somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছাপোষাঃ একজন বাবার গল্প (১ম পোষ্ট)

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘বাবা, এই বাবা। কই তুমি?’
‘এইতো, এখানে,’ মেয়ের ডাক শুনে নিজের স্টাডি থেকে প্রতিউত্তর দেন ওমর সাহেব। শুক্রবার দিন তাই অফিস নেই বলে বই পড়ছেন তিনি। এক সরকারী অফিসে মোটামুটি মানের একটা চাকরী করেন। যা পান তাই দিয়ে বাবা আর মেয়ের সংসার ভালই চলে যায়। খুব একটা উচ্চাভিলাষী নন, তাই বা হাতের কাজ করেন না। মোটকথা ছাপোষা ধরনের একজন সুখী মানুষ তিনি। পিছুটান বলতে প্রাণপ্রিয় একমাত্র মেয়ে নাবিলা। পৃথিবীতে আপন বলতে ওই একজনই। তার আদর-স্নেহ-ভালবাসার একমাত্র পাওনাদার। শাসন অবশ্য করেন না, কারণ প্রয়োজন পড়েনা। বরং মেয়ের শাসনে থাকতে হয় তাকে। এই ব্যাপারটা খুব উপভোগ করেন তিনি।

স্টাডির দরজায় এসে উপস্থিত হয় নাবিলা। ‘সকাল সকাল শুরু হয়ে গেছে, তাইনা?’ বাবার দিকে কপট রাগের দৃষ্টিতে তাকায় সে।
‘কেন মা, বই পড়া বুঝি খারাপ?’ হাসেন ওমর সাহেব।
‘না, খারাপ না। কিন্তু তুমি আজ শুধু আমাকেই সময় দেবে। মনে নেই, আজ আমাদের ফাদার’স-ডটার’স ডে? আমি আজ নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াব তোমাকে। তবে শর্ত একটাই, খারাপ হলেও খারাপ বলা যাবে না।’
‘আমি জানি, তোর রান্নার হাত কেমন,’ আদরের হাসি হাসেন তিনি। ‘আমার জিভে এখনই জল এসে যাচ্ছে। মেনু টা কি তা জানতে পারি কি, মিস?’
জোরে হেসে ওঠে নাবিলা বাবার কৌতুকে। ‘না না। ওটা সিক্রেট। তবে এখন আমরা কফি খাব। তাই শুনতে এলাম। ব্ল্যাক কফি খাবে নাকি হোয়াইটনার দেব?’
‘তোর যা মনে হয় তাই নিয়ে আয়। আমার স্বাস্থ্যের জন্য কি ভাল, তা আমার চেয়ে তুই ভাল জানিস। শুধু শুধু জানতে এসেছিস।’
‘জানতে এসেছি কারণ তোমার সাথে কথা বলতে আমার ভাল লাগে,’ বলে হেসে চলে গেল নাবিলা।

হঠাৎ করে মন খারাপ হয়ে গেল ওমর সাহেবের। মেয়ের দিকে তাকালে বুকের কোথায় যেন একটা চিনচিনে ব্যাথা হয় তার। স্ত্রীর কথা মনে পড়ে যায়। নাবিলাকে জন্ম দিতে গিয়ে অপারেশন টেবিলের ঝলমলে আলোর নিচেই মৃত্যু হয় তার। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে চোখের জলে বিদায় দেন স্ত্রীকে। মনে মনে শপথ নেন মায়ের অভাব কোনদিন বুঝতে দেবেন না তিনি মেয়েকে। মেয়ের সারা জীবন ধরে ওই চেষ্টাটাই করে গেছেন। খারাপ লাগে এই ভেবে যে নাবিলার পৃথিবীটা খুব ছোট। আত্মীয় স্বজন নেই তার। যারা আছে দুই একজন তারাও অনেক দূরে দূরে থাকে। অন্তর্মুখী মানুষ হবার দরুন অন্যদের সাথে খুব একটা মেশামেশি করেন না।
মেয়েটাও হয়েছে এমন। এত বড় হয়ে গেছে কিন্তু বন্ধু বান্ধব হয় নি খুব একটা। কয়েকজন বান্ধবী আছে মাত্র। নাবিলার চেহারা ওর মায়ের মতই। অসম্ভব সুন্দর। এটা নিয়েও খুব ভয় হয় তার। ব্যস্ততার কারণে চোখে চোখে রাখতে পারেন না। তবে মনের বড় একটা অংশ মেয়েকে নিয়েই সবসময় চিন্তা করে। আর চিন্তাটা নাবিলার বয়সের সাথে ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে।

নিজের ভাবনায় ডুবে ছিলেন, তাই নাবিলা একটা ট্রেতে দুই মগ কফি নিয়ে এসে স্টাডি তে ঢুকলেও টের পেলেন না তিনি।
‘কি ভাবছ, বাবা?’ ট্রে নামিয়ে রাখতে রাখতে প্রশ্ন করল সে।
ওমর সাহেব মেয়ের দিকে তাকান মাত্রই সে বুঝে ফেলল তার চিন্তাধারা। বাবাকে হাড়ে হাড়ে চেনে মেয়ে।
‘তুমি আবার দুশ্চিন্তা করছ?,’ অভিমান নাবিলার কণ্ঠে। ‘কতবার বলেছি শুধু শুধু চিন্তা না করতে। ডাক্তার আংকেল কি বলেছে শোননি?’
‘ডাক্তার কি আর সবকিছু বোঝে!’
‘না, তুমি একাই বোঝ। বইতে সব লেখা আছে তাইনা!’ এবার মুখ টিপে হাসে নাবিলা। বাবার হাতে একটা মগ তুলে দিয়ে নিজেরটা নিয়ে তার সামনে একটা নিচু টুলে বসে।
‘তারপর,’ আলাপ জমানোর ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলেন ওমর সাহেব। ‘কলেজ লাইফ কেমন লাগছে? নিজেকে বড় বড় মনে হচ্ছে তাইনা?’
‘শুধু ড্রেসের রঙটাই যা চেঞ্জ হয়েছে,’ মুখ বাকায় নাবিলা। ‘সবাই যার যার লাইফ নিয়ে বিজি। আর কি সব বিষয় নিয়ে কথা বলে মেয়েরা! আমার ভাল লাগে না।’
‘কি নিয়ে কথা বলে?’
‘তোমাকে বলা যাবে না,’ হাসে সে। ‘তুমি শুনে কি করবে মেয়েদের আড্ডার কেচ্ছা?’
‘তোর তাহলে কি নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগে?’
‘তুমি ছোটবেলা থেকে যা যা শিখিয়েছ তাই নিয়ে। ওইগুলো নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না। বলে আমি নাকি জ্ঞান ফলাই। তাই কেউ পছন্দ করে না।’
‘তোকে যদি কেউ পছন্দ না করে, তাহলে বুঝবি তার নিজেরই ঝামেলা আছে। জেলাস! তুই ক্লাশের ফার্স্ট গার্ল, গুড এন্ড ইনোসেন্ট লুকিং, ভাল গান- বক্তৃতা- বিতর্ক পারিস। এমনকি মার্শাল আর্ট ও শিখিস। ঈর্ষা করার জন্য এর ভিতর যে কোন একটা কারনই যথেষ্ট। ওরা তোর মত পারে না, তাই মিশতে চায় না।’
‘ইশশ, তোমাকে বলছে!’
‘হুম বলেছে তো।’
‘কে বলেছে?’
‘আমার মন আর অভিজ্ঞতা,’ বলে হাসেন ওমর সাহেব। মেয়েও হাসে তার সাথে।

এরকম হালকা ধরনের আলাপচারিতা আর নিজেদের ব্যস্ততা নিয়ে দিন কাটে দুইজনের। বাবার চিন্তা সবসময় মেয়ের ভাল মন্দ আর মেয়ের চিন্তা বাবার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে। সকাল সকাল ওমর সাহেব অফিসে যান। নাবিলার সাথেই বেরোন বাসা থেকে। মেয়েকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে অফিস ধরেন। বিকেলে অফিস থেকে ফেরেন। কলেজ-কোচিং আর মার্শাল আর্ট এর ক্লাশ শেষে ক্লান্ত হয়ে মেয়ে বাসায় ফেরে। বাথরুমে তোয়ালে, সাবান-শ্যাম্পু সবকিছু রেডি করে রেখে দেন তিনি। সন্ধ্যায় মেয়ের হাতে বানান নাস্তা খান দুইজনে মিলে। মেয়ে পড়ার টেবিলে বসে আর তিনি চলে যান নিজের স্টাডি তে। রাতের খাবার দুইজন একসাথে বসে খান। নাবিলা ঘুমিয়ে পড়লে তারপর তিনি ঘুমাতে যান। এই নিয়মের ব্যতিক্রম খুব কমই ঘটেছে।

এক রাতে মেয়ের ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন ওমর সাহেব। মেয়ের ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। বুক কেপে উঠল তার। ছোটবেলা থেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে নাবিলার। মাঝে মাঝে সেটা দেখা দেয়। রাতের বেলা তাই রুমের দরজার ছিটকিনি খুলে ঘুমায়। ওমর সাহেব আস্তে করে মেয়ের রুমে ঢুকেন। দেখেন খাটে শুয়ে নিচু গলায় কাঁদছে মেয়েটা। মায়ের একটা ছবি যেটা সবসময় খাটের পাশে ডেস্কের উপর থাকে সেটা জড়িয়ে রেখেছে বুকের সাথে।

সামনের দৃশ্য দেখে ওমর সাহেবের মনে হল ভারী একটা পাথর কে যেন তার বুকের উপর ঠেলে তুলে দিল। সবসময় একটা চিন্তাই তাকে ঘিরে থাকে। মেয়ের মনের সুখ-শান্তি। কেননা মেয়েই তার পৃথিবী। তার একমাত্র সম্পদ। কিন্তু দুঃখ হল মেয়ের মন তো আর তিনি নিয়ন্ত্রন করতে পারেন না। তিনি চেষ্টা করতে পারেন শুধু। ঠিক এই জায়গায়ই তার অসহায়ত্ব। তিনি ধীরে ধীরে গিয়ে মেয়ের পাশে বসেন। কপালে হাত রাখেন আলতো করে। বাবা রুমে ঢুকেছে বুঝতে পেরে নাবিলা চোখ বুজে আছে।
‘আমার পৃথিবীতে আসাটা তোমার জন্য অনেক কষ্টের ছিল, তাইনা বাবা?’ ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে সে। মায়ের ছবিটা আরও শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরল।
‘কেন মা?’ নরম গলায় প্রশ্ন করেন তিনি।
‘আমার কারণে তুমি মা কে হারিয়েছ।’
শক্ত করে চোখ বুজলেন ওমর সাহেব। বুঝতে শেখার পর থেকে কেন জানি মায়ের মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করে নাবিলা। এত কিছু বোঝে মেয়েটা কিন্তু এই ব্যাপারটা বার বার বোঝানোর পরেও বোঝেনা সে।
‘মৃত্যু খুব খারাপ জিনিস মা। কিন্তু এর উপর আমাদের কোন হাত নেই। পৃথিবীতে আসার হয়ত একটা সিরিয়াল আছে কিন্তু যাওয়ার কোন সিরিয়াল নেই। সব আল্লাহ এর ইচ্ছা।’
‘আল্লাহ এর কেন এতবড় একটা খারাপ ইচ্ছা হল,’ অবোধ অভিমান ঝরে নাবিলার কণ্ঠে।
‘ওভাবে বলতে হয় না, মা। আল্লাহ্‌ যা করে ভালর জন্যই করে। আমরা মানুষ। আমাদের জ্ঞান অনেক ক্ষুদ্র। এত ক্ষুদ্র জ্ঞান আর বুদ্ধি দিয়ে আল্লাহ্‌ এর ইচ্ছা বোঝা যায় না। তুই মায়ের জন্য আল্লাহ্‌ এর কাছে দোয়া কর। একদিন না একদিন আমরা সবাই আবার এক হব। দেখিস অনেক মজা হবে সেদিন।’ হাসতে চেষ্টা করেন ওমর সাহেব কিন্তু চোখ দিয়ে অশ্রুর একটা প্রবাহ বেরিয়ে আসে। লুকানোর জন্য অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকেন তিনি। অনেকক্ষণ দুইজনে কোন কথা বলে না। কিন্তু মনে মনে অনেক কথা হয়ে যায় তাদের ভিতর। নীরবতা মাঝে মাঝে যা দিতে পারে, হাজার হাজার শব্দও তার সামনে একেবারে নস্যি।

