somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বন্ধু হতে চেয়ে তোমারঃ গল্প (সম্পুর্ণ)

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[ছেলেবেলায় কোনো পাগল দেখলে জিজ্ঞেস করতাম, ‘ এই পাগল, তোর পাগলি কই?’ পাগল নিশ্চুপ থাকতো... একা একা বিড় বিড় করতে করতে বিভ্রান্ত মস্তিষ্ক নিয়ে চলে যেত। তখন খুব জানতে ইচ্ছে করত সে কি বলছে। আজ অনেক বড় হয়েছি! এতোটা বড় হয়েছি যে কল্পনায় সেই পাগলকে নিয়ে আসতে পারি। শুধুই কি তাই? ওর হারিয়ে যাওয়া পাগলিও সাথে থাকে। তবে এরা ডিজিটাল যুগের পাগলা-পাগলি। আমার খুব পরিচিত এক ক্যাম্পাসে এই জুটি পাগলা-পাগলি হিসেবে বেশ খ্যাত। এই গল্পে সঙ্গত কারনে ছদ্মনামে এদের পরিচয় দিয়েছি। নিজেদের ভিতর খুব উচ্চ মার্গের সংলাপে এরা ব্যস্ত থাকে। এদেরকে নিয়েই কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। তবে সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ এগুলো পড়ে পাগল হলে আমি দায়ী থাকবো না কিন্তু...]

১.

একদিন কথা হচ্ছে দুজনার।

পাগলঃ ‘ কি ভাবছ?’

পাগলিঃ ‘ ভাবছি কৃষ্ণচূড়ার রং এতো লাল কেন? লালের প্রতি কঠিন একটা মোহ আছে আমার। কেমন মাতাল মাতাল লাগে!

- ‘তোমায় আমি সেই লাল এর উৎসমুখে নিয়ে যাবো একদিন। সেখানে দিগন্ত বিস্তৃত রক্তিম আভা নিয়ে সারি সারি কৃষ্ণচুড়া! এ জগতকে রাঙানোর কাজে এতোটাই ব্যস্ত যে বিশ্বচরাচরের আর কোনোদিকে ওদের খেয়াল নেই।‘

: ’ জানো, আমার জানালায় যে গাছটা উঁকি দিচ্ছে, তার গায়ে পাতার চেয়ে ফুল বেশী। সবসময় যেন আমাকে প্রলুব্ধ করছে!'

-‘ হ্যা, ঠিক তোমার মতো! পাতার চেয়ে ফুল বেশী... তুমি যতটা না নারী তাঁর থেকে প্রেমিকা বেশী... ভালবাসার ডালি নিয়ে অপেক্ষারত একজন বিশেষ কেউ!

:’ উফ! আমাকে মাটির এক হাত উপরে তুলে দিচ্ছ কেন বলতো?

-‘ আচ্ছা এখুনি নামিয়ে আনছি। তবে ওখানে গেলে মাতাল হবার সকল উপকরণও তুমি পাবে। দেখব কতটা মাতাল হতে পারো!’

:’ ইস...মাতাল হতে আমার বয়েই গেছে! তবে তুমি পাশে থাকলে আমি এমনিতেই অবসন্ন হয়ে যাই!’

-‘ এবার কি আমাকে ওপরে তুলে দিতে চাও?’

:’ নাহ! চল হাত ধরে এক সাথে কিছুক্ষণ হাঁটি...’

আর একদিন...

কাঁটা পাহাড়ের ছোট্ট যাত্রী ছাউনিতে আমাদের পরিচিত সেই পাগল তাঁর পাগলিকে নিয়ে বসে আছে। আকাশের অবস্থা খুব গম্ভীর। যে কোনো মুহুর্তেই মনে হয়ে কেঁদে ফেলবে। ওরা দুজন বসে আছে... গল্প করছে...

পাগলঃ 'দেখেছ মেঘগুলো আকাশকে কি করেছে? কেমন ভয়ংকর লাগছে না ওদেরকে!'

পাগলিঃ - কি হাস্যকর কথা বলছ তুমি! মেঘ আবার ভয়ংকর হয় নাকি... মেঘ মানে তো আকাশের মন খারাপ...

' ঠিক আমার মতো?'

- তোমার বুঝি মন খারাপ?

' কেন বোঝনা? আকাশের পানে আর আমার দিকে তাকিয়ে দেখ... কিংবা নিজের মনকে জিজ্ঞেস কর...'

- বাহ রে! মানুষ আর আকাশ কি এক হতে পারে...!

' কেন পারে না? আকাশের মতো উদার বিশাল হতে তো তোমরাই আমাদেরকে বল! বল না?'

- মেঘ আকাশের শুদ্ধ আত্মা... অভিমানী রূপ। অভিমান কি পুরুষের সাজে? আকাশ হল নারীর মতন, মেঘ তাঁর অশ্রুজল...

' নাহ! শুধু তোমাদেরই সাজে?'

- রাগ করলা বুঝি?

' রাগ করলে কি করবে? রাগ ভাঙ্গাবে? আমাকে মানাবে? যা চাই তা দিবে?'

- কি চাও? বাদাম খাবে? নাও খাও...

' নাহ! ইস যদি আকাশ হতে পারতুম! তাও তোমার অশ্রু জলের কাছাকাছি তো থাকতাম। তোমার শুভ্র জলের উষ্ণ পরশ মাখিয়ে নিতাম সারা দেহে।'

- হি হি হি... আচ্ছা এতো কিছু থাকতে আমার চোখের জল ই চাইলে তুমি?!

' কীভাবে বুঝলে শুধু ওটাই চেয়েছি? আর সেই 'এতো কিছু' গুলো কি? আমায় বলবে?'

- নাহ! বলব না। ... মানুষ তাঁর প্রিয়ার মুখে হাসি দেখতে চায় আর তুমি অশ্রু?!

' ওটা যে আনন্দাশ্রু জানু! আনন্দজল ও বলতে পারো, তবে সেটা বলাতে আবার শ্রুতিকটু কিংবা ভাষাগত বিভ্রম হবে নাতো?'

-যাও, ফাজলামো কর না।

' আমি আগেই বলেছিলাম। কি রাগ করলে?'

-হ্যা!

' এখন উপায়? কি করলে রাগ কমবে শুনি?'

-আমার কথা শুনতে হবে। শুনবে?

' কোনটা শুনি নি?'

-না, বল শুনবে?

' আগে বলই না ?'

-চল বৃষ্টিতে ভিজি!

' মাথা খারাপ?! তোমার না সাইনোসাইটিসের প্রব্লেম?'

-তুমি সাথে আছ না জানু! আর কোনো প্রব্লেম নেই।

' আমার সমস্যা আছে।'

-তোমার আবার কি সমস্যা?

' আমার হিংসা হয়।'

-কাকে নিয়ে?

' বৃষ্টির প্রতি... '

-মানে?

' তোমার সাথে সারাদিন ঘুরে ঘুরে কি পাই? বাদামের খোসা রাখার জন্য খালি ঠোঙ্গা... না হয়, চুল ছেড়ে দিবে তুমি- চুলের কাটা পরম নির্ভরতায় থেকে যায় আমার হাতে...

-এর সাথে বৃষ্টির সম্পর্কটা বুঝলাম না?

‘বুঝলে না? বৃষ্টি না চাইতেই তোমার সারা শরীরে ইচ্ছেমত ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে! তোমাতে অবগাহন করে সে মৃদু লয়ে-কখনো বা বেগে না হয় টিপটিপ... টিপটিপ... ঝিরঝিরে অনুভুতির শিহরণ জাগানোর অলিখিত অধিকার সে পেয়ে গেলো না চাইতেই!’

-আর?

‘ তোমার ক্ষীন কটিকে কামড়ে ধরা ঐ একটুকরো আকাশ রঙ্গা সিফন শাড়ি, যা পারেনি লুকোতে তোমার হৃদয়কে ঢেকে রাখা মাংসল পাহাড়। দেখ, কি অবলীলায় সে ওগুলোকেও লেপ্টে দিয়ে দলিত-মথিত করে যায়... আর ব্যঙ্গ করে আমায়! ‘

-উফ! আর শুনতে চাই না। থামো, থামো।

‘ না, শোনই না।‘

-আর শুনবো না। এর থেকে আজ না হয় বৃষ্টিই হও তুমি! তোমার কথার শরের থেকে অন্তত কম আঘাত দেবে!

‘বলছ?’

-হ্যা! চল, আজ তোমার আকাশের মন খারাপ। আমি নারী-আমায় ইচ্ছেমত খাবলে খুবলে আঘাত করে যদি তার মন ভালো করা যায়?

‘পিঞ্চ মারছ?’

-না সাহেব, চল, আজ তোমার আকাশে এই মেঘ বালিকা নিজের স্বরূপ উন্মোচন করবে। যার জন্য এতোদিন অপেক্ষা করে আছ। তোমায় আর বাদামের খোসা রাখার ঠোঙ্গা হাতে বয়ে বেড়াতে হবে না... কিংবা চুলের কাঁটার সযতন আবাসভুমি হবে না তোমার হাত।

‘ আমি আসলে কথার কথা হিসাবে বলেছিলাম... ‘

-চল, এখন আর ব্যাক করার সুযোগ নেই তোমার।

কাটা পাহাড়ের নির্জন পীচঢালা পথে পাগলি পাগলের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। ওদের দুজনের ওপর প্রচন্ড এক হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বৃষ্টি। চারিদিক অন্ধকার.. আর এর মাঝে সাদা ফোটা ফোটা হয়ে ঝরে পড়া আকাশের আনন্দজল আদিম উচ্ছ্বাসে ওদের দুজনকে শিহরিত করে... কামনার জমাট বাঁধা ঠান্ডায় কেঁপে ঊঠে একে অপরের চোখে তাকিয়ে ইচ্ছেমতো পুড়ে যাবার জন্য যথেষ্ট এক ফায়ারপ্লেস দেখতে পায়!!

২.

জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়েরা বসে আছে। চ্যাট করছে। লাইব্রেরীর বারান্দায়। এখানে ওয়াইফাই এর নেট বেশী পাওয়া যায়। অধিকাংশই মোবাইলে নেট ইউজ করছে। ল্যাপটপ এবং ট্যাবের সংখ্যাও কম নয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকলেও কেমন একটা প্যাটার্ণ আপনাতেই এসে গেছে। চারুকলার যে ছেলেটি ওর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বসে আছে... তাঁর চোখের ভাষা পড়তে ব্যস্ত... ওকে বললেই সে এই প্যাটার্ণটি এঁকে দিতো!

দক্ষিণ পাশের এল সেপ কোনাটিতে পাগলি পাগলকে নিয়ে...

পাগলি চশমা পড়ে আছে। ক'দিন ধরে খুব জ্বালাচ্ছে তাঁর চোখ দুটো । শেষে ডাক্তারের শরনাপন্ন... এবং এখন চার চোখ নিয়ে পাগলের পাশে বসে থাকা। থেকে থেকে পাগল হাসছিল। অনেকক্ষণ এটা বুঝতে পারলেও এতোক্ষণ কিছু বলেনি পাগলি। এবারে আর সহ্য হল না। ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে বলল,

- কি ব্যাপার? সেই কখন থেকে তোমায় দেখছি হেসেই যাচ্ছ?

' আমার হাসতে কি মানা নাকি? আমি কি রামগরুরের ছানা?'

- দেখ ঢং করবা না। এমনিতেই চোখের জ্বালায় অতিষ্ট... তোমার যন্ত্রণা টলারেট করতে পারব না বাপু আগেই বলে দিচ্ছি।

' ওকে ওকে ... '

- বল কেন হাসছিলে?

' তোমাকে দেখে!'

-মানে? আমি এখন হাসির পাত্র হয়ে গেলাম?

' পাত্র নয় পাত্রী'...

রাগে চোখ থেকে চশমা খুলে নিল... অভ্যাস নাই বলে বার বার খুলে পাশে রেখে চলেছিল এতোক্ষণ। মুগ্ধ হয়ে পাগল তাকিয়ে ছিল। এবারে আরো বেশী হল। রাগে পাগলি ফনা তোলা সাপের মত ফোঁস ফোঁস করছে। তাল মিলিয়ে ওর উদ্ধত বুক দুটোও ঊঠানামা করছে। আর কাকের চোখের মত কালো চোখ দুটি যেখানে অনবরত পাগল হারিয়ে যায়, সেগুলো জলন্ত অঙ্গার কখন হয়ে উঠবে সেই অপেক্ষায় ছিল সে। কিন্তু বিনা মেঘে আষাঢ়ের বৃষ্টি নামছে সেই দু'চোখ বেয়ে। হতভম্ব পাগল... আশেপাশে তাকায়... একটু কি বিব্রত বোধ করে?

' কি হল? এ্যাই, আমি দুষ্টুমি করেছি...'

- হি হি হি... তো আমি কি করছি?

চোখ দিয়ে ঝরে পড়া মুক্তোবিন্দুর দিকে তাকিয়ে পাগল হাস্যরত ওর প্রিয়াকে দেখে অবাক হয়। ইতোমধ্যে সে রুমাল দিয়ে নিজেকে ফ্রেশ করছে...

- তুমি কি মনে করেছ আমি কাঁদছি?

' তো কি করছিলে? হাসছিলে? সবাই কীভাবে দেখছিল...'

- এতেই মন খারাপ হয়ে গেলো? একেবারে ছেলেমানুষ! শোন, জীবনে কখনো চশমা পড়েছি? আজ সেই তখন থেকে চুলকাচ্ছে। আর আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরেই ঐ ঢল নেমেছিল ।

' এখন তো দেখছি একেবারে আগুনে রং ধরেছে তোমার চোখ! চল আর কাজ করতে হবে না... বন্ধ কর... '

দেশের সব থেকে বড় শহীদ মিনারের দিকে ওরা হেঁটে যায়। ল্যাপটপের ব্যাগ কাঁধে পাগলির ডান হাত ধরে পাগল জীবনের পথ ধরে আগায়। শহীদ মিনারকে মাঝে রেখে বৃত্তাকারে সবুজ ঘাসের গালিচা আর যায়গায় যায়গায় ফুলের গাছ... ছোট-বড়-মাঝারি... আর ঝোপওয়ালা... এক কালারফুল জগৎ! ঘাসের কার্পেটে পাগলের কোলে মাথা রেখে পাগলি শুয়ে আছে। বিকেলের অস্তগামী সুর্য তাঁর কোমল হাসিতে ওদেরকে আশীর্বাদ করছে... নাম না জানা পাখীরা ওদেরকে গান শোনাচ্ছে... রং বে রঙের প্রজাপতি ঊড়ছে... কখনো কাছে আসছে... পরক্ষনেই দূরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ধরা দিচ্ছে না! জীবনটাও তো এমনি... তাঁর আসল রূপ নিয়ে কারো কাছেই ধরা দেয় না।পাগলির কথায় পাগলের ধ্যান ছুটে যায়...

- এ্যাই শুনছ!

' হ্যা!'

- আমি চশমা বাদ দিয়ে লেন্স নিলে কেমন হয়? কালার লেন্স?

' খুব খারাপ হয়'

- মানে?

' তোমার চোখ এমনিতেই সুন্দর!'

- কেমন সুন্দর? কি রং আমার চোখের? বলতো?

'এই তো ঝামেলায় ফেলে দিলে... কখনো কালো... কখনো মনে হয় বাদামী... আর সময়ে সময়ে আগুনে রূপ ধারণ করে!'

- ব্যাখ্যা কর, প্লীইইইজ...

' যখন তোমার হৃদয় উপত্যকাকে চোখের মুগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে ছুঁয়ে দেই, তখন শান্ত নদীর কালো জলের মতো তুমি অপেক্ষার প্রহর গোনো। তখন কালো...

-তারপর!

' একটু কাছে গিয়ে উপত্যকার বন্ধুর পথে হাঁটার জন্য ডিভাইডার গুলোকে সরানোর চেষ্টা করতেই ও দুটো বাদামী হয়ে যায়'

- আর শেষটা?

' ওটা বললে তুমি আমাকে এখুনি পোড়াতে চাইবে'

- না চাইব না।

' তোমার হৃদয় উপত্যকাকে আমি অনুভব করতে চাইলেই ওগুলো আগুনের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নেয়... আমি ভয়ে নিজেকে আবার সেই শান্ত জলের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসি।'

- তাঁর মানে আমার আবেগের উপর চোখের রঙের ওঠানামা?

' হ্যা! ব্যাপারটা তো সেরকমই মনে হচ্ছে...। হাহ হা হা'

পাগলি এবার উঠে বসে।

পাগলের সাথে সামনা সামনি... চোখে চোখ রাখে...

পাগল একটা ঢোক গিলে... দেখে পাগলির চোখ আগুনে রং ধারণ করেছে !

পাগলি হাসে... হীরের কুঁচির মত জ্বলজ্বলে চোখে ও হাসতেই থাকে।

- আমার আগুনে চোখের অর্থ তুমি এতোদিন যা জেনে এসেছ সেটা ভুল ছিল জানু! তোমাকে আমার হৃদয় উপত্যকা থেকে নামিয়ে দেবার জন্য নয়... উপত্যকায় তোমার ইচ্ছেমতো বিচরণ করে... প্রবল এক ঝড় হয়ে আমাকে এলোমেলো করে দেবার আহ্বানেই ও দুটো আগুন হয়ে উঠতো! কিন্তু আফসোস! তুমি বুঝলে না বন্ধু...

' এখন ও তো বেশী দেরী হয়নি!'

একে অপরের দিকে তাকায়।

বোঝার মাঝেও কিছু যেন বাকি রয়ে যায়... সেই না বোঝাকে খুব নিবিড়ভাবে বুঝতে ওরা দুজন নিজেদের অজান্তে খুব কাছে এসে যায়। দিনের আলোয় সবার সামনে থেকেও ওরা খুব কাছাকাছি চলে আসে। সবুজ ঘাসের গালিচা আহবান করে... পাখীরা লজ্জায় মুখ লুকায়... আর প্রজাপতি রঙিন চাদর দিয়ে ওদেরকে ঢেকে দেয়!

আদম -হাওয়া ছাড়া এখন আর কোথাও কেউ নেই...

সৃষ্টি সুখের উল্লাসে সমগ্র প্রকৃতি ও কাঁপছে।

৩.

-তুমি আমাকে আর ছোঁবে না

' কেন হঠাৎ আবার কি হল?'

- ছোঁবে না, ব্যস।

আমাদের পরিচিত পাগল-পাগলি নতুন কলা ভবনের সামনের সিঁড়িতে বসে আছে। ওদেরকে পাগল ও পাগলি হিসাবে পরিচয় করালেও ওদের যার যার নাম রয়েছে। শিহাব ও রুনা। এরাই ওরা। আজ রুনার মন খারাপ। ভীষণ খারাপ।

এবং বিমর্ষ।

সকাল থেকেই হৃদয়ের ঈষাণ কোণে কালো মেঘের আনাগোনা সে টের পাচ্ছে।একটা অমূলক ভয় ভিতরে কাজ করছে। শিহাবের উপস্থিতিও সেটা কাটাতে পারছে না। মোট কথা আজ ওর আকাশে একরাশ কালো মেঘ, অন্য দিনের চেয়ে ভিন্ন বার্তা নিয়ে এসেছে।

শিহাবঃ ' আমি কি কোনোভাবে তোমাকে হার্ট করেছি?'

রুনাঃ - জানি না। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

' চলো দুজনে হাত ধরে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াই'

- তুমি কি আমার শরীর ছাড়া আমাকে কল্পনা করতে পার না? যখনি কাছে আসবে শুধু ধরা ধরি আর ছুঁয়ে দিতে চাও... কেন ?

' হোয়াট?!'

- হৃদয়টা কি তোমার কাছে কোনো মাইনে রাখে না?

' আমি কোনো হৃদয় বিশেষজ্ঞ নই'

- তবে কি তুমি? একজন ডোম? যে মৃতদেহকে ব্যবচ্ছেদ করায় আনন্দ পায়?

' তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?

- স্যরি...

দুজনে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। শিহাব পকেট থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করে। রুনার দিকে সম্মানজনক দূরত্ব রেখে ওটা বাড়িয়ে দেয়।

- কি ওতে?

