মানুষ স্বভাবজাত কারনেই মুক্ত ও স্বাধীন জীবনযাপনে সক্রিয়। পরাধীনতা ও দাসত্বের শৃঙ্খলকে মানুষ কোন কালেই মেনে নিতে পারেনি। মুক্ত-স্বাধীন জীবনের জন্য মানুষ সর্বকালেই সর্বাত্মক চেষ্টা ও সর্বাধিক ত্যাগ ও কুরবানী দিতে সামান্যতম কুন্ঠাবোধ করেনি। এই বিশাল পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী ইতিহাসগুলো তারই প্রমাণ বহন করছে। কেননা মানুষের মন-মগজ জন্মগতভাবেই মুক্তি ও স্বাধীনতা প্রিয়। নিতান্তই মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি হলো দাসত্ব ও পরাধীনতার প্রতি তীব্রবেগে ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রকাশ। পরাধীন জাতির স্বাধীনতা অর্জনের দৃঢ় সংকল্প ও অনমনীয়তার মূলে নিহিত থাকে স্বাধীনতা অর্জনের সর্বশেষ মাত্রার কুরবানী করার উৎসাহ ও উদ্দীপনা। এই উৎসাহ ও উদ্দিপনাই মানুষকে মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়তে সাহায্য করে। পৃথিবীর কত দেশে কত কোটি মানুষ স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন-যৌবন অকাতরে বিলিন করে দিচ্ছে, হাসিমুখে ফাঁসির দড়িতে ঝুলছে, শত্রুপক্ষের প্রচন্ড গোলাবারুদের মুখে নিজের বুকটাকে টান করে ধরছে, তার কোন হিসাব নেই। পাশাপাশে এর বিপরীত দৃশ্যও দেখা যায়। কত মানুষ নীরবে নি:শব্দে পরাধীন জীবন যাপন করছে। কোনপ্রকার প্রতিবাদ প্রতিঘাত ছাড়াই সয়ে যাচ্ছে সকল প্রকার অত্যাচার, নির্যাতন, নিষ্পেষণ, অপমান-লাঞ্চনা আর জ্বালা যন্ত্রণা। যতপ্রকার কষ্ট আর লাঞ্চনাই আসুক তারা মৃত্যূর চেয়ে বেচে থাকেকে বেশী ভালোবাসে।
কিন্তু একই মানুষ, একই দেশ, একই সমাজে একই পরিস্থিতির স্বীকার হওয়ার পরও মানুষের মাঝে দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ভূমিকা কেন? এর মূল কারন যে চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধে পার্থক্য তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিশ্বাস ও মূল্যবোধে যে পার্থক্য ও তারতম্য রয়েছে তা-ই মানুষকে দুটি পরস্পর বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ করে।
যারা মনে করে, এ জীবন যতই লাঞ্চনা আর অপমানের হোক না কেন মৃত্যূর চেয়ে এটাই অধিক প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ। তারা মৃত্যূর সামান্যতম আশংকা সহ্য করতে পারেনা। এমনকি মৃত্যূর আগমনের কথাও শুনতে চায়না। আর যারা লাঞ্চনার জীবনের চেয়ে মৃত্যূকে বেশী সম্মান ও কামনা করে তারা কখনো মৃত্যূকে ভয় করেনা। এমনকি তারা মৃত্যূর সাথে পাঞ্জা লড়তেও বিন্দুমাত্র সংকোচবোধ করে না। তাই কোথাও মানুষ মৃত্যূর ভয়ে কাতর ও অক্ষমে পরিণত হয়েছে। আবার কোথাও পরাধীনতা মানুষকে মৃত্যূর পথে পাগল করে তুলছে। প্রথমোক্ত মানুষ বেচে থাকাটাকেই চরম সার্থকতা মনে করছে। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ মৃত্যূবরণই নিজের জীবনের চরম সার্থকতা বলে মনে করছে। একই মানুষের মধ্যে এ পার্থক্য শুধুমাত্র দুজনের বিশ্বাসে, মূল্যবোধে, দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য থাকার দরুণই অনিবার্য ও স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
এক শ্রেণীর মানুষ স্বীয় আদর্শ, লক্ষ-উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য জীবনকে অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে। আবার আরেক শ্রেণীর মানুষ পার্থীব জীবনের মোহে পড়ে মহান আদর্শকে বাস্তবায়নের দায়িত্বকে এড়িয়ে, অস্বীকার করে, নিসংকোচে বিক্রি করে দিচ্ছে। বস্তুত এটা একটা বিচিত্র জগত। আরও বিচিত্র হলো এখানকার বাসিন্দারা। বর্তমান দুনিয়ার বাহ্যিক অবস্থা আমাদেরকে এই তত্ত্বের তাৎপর্য বুঝতে অনেকটা সহযোগিতা করছে। এক প্রকারের মানুষ পরকালের জীবনকে দুনিয়ার সামান্যতম জীবনের বিনিময়ে গলাটিপে হত্যা করছে। আরেক প্রকারের মানুষ পরকালের জীবনে সুখী হওয়ার বিশ্বাস নিয়ে দুনিয়ার তুচ্ছ জীবনকে উপেক্ষা করে চলছে। তা থেকে বুঝতে একটু ও অসুবিধা হচ্ছেনা যে, এ পার্থক্য দুনিয়ার জীবন ও পরকালের জীবনের মূল্যায়নে মৌলিক পার্থক্যের ফসল।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, মানুষের জীবনে বিশ্বাসের তীব্র ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। তাই আমরা একথা বলতে পারি যে, দুনিয়ার বুকে দাসত্ব ও শৃঙ্খলমুক্ত জীবনযাপন করতে হলে শুধুমাত্র বিশ্বাসের পরিবর্তন হলেই যথেষ্ট। শুধুমাত্র একটি আদর্শিক বিশ্বাস নিয়ে সামনে অগ্রসর হলেই সম্ভব সকল প্রকার যুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, নিষ্পেষণ, দুর্নীতি, দু:শাসনের মুলৎপাটন করে একটি আদর্শিক সুন্দর, সুশৃঙ্খল, ইনসাফপূর্ণ, কল্যাণজনক, ইসলামী, ও খিলাফতভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। অতএব শৃঙ্খলমুক্ত সমাজ গঠনে বিশ্বাসের ভূমিকা অপরিসীম।