সময় নিজের মত করে বয়ে চলে এরপর। হাজার হাজার ব্যস্ত মানুষের শহরের ভিড়ে বাবা-মেয়ের এই ছোট্ট সংসারটাও তার নিজস্ব সুখ-দুঃখ কে সাথে নিয়ে চলতে থাকে। ওমর সাহেব এর মন কিছুদিন ধরে বেশ খারাপ। কারণ একটাই। নাবিলা। কি যেন হয়েছে মেয়েটার। দিন দিন যেন গুটিয়ে যাচ্ছে নিজের ভিতর। তার মাঝে মাঝে মনে হয় আত্মকেন্দ্রিকতা শুধুমাত্র পুরুষের জন্য। আবেগ লুকানো পুরুষদেরই সাজে। অন্তর্মুখী মেয়েদের সুখী হতে গেলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। এমনিতেই মেয়েরা জন্মগত ভাবে চাপা স্বভাবের। মেয়েদের মনের কথা কাউকে না কাউকে খুলে বলতে হয়। তিনি বুঝতে পারেন কিছু কথা আছে যা অবলীলায় বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা যায়, কিন্তু বাবার কাছে যায় না।

নাবিলার তেমন কোন মানুষ না থাকার কারণে কত কথা যে তার মনে জমেছে তা কে জানে। কিন্তু তিনি কি করবেন? একজন ভাল মহিলা সাইকিয়াট্রিস্ট কে চেনেন তিনি। কিন্তু মনে হয় না মেয়ে তার কাছে সিটিং দিতে রাজি হবে। আর জোর করা তার স্বভাবে নেই।

কিন্তু দিনকে দিন জিনিসটা খারাপের দিকে যেতে লাগল। একদিন বিকেলে বাসায় ফিরে সোজা নিজের রুমে গিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল সে। কাঁদতে লাগল জোরে জোরে। কয়েকবার তার দরজায় ধাক্কা দিলেন ওমর সাহেব। কিন্তু খুলল না সে। তিনিও আর জোর করলেন না। এখন একা থাকতেই দেয়া ভাল। পরে নিজে থেকেই বলবে তাকে। মেয়েকে ভাল করেই চেনেন তিনি।

সেদিন রাতে স্টাডি তে বসে ছিলেন তিনি। নাবিলা রুমে ঢুকেই তাকে জড়িয়ে ধরল। ছোট বেলায় সারাক্ষণ কোলে কোলে রাখতেন মেয়েটাকে। বড় হবার পর স্বভাবতই একটা দুরত্ব তৈরি হয়ে যায়। আজ সেই মেয়ে আবার মেয়েলি লাজলজ্জা ভুলে তার বুকে ফিরে এসেছে। নিশ্চয়ই তার পিছে অনেক বড় কোন কারণ আছে। ঘাড়ের উপর কয়েক ফোটা পানির অস্তিত্ব অনুভব করে তিনি বুঝলেন নীরবে কাঁদছে নাবিলা। আদর করে চুলে হাত বুলালেন মেয়ের।
‘কি হয়েছে মা, আমাকে খুলে বল,’ বললেন ওমর সাহেব।
কিছুক্ষণ পর তাকে ছেড়ে দিল নাবিলা। তিনি মেয়েকে সামনে বসালেন। চোখে প্রশ্ন তার। হাত দিয়ে চোখ মুছে একটু ধাতস্থ হল নাবিলা। তিনি এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন মেয়ের জন্য। কাঁপা কাঁপা হাতে পানিটুকু খেল সে। তারপর বলল, ‘একটা খারাপ ছেলে আমার পিছনে লেগেছে, বাবা। তোমাকে কিছু বলিনি আগে। কিন্তু দিন দিন ধৈর্য্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।’

গত কিছুদিন যাবত যা যা ঘটেছে সব খুলে বলল সে বাবাকে। স্থানীয় এক ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে সে। রাজনৈতিক ক্ষমতাও আছে তার বাবার। পড়ালেখা করে না আর। বখাটে ছেলেদের একটা গ্রুপের লিডার বলা যায় তাকে। বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সারাদিন আর বখাটেপনা করে মেয়েদের সাথে। একদিন নাবিলার সামনে এক মেয়েকে ডিস্টার্ব করায় প্রতিবাদ করে সে। এরপর থেকে তার পিছে লেগেছে। তার জীবনটা অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে। সারাদিন কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে এখন। অশ্লীল ইঙ্গিত করে। কোচিং এর সামনেও যায়। পথে বাইক নিয়ে ফলো করে তাকে। খারাপ কথা বলে।

শুনে রাগে আর ভয়ে হাত পা কাঁপতে থাকে ওমর সাহেবের। নাবিলার মত নরম মনের একটা মেয়ের জন্য ব্যাপারটা যে কি মাত্রায় অসহনীয় তা তিনিই জানেন। সারা জীবন মেয়েকে আদর-যত্ন-স্নেহ-মমতা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন তিনি। ভয়ের সংজ্ঞা কি জানতে দেননি তাকে। কিন্তু এখন প্রতিমুহুর্তে যে আতঙ্ক নিয়ে নাবিলা প্রত্যেকটা দিন পার করছে, তা তিনি লাঘব করবেন কিভাবে?
বর্তমানে সমাজের যে চিত্র, সেখানে তার সামাজিক অবস্থান নিচের দিকে। যেন কোন মুল্যই নেই তার মত নরম স্বভাবের লোকদের! জোর যার মুল্লুক তার- এ সমাজ লোভী-ক্ষমতাশালী আর দুর্নীতিবাজদের কদর করতে জানে শুধু। অন্যরা মরল না বাঁচল, তাতে ঘুনে ধরা সমাজের কিছুই আসে যায় না। বাস্তববাদী বলে নিজের অসহায়ত্ব আরও বেশি করে উপলব্ধি করতে পারেন ওমর সাহেব।

নাবিলার সামনে ঢাল হিসেবে একমাত্র তিনিই আছেন। তাকেই কিছু একটা করতে হবে। মেয়েকে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আশ্বাস দিয়ে ঘুম পাড়ালেন তিনি। ঘুমিয়ে যাবার পরেও তার হাতদুটো শক্ত করে ধরে ছিল নাবিলা। তিনি সাবধানে সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে ভাবতে লাগলেন কি করা যায়।

পুলিশের কাছে গিয়ে কোন লাভ হবে না। অযথা হেনস্তা হতে হবে। নিজের মেয়েকে আগে ঠিক করেন- এমন কথা শুনাও বিচিত্র কিছু নয় তাদের কাছ থেকে। ভাবলেন সরাসরি ছেলেটার বাবার কাছে যাবেন। অনুরোধ করবেন ছেলেকে এসব কাজ থেকে বিরত থাকতে। জোর তিনি খাটাতে পারবেন না। আর খাটিয়ে ঝামেলা আরও বাড়ানো ছাড়া কোন লাভ হবে না।

পরদিন তিনি খোঁজ খবর নিয়ে ছেলেটার বাবার কাছে গেলেন। চটকদার পাঞ্জাবী পরা ভারী চেহারার লোকটি তাকে দেখে খুবই বিরক্ত হল। ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত ছিল, বাঁধা পড়ায় ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আর কথার বিষয়বস্তু শোনার পর যেন তাকে শত্রুর দৃষ্টিতে দেখতে লাগল বলে মনে হল ওমর সাহেবের। শেষে বলল যে, ছেলের কাছে শুনে দেখবে।
আর নিষেধ করে দেবে তাকে। তারপর এমনভাবে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল যেন ওমর সাহেব তাড়াতাড়ি তার চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলেই সে বাঁচে। তিনিও আর দেরি করলেন না। বেরিয়ে এলেন রুম ছেড়ে।

এই ঘটনার তিনদিন পরে হন্তদন্ত হয়ে বিকালে বাসায় ফিরল নাবিলা। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। গায়ে মার্শাল আর্ট এর সাদা ড্রেস পরা। অন্যদিন প্র্যাকটিস থেকে কাপড় বদলে সাধারণ পোশাকে ফেরে বাসায়। ব্যতিক্রম দেখে আর তার চোখমুখ দেখে ওমর সাহেব কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘বাবা, রনি কে মেরে এলাম এইমাত্র।’

বখাটে ছেলেটার নাম রনি। সে নাকি তার প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল। সবার সামনে চিৎকার করে বলছিল যে, ‘এতবড় সাহস আব্বার কাছে নালিশ করেছিস।’ মাতাল হয়ে আরও কিছু অশ্লীল কথা বলে। শুনে রাগ চড়ে যায় তার মাথায়। সাথে সাথে একটা লাথি মেরেছে সে তার চিবুক বরাবর। পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত লেগে অজ্ঞান হয়ে গেছে। তারপর সে ওখান থেকে চলে এসেছে।

ভয় পেলেও মেয়েকে স্বান্তনা দেন ওমর সাহেব। গত দুইদিন ছেলেটা আর জ্বালাচ্ছিল না তাই ভেবেছিলেন ব্যাপারটা বুঝি মিটে গেছে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন মোটেই তা নয়। পরের কয়েকদিন খুব ভয়ে ভয়ে কাটাল বাবা-মেয়ে দুইজন। কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না। নাবিলার বাইরে যাওয়া আপাতত বন্ধ। কয়েকদিন অর্ধদিবস অফিস করছেন ওমর সাহেব। একে একে দুই সপ্তাহ কেটে গেল। সাথে সাথে ভয়ও কেটে গেল অনেকটা। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এল জীবন। ঘরের মধ্যে দিন কাটাতে কাটাতে হাঁপিয়ে উঠছিল নাবিলা। বাবার সম্মতিক্রমে আবার কলেজে যাওয়া শুরু করল সে। দুইজনের চিরচেনা জীবন শুরু হল যেন নতুন করে।

মাসখানেক পর একদিন রাত হয়ে গেলেও ফিরল না নাবিলা। ফোন বন্ধ। সম্ভাব্য সব জায়গায় ফোন দিলেন ওমর সাহেব, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারল না। বুকে খাঁচায় হৃৎপিণ্ড পাগলা ঘোড়ার মত লাফাচ্ছে তার। কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না। পাগলের মত রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন। স্কুল- কোচিং- প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড কিছু বাদ দিলেন না। নাবিলার ক্লাসমেট, শিক্ষক, প্রশিক্ষক সহ অনেক মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন কখন তাকে শেষ দেখেছে। এক গার্ড জানাল সন্ধ্যায় তাকে শেষ দেখা গেছে প্র্যাকটিস শেষে বেরিয়ে যেতে। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন ওমর সাহেব।

তার সহজ সরল মেয়েটা কোথায় চলে গেল? কোথায় খুঁজবেন তাকে? কয়েকজন তাকে বুদ্ধি দিল পুলিশের কাছে যেতে। বিপদে পড়লে মানুষের কোন হুশ থাকে না। তিনি একটা জিডি করলেন থানা তে। মেয়ে নিখোঁজ শুনে কেউ গরজ দিল না তেমন একটা বলে তার মনে হল। সবাই টিপিক্যাল টিনেজ মেয়ে নিখোঁজ টাইপ বলে ভাবতে লাগল। কিন্তু তিনি তো তার মেয়েকে চেনেন ভাল করে।

রনির বাসায় গিয়েছিলেন। দেখলেন সে বাড়িতেই আছে। তার আব্বা আবারও বিরক্ত হল তাকে দেখে। নাবিলার নিখোঁজ সংবাদ শুনে একটু সহমর্মিতা দেখাল অবশ্য। অনেক রাতে বাসায় ফিরলেন ওমর সাহেব। একজন অর্ধমৃত মানুষের মত নিজের ঘরের ভিতর গিয়ে বসলেন। নিজের মনে এলোপাথাড়ি ভাবে ভাবতে লাগলেন অনেক কিছু। কে জানে কেমন আছে এখন তার মেয়েটা? কোন বিপদে পড়েছে? তাহলে এখন কি অবস্থায় আছে? নিশ্চয়ই মনে মনে বাবাকে খুঁজছে। ভাবছে বোধহয় বাবা এসে তাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। কিন্তু তোকে কোথায় পাব মা? নিঃশ্বব্দে কাঁদতে লাগলেন ওমর সাহেব।

পরবর্তী দুইটা দিন নরকযন্ত্রণা ভোগ করলেন তিনি। নাবিলাকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায় নি। পুলিশ ষ্টেশনে যে কতবার গিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। গতানুগতিক সেই উত্তর পেয়েছেন প্রতিবার। খোঁজ চলছে। কিন্তু তার মনে হয়েছে পুলিশ কাজের কাজ তেমন করছে না। কানাঘুষো শুনতে পাচ্ছেন তিনি এখন তার চারপাশে। কেউ কেউ তাকে সহমর্মিতা দেখালেও অধিকাংশ মানুষ নাবিলার চরিত্রের দিকে ইঙ্গিত করছে। মানসিকভাবে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন ওমর সাহেব।

অবশেষে নিখোঁজের পর তৃতীয় দিন রাতে থানা থেকে ফোন এল নাবিলাকে পাওয়া গেছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শুনে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল ওমর সাহেবের। হাসপাতাল!! কি হয়েছে নাবিলার? মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল তার। পড়ে যেতে যেতে চেয়ার ধরে কোনমতে নিজেকে সামলে নিলেন। এরপর আলমারি থেকে নগদ যত টাকা ছিল সব বের করে নিয়ে পুলিশের দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী হাসপাতালে ছুটলেন।

পুলিশের কয়েকজন সদস্য দাঁড়িয়ে ছিল হাসপাতালের দরজায়। তারা ওমর সাহেবকে আটকাল। জানাল যে, নাবিলাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খুলে বলল তাকে কিভাবে পাওয়া গেল। পুলিশের কোন ক্রেডিট নেই অবশ্য। শহরের কিনারায় এক নদীর কাছে কয়েকজন লোককে দেখে সন্দেহ হয় একজন জেলের। কিছু একটা বয়ে নিয়ে এসেছিল তারা। সেই জেলে জোরে হেকে উঠলে তাড়াতাড়ি তারা সেটা ফেলে পালিয়ে যায়। লোকজন তারপর ঘটনাস্থলে গিয়ে চাদর মোড়ানো একটা দেহ দেখতে পায়। খুলে দেখে এক তরুণীর ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহ। ওরা ভেবেছিল মেয়েটা মৃত। তারপর পুলিশে খবর দেয় তারা। পুলিশ তরুণীকে নাবিলা বলে সনাক্ত করে । তারপর উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তার দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায় এরপর তাকে। অপারেশন চলছে এখন। ভাল কিছু শোনার আশা-ভরসা এইকয়দিনে যা ছিল ওমর সাহেবের তা দপ করে নিভে গেল। বসে পড়লেন মেঝেতে। সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্নটাই শেষ পর্যন্ত জলজ্যান্ত বাস্তব হয়ে উঠল!

দুইজন পুলিশ তাকে ধরে ওয়েটিং রুমে নিয়ে বসাল। যারা সেখানে ছিল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। অজস্র টুকরো টুকরো স্মৃতি এসে ভিড় করছিল ওমর সাহেবের মনে। নাবিলার কথা, হাসি, কান্না, শাসন। কখনো হাসছিলেন আবার কখনো কাঁদছিলেন তিনি। কেমন একটা ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছেন। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী ফাঁকা হয়ে গেছে। তিনি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে। তার চারপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নাবিলার হাসি আর বাবা ডাক। তাকে যেন বলছে, ‘পারলেনা বাবা। তুমি ব্যর্থ হয়ে গেলে।’

নাবিলা বলে এক চিৎকার দিয়ে বেহুশ হয়ে গেলেন ওমর সাহেব। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলেন হাসপাতালের এক বেডে শোয়া তিনি। তাকে ঘিরে আছে দুইজন পুলিশ আর কয়েকজন লোক। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। তিনি বুঝতে পারলেন না, তাকে এভাবে দেখার কি আছে। এপ্রোন পরা একজন কে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘নাবিলা কেমন আছে?’ তার মনে হয়েছে উত্তরটা লোকটার কাছ থেকে পাওয়া যাবে।
একটু ইতস্তত করল লোকটা, ‘এখনো জ্ঞান ফেরেনি। আই সি ইউ তে আছে।’
‘আমার মেয়েকে দেখব আমি।’
‘সেটা সম্ভব না। এমনিতেই দেখতে দিতাম না। আর আপনার এই শারীরিক কন্ডিশনে দেখতে দেবার তো প্রশ্নই আসে না।’ বলে চলে যেতে উদ্যত হল এপ্রোনধারী।
‘আমার মেয়ে ভাল হয়ে যাবে তো ডাক্তার?’
‘উপরওয়ালার কাছে দোয়া করুন,’ তার দিকে না তাকিয়ে বলল সে।

পাক্কা উনিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হল ওমর সাহেবকে নিজের মেয়েকে দেখার অনুমতি পেতে। নাবিলার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি এখনো। দরজা ঠেলে আস্তে করে নাবিলার কেবিনে প্রবেশ করলেন তিনি। ভিতরটা দেখে বোঝা যাচ্ছে যত্ন আত্তির কোন ত্রুটি করা হয় নি তার। বেডের চারপাশে বিভিন্ন মেডিক্যাল এপারাটাস। অপরিচিত সেই যন্ত্রগুলোর মনিটরে বিভিন্ন ধরনের সংখ্যা আর গ্রাফ দেখা যাচ্ছে। সাদা একটা চাদরে গলা পর্যন্ত ঢাকা নাবিলার। চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মুখ করে আছে। চাদরের নিচ থেকে একটা হাত বেরিয়ে আছে। স্যালাইনের সুচ ঢোকান সেখানে।

জন্মের পর থেকে একদিনের জন্যও যে মেয়েকে চোখের আড়াল করেননি, আজ সেই মেয়েকে চারদিন পর এই অবস্থায় দেখে ওমর সাহেবের মনের অবস্থা কেমন হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। ধীরে ধীরে মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন তিনি। ঠোঁটের কোনায় আর চোখের নিচে কালশিটে দাগ দেখতে পেলেন। পাশবিক অত্যাচারের চিহ্ন। ডাক্তার এর সাথে কথা হয়েছে তার। জানেন যে নাবিলার সারা দেহে এরকম এবং এর থেকে খারাপ আরও অজস্র চিহ্ন রয়েছে। ডাক্তার সরাসরিই বলেছে তাকে। অনেক বার যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে নাবিলা, সাথে শারীরিক অত্যাচার।

অনুভুতিশক্তি আরও অনেক আগেই লোপ পেয়েছে ওমর সাহেবের। দুঃখ-কষ্ট-রাগ কিছুই অনুভব করতে পারছেন না তিনি। শুধু কয়েকটা কথাই বারবার ঘুরে ফিরে মনের মধ্যে আসছে। কতটা মানসিক আর শারীরিক কষ্টের মধ্য দিয়ে গত কয়েকটা দিন পার করেছে তার আদরের মেয়েটা। বদ্ধ ঘরে না জানি কতবার বাবা বাবা বলে চিৎকার করেছে! না জানি কতবার অনুনয় বিনয় করেছে তার অত্যাচারকারী কে তাকে ছেড়ে দেবার জন্য। যৌন নির্যাতনের সময় না জানি কতটা ঘৃণায় শরীরটা কুঁকড়ে উঠেছে তার!!

মেয়ের কপালে একটা হাত রাখলেন ওমর সাহেব। চোখ খুলল নাবিলা। আস্তে আস্তে ঘুরে বাবার দিকে তাকাল। মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বুক কেঁপে উঠল বাবার। ওই চোখগুলো তিনি চেনেন না! তার চিরচেনা মেয়ে নয় সামনের ওই চোখধারী নাবিলা!! এই কয়দিনে অনেক কিছু দেখে ফেলেছে ওই চোখ যা সারা জীবনে কোনদিন দেখেনি আর দেখার কথাও ছিল না। মেয়ের দৃষ্টিটা সহ্য করতে পারলেন না তিনি। ফিরিয়ে নিলেন নিজের চোখ।
‘বাবা,’ মলিন কণ্ঠে বলল নাবিলা।
‘কি মা?’
‘কোথায় ছিলে তুমি?’
ছাত্রজীবনে ব্রিলিয়ান্ট হিসেবে খ্যাতি ছিল ওমর সাহেবের। জীবনে অনেক কঠিন কঠিন প্রশ্নের উত্তর অবলীলায় লিখে এসেছেন উত্তরপত্রে। কিন্তু আজ মেয়ের এই ছোট আর জানা উত্তরের সামনে হেরে গেলেন তিনি। উত্তরপত্র সাদাই রয়ে গেল। জীবন খাতায় যেন শুন্যই পেলেন তিনি।
‘কতবার তোমাকে ডাকলাম,’ নিচুস্বরে বলে চলেছে নাবিলা, ‘তুমি সাড়াও দিলে না।’ চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল তার। এই পৃথিবীতে সে আর নেই যেন। মনের মাঝে নতুন যে অন্ধকার পৃথিবীর নষ্টজন্ম হয়েছে, তার অন্ধকারে নিজেকে লুকিয়ে অজানা এক পথে ভ্রমন করছে সে। এই পৃথিবীর সুর্য আর ফ্লুরোসেন্ট-নিয়নের আলোয় নিজেকে নগ্ন মনে হচ্ছে।

মুখ ঘুরিয়ে আবার শুয়ে রইল সে। রাতে ডাক্তারের অনুমতিক্রমে নাবিলার জবানবন্দী টুকে নিল পুলিশ। সেই বখাটে ছেলে রনিই তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল আরও কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায়। এক রুমে তাকে আটকে রেখে নির্যাতন চালায় সে। রাগে পাগল হয়ে গিয়েছিল রনি তাকে লাথি মারার জন্য। কেউ যেন তাকে সন্দেহ না করে তাই ঘটনাটার পর চুপ করে ছিল সে। এমনকি নাবিলাকে তুলে নেবার সময় নিজে ছিল না । শক্ত একটা এলিবাই তৈরি করেছিল সে বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিয়ে। কারণ তাকে যে সন্দেহের তালিকায় প্রথমে রাখা হবে বুঝে গিয়েছিল।

পুলিশ এরপর আর দেরি করল না। রনিকে গ্রেফতারের জন্য বেরিয়ে গেল। বাসায় তাকে না পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় খবর নিয়ে এক বস্তি থেকে পরেরদিন তাকে গ্রেফতার করল পুলিশ। ওমর সাহেবের ওদিকে মন নেই এখন। তিনি এখন নাবিলাকে নিয়ে ব্যস্ত। বাসা আর হাসপাতাল করেই দিন কাটছে তার। খাবার নিয়ে আসেন বাসা থেকে। নিজ হাতে খাইয়ে দেন, যদিও খেতে চায় না নাবিলা। কথাও একদম বলে না বললেই চলে।
একদিন বিকেলে মেয়ের কেবিনে কিছু খাবার নিয়ে ঢুকলেন ওমর সাহেব। ওর অবস্থার কোন উন্নতি হয় নি এই কয়দিনে। বেডের পাশে খাবারগুলো রেখে কেবিনের পশ্চিম দিকের জানালা খুলে দিলেন তিনি।
‘দ্যাখ মা, আকাশটা কি সুন্দর আবির রঙয়ের মেঘে ছেয়ে গেছে! তোর খুব পছন্দের এই রকম বিকেল।’, নিজের মনে বলে চলেছেন তিনি। ‘মনে নেই, এইরকম বিকেলে আমাকে বলতি ছাদে যেতে আর তুই চা বানিয়ে নিয়ে আসতি দুজনে মিলে খাব বলে। আমাকে মিষ্টি বিস্কিট খেতে দিতিস না। তুই খেলে আমারও খেতে ইচ্ছা হতে পারে বিধায় তুইও ডায়া বিস্কিট খাইতি।’
আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল নাবিলা। ‘আমার আকাশে এখন শুধু কাল রঙ বাবা। আবির রঙয়ের মেঘ দিয়ে কি হবে!’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ওমর সাহেব। নাবিলা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে চাইছে না। তার বেডে এসে বসলেন তিনি। ‘রনিকে জেলে চালান দেয়া হয়েছে।’, বললেন তিনি মেয়েকে। ‘কিছুদিনের মধ্যেই বিচার শুরু হবে। উকিল ঠিক করেছি ভাল একজন।’
কোন প্রতিক্রিয়া হল না মেয়ের। ‘কিছু বল মা।’, তিনি বললেন।
মেয়ের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। নাবিলা বলল, ‘জীবনে মাত্র দুইজন পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেছে। কিন্তু কত পার্থক্য তাদের ভিতর, তাই না বাবা? একজন পৃথিবীর সব সুখ এনে দিল আমাকে আর আরেকজন সবটুকু নিয়ে গেল আমার কাছ থেকে।’
‘উপযুক্ত বিচার হবে ওর, দেখিস তুই’, টলমল চোখে বলল ওমর সাহেব।
‘কিন্তু আমার কি হবে বাবা? আমি আর কোনদিন স্বাভাবিক হতে পারব না। গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতাকে দুঃস্বপ্ন বলে ভুলে থাকতে পারব না। প্রতি মুহুর্তে আমাকে কুরে কুরে খাবে ওগুলো। দেখেছ বাবা, মানুষের মন কি জিনিস! তোমার দেয়া এত বছরের আদর-স্নেহের স্মৃতিগুলো মাত্র তিনদিনের নিচে চাপা পড়ে গেল। কি আশ্চর্য!!’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে মা।’
‘কিছুই ঠিক হবে না। আমি স্বার্থপর হয়ে গেছি বাবা। অনেক স্বার্থপর! শুধু নিজের কথাই চিন্তা করছি এখন। তোমার কথা চিন্তা করছিনা যে, আমাকে হারালে তুমি কি নিয়ে বাঁচবে। আমার এই অবস্থা থেকে সেরে উঠতে অনেক ইচ্ছাশক্তির দরকার, কিন্তু আর কোন ইচ্ছাশক্তিই যে অবশিষ্ট নেই আমার, বাবা। সব হারিয়ে ফেলেছি। শুধু নিচের দিকেই তলিয়ে যাচ্ছি আমি। তোমার দোহাই লাগে বাবা, আমাকে টেনে রেখ না। তোমার স্বার্থপর মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। আমাকে সরে গিয়ে বাঁচতে দাও, রাখতে গিয়ে মেরে ফেল না।’ বাবার গলা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল নাবিলা।
‘তোমার সাথে আরও অনেক দিন বাঁচার ইচ্ছা ছিল, বাবা।,’ কাঁদতে কাঁদতে ফিসফিস করে বলতে লাগল নাবিলা। ‘অনেক কিছু দেখার বাকি ছিল জীবনের। কিন্তু এই অন্ধ চোখ দিয়ে আর কিছুই দেখতে পাব না আমি। তোমাকেই ঝাপসা লাগছে এখন। মাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি, বাবা। কি সুন্দর সাদা পোশাক পরে থাকে সবসময়। আমাকে কাছে ডাকে শুধু। আমি মায়ের কাছে যাব। আমাকে মায়ের কাছে যেতে দাও, বাবা। প্লিজ।’

