somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুক রিভিউ: পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল

০৬ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৮:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

---পাঠ প্রতিক্রিয়া---
বই: পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল
লেখক: প্রীতম বসু
জনরা: হিস্টোরিক্যাল থ্রিলার

কাহিনী সংক্ষেপ :
চয়নবিলের তলা থেকে আবিষ্কৃত হল পাথরে খোদাই করে ১৪০০ সালের কথ্য বাংলা ভাষায় ও লিপিতে লিখিত পঞ্চাননমঙ্গল কাব্য। কিন্তু সেখানে কেন পঞ্চানন ঠাকুরের পূজার মন্ত্রে আমাদের পূর্বপুরুষেরা লুকিয়ে রেখেছিল অজস্র আধুনিক অঙ্কের সুত্র?

ছয়শত বছর আগেরকার বাঙ্গালির অজস্র অজানা পারদর্শীতার আলেখ্য দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠবে, কিন্তু এক অশুভ বৈদেশিক শক্তি পঞ্চাননমঙ্গল ধ্বংস করার জন্য কেন উন্মত্তপ্রায়? বখতিয়ার খলজী নালন্দা ধ্বংস করে তিনমাস ধরে পুথি পুড়িয়ে আমাদের অতীত মুছে দিয়েছিল। তবে কি পঞ্চাননমঙ্গলের সাথে সাথে হারিয়ে যাবে প্রাচীন বাঙ্গালির বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শনের শেষ দলিল?

প্রতিক্রিয়া:
বই পাঠের প্রতিক্রিয়ায় যাবার আগে রিভিউ এর প্রয়োজনেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্মন্ধে কিছু কথা বলে নেয়া দরকার। যারা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করেছেন, কিংবা বিসিএস পরীক্ষা দেবার জন্য হলেও এ সম্মন্ধে পড়তে বাধ্য হয়েছেন তারা জেনে থাকবেন (না পড়া থাকলে যারা এই রিভিউ পড়ছেন তারাও এই ফাঁকে জেনে রাখুন) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে তিনটি যুগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাচীন-মধ্য-আধুনিক যুগ।

প্রাচীন যুগের সাহিত্যের আদি নিদর্শন হল চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় বা চর্যাপদ, যা ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাধন সঙ্গীত; যেটা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৫ সালে নেপালের রাজদরবার থেকে আবিষ্কার করেন।

মধ্যযুগের (১২০০-১৮০০) প্রথম দিককার ১৫০ বছর, মতান্তরে ২৫০ বছর সময়কালকে বলা হয় 'অন্ধকার যুগ', কারন এই সময়কালে বাংলা সাহিত্যের কোন উল্লেখযোগ্য নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যতিক্রম শুধু রামাই পন্ডিতের 'শূন্য পূরাণ' এবং হলায়ুধ মিশ্রