পরশ পাথর প্রাপ্তি :পর্ব-১
পরশ পাথর প্রাপ্তি: পর্ব-২
পরশ পাথর প্রাপ্তি পর্ব -৩
পরশ পাথর প্রাপ্তি পর্ব -৩ এ বলা হয়েছে আমাকে গল্প শুনানোর সময় ছোট কাকা বলেছিলেন প্রথম দর্শনেই মহুয়ার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে নদের চাঁদ তৎক্ষণাৎ তার প্রেমেতো পরলই , হাজার টেকার শাল দিল আরো দিল টেকা কড়ি, বসত করতে হুমড়া বাইদ্যারে দিল একখান বাড়ী। উদ্দেশ্য মহুয়া তার এলাকায় স্থায়ী হোক। হুমরা বেদে উপহার গ্রহণ করল , পাশের গ্রাম উলুয়াকান্দায় গিয়ে বাড়ি বানাল। এই পর্যন্ত বলে কাকা শুরু করেছিলেন একটি গান-(অনেক বছর পরে গানের সব কথাগুলি জানতে পারি ময়মনসিংহ গীতিকায় থাকা মহুয়ার কাহিনী পাঠে)
নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা বানলো জুইতের ঘর,
লীলুয়া বয়ারে কইন্যার গায়ে উঠলো জ্বর।
নয়া বাড়ী লইয়া রে বাইদ্যা লাগাইল বাইঙ্গন,
সেই বাইঙ্গন তুলতে কইন্যা জুড়িল কান্দন।
কাইন্দ না কাইন্দ না কইন্যা না কান্দিয়ো আর,
সেই বাইঙ্গন বেচ্যা দিয়াম তোমার গলায় হার।
https://www.kishorgonj.com/মহুয়া-সুন্দরী-ও-নদের-চাঁ/
পরবর্তীতে হাই স্কুলে ক্লাশ নাইনে পড়ার সময়ে বাংলা পাঠ্য বই ‘কিছছা কাহিনী’ নামক সহায়ক গ্রন্থে থাকা কাজল রেখা নামে একটি কিসছা পড়ানোর সময় বাংলার শিক্ষক্ষের কাছে শুনেছি ময়মনসিংহ গিতীকা নামে বাংলা সাহিত্যে বি্খ্যাত একটি ঐতিহ্যবাহী লোকসাহিত্যগাথা পুস্তক আছে, সেখানে 'কাজল রেখা'সহ আরো অনেক বিখ্যাত লোকগাথা আছে। উল্লেখ্য আমার বড় কাকা ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক। কর্মসুত্রে বিভিন্ন সরকারী কলেজে বদলির চাকুরী ও ব্যচেলর কোয়ার্টারে থাকার কারণে উনার বিশাল গ্রন্থ সংগ্রহের বেশীর ভাগই দেশের বাড়ীতে বুক সেলফ সংরক্ষন করে রাখতেন । বই পাগল কাকা উনার মাসিক বেতনের প্রায় অর্ধেকই ব্যয় করতেন পুস্তক ক্রয় ও পুথি সংগ্রহের কাজে।উনার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দেখেছি এমন ভাবেই বই কিনতে । উনার বিশাল সংগ্রহশালায় পুর্ব বঙ্গ ও পশ্চিম বঙ্গের সে সময়কার নামকরা সাহিত্যিকদের প্রায় সকল বইই ছিল। প্রতি বছর ভাদ্র মাসে প্রখর রোদের সময় আমি আর দাদী দুজনে মিলে পুরাতন পুঁথি আর বইগুলি বুকসেলফ হতে বেড় করে রোদে শুকাতে দিতাম যেন বইগুলিতে উইপোকা না ধরে ।অনেক সময় দেখা যেত বেশ কিছু বইয়ে উই পোকা বাসা বেধেছে। বইগুলি রোদে শুকাতে দিয়ে লম্বা কাঠি নিয়ে বসে থাকতাম কাকে যেন সেগুলি তুলে নিয়ে না যায়, কারণ কাক সুযোগ পেলেই পুথির পাতা তার বাসা বানাবার জন্য তুলে নিয়ে যায় গাছের মগডালে তার বাসার ভিতরে।কাকের বাসা থেকে ছিনতাইকৃত পুঁথির পাতা উদ্ধার করতে গিয়ে দেখা যেতো আয়না, চিরুনী, সাবান, সেম্পু,সুতা,কাপড়, শুকনা মরিচ, আদা,রসুন তথা পুরা এক সংসারের জিনিষ রয়েছে কাকের বাসার মধ্যে। যাহোক পুরাতন বই রোদে শুকাতে দেয়ার সময় এক দিন একটি বই এর উপরে লেখা ময়মনসিংহ গীতিকা নাম লেখা দেখতে পাই। মনে পড়ল এইতো সেই ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ যার কথা স্যার ক্লাশে বলেছেন কাজল রেখা কিছসা কাহিনীটি পাঠ দানের সময় ।
ছবি-২ : ময়মনসিংহ গীতিকা
বিশাল গ্রন্থখানি হাতে নিয়ে পাতার পর পাতা উল্টিয়ে কাব্যকারে লেখা অনেক কাহিনী সাথে কিছু ছবি দেখে মনে হল সুন্দর সুন্দর কিছছা কাহিনীর একটি রত্ন খনি পেয়েছি। পরে দিন কয়েক লাগিয়ে রাতে দিনে সবগুলি কাহিনী পাঠ করেছি। এর ভিতর দেখতে পাই বছর পাঁচেক আগে কাকার মুখে গল্পচ্ছলে শুনা মহুয়া ও নদের চাদের কাহিনী।যার কিছুটা পরশ পাথর প্রাপ্তি ৩য় পর্বে উল্লেখ করেছি।
এখন পরশ পাথর প্রাপ্তি ৪র্থ পর্বে স্মৃতি কথা লেখার সময় কাকার মুখে শুনা সেই মহুয়া গল্পের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে খুলে বসলাম ময়মনসিংহ গীতিকা নামের বিশাল গ্রন্থখানি।
এবার প্রথমেই মনযোগ গেল এর ভুমিকা পাঠে, যা ছোটবেলায় গিয়েছিলাম শুধু পাতা উল্টিয়ে ।তখন ভুমিকার বিশাল একটি অধ্যায়ে লেখা পন্ডিতি কথা বাদ দিয়ে সরাসরি চলে গিয়েছিলাম
মহুয়া, মলুয়া, দেয়ান ভাবনা , কাজলরেখা, কঙ্ক লীলা , চন্দ্রাবতী প্রভৃতি মনোমুগ্ধকর কাহিনী পাঠে।
এবার ড.দিনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত ময়মনসিংহ গীতিকার ভুমিকায় থাকা প্রথম লাইনটিই মনযোগ আকর্ষন করে ।সেখানে তিনি লিখেছেন এই গাথাসমূহের সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে ।
ছবি-৩ : চন্দ্রকুমার দে ( সুত্র : Click This Link
এরপর তিনি গাথা সংগ্রহে চন্দ্রকুমার দের ভুমিকা বর্ণনা করেছেন, তাঁর কাজের মূল্যায়ন করেছেন, প্রশংসা করেছেন লোকগাথার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা এবং সেগুলো সংগ্রহের অসীম ত্যাগ তিতিক্ষা এবং পরিশ্রমের কথা উল্লেখ করেছেন:
কি কষ্টে যে এই সকল পল্লীগাথা তিনি সংগ্রহ করিয়াছেন, তাহা তিনি ও তাঁহার ভগবানই জানেন এবং কতক আমি জানিয়াছি। এই সকল গান অধিকাংশ চাষাদের রচনা। এইগুলির অনেক পালা কখনই লিপিবদ্ধ হয় নাই। পূর্ব্বে যেমন প্রতি বঙ্গপল্লীতে কুন্দ ও গন্ধরাজ ফুটিত, বিল ও পুষ্করিণীতে পরম ও কুমুদের কুঁড়ি বায়ুর সঙ্গে তাল রাখিয়া দুলিত — এই সকল গানও তেমনই লোকের ঘরে ঘরে নিরবধি শোনা যাইত, ও তাহাদের তানে সরল কৃষকপ্রাণ ত্নময় হইয়া যাইত। ফুলের বাগানে ভ্রমরের মত এই গানগুলিরও শ্রোতার অভাব হইত না। কিন্তু লোকের রুচি এইদিকে এখন আর নাই। এইগুলি গাহিবারও লোকের অভাব হইয়াছে, যেহেতু এই শ্রেণীর গানের উপর শ্রোতার সেই কৌতুকপূর্ণ অনুরাগ ফুরাইয়া আসিয়াছে। যাহা লিখিত হয় নাই, আবৃত্তিই যাহা রক্ষার একমাত্র উপায়, অভ্যাস না থাকিলে সেই কাব্য-কথার স্মৃতি মলিন হইয়া পড়িবেই। এখন একটি পালাগান সংগ্রহ করিতে হইলে বহু লোকের দরবার করিতে হয়। কাহারও একটি গান মনে আছে কাহারও বা দুইটি, — নানা গ্রামে পর্য্যটন করিয়া নানা লোকের শরণাপন্ন হইয়া একটি সম্পূর্ণ পালা উদ্ধার করিতে পারা যায়। এইজন্য চন্দ্রকুমার প্রতিটি পালা সংগ্রহ করিতে গিয়া অনেক কষ্ট সহিয়াছেন।
বুঝাই যাচ্ছে পল্লীর গাথাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চন্দ্রকুমারের ছিল হৃদয় নিংড়ানো আকুতি? পথ চলতে গিয়ে যখন তিনি কৃষান বালকের কন্ঠে শুনেন
আমার বাড়ীতে যাইওরে বন্ধু খালে হাঁটু পানি
ভিজা চুলে মুছ্যা দিবাম তোমার পা দুখানি
তখন চন্দ্রকুমার বলে উঠেন আহা কি মধুর! কি সুন্দর! থামিও না বালক গাও।’
এমন আবেগমথিত আহবানই ছিল চন্দ্রকুমার দের। সুত্র:কাজী মামুন https://blog.mukto-mona.com/2013/07/20/36241/
চন্দ্রকুমারই বিশ্বখ্যাত ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র সংগ্রাহক। তাঁর সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত পল্লী গাথার ভিত্তিতেই ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের এই অমূল্য সম্পদ।
চন্দ্র কুমার দে যেসব লোকসাহিত্য সংগ্রহ করেছেন সেগুলো দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ গীতিকা (১৯২৩) এবং পূর্ববঙ্গ-গীতিকা (১৯২৩ – ১৯৩২) নামে প্রকাশ করেন। ময়মনসিংহ গীতিকায় অন্তর্ভুক্ত চন্দ্রকুমার সংগৃহীত পালা গুলো হচ্ছেঃ
• মহুয়া (রচয়িতা দ্বিজ কানাই),চন্দ্রাবতী (রচয়িতা নয়নচাঁদ ঘোষ),‘কমলা (রচয়িতা দ্বিজ ঈশান),দেওয়ানা মদিনা (রচয়িতা মনসুর বয়াতী,
• ‘দস্যু কেনারামের পালা (রচয়িতা চন্দ্রাবতী),কঙ্ক ও লীলা, মলুয়া, দেওয়ান ভাবনা, কাজলরেখা ও রূপবতী ।
তাঁর সংগৃহীত যে সমস্ত পালা পূর্ববঙ্গ গীতিকায় ৪ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর কয়েকটির নাম হলঃ ধোপার পাট, মইষাল বন্ধু, কমলা রাণীর গান,দেওয়ান ঈশা খাঁ, ভেলুয়া, আয়না বিবি ও গোপিনী কীর্তন, মসনদ আলী, ফিরোজ খাঁ দেওয়ান, শ্যামারায়ের পালা, শিলাদেবী, আন্ধা বন্ধু, বগুলার বারমাসী, রতন ঠাকুরের পালা, পীর বাতাসী, জিরালনি, সোনারায়ের জন্ম ও ভারাইয়া রাজার কাহিনী।
এই পালাগুলোর অধিকাংশই ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও সিলেট এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
এ ছাড়াও অসংখ্য কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন চন্দ্র কুমার দে । তিনি সংগ্রহ করেছিলেন গ্রাম-বাংলায় ছড়িয়ে থাকা লোকসাহিত্যের আরও নানা নিদর্শন, যার অনেকগুলিই সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে। নিজ গ্রাম থেকে ‘মহাভারতী’ নামে একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন চন্দ্র কুমার। এর একটি সংখ্যাও আজ কারও সংগ্রহে নেই। ‘ত্রিপত্র’ নামে একটি বই ছাড়া তাঁর আর কোন বই প্রকাশিত হয়নি কখনও।
পল্লীর সাধারণ মানুষের রচিত এসব গাঁথা-গীতিকা তখন ঝড় তুলেছিল বিশ্ব সাহিত্যে। বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছিল মর্যাদার আসন। কিন্তু বলা বাহুল্য, চন্দ্র কুমার দে’র নিজ গ্রামে আজ তাঁর কোন স্মৃতি-চিহ্নই নেই। বেহাত হয়ে গেছে তার পৈত্রিক বাস্তুভিটাটি। সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তাঁর অনেক রচনা-নিদর্শনও।
এই উপেক্ষিত চন্দ্রের জীবনটাও ছিল দুঃখে ভরা। খুব অল্প বয়সেই চন্দ্র মাতৃহারা হন। কৈশোরে গ্রামের জমিদার তার পিতার সহায় সম্পত্তি চোখের সামনে কেড়ে নিলে পিতা রামকুমার অচিরেই শোকে দুঃখে পৃথিবীর মায়া কাটান। এরপর পেট বাঁচাতে চন্দ্র নিজ গ্রামের মুদি দোকানে ১ টাকা বেতনের চাকুরী নেয়। কিন্তু ভাবুক ও সাংসারিক বিষয়াদি সম্পর্কে অনভিজ্ঞ চন্দ্রকে কিছুদিনের মধ্যেই ঐ দোকান থেকে অর্ধচন্দ্র পেতে হয়। কিন্তু দোকানের খাতায় হিসাব-নিকাশের বদলে ছড়া-কবিতা লিখে রাখায় মালিক মহা বিরক্ত হয়ে একদিন বিদায় করে দেন তাঁকে। এরপর হতভাগা চন্দ্রকুমার কলেরায় আক্রান্ত হন। পরিত্রাণের আশায় হাতুড়ে চিকিৎসকের স্মরনাপন্ন হযেছিলেন। এতে সুস্থ তো হলেনই না, উপরন্তু মানসিক বৈকল্য দেখা দিল, যা প্রায় দু’বছর স্থায়ী হয়েছিল। এই চরম দুর্দিনে এক গ্রাম্য জমিদার
A4 রামগোপালপুর জমিদার শৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর বাড়ী
তাকে মাসিক ২ টাকা বেতনে তহশীল আদায়ের চাকুরী দেন। এই চাকুরীটিই চন্দ্রের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তহসীল আদায় করতে চন্দ্রকে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরতে হত। ঐ সময়ই তিনি কৃষকদের কণ্ঠে শুনতে পান অপূর্ব সব পল্লী গাথা ও উপাখ্যান। কিন্তু গ্রাম-গ্রামান্তর ঘুরে তহশিলের বদলে তিনি লিখে আনতে লাগলেন পল্লীর গায়েনদের গাঁওয়া উপাখ্যান।
এসব কারণে একদিন এ চাকরিটিও হারাতে হয় তাঁর। এর কিছুদিন পর ময়মনসিংহ হতে কেদারনাথ মজুমদার এর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সৌরভ’ পত্রিকায় চন্দ্রনাথ লেখালেখি করেন ।
উক্ত পত্রিকায় চন্দ্র কুমার দে’র লোক সাহিত্যের উপর কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে সৌরভ পত্রিকায় মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর উপর প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ পড়ে মুগ্ধ হন ড. দীনেশ চন্দ্র সেন। তারপর পত্রিকার সম্পাদক কেদার নাথ মজুমদারের মাধ্যমে চন্দ্র কুমার দে’র সাথে পরিচিত হন এবং তাঁঁকে দিয়ে দিনের পর দিন কষ্টসাধ্য সাধনার মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গীতিকা গুলি সংগ্রহ করান ।
উল্লেখ্য ময়মনসিংহ হতে প্রকাশিত সৌরভ পত্রিকায় পবিত্র কোরানের প্রথম বাংলা অনুবাদকারী গিরিশ চন্দ্র সেন, বাংলার স্বভাব কবি গোবিন্দ দাস, চন্দ্রকুমার দে ও সৌরভ কুমার রায়সহ তখনকার সময়ের নামকরা কবি-সাহিত্যিকগণ লিখতেন।উল্লেখ্য সৌরভ পত্রিকার সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদার ছিলেন একজন ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। তিনি সে সময়ে উত্তর-পুর্ব বঙ্গের ইতিহাস ও সাহিত্যকে সমগ্র বঙ্গ সমাজে পরিচিত করাতে সহায়তা করেছেন ।
ছবি-৫ : কেদারনাথ , সম্পাক, সৌরভ পত্রিকা
লেখালেখির সুবাদে চন্দ্র কুমার দে’র ওপর সুদৃষ্টি পড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে মাসিক ৭০ টাকা বেতনে পালাগান সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করেন।
এরপর শুরু হয় চন্দ্রকুমারের গ্রাম-বাংলার আনাচ -কানাচ থেকে হারানো মানিক খুঁজে বের করার অমানুষিক সংগ্রাম। কেমন ছিল এই সংগ্রাম? চন্দ্রের ভাষায়:
এই সংসার চিন্তা বিব্রত পথিক দুঃখ দারিদ্র্যের বোঝা ঘাড়ে ফেলিয়া যখন পাগলা বন হরিণের মত বাঁশীসুরে উধাও হইয়া ছুটিয়াছিল, পাড়াগায়ের এক হাটু কাঁদা ভাঙ্গিয়া মেঘে ভিজিয়া রৌদ্রে পুড়িয়া কৃষকের গোয়াল ঘরের সাঁঝালের ধারে বসিয়া এই কৃষক গীতি সংগ্রহ করিয়াছে, তখন তাহাকে লোকে ক্ষ্যাপা বলিয়া উপহাস করিতে ছাড়ে নাই।
অপরিসীম ভালবাসা না থাকলে, আত্মত্যাগ না থাকলে কারো পক্ষে সম্ভব এমন সাধকের রূপ পরিগ্রহ করা?
গীতিকা সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত হয়ে চন্দ্র কুমারের যেমন জীবিকার সংস্থান হয়, তাঁর সংগৃহূত এই গীতিকা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের সাহিত্য-দরবারে কাছে পরিচিতি পায়। এর সম্পাদক হিসাবে দীনেশচন্দ্র সেন আন্তর্জাতিক মর্যাদায় অভিষিক্ত হন।
দীনেশচন্দ্রের আলোয় জ্বল জ্বল করে বিশ্বসভায় দ্যুতি ছড়িয়ে যায় ময়মনসিংহ গীতিকা, অনেকটা সম্রাট সাজাহানের তাজমহলের মত করেই। এদিকে আড়ালে-আবডালে, লোকচক্ষুর একেবারে অন্তরালে থেকে যান তাজমহলের আসল কারিগর হতভাগা চন্দ্রকুমারেরা।
তবে একথা সত্য যে দীনেশচন্দ্রের সমর্থন ও উদ্যোগ না থাকলে ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ হয়ত কখনই পৃথিবী জয় করতে পারত না। তাই দীনেশচন্দ্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য এবং অবিস্মরণীয়।
তবে চন্দ্রকুমারের অবদানের গুরুত্ব ,তাঁর প্রচেষ্টা ও ঐকান্তকতা নিয়ে সঠিক আলোচনা ও গবেষনা হলে তার গড়া তাজমহলের উজ্জলতা বাড়বে বই কমবেনা। আমাদের ভাবতে হবে, যে চন্দ্রের আলোয় আমাদের লোকজ তাজমহলটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য ছিল বড্ড প্রয়োজন, তাকে আমরাই নিভে যেতে দিয়েছি, হারিয়ে যেতে দিচ্ছি বিস্মৃতির অতলে!
বিনয়ী চন্দ্রকুমার যদিও নিজেকে উপেক্ষিত ভাবেননি, তবে বাঙালি পাঠককুলে তার মত উপেক্ষিত নায়ক কিন্তু আর একজনও আসেনি। ময়মনসিংহ গীতিকার সুচনা লগ্নে ভুমিকার কিছু অংশ জুরে তাঁর জীবন সংগ্রামের কটি কথা বলেই চন্দ্রকুমারকে অর্ধচন্দ্র প্রদর্শন করা হয়েছে! অথচ তিনি শুধু একজন সাহিত্য প্রেমিই ছিলেন না তাঁর সাহিত্য কর্মের প্রতিভার স্বাক্ষরও তিনি দিয়েছিলেন তখনকার সুধি সমাজে ।
চন্দ্রকুমারের মত এমন একজন ছিলেন বলেই বৃহত্তর ময়মসসিংহের ভাটি অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মনি-মুক্তো আমরা বের করে আনতে পেরেছি। কিন্তু কি সন্মান দিয়েছি সেই বিরল মুক্তো সংগ্রাহককে?
চন্দ্রকুমার সম্বন্ধে ডঃ দীনেশ সেন তাঁর ময়মনসিংহ গীতিকার ভূমিকায় যে-পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তার আসল পরিচয়টাই অনেকটাই অজ্ঞাত রয়ে গেছে। যার একক কীর্তি সমস্ত বঙ্গ সাহিত্যে এক উচ্চ স্থানের দাবী রাখে- তাকে আমরা শুধু একজন সংগাহকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছি। আমাদেন ব্লগার নুরু ভাই অনেকের জন্ম ও মৃত্যু দিবস উপলক্ষে অনেক পোষ্ট দিয়ে থাকেন । চন্দ্রকুমারের প্রতি উনার দৃস্টি আকর্ষন হলে আমরা তাঁর বিষয়ে আরো অজানা অনেক কথা জানতে পারতাম ।
দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর সম্পাদিত জগদ্বিখ্যাত ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ ও ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’য় তথ্যদাতা হিসেবে চন্দ্রকুমারের পরিচয় সন্নিবেশ করেছেন, তাকে বিনে পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন, অনাথ ও চিররুগ্ন চন্দ্রকুমার যখন স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে সংসার নির্বাহ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তখন দীনেশচন্দ্র তাকে চাকুরী-থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চন্দ্র শুধু সংগ্রাহকই রয়ে গেছেন, হতে পারেননি নায়ক।বিনয়ের অবতার চন্দ্রকুমার নীজেই বলেন:
দীনেশচন্দ্র আমার সংগৃহীত ভাঙ্গা ইটে আজ বঙ্গ ভাষার বিচিত্র তাজমহল গড়িয়া তুলিয়াছেন, আমি তাহার মজুর মাত্র। তিনি এ বিরাট যজ্ঞভূমির অধিনায়ক হোতা। আমি শুধু সমিধ কাস্ঠ বহন করিয়াছি মাত্র।
তবে বাংলা ১৩৩৬ সনে ময়মনসিংহ শহরে অনুষ্ঠিত ‘সারস্বত সাহিত্য সম্মিলনে’ চন্দ্রকুমার দে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন, যার উপসংহারে তিনি বলেন:
আমি ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক। আমি হীন নহি-উপেক্ষিত নহি-ইহার চাইতে গর্ব গৌরব করিবার জিনিস আমার কিছুই নাই। আমার ময়মনসিংহ আজ সমগ্র জগতের মধ্যে তাহার সন্মানের আসন বাছিয়া লইয়াছে ( লেখা সুত্র: কাজীমামুন : https://blog.mukto-mona.com/2013/07/20/36241/ )
বাংলা ১৩৪৬ সনে (১৯৩৯) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মৃত্যুর প্রায় বছর দুয়েক আগে দীনেশচন্দ্র সেনকে এক পত্রে লেখেন:
ছবি-৬ : ১৯১৩ সনে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
“বাংলা প্রাচীন সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি কাব্যগুলি ধনীদের ফরমাসে ও খরচে খনন করা পুষ্করিণী; কিন্তু ময়মনসিংহ গীতিকা পল্লী হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে স্বত উচ্ছ্বসিত উৎস, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছ ধারা। বাংলা সাহিত্যে এমন আত্ম-বিস্মৃত রসসৃষ্টি আর কখনো হয় নি।“-রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর
ময়মনসিংহ গীতিকা ইংরেজী ভাষায় অনূদীত হয়ে প্রকাশের পর বিদেশের সুধীবৃন্দকে প্রবল ভাবে আকৃষ্ট করে। বিশেষ করে মনীষী রোমা রোলাঁ, ড. সিলভা লেভি, স্যার জর্জ গ্রীয়ারসন, উইলিয়াম রদেনস্টাইন, ফ্রান্সিস. এইচ. স্ক্রাইন, ই.এফ. ওটেন ময়মনসিংহ গীতিকা সম্পর্কে উচ্চসিত প্রশংসা করেন।
ছবি-৭: ১৯১৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত ফরাসী দার্শনিক রোমা রোঁলা
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ গ্রন্থে বলেন-‘গীতিকা গুলোর সাহিত্যিক মূল্য বিদেশী সাহিত্য রসিকেরা কি দিয়াছেন, তাহা জানিলে বোধ হয় আমরা আমাদের ঘরের জিনিসকে একটু বেশি আদর করিব।’
ময়মনসিংহ গীতিকার সাহিত্য মূল্য অসীম। গীতিকাগুলি প্রধানত নায়িকা প্রধান। মহুয়া পালার নায়িকা যখন জল আনতে নদীর ঘাটে যায় তখন নায়ক নদ্যার চাঁদের সাথে ভীরু প্রণয়ীর সসঙ্কোচ আত্মনিবেদনে চিরন্তন প্রেমের পরিবেশ পাওয়া যায়। অসাধারন ব্যঞ্জনাময় তার প্রণয়ের প্রকাশ। যেমন-
‘‘জল ভর সুন্দরী কন্যা জলে দিছ ঢেউ ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।।’’
শুধু তাই নয় মহুয়ার রূপের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ নায়ক নির্লজ্জের মত তার প্রেমের প্রকাশ করে অকাতরে। যেখানে নেই কোন আধুনিক প্রেমের ভনিতা।
‘‘কঠিন আমার মাতা-পিতা কঠিন আমার হিয়া ।
তোমার মত নারী পাইলে আমি করি বিয়া।।’’
প্রেমিকাকে নিজের করে পাবার যে বাসনা তা পূরনে প্রেমিক যে কোন অবলম্বন গ্রহণ করতে পারে।
‘‘কোথায় পাইবাম কলসী কন্যা কোথায় পাইবাম দড়ি।
তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুব্যা মরি।।’’
চিরন্তন গ্রামীণ সরল পরিবেশ, অতিথি পরায়নতা, মানুষের সাথে মানুষের বন্ধনের এক অকৃত্রিম রূপ আমরা ময়মনসিংহ গীতিকায় দেখতে পাই।
‘‘আমার বাড়িত যাইওরে বন্ধু বইতে দিয়াম পিড়া।
জলপান করিতে দিয়াম শালি ধানের চিড়া।।
শালি ধানের চিড়া দিয়াম আর ও শবরী কলা।
ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা।।’’
ময়মনসিংহ গীতিকার অধিকাংশ গীতিকায়ই প্রণয়মুলক। এতে গ্রামীণ প্রেমের বর্ণনা অপূর্ব রূমান্টিকতায় বর্নিত। কাজল রেখা, মহুয়া, মলুয়া, লীলা, চন্দ্রাবতী প্রভৃতি গীতিকার নায়িকাদের প্রেম ও ত্যাগের গভীরতা আমাদের মর্মকে স্পর্শ করে নিবিরভাবে।
এই পল্লীগাথার রমণীরা অনেকবার কুলধর্ম বিসর্জন দিয়েছেন, কিন্তু কখনোই নারী ধর্ম ত্যাগ করেন নি । বরঞ্চ নারীধর্মের যে সমস্ত মুর্ত্তিগুলি এই সকল গাথায় পাওয়া যাচ্ছে তারা পতিরত্যে ,বুদ্ধির তীখ্নতায় ,বিপদে ,ধর্যে উপায়-উদ্ভববনায় এবং একনিষ্ঠায় আতুল্য। এই গীতিকায় জাতি বিচার কুলশীল পদমর্যাদা সমস্তই প্রেম রত্নাকরের অতল জলে ডুবে গিয়েছে, এরা মুক্ত গগনের সীমাহীন পথের পথিক। প্রেম পারিজাত স্পর্শে এরা প্রাণ ত্যাগ করেও অমর হয়েছেন এরা কোন গৃহের সম্পর্কিত নহেন, এরা পরস্পরের প্রতি উদ্দাম, অনুরাগ ভিন্ন অন্য কোন বিধি মানে নাই, এদের ধর্ম নাই পরস্পরের জন্য এরা কোন গৃহ সুখ কল্পনা করে নাই ।
ময়মনসিংহ গীতিকার পালা গুলোর মাঝে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির অপূর্ব সম্মিলন পাওয়া যায়। যা চিরায়ত অসা¤প্রদায়িক বাঙ্গালী চেতনার পরিচয় বহন করে।
ময়মনসিংহ-গীতিকায় থাকা মহুয়া’র( প্রাচীন পল্লী নাটিকা)বন্দনা গীতিতেইতা পরিস্ফুট যথা
বন্দনাগীতি
পুবেতে বন্দনা করলাম পুবের ভানুস্বর( ভানুর ইশ্বর=শিব)
এক দিকে উদয়রে ভানু চৌদিকে পশর
দক্ষিণে বন্দনা গো করলাম ক্ষিরো নদী সাগর ।।
যেখানে বানিজ্জ করে চান্দ সদাগর।।
উত্তরের বন্দনা গো করলাম কৈলাস পর্বত।
যেখানে পড়িয়া গো আছে আলীর মালামের পাথ্থর ।।
পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা হন স্থান ।
উর্দিশে বাড়ায় বাড়াই ছেলাম মমিন মুসলমান ।।
সভা কইরা বইছ ভাইরে ইন্দ(হিন্দু) মুসলমান
সভার চরণে আমি জানাইলাম ছেলাম ।।
চাইর কোনা পির্থিমিবী গো বইন্ধ্যা মন করলাম স্থির।
সুন্দরবন মুকামে বন্দলাম গাজী জিন্দাপীর।।
আসমানে জমিনে বন্দলাম চান্দে আর সুরুয।
আলাম-কালাম বন্দুম কিতাব আর কুরাণ।।
কিবা গান গাইবাম আমি বন্দনা করলাম ইতি ।
উস্তাদের চরণ বন্দলাম করিয়া মিন্নতি ।
বন্দনাগীতি সমাপ্ত
গ্রামের সহজ সরল যে মানুষের হাতে এত অপূর্ব সুন্দর সাহিত্য সৃষ্টি হয় সেই সকল লৌকিক কবির প্রতি হাজার প্রনাম ও সালাম।
যাহোক শেষ জীবনে ময়মনসিংহ শহরের নওমহলে দুই শতাংশের একটি বাড়ি কিনেছিলেন চন্দ্র কুমার। ওই বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর সে বাড়িটিও বিক্রি করে দেয়া হয়। চন্দ্র কুমারকে দাহ করা হয়েছিল ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে কেওয়াটখালি শ্মশানঘাটে। তাঁর পরিবার-পরিজনরা সেখানে ছাতাকৃতির একটি স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকবাহিনী সে স্তম্ভটিও ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়। এ ভাবেই দিন দিন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে থাকেন চন্দ্র কুমার দে। বললে- বাড়িয়ে বলা হবে না যে, তাঁর নিজ গ্রামের নতুন প্রজন্মের অনেকে আজ তাঁর নামটিও জানে না।
সত্যি বলতে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি এবং রস হৃদয়ঙ্গম করতে আমাদের এখনো বাকি রয়েছে। আর সেই সমৃদ্ধির অন্যতম কারিগর চন্দ্রকুমার প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলী ।
জলা জঙ্গলাকীর্ণ ময়মনসিংহের গ্রামগুলি পালার পটভূমি । ওই অঞ্চলের অধিকাংশই বনভূমি চর নদ-নদী, ছোট খাল , শাখা নদী , বিশাল বিশাল বিল বা হাওর পরিবেষ্টিত হয়ে অনেকানেক গ্রাম দ্বীপের মত জেগে থাকে । পর্বত গাত্র বেয়ে যেমন নেমেছে নদী,তেমনি নেমেছে হিস্র-সর্প-ব্যাঘ্র-সঙ্কুল ঘন অরণ্যভুমি।ঝিল ও তরাগ,কুড়া পাখির গুরুগম্ভীর শব্দেনিনাদিত আকাশ, বার দোয়ারী ঘর, সানবাঁধা পুকুর ঘাট ,স্বর্ণপ্রসু শালিধানের ক্ষেত, সুরভিময় কেয়াবন-সবমিলে এক বিচিত্র নিসর্গ শোভা।
দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহ-গীতিকার ভুমিকায়লিখেছেন’বাঙ্গালার মাটির যে কি অকর্ষন তাহা স্বভাবের খাটি সৃষ্টি, এইগীতিগুলিতে দৃষ্ট হইবে। বাঙ্গালার চাঁপা, বাঙ্গালার নাগেশ্বর ও কুমুদ ফুল,বাঙ্গালার কুটিরেকুটিরে কি চমতকার দেখা ,এই সাহিত্যের পথেঘাটে তাহারনিদর্শন আছে।বর্ষার কদম্ববৃক্ষ ,মান্দার গাছের ডালে-ঘেরা কদলী বন,নদীর ধরে কেয়া ফুলের ঝাড়,মুক্তাবর্ষী প্রস্রবণপ্রতিম বৃহত তরুশাখা হইতে অজস্র বকুল ফুলেরদন- কাব্য বর্ণিত কর্মশলার মাঝে মাঝে উঁকি মারিয়া আমাদের শ্রম অপনোদন ও চোখের তৃপ্তি ঘটাইয়া যায় । কোথাও বর্ণনার বাহুল্য নাই অথচ কৃষকের দৃষ্টি যেরূপ কিছুতেই মাথার উপরকার আকাশ ও চোখের সামনের শ্যামল বনরাজি এড়াইতে পারেনা , এই কাব্য সাহিত্যের নানা ঘটনার মধ্যেপরিপাশ্বিক শোভা দৃশ্যগুলিও সেই রূপ পাঠকের অপরিহার্য্য সহচররূপে সঙ্গে সঙ্গে থাকিবে ।
একটু মনযোগী হয়ে পাঠ করলেই গীতিকার প্রতিটি পালায় স্বতন্ত্র ভোগলিক পাকৃতিক পরিবেশের চিত্র স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এবার আসা যাক ময়মনসিংহ গীতিকায় থাকা কয়েকটি পালার কথায় ।
মহুয়া
https://upload.wikimedia.org/wikisource/bn/3/39 /মৈমনসিংহ_গীতিকা_(প্রথম_খণ্ড)_-_দীনেশচন্দ্র_সেন.pdf
নমশূদ্রের ব্রাহ্মণ দ্বিজ কানাই নামক কবি প্রায় ৪০০ বৎসর পূর্বে এই পালা গান রচনা করেন। ধারনা করা হয় এর রচনাকাল ১৬৫০ সন ।মহুয়া পালায় ১৭৫৫টি ছত্র আছে যা ২৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত করে ময়মনসিংহ গীতিকায় প্রকাশিত হয়েছে ।প্রবাদ আছে এর রচয়িতা দ্বিজ কানাই নমসুদ্র সমাজের অতি হীনকুল-জাতা এক সুন্দরীর প্রেমে মত্ত হয়ে অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন ।এজন্যই নদের চাঁদ ও মহুয়ার কাহিনীতে তিনি এরূপ প্রাণঢালা সরলতা প্রদান করতে পেরেছিলেন। নদের চাঁদ ও মহুয়ার গান এক সময়ে পূর্ব ময়মনসিংহের ঘরে ঘরে গীত অভিনীত হতো, কিন্তু উত্তরকালে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কঠোর সাসনে এই গীতিবর্ণিত প্রেম দুর্নীতি বলে প্রচারিত হয়। এবং হিন্দুরা এই গানে উৎসাহ দিতে বিরক্ত হন । চন্দ্রকুমার বহুকষ্টে এই গীতিকবিতার অংশ উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছেন । গীতিকার প্রথম ১৬ স্তোত্র জনৈক মুসলমান গায়ক রচিত। গীতি বর্ণিত ঘটনার স্থান নেত্রকোনার নিকটবর্তী। নেত্রকোনার বৃস্তিত ‘তলার হাউর’ এর পূর্বে বামন কান্দি, বাইদার দিঘি, ঠাকুরবাড়ির ভিটা উলুয়াকান্দির অবস্থান রাজকুমার নদের চাঁদ ও মহুয়ার স্মৃতি বহন করতেছে।