' খুলে দেখ'

র‍্যাপিং পেপারে মোড়া ক্ষুদ্র প্যাকেটি খুলেই আশ্চর্য হয়ে যায় রুনা।

একটু আনন্দ...বিস্ময় এবং পেয়েও হারানোর বেদনা ওকে তাড়িত করে। একটু কষ্টও কি মনকে ব্যথাতুর করে দেয় ?! ... বিচিত্র এক ভাব মুহুর্তেই খেলা করে যায় ওর ভিতর।

ঘাস ফুলের অতি সাধারণ দু'টি ফুল যাকে কানের দুলে রূপ দেয়া হয়েছে। রুনা যে কোনো ধরণের অলঙ্কার ব্যবহারের বিরোধী। সে নিজেকে সকল সাজগোজ এবং প্রসাধনী মুক্ত রেখে চলে। এটা শিহাব ভালোই জানে।

- এটা কেন?

' তুমি তো আর কৃত্তিম জিনিস পড়বে না... তাই অনেক খুঁজে খুঁজে এই দুটো সংগ্রহ করলাম। এতে তোমার নিয়মের ব্যাঘাত ঘটবে না। তুমি নারী... তোমাতে আর প্রকৃতি এক হবে এগুলো পড়লে!'

- তবে তুমি নিজে পড়িয়ে দাও!

' নাহ! তোমাকে আর যদি ছুঁয়েছি কখনো!

- এখন আমি বলছি!

' কি পেয়েছ আমাকে? ইচ্ছে হল কাছে আসবে, ইচ্ছে হল দূরে ঠেলে দেবে?'

ঘাস ফুল দুটির দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে রুনা। এরপর যখন সে কথা বলে শিহাবের কানে তা মনে হয় যেন কোনো দূর গ্রহ থেকে কেউ কথা বলছে... যাতে হৃদয় নিংড়ানো কষ্ট এবং না পাওয়ার বেদনা মিশে আছে।

- তুমি আমি দুজনেই ইতিপুর্বে হৃদয়ের ব্যাপারে অন্য কারো কাছ থেকে ফিরে এসেছি। সোজা কথায় আমরা রিজেক্টেড। যাকে ভালোবাসতাম তাঁকে পেতে চেয়েছি পাগলের মতো... কিন্তু তাঁর মন ও শরীর দুটোই হাফ ডান পাওয়া হয়েছে আমার... একটা অতৃপ্তি- অসম্পুর্ণতা আমাকে আগ্রহহীনা করে ফেলেছে... আমি একা থেকেও একা ছিলাম না। অতীত আমাকে বেঁধে রেখেছিল। আমার পৃথিবীটা আমি আমার মত গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলাম... যেখানে বন্ধুরা ওয়েলকাম বাট প্রেমিক নইব নইব চ...

' এটা তোমার অনুভুতি। এর ভিতরে আমি এলাম কীভাবে?'

- তুমিও যে কোনোভাবেই হোক প্রত্যাখ্যাত হয়ে মোমের মত গলানো হৃদয় নিয়ে আমার কাছে এলে। তোমার মনটা একেবারে শুন্য হয়েছিল। আমিও একটা শুন্য মন খুঁজছিলাম... যেখানে আমি নিজের মত করে বসত গেঁড়ে তাকেও আমার শুন্য মনে নিয়ে আসতে পারি। যে প্রথমে আমার বন্ধু হবে... ধীরে ধীরে একজন অন্যজনে অবগাহন... সমর্পণ... কিন্তু তুমি তোমার ছেলেমানুষি আর উচ্ছলতা দিয়ে যেভাবে আমাকে আকর্ষণ করছিলে... একসময় নিজেকে ধরে রাখা আমার জন্যও টাফ হয়ে পড়ল। আমি তোমার রিক্তের বেদনাকে আড়াল করে দিতে, তোমাকে এবং আমার নিজেকেও একটু সুখী দেখতে চেয়ে ভেসে গেলাম।

' তাই?'

- হ্যা! এবং কি অদ্ভুত ব্যাপার জানো, ভেসে গিয়েই বুঝলাম কি করছি আমি... ফিরতে চাইলাম। তবে তোমাকে কষ্ট দিতেও মন চাইছিল না। আমি কি করব বল এখন?

' প্রথমত; মনটাকে আর শুন্য ভেব না। যেভাবেই হোক আর যাই হোক কিছু তো পেয়েছ। নিজেকে শুন্য হতে দিও না। আমি এই মুহুর্ত থেকে তোমাকে বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রতিটি মানুষ আলাদা... তুমি যা ভাবছ সেটা তোমার ভাবনা, আমারটা আমার নিজের। তোমার একটা কথা অবশ্য ঠিক। বন্ধুর চেয়ে আপন আর কেউ হয় না। নিজের অভিজ্ঞতায় বলছি, সম্পর্কের ভেতর থেকে দেখেছি, বাইরে থেকেও দেখেছি!'

- তুমি আমাকে আরো বোঝ... আমি তোমার হাত ধরে সময়ের ওপর সব ছেড়ে দিলাম... এবং আমি এই মুহুর্ত থেকে দরোজার বাইরেই কমফোর্ট ফিল করছি। এখন আমার হাত ছেড়ে দেয়া কিংবা আরো শক্ত করে ধরে থাকা তোমার ব্যাপার।

' একসময় হয়তো তুমি দরোজা অতিক্রম করতে পারবে... তবে সেটা কত দিন...মাস...বছর লাগবে আমরা কেউ জানি না!'

- আমি একটা বন্ধু চেয়েছি, যে আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে কিন্তু আমার ভেজা শরীর তাঁকে টানবে না... আমি তাঁর সাথে পুকুরের এপার থেকে ওপারে সাঁতড়িয়ে যেতে চাই... আমি ওড়না পড়ি না, এটা সে দেখবে না!

' আমি ওড়নার নীচের সব কিছু এতো দেখেছি যে ওটা আমার না দেখলেও চলবে'

- আবার শুরু করলে?

' না, সিরিয়াস মুড থেকে একটু রিল্যাক্স মুডে আসার চেষ্টা করলাম। তোমার দিক থেকে একে অপচেস্টা ও বলতে পারো।'

ঘাসফুলের কানের দুল দুটিকে দেখিয়ে রুনা শিহাবকে বলে,

- এখন কি এগুলো আমাকে পড়িয়ে দেবে?

' না, যেদিন তোমার প্রেমিক থেকে বন্ধু হতে পারব, সেদিনই ও দুটো পড়াবো।'

- প্রোমিজ? নাকি রাগ করে বলছ?

' ইটস আ জেন্টেলম্যান প্রোমিজ... এন্ড আই রিয়েলি মীন ইট'

- বেশ! তবে এগুলো আমি যত্ন করে রেখে দিচ্ছি সেদিনের অপেক্ষায়।

'আচ্ছা।'

- একটা কথা, তুমি যেদিন ওটা করে দেখাতে পারবে, সেদিন কদম ফুটবে। আমি নিজে সেই কদমের অপেক্ষায় রইলাম!

' কদম কত ভাগ্যবান! কেউ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে... আর আমি?'

- যাও!... তোমাকে ও কদম দেয়া হবে

' না, আমি কদম প্রদানকারিনীকে চাই!'

একজন প্রেমিক তাঁর প্রেমিকাকে নিয়ে পাশাপাশি হেঁটে চললো। আশেপাশে আরো অনেকে হাত ধরে চলছে... কিন্তু সে প্রেমিক থেকে আগে বন্ধু হবার সাধনায় নেমেছে। তাই নিরাপদ দূরত্বে থেকেই দুজনে হৃদয়ের কাছাকাছি থাকার আপ্রাণ চেষ্টারত... রুনার আকাশের কালো মেঘগুলো সাদা মেঘবালিকায় পরিণত হয়েছে। শিহাব সেই মেঘবালিকাদের দেখে দেখে পথ চলছে।

৪.

ক'দিন ধরে ঝগড়া... কথা বন্ধ রুনা ও শিহাবের।

মামুলি এক ব্যাপার নিয়ে। প্রায়ই এমন হয় ওদের দুজনের ভিতর। ভীষণ ছেলেমানুষ ওরা।

শিহাবের খুব ইচ্ছে করছে রুনাকে এক নজর দেখতে। কিন্তু ইগোর বেড়াজাল ডিঙ্গাতে পারছে না সে।মোবাইল হাতে নিয়ে সেভ করা পরিচিত নাম্বারটি বের করেছে অনেকবার... সবুজ বাটনটিতে জাস্ট একটা প্রেস করাটা যে এতো ভারী হয়ে উঠবে- আগে কি কখনো ভেবেছে সে? এরকম অস্থিরতায় কেটে গেলো কয়েকটি দিন।

একদিন গভীর রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে শিহাবের ঘুম ভাঙ্গে। এক সমুদ্র ঘামের মধ্যে ভাসতে ভাসতে সে জেগে উঠে। স্বপ্নটা এতোটাই বাস্তব যে তাঁর রেশ যেন শিহাবের সারা ঘরে ছড়িয়ে আছে... তাঁর প্রিয়া চলে যাচ্ছে তাঁকে ছেড়ে!

বুকের গভীরে চিনচিনে ব্যাথাটা বাড়ে... পানি খায়... কিন্তু অস্থিরতা কমে না।

ঘড়ি দেখে শিহাব।

রাত তিনটা।

জানালার পর্দা সরাতেই ঘরের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ে জোছনা... তাঁকে বলে দেয়, " পাহাড়ী বৃষ্টিতে আমার ভেজা হয়ে গেছে... এখন কেবল আর একটা ইচ্ছেপূরন বাকি। সেও হয়ে যাবে... পাহাড়ি পূর্ণিমার তরল আগুনে পুড়ব বলে অপেক্ষায় আছি কখন গৃহত্যাগী জোছনা উঠে..."। শিহাবের চোখ ভিজে উঠে... তাঁর কেবল মনে হতে থাকে এই জীবনে রুনার মিষ্টি মুখটি সে বুঝি আর দেখতে পাবেনা!

ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ে শিহাব।

রুনার বাসার পথে এগোয়।

গোকুলনগর থেকে সিএন্ডবি কম দূরে নয়... কিন্তু শিহাব যেন উড়ে চলে।

শিহাব যখন রুমার বাসার সামনে পৌঁছায় ততোক্ষণে তাঁর হাঁফ ছুটে গেছে... বাসার গেটে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়... আকাশের পানে তাকায় চিবুক সোজা করে। হ্যা... রুনার রুমে ডিম লাইট জ্বলছে... ফ্যান ঘুরছে আর তাতে প্রবল ঝড় উঠেছে জানালার পর্দায়।

ঝড় উঠেছে শিহাবের বুকেও... খুব কাছ থেকে খুব সন্তর্পনে প্রিয়াকে দেখতে পেয়ে আবেগী ঝড়!! পকেট থেকে সেল ফোন বের করে শিহাব। কিছুক্ষণ হাতে নিয়ে পরিচিত নাম্বারটির ওপর হাত বুলিয়ে যায়... যেন রুনার হৃদয়ের দুই অলিন্দেই তাঁর ঘোরা হয়ে গেলো। নিশ্চিন্ত... ক্লান্ত... তবে একটা পরম নির্ভরতা অনুভব করছে।ওর প্রিয়া শান্তিতে ঘুমাচ্ছে! কি দরকার ওকে সেখান থেকে জাগানোর? সে যে এসেছিল সেটা সে নাই বা জানলো... আর ভালোবাসায় দেখানোটা কম... উপলব্ধিটা বেশী হওয়া উচিত।

যে পথ দিয়ে সে এসেছিল চরম উদ্ভ্রান্তের মত... মোবাইল পকেটে রেখে সে পথ দিয়েই পায়ে পায়ে ফিরে যায় শিহাব।

জানালার পর্দা বাতাসে উড়ছে। তারই ফাঁক দিয়ে রুনা শিহাবকে চলে যেতে দেখে। একটা অপসৃয়মান ছায়ার মতো রুনাকে হৃদয়ে নিয়ে ফিরে গেলো মানুষটা!

সে কেন এসেছিল?

এসেছিলোই যখন ওকে ডাকলো না কেন?

মোবাইল বের করেও ফোন করল না কেন?

এতোগুলো কেন'র উত্তর কি জানা হবে কখনো??

ভাবতে ভাবতে রুনা নিজে এটা বিস্মৃত হল, ঠিক এই সময়ে সে ঘুম থেকে উঠে জানালার পাশে কিসের জন্য দাড়িয়েছিল? প্রকৃতি আমাদেরকে নিয়ে খেলা করে... অনেক রহস্য দেখিয়ে দেয়... আবার এমন অনেক সহজ কিছুও দেখতে দেয় না... ভুলিয়ে দেয়। আর এই ভুল-ভোলানি খেলার একটা মাত্র যায়গাই সে বেছে নিয়েছে...সকল অনুভুতির জন্ম হয় যেখানে... সেই হৃদয়!!

৫.

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজাপতি মেলায়... বিভিন্ন যায়গা থেকে দলবেঁধে- একা একা অথবা জোড় বেঁধে সুন্দরের প্রতি চিরন্তন আকর্ষনে সবাই এসেছে। সব বয়সের নারী-পুরুষ- শিশু রয়েছে। এ যেন রঙিন প্রজাপতির হাটে রঙের মেলা বসেছে! কত রঙিন পোষাকে দর্শনার্থীদেরকে দেখা যাচ্ছে।এদের মাঝে আমাদের সেই পাগল-পাগলি, রুনা এবং শিহাবও রয়েছে।

তবে আজ একা ওরা।

আলাদা আলাদা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

গত পরশুদিন শিহাব মধ্যরাতে রুনার বাসার সামনে এসে রুনাকে দেখে যাবার পর আজ এই প্রথম ওরা বাইরে বের হল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান জহির রায়হান মিলনায়তনে এই এখুনি শুরু হতে যাচ্ছে। তুহিন স্যার, মুকিত মজুমদার বাবু এবং মাননীয় ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সহ প্রাণীবিদ্যা বিভাগের চেয়্যারম্যান স্টেজে চলে এসেছেন। বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের সুত্রপাত হল। এখন ওনারা বক্তব্য রাখছেন।

অডিটোরিয়ামের সিঁড়ির সামনেই দর্শকদের আসন। সেখানে বসে বসেই রুনা তুহিন স্যারের সূচনা বক্তব্য শুনছে... চোখ সামনের দিকে কিন্তু মন একজনকে খুঁজে ফিরছে। বেশ কয়েকবার ডাইনে-বায়ে তাকিয়েছে... সে আছে কিনা দেখছে। কিন্তু তাঁর চোখ শিহাবের সেই পরিচিত-ভালোলাগা অবয়বকে পায়নি।

রুনার চোখ যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, সে একেবারে রুনার পিছনে। বেশ পিছনে। তবে শিহাবের ওখান থেকে শুধু রুনার কাঁধ ও মাথা দেখা যাচ্ছে। ওর চুলের সাথে অবহেলায় পড়ে থাকা বেলী ফুলকে সে এখান থেকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। রুনা যে কয়েকবার এদিক সেদিক তাকিয়েছে, সেটা ও দেখেছে। প্রথমে মজা লাগলেও পরক্ষণেই বিষন্নতায় ছেয়ে যায় শিহাবের মন। ওর বন্ধু ওকে খুঁজে পাচ্ছে না... কি অসহায় লাগছে রুনাকে এখন!

