গেল।দেনমোহর ঠিক হল ২৫ হাজার টাকা।সেই সাথে শর্ত দেওয়া হল,বিয়ের পর কবিকে দৌলতপুরেই থাকতে হবে।এমন অযাচিত শর্ত শুনে নার্গিসেরও মন খারাপ হয়ে গেল।খ্যাতিকেই যারা বড় পাওনা হিসেবে দেখেছে তারাই কিনা টাকা চাইছে!নজরুলের দূরাবস্থা কি তারা জানে না!দেশজুড়ে যার এত যশ খ্যাতি,তাকে লাগাম পড়ালে কোন যুক্তিতে সে মেনে নিবে!নার্গিসের মন প্রতিবাদ করে উঠে।কিন্তু পাত্রীর মতামত জানানোর উপায় নেই।চারপাশের কোলাহল থেমে গেল।অজানা অমঙ্গলের আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠে।
বিয়ের আসরে বরবেশে দেখা গেল নজরুলকে।নার্গিসের অপেক্ষা যেন ফুরোতে চায় না।
বাসরঘরে বসে আছে।চোখে কাজল দেওয়া হল।কপালে টিকলি,গলায় মায়ের দেওয়া সোনার হার,সাদা পাথরের ছোট্ট নাকের নথ,কানে ঝুমকো,হাতে সোনার বালা,শাড়িতে আতর।সাজগোজের কমতি নেই।কবির চোখ বুঝি ধাঁধায় পড়ে যাবে।উগ্র মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল তনু-মন।
চলবে....
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:০১