বগুড়া : ফসল পরিণত না হতেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার নামে টিন দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। ডানে অপরিণত আলু তুলতে বাধ্য করছে আয়োজকরা । সমকালমোহন আখন্দ, বগুড়া ব্যুরো
'হামি ৪০ শতক মাটিত লাউ আর মরিচের আবাদ করিচনু গাছোত ছোট ছোট লাউও ধরিছিল। কিন্তু কমিটির লোকজন মেলা লাগাবার য্যায়া হামার ২৮ শতক জমির সব লাউ গাছ পা দিয়ে পিষে শ্যাষ করিছে। আর ১২ শতক জমিত লাগানো মরিচের গাছেত ফলন না আসতেই সব গাছ তুলে ফেলে দিবার কছিল। হামি মনের দুঃখে তুলিনি... ক্ষতিপূরণের ট্যাকাও লিইনি... আলল্গাহ ওরকেরে বিচার করবি।' ক্ষোভ মেশানো কণ্ঠে এ কথা বলছিলেন বগুড়া সদর উপজেলার নামাবালা গ্রামের বয়োবৃদ্ধ কৃষক নুরুন্নবী।
শহরের মাটিডালি বিমান মোড়ের পূর্বদিকের দ্বিতীয় বাইপাস সংলগ্ন ওই গ্রামের প্রায় ১৫ একর জমিতে লাগানো আলু, মরিচ, ভুট্টা, বেগুন ও লাউসহ বিভিন্ন ধরনের আবাদ ধ্বংস করে 'আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা' আয়োজনের তোড়জোড় চলছে। বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্তৃপক্ষ মেলাটি আয়োজনের জন্য 'ফেম এন্টারপ্রাইজ' নামে স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। চুক্তি মোতাবেক মাসব্যাপী মেলার জন্য ওই প্রতিষ্ঠান চেম্বার কর্তৃপক্ষকে লভ্যাংশ বাবদ আগাম ২০ লাখ টাকা পরিশোধ করবেন।
আগামী ১ মার্চ মেলা উদ্বোধনের কথা বলা হলেও আয়োজকরা প্রায় ১ মাস আগে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই ঢেউটিনের বেড়া দিয়ে দিয়ে সীমানা নির্ধারণ, স্টল-প্যাভিলিয়ন এবং সার্কাসের প্যান্ডেল তৈরি শুরু করে দিয়েছে। এর আগেও ২০০৯ সালের ১৯ মার্চ বগুড়া চেম্বারের উদ্যোগে ওই একই স্থানে ১২ একর জমিতে লাগানো অপরিণত ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসল কেটে মাসব্যাপী বাণিজ্যমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। তবে কাগজে-কলমে 'আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা' দাবি করা হলেও বাস্তবে সেখানে বিদেশি কোনো স্টল ছিল না। বরং সন্ধ্যা নামলেই অশল্গীল নৃত্য আর জুয়ার জমজমাট আসর বসনো হতো মেলা প্রাঙ্গণে। লটারির পুরস্কার বিতরণ নিয়ে বিরোধের জের ধরে সংঘর্ষ, হামলা এবং অগি্নসংযোগের মতো সহিংস ঘটনার জেরে গত বছরের ২০ এপ্রিল মেলা প হয়ে যায়।
মেলার কারণে উচ্ছেদ হওয়া মরিচ বীজতলার মালিক রনজু জানান, তার ৪ শতক জমিতে তিনি ৪ হাজার মরিচের চারা লাগিয়েছিলেন। ফাল্গুন মাসের শেষে (মার্চের মাঝামাঝি) গাছগুলো পরিণত হতো। তখন ১০০ গাছ ৩০০ টাকা হিসেবে ৪ হাজার গাছ থেকে তার ১২ হাজার টাকা আয় হতো। কিন্তু মেলার জন্য আগেভাগে উঠিয়ে নিতে আয়োজকরা তাকে শতক প্রতি ৩০০ টাকা করে ৪ শতাংশের ক্ষতিপূরণ হিসেবে মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়েছে।
বগুড়া সদর উপজেলা কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা ফসলের ক্ষতি করে মেলা আয়োজনের কথা স্বীকার করলেও এ নিয়ে কেউ কিছু বলতে রাজি হননি। মাটিডালি মহলল্গার এসএসসি পরীক্ষার্থী শাকিব হোসেন ১ মার্চ থেকে মেলা আয়োজনের ঘোষণায় রীতিমতো শঙ্কিত। সে জানায়, ১৪ মার্চ পর্যন্ত তাদের পরীক্ষা চলবে। এর মধ্যে মেলা শুরু হলে মাইকের শব্দে পড়ালেখা তো দূরের কথা, রাতের ঘুমও হারাম হয়ে যাবে। এদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী-২ এসএম রেজাউল করিম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের কথা স্বীকার করে বলেন, 'সেচ মৌসুমে সব ধরনের আলোকসজ্জার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মেলার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন থাকায় আমরা সংযোগ দিতে বাধ্য।'
বোরো মৌসুমে এ ধরনের মেলায় জেলা প্রশাসন সহযোগিতা করেছে বলে চেম্বারের দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বগুড়ার জেলা প্রশাসক ইফতেখারুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, 'মেলায় জেলা প্রশাসনের কোনো অংশগ্রহণ নেই। যারা করছে তারা সংশিল্গষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়েই করছে।' মেলা আয়োজনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ফেম এন্টারপ্রাইজের অন্যতম কর্ণধার আবদুল মান্নান জানান, যে ৪৩ বিঘা জমি (প্রায় ১৫ একর) নেওয়া হয়েছে তাতে যাদের ফসল ছিল তাদের সবাইকে যথাযথ ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়েছে। বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্র্রিজের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ জেলা কমিটির সভাপতি মমতাজ উদ্দিন জানান, অন্য কোনো জায়গা না পাওয়ার কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই ফসলি জমি বেছে নিতে হয়েছে। তিনি দাবি করেন, প্রতিটি কৃষককে তার ফসলের বিপরীতে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।