নিজের চিন্তায় নিজেই চমকে যায় শিহাব।

বন্ধু?!

আসলেই কি সে বন্ধু ভেবেছে রুনাকে?

এইমাত্র?

দশ দিককে স্তব্ধ করে দিয়ে হৃদয় ও ব্রেইনকে প্যারালাইজড করা এক অনুভুতিতে আচ্ছন্ন শিহাব পায়ে পায়ে সামনের দিকে আগায়। কয়েকজনের সাথে অভদ্রজনিত ধাক্কায় তাঁদের ভ্রুকুটিকে নিজের অজান্তেই উপেক্ষা করে একসময় রুনার কাছে যেতে পারে।

এখন রুনা একবার পিছনে ফিরলেই ওকে দেখতে পাবে। কিন্তু শিহাব সব সময় দেখে এসেছে, জীবনে তোমার যখন অন্তত একবার পিছনে ফিরে দেখা প্রয়োজন- ঠিক সেই সময়টাতে আর ফেরা হয় না। রুনাকে কি সে ডাকবে?

নাকি অপেক্ষা করবে? কখন সে ওকে দেখে। প্রয়োজনে শিহাব এক যুগ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে।

কতক্ষণ ওভাবে ছিল শিহাব নিজেও বলতে পারবে না। তবে পরিচিত কন্ঠের আওয়াজে সে অনেক দূর থেকে কাছে চলে আসে... দেখে সাময়িকভাবে অনেক দূরে চলে যাওয়া সেই প্রিয় মুখ একেবারে ওর কাছে... তাঁর শরীর ভেদ করে হৃদয়ের কোনো এক গভীর থেকে মনকে মাতাল করে দেয়া ভালবাসার পারফিউম ওকে ক্লোরোফর্মের মত সাময়িক বিবশ করে দিতে চায়। চোখে চোখে নীরবে কথা না বলেই সমঝোতা হয়ে গেলো।সঠিক সময়ে দু'জনেই পিছনে ফিরতে পেরেছে। রুনা তাঁর আসন থেকে উঠে শিহাবের পিছু নেয়... দুই পাশে গাছ নিয়ে কালো পীচ ঢালা একটি নির্জন রাস্তা ধরে রুনা-শিহাব হাঁটতে থাকে।

পাশাপাশি থেকেও বেশ খানিকটা ব্যবধানে হাঁটছে ওরা। নীরবে একে অপরের হৃদয়ের ভালোলাগার উত্তাপটুকু অনুভব করছে। এলোমেলো বাতাসে রুনার অবাধ্য চুলগুলো উড়ছে... সেগুলোর সাথে ওর মনটাও কি? একসময় রুনা বলে-

- জানো, এরকম পরিবেশে 'ওর' সাথে সেই সময়গুলোতে ওর হাত ধরে হাঁটতে খুব ইচ্ছে করত। কিন্তু সে আমার হাতের থেকে আমার শরীরের বিশেষ যায়গাগুলো স্পর্শ করতে পছন্দ করত।

' বাদ দাও তো... যে চলে গেছে লেট হিম গো... গো ফরএভার'

- আরে শোনই না। আমি যখনই তাকে বলেছি, তোমার হাতটা একটু ধরি... চল একটু হাঁটি... সে কি বলত জানো?

' কি বলতো?'

- তুমি একটি গেঁয়ো মেয়ে, এই যুগে এখনও হাত ধরাধরি... রাবিশ... আমি নীরবে চোখের জল লুকানোর জন্য ওর সেই অপমান হেসে উড়িয়ে দিতাম। কিন্ত বিশ্বাস কর, আমার হৃদয়টা ভেঙ্গে যেতো। কতবার যে সেটি ছিন্নভিন্ন হয়েছে! তোমায় যদি দেখাতে পারতাম!

' তুমি আমার হাত ধরবে?

শিহাবের বাড়িয়ে দেয়া হাতকে দেখে রুনা... ওর চোখের পানে তাকায়। সেখানে নীরবে কিছু একটা খোঁজে... নিজের মনের ভিতরেও একটু ঘুরে আসে। শিহাব হাসে, বলে-

'ভয় নেই, এটা প্রেমিকের হাত নয়!'

- তবে কার হাত?

' বন্ধুর হাত!'

- বন্ধু? হতে পেরেছ?

' হ্যা!

- আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? এই হাত মুহুর্তে লোভীর হাতে পরিণত হবে নাতো?

' না... একবার বন্ধু হতে পেরেছি যখন... মনে হয় না আর পিছে ফিরতে পারব।

রুনা পরম নির্ভরতায় শিহাবের হাত ধরে... দুজন প্রেমিক-প্রেমিকার হাত একজন বন্ধুর হাতে পরিণত হয়। একটা লম্বা সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথ ধরে জীবনের বাঁকা পথের পথিক হয়ে ওরা আগাতে থাকে। পিছনে ফেলে যায় কিছু বিষাক্ত নিঃশ্বাস... তিক্ততায় ভরা কিছু মুহুর্ত... আর... আর... ধুত্তুরি, থাকনা ওগুলো পিছনেই পড়ে।।
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×