মহুয়াকে ধনু নদী পারের কাঞ্চনপুর গ্রাম হতে চুরি করে ছিল হুমরা নামের এক বেদে ।
ময়মনসিংহ-গীতিকা
মহুয়া
( প্রাচীন পল্লী নাটিকা)
বন্দনাগীতি
পুবেতে বন্দনা করলাম পুবের ভানুস্বর১( ভানুর ইশ্বর=শিব)
এক দিকে উদয়রে ভানু চৌদিকে পশর২
দক্ষিণে বন্দনা গো করলাম ক্ষিরো নদী সাগর ।।
যেখানে বানিজ্জ করে চান্দ সদাগর।।
উত্তরের বন্দনা গো করলাম কৈলাস পর্বত।
যেখানে পড়িয়া গো আছে আলীর মালামের পাথ্থর ।।
পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা হন স্থান ।
উর্দিশে বাড়ায় বাড়াই ছেলাম মমিন মুসলমান ।।
সভা কইরা বইছ ভাইরে ইন্দ(হিন্দু) মুসলমান
সভার চরণে আমি জানাইলাম ছেলাম ।।
চাইর কোনা পির্থিমিবী গো বইন্ধ্যা মন করলাম স্থির।
সুন্দরবন মুকামে বন্দলাম গাজী জিন্দাপীর।।
আসমানে জমিনে বন্দলাম চান্দে আর সুরুয।
আলাম-কালাম বন্দুম কিতাব আর কুরাণ।।
কিবা গান গাইলাম আমি বন্দনা করলাম ইতি ।
উস্তাদের চরণ বন্দলাম করিয়া মিন্নতি ।
বন্দনাগীতি সমাপ্ত
Maimonsingha-GitikaVol.1,No.2 Ed.3rd
হুমরা বেদে
উত্তরে না গারো পাহাড় ছয় মা্ইস্যা পথ ।
তাহার উত্তরে আছে হিমানী পর্বত।।
হিমানী পর্বত পারে তাহারই উত্তর ।
তথায় বিরাজ করে সপ্ত সমুদ্দর ।।
চান্দ সুরুয নাই আন্দারিতে ঘেরা ।
বাঘ ভাল্লুক বইসে মাইন্সের নাই লরাচর।।
বনেতে করিত বাস হুমরা বাইদ্যা নাম।
তাহার কথা শুন কইরে ইন্দু মুসলমান ।।
ডাকাতি করিত বেটা ডাকাইতের সর্দ্দার ।
মাইন্কানামে ছুডু ভাই আছিল তাহার ।।
ঘুরিয়া ফিরিয়া তারা ভ্রমে নানান দেশ।
অচরিত ( ) কাইনী কথা কইবাম সবিশেষ ।।
আর ভাইরে,
ভর্মিতে ভর্মিতে তারা কি কাম করিল ।
ধনু নদীর পারে যাইয়া উপস্থিত অইল ।।
ছবি-৯ : ধনু নদী
কাঞ্চনপুর নামে তথা আচিল গেরাম।
তথায় বসতি করিত বির্দ্দ এক বরাম্মন।।
ছয় মাসের শিশু কইন্যা পরমা সুন্দরী ।
রাত্রি নিশাকালে হুমরা তারে করল চুরী ।।
চুরী না কইরা হুমরা ছাইরা গেল দেশ ।
কইবাম সে কন্যার কথা শুন সবিশেষ ।।
ছয় মাসের শিশু কন্যা বচ্ছরের হইল ।
পিঞ্জরে রাখিয়া পঙ্খী পালিতের লাগিল।।
এক দুই তিন করি শুল বছর যায় ।
খেলা কছরত তারে যতনে শিখায় ।।
সাপের মাথায় যেমন খাইক্যা জ্বলে মণি।
যে দেখে পাগল হয় বাইদ্যার নন্দিনী ।।
বইদ্যা বাইদ্যা করে লোকে বাইদ্যা কেমন জনা ।
আন্ধার ঘরে থইলে কন্যা জলে কাঞ্চা সোনা।।
হাট্টিয়া না যাইতে কইন্যার পায়ে পরে চুল ।
মুখেতে ফুট্টা উঠে কনক চাম্পার ফুল ।।
াআগল ডাগল আখিরে আসমানের তারা ।
তিলেক মাত্র দেখলে কইন্যা না যায় পাশুরা।।
বাইদ্যার কইন্যার রূপে ভাইরে মুনীর টলে মন।
এই কইন্যা লইয়া বাইদ্যা ভরমে তিরভুবন ।।
পাইয়া সুন্দরী কইন্যা হুমরা বাইদ্যার নারী ।
ভাব্যা চিন্তা নাম রাখল “মহুয়া সুন্দরী”।।
ষোল বছর কেটে গেছে। ডাকাতি ছেড়ে হুমরা বেদে হয়ে স্থায়ী হয়েছেন গারো পাহাড়ের অনেকটুকু উত্তরে যেখানে হিমানী পর্বত, তারও উত্তরে যেখানে বাঘ-ভাল্লুক ভিন্ন প্রানীর দেখা মেলা ভার, সেই অন্ধকার জঙ্গলে।
হুমরা বাইদ্য্ দল বল নিয়ে ঘুরে বেড়য় দেশ দেশান্তরে।
আর সেই শিশুকন্যা? সে থাকে হুমরা বেদের সাথেই, হুমরা তাকে খেলা শেখায়, বেদে’র কৌশল শেখায়। ষোড়শী কন্যাকে যেই দেখে সেই পাগল হয়- সাপের মাথায় যেমন থাইক্যা জলে মণি, যে দেখে পাগল হয় বাইদ্যার নন্দিনী। কাঁচা সোনা হয়ে হুমরা বেদের অন্ধকার ঘর আলোকিত করে রাখে সে, হাট্টীয়া না যাইতে কইন্যার পায়ে পরে চুল, মুখেতে ফুট্টা উঠে কনক চাম্পার ফুল। তার ডাগর ডাগর চোখের তাঁরার আলোয় পথ খুঁজে হুমরা তাকে নিয়ে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ায়। পাইয়া সুন্দরী কইন্যা হুমরা বাইদ্যার নারী, ভাব্যা চিন্ত্যা নাম রাখল “মহুয়া সুন্দরী”
মহুয়ার চরিত্রগুলো হলো- নদের চাঁদ, মহুয়া, হুমরা বেদে। এর রচনাকাল ধরা হয় ১৬৫০ সাল। এই পালায় মোট ৭৮৯টি ছত্র আছে।সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদ ছিলেন এক জমিদারের দেওয়ান। অপর পক্ষে রূপবতি মহুয়া বেদে সরদার হুমরা বেদের পালিত কন্যা, যাকে শিশুকালে হুমরা বেদে নেত্রকোণার কাঞ্চণপুর থেকে ডাকাতি করে নিয়ে আসে। জানা যায়, বেদে মহুয়াও এক সভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন।
বেদেরা ঘাটে ঘাটে নোঙ্গর ফেলত ও হাট বাজারে পাড়ায় সাপের খেলা দেখাত। বেদে মহুয়া যখন নদের চাঁদের গ্রামে সাপের খেলা দেখাতে আসে তখন মহুয়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে নদের চাঁদ তাকে প্রণয় নিবেদন করে। মহুয়াও নদের চাঁদের প্রণয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করে। কিন্তু দুজনের প্রণয়ের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সরদার হুমরা বেদে।
ততততত
গভীর নিশিতে মহুয়ার সঙ্গে নদ্যার ঠাকুরের পুনর্মিলন
ফাল্গুন মাসে চল্যা যায়রে চৈত্র মাস আসে।
সোনার কুকিল কু ডাকে বইস্যা গাছে গাছে।।
আগ রাঙ্গিয়া সাইলের ধান উঠ্যাছে পাকিয়া ।
মধ্য রাত্রে নদ্যার চান উঠিল জাগিয়া ।।
শীর ছিল আর বাশিটি তুইল্যা নিল হাতে ।
ঠার দিয়া বাজাইল বাশী মহুয়ায় আনিতে।।
আসমানেতে চৈতার বউ (বউ কথা কও পাখী)ডাকে ঘনে ঘন।
বাশী শুন্যা সুন্দর কইন্যার ভাঙ্গ্যা গেল ঘুম।।
সুখে ঘুমায় বাইদ্যার দল নয়া ঘরে শুইয়া
ঘরের বাইর হইল কইন্যা পাগল হইয়া ।
শেষ বিদায়- মহুয়ার উক্তি
শুন শুন নদ্যার ঠকুর বলি যে তোমারে
এই না গেরাম ছাড়্যা যাইবাম আমি নিশাকালে।।
মাও মাপে সঙ্গে কইরা ছাইরা যাইবো বাড়ী ।
তোর সঙ্গে যাইয়াম রে বন্ধু হইয়া দেশান্তরী।।
তোমার সঙ্গে আমার সঙ্গেরে বন্ধু এই না শেষ দেখা
কেমন কইরা থাকবাম আমি হইয়া অদেখা ।।
আমি যে অবলা নারী আছে কুল মান।
বাপের সঙ্গে নাহি গেলে নাহি থাকব মান।
পড়্যা রইলো বাড়ী জমি পড়্যা রইলা তুমি।
মন কইরা পাগল মনে বান্ধ্যা রাখাম আমি।।
আর না শুনবাম রে বন্ধু তোমার গুণের বাশী।
আর না জাগিয়া বন্ধু পুয়াইবাম নিশি।।
মনে যদি লয়রে বন্ধু রাখ্যো আমার কথা।
দেখা করতে যাইও বন্ধু খাওরে আমার মাথা।।
যাইবার কালে একটি কথা বল্যা যাই তোমারে।
উত্তর দেশে যাইও তুমি কয়েক দিন পরে ।।
পরদিন
বাঁশ লইল দড়ী লইল সকল লইয়া সাথে।
পলাইল বাইদ্যার দল আইন্ধ্যারিয়া রাতে।।
মহুয়া পৃ: ১৭
এক দিন নদের চাঁদ মহুয়াকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এদিকে হুমরা বেদে তা জানতে পেরে দলবল নিয়ে তাঁদের পিছু ধাওয়া করে। অবশেষে তারা মহুয়া এবং নদের চাঁদকে ধরে ফেলে। হুমরা বেদে নদের চাঁদকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সরদার মহুয়ার হাতে বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে বলে ‘‘যাও নদের চাঁদকে মেরে ফেল’’। বিষলক্ষা ছুরি নিয়ে মহুয়া নদের চাঁদের দিকে এগিয়ে যান। নদের চাঁদের সম্মুখে পৌছে বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে তিনি তাঁর নিজের বক্ষ বিদীর্ণ করেন এবং মাটিতে ঢলে পড়েন। প্রণয় পিয়াসী নদের চাঁদ মহুয়ার এই আত্মত্যাগ সহ্য করতে না পেরে প্রেমের প্রতিদান সরূপ বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে নিজ জীবন আত্মহুতি দেন। মহুয়া ও নদের চাঁদের এই আত্ম ত্যাগ চিরন্তন প্রেমকে মহিমান্বিত করেছে। আজও সেই প্রেমের অমর কহিনী লোক মুখে মুখে বিরাজমান।
দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় লিখেছেন, ”মহুয়ার প্রেম কী নির্ভীক, কী আনন্দপূর্ণ! শ্রাবণের শতধারার ন্যায় অশ্রু আসিতেছে, কিন্তু প্রেমের মুক্তাহার কণ্ঠে পরিয়া মহুয়া চিরজীবী, মৃত্যুকে বরণ করিয়া মৃত্যুঞ্জয়ী হইয়াছে”।
চন্দ্রাবতী
বাংলা ভাষার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী (1550 থেকে11 600 ) চন্দ্রাবতীর নিজের জীবন কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে বিখ্যাত পালা চন্দ্রাবতী । নয়নচাঁদ রচিত মৈমনসিংহ গীতিকায় এটা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ।
চন্দ্রাবতীর বাবা দ্বিজবংশি ছিলেন বিখ্যাত মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা। এই মহিলা কবির জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার নীলগঞ্জ স্টেশন এর কাছাকাছি পাতুয়াইর গ্রামে ।চন্দ্রাবতীর উল্লেখযোগ্য রচনা হলো ‘দস্যু কেনারাম ও মলুয়া । দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত মৈমনসিংহ গীতিকায় এ দুটিও স্থান পেয়েছে ।
নয়নচাঁদ ঘোষ রচিত চন্দ্রাবতী পালা থেকে জানা যায় চন্দ্রাবতীর জীবন ইতিহাস ছিল বড়ই করুণ এবং বিয়োগান্তক। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন সাহিত্য প্রতিভাদীপ্ত নারী তেমনি ছিলেন পরমা সুন্দরী ও প্রেমিক মনের অধিকারী ।
চন্দ্রাবতী নীজ পরিচয় ও গৃহপরিচয় এভাবে দিয়েছেন -
ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়।
বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়।।
ভট্টাচার্য্য বংশে জন্ম, অঞ্জনা ঘরণী।
বাঁশের পাল্লায় তালপাতার ছাউনি।।
ঘট বসাইয়া সদা পূজে মনসায়।
কোপ করি সেই হেতু লক্ষ্মী ছেড়ে যায়।।
দ্বিজবংশী পুত্র হৈল মনসার বরে।
ভাসান গাইয়া যিনি বিখ্যাত সংসারে।।
ঘরে নাই ধান-চাল, চালে নাই ছানি।
আকর ভেদিয়া পড়ে উচ্ছিলার পানি।।
ভাসান গাইয়া পিতা বেড়ান নগরে।
চাল-কড়ি যাহা পান আনি দেন ঘরে।।
বাড়ীতে দরিদ্র জালা কষ্টের কাহিনী।
তাঁর ঘরে জন্ম নিলা চন্দ্রা অভাগিনী।।
চন্দ্রাবতীর হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন জয়ানন্দ নামের এক যুবক, তিনি ছিলেন চন্দ্রাবতীর খেলার সাথী ও সহপাঠী । কৈশুর উত্তীর্ণ হলে জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর সম্পর্ক প্রেমে গড়ায়, চন্দ্রাবতী কাব্যে তার স্পষ্ট উল্লেখ আছে।
তেমনি চন্দ্রাবতীর পুর্বরাগে রয়েছে সুন্দর ছবি
ডাল যে নুয়ায়ে ধরে জয়ানন্দ সাথী
তুলিল ম’লতি ফুল কন্যাচন্ত্রবতী ।
একদিন তুলি ফুল মালা গাথি তায়
সেইতো না মালা দিয়া নাগরে সাজায়।।
-চন্দ্রাবতী পৃ:১০৩
কিন্তু চন্দ্রাবতীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার পরও জয়ানন্দ এক মুসলিম নারীর প্রেমে আসক্ত হন। পরে চাপে পরে ধর্মান্তরিত হয়ে তাকে বিয়ে করেন। চন্দ্রাবতী এ বিয়োগ ব্যথা মেনে নিতে পারেননি । বিরহ অভিমানে তিনি স্থির করেন কুমারী থেকে শোদ্ধাচরিনীর মতো শিব পূজায় মনোনিবেশ করে জীবন কাটিয়ে দেবেন । পিতাকে এই ইচ্ছার কথা জানালে পিতা ফুলেশ্বরী নদীর তীরে শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
কবির ভাষায়
অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে
শিব পূজা করো আর লেখ রামায়ণে
সকাল-বিকাল শিবের পূজা আর রামায়ণ রচনা এই হল চন্দ্রাবতীর কাজ।
চন্দ্রাবতীর লেখা আসমাপ্ত রামায়ণ সংকলিত হয়েছে পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকার চতুর্থ খণ্ডে। চন্দ্রাবতীর রামায়ণকে অনেকে দুর্বল এবং অসমাপ্ত বলে সরিয়ে রেখেছিলেন। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পাঠে বিস্ময়াভূত নবনিতা দেব সেন বলেছেন যে, এটি দুর্বল বা অসমাপ্ত কোনোটিই নয়। এটি একজন নারীর দ্বারা রচিত কাব্য যেখানে রামের গুণগান না করে তিনি সীতার দুঃখ ও দূর্দশার দিকটাই বেশি তুলে ধরেছিলেন যা তৎকালীন পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধাচারণ হিসাবে দেখা হয়েছিল। ফলে তিনি অন্য পালার জন্য খ্যাতি পেলেও রামায়ণ রচয়ীতা হিসাবে গুরুত্ব পান নি।
দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণের সাথে মেঘনাদবধের আশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর ধারণা মেঘনাদবধ কাব্য রচনার আগে মাইকেল মধুসুদন দত্ত চন্দ্রাবতীর রামায়ন পড়েছেন এবং তারই প্রভাব পড়েছে মেঘনাদবধে (সুত্র: পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা – দীনেশচন্দ্র সেন)
ওদিকে আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হতে থাকলেন জয়ানন্দ। একদিন সন্ধ্যায় দরজা বন্ধ করে চন্দ্রাবতী মন্দিরে পূজা করছিলেন। অনুশোচনায় দগ্ধ জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। কিন্তু অভিমানী চন্দ্রাবতী মন্দিরের দরজা খুললেন না। বাইরে দাঁড়িয়ে অনুনয়-বিনয় করলেন জয়ানন্দ। মন্দিরের সামনে বেদীতে মালতী ফুলের রস দিয়ে চারছত্রের একটি পদে চন্দ্রাবতী ও গৃথিবীকে চির বিদায় জানিয়ে সেখান থেকে চলে গিয়ে ফুলেশ্বরীর জলে আত্মাহুতি দেন। কবির ভাষায় জয়ানন্দের কবিতাটি ছিল এমন
শৈশব কালের সঙ্গী তুমি যৌবন কালের সাথী
অপরাধ ক্ষমা করো তুমি চন্দ্রাবতী ।
পাপীষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সন্মত
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত।।
অনেক দেরীতে চন্দ্রাবতী মন্দিরের কপাট খুলে কবিতাটি দেখতে পান ।তিনি বুঝতে পারেন জয়ানন্দের আগমনে দেবালয় অপবিত্র হয়েছে। তাই তার লেখা কবিতাটি ধুয়ে ফেলার জন্য কলসি নিয়ে নদীর ঘাটে জল আনতে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন ফুলেস্বরীর জ্বলে তার প্রেমিক জয়ানন্দের প্রাণহীন দেহ ভাসছে । এ দৃশ্য দেখার পর চন্দ্রাবতীর মনেও তীব্র অনুশোচনা জেগে উঠে। তিনিও জয়ানন্দের মতো ফুলেশ্বরীর জলে প্রাণ বিসর্জন দেন।কালের বিবর্তনে এখন আর ফুলেশ্বরী নদীর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু শিবমন্দির আজও চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দের অমর প্রেমের ট্রাজেডি বুকে ধারণ করে নিজস্ব মহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়ে সবাই অবশ্য একমত নন। নয়ানচাঁদ নিজেও তাঁর চন্দ্রাবতী পালাগানে চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়ে কিছু বলেন নাই। কারো কারো মতে নদীর ঘাটে মৃত অবস্থায় জলে জয়ানন্দের লাশ ভাসতে দেখে তীব্র অনুশোচনায় চন্দ্রাবতীও পরবর্তীতে ফুলেশ্বরী নদীর জলে ঝাঁপিয়ে জয়ানন্দের মত অনুগামী হন। আবার কারো মতে, জয়ানন্দের জলে ডুবে আত্মহত্যা বা মৃত্যুর কিছুদিন পরপরই শোকাবিভূত চন্দ্রাবতী মর্মান্তিক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। দীনেশ্চন্দ্র সেন মৈমনসিংহ-গীতিকার ভূমিকায় লিখেছেন, “প্রবাদ এই যে, প্রেমাহতা চন্দ্রা জয়চন্দ্রের শব দর্শন করার অল্পকাল পরেই হৃদরোগে লীলা সংবরণ করেন।“
অপরদিকে ব্রজেন্দ্রকুমার দে তাঁর মঞ্চনাটক ‘কবি চন্দ্রাবতী’-তে দেখিয়েছেন যে, শোক এবং অপমান থেকে বাঁচার জন্য চন্দ্রাবতী নিজেই গিয়ে ফুলেশ্বরীর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন।
তবে যেভাবেই হোক, হৃদয়ে গভীর আঘাত নিয়ে তীব্র মনোযাতনায়, অসামান্য প্রতিভাবান বাংলার এই প্রথম নারী কবির মৃত্যু হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর মত অভাগিনী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। নিজেকে ধুপের মত পুড়িয়ে তিনি যে কাব্য সৌরভ পরিবেশন করে গিয়েছেন অনাগত সময়ের জন্য তার খবর শহরে মানুষেরা রাখে নি। কিন্তু পল্লীর মানুষেরা তা ভোলে নি। তাঁদের মুখে গীত হয়ে দুখিনী কবি চন্দ্রাবতী আজো বেঁচে আছেন।
চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির এবং তাঁর অসংখ্য লোকগীতিকে কেন্দ্র করে কাচারিপাড়ায় চন্দ্রাবতী মেলার আয়োজন বাংলার আদি কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিকে অমলিন রাখার একটি উৎকৃষ্ট উদ্যোগ হতে পারে বলে অনেকের অভিমত।
পরশ পাথর প্রাপ্তি ৫ম পর্বে ময়মনসিংহ গীতিকায় থাকা অনান্য পালাগুলির উপর আলোচনায় অংশ গ্রহনের জন্য আম্ন্ত্রন রইল ।
ছবিসুত্র : কৃতজ্ঞতার সহিত গুগল অন্তর্জাল ও যথাস্থানে উল্লেখিত সুত্র সমুহ
তথ্যসূত্র
১. Dr. Dinesh Chandra Sen. History of Bengali Language
And Literature (A Series of Lectures Delivered As Reader
To The Culcutta University), vol.1,Gyan Publishing
House, 2007, ISBN-13: 978-8121209359, 2007
২. Bengali Folk-Ballads from Mymensingh and the Problem
of Their Authenticity" by Dusan Zbavitel Review by:
Niharranjan Ray, Indian Literature. 1964; 7(2):127-129.
Sahitya Akademi, Stable URL: https://www.jstf
or.org/stable/23329262
৪. বদিউজ্জামান সম্পাদিত , মোমেনশাহী গীতিকা, বাংলা একাডেমি,ঢাকা, একাত্তর।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ৩:৪৫