নাবিলাকে ঔষধ খাওয়াতে এক নার্স এসেছিল। বাবা আর মেয়ের এই কথোপকথন শুনে চোখ মুছে নীরবে বেরিয়ে গেল। সেদিন রাতের দিকে নাবিলার অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে লাগল। কেবিন থেকে ওমর সাহেবকে বের করে দিল ডাক্তার। বাইরে দাঁড়িয়ে গ্লাস লাগানো দরজা দিয়ে ভিতরের সব কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিল তার সামনে সব কিছু ধীরে ধীরে নড়ছিল। নাবিলাকে ঘিরে পাঁচজন মানুষ তার জীবন বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। একজন ডাক্তার ডিফিব্রিলেটর দিয়ে বারবার বুকে চাপ দিচ্ছিল আর নাবিলার সারা শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠছিল। কিন্তু যার নিজেরই বাঁচার কোন ইচ্ছা নেই, তাকে আটকাবে কে!

ডাক্তারের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে নাবিলা চলে গেল। যমে মানুষে টানাটানিতে মানুষের পরাজয় ঘটল। ওমর সাহেব মেয়ের মৃত্যুতে আর নতুন করে কাঁদলেন না। অল্প সময়ের ভিতর অনেক কিছু বুঝতে পেরেছেন যেন তিনি। কোথায় যেন শুনেছিলেন, ‘Death is just another path, one that we all must take.’ নাবিলা এখন সেই পথের যাত্রী। নিজের ইচ্ছাতেই সে যাত্রী হয়েছে এই পথের। তার মা দাঁড়িয়ে আছে সেই পথের শেষ মাথায় তার অপেক্ষায়। হয়ত এতক্ষণে সে খুঁজে পেয়েছে তার মাকে। খুঁজে পেয়েছে তার হারিয়ে যাওয়া কোল!

নাবিলাকে সমাহিত করার সকল কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করলেন ওমর সাহেব। পিতামাতার কাছে সবচেয়ে ভারী নাকি নিজের কাধে সন্তানের লাশ। কিন্তু তার সেরকম মনে হল না কেন জানি। নিজের ছোট বাড়িটার আঙিনায় মায়ের কবরের পাশেই কবর দিলেন মেয়েকে। সাদা কাফনের মোড়কে আবৃত হয়ে কবরের অন্ধকারে রয়ে গেল সাদা মনের মেয়েটা।

ওমর সাহেবের এখন একটাই চিন্তা। তার মেয়ের যারা এই অবস্থা করেছে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। কিন্তু এখানে তিনি বড় একটা ধাক্কা খেলেন। পুলিশে গ্রেফতার করা এক জিনিস আর কোর্ট যে আলাদা জিনিস তা বুঝলেন নতুন করে। রনির বাবা প্রচুর টাকা দিয়ে ডাকসাইটে এক উকিল ভাড়া করেছে। কোর্টে মাত্র কয়েকটা কথা বলে ব্যাপারটাকে প্রায় নিজের পক্ষে নিয়ে নিল সে। ভিক্টিম এর জবানবন্দী অনুযায়ী রনি অপরাধী। কিন্তু এবার যুক্তি আর প্রমানের উপর নির্ভর করছে শাস্তি। নাবিলাকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছিল জানত না সে। কাজেই পুলিশ সেই জায়গা খুঁজে পেল না। রনিরা পুরোপুরি অস্বীকার করল নাবিলাকে অপহরণের ঘটনা। বলল হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছে তাদের নামে। অনেকে সাক্ষী দিল ঘটনার কয়েকদিন রনি বাড়িতেই ছিল।

নাবিলার শরীরে কোন আলামত পাওয়া যায়নি যা দিয়ে প্রমান করা যায় রনি অপরাধী। স্পার্ম কিংবা ফিঙ্গারপ্রিন্ট কিছুই না। খুব সাবধানে কাজটা করা হয়েছে। ভিক্টিম এর জবানবন্দী আর তার পিতার সন্দেহ প্রমানের অভাবে ধোপে টিকল না। বিচারক জামিন মঞ্জুর করলেন অপরাধীদের। কোর্ট সন্তান হারানো পিতার মন বোঝে না, প্রমান খোঁজে।

এবার একরাশ হতাশা আর দুঃখ ছেঁকে ধরল ওমর সাহেবকে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে তার মেয়ের অত্যাচারকারীরা। এমনকি হুমকিও পেলেন তিনি কেস তুলে নেবার। কয়েকদিন থানা আর কোর্ট দৌড়াদৌড়ি করে ক্ষান্ত দিলেন তিনি। উপলব্ধি করতে পারলেন রুঢ় সত্যটা। তার মেয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ীরা সাজা না পেলে থানা বা কোর্টের কারও কিচ্ছু আসবে কিংবা যাবে না।


শেষ পোষ্টের লিংকঃ Click This Link

চলবে................
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:১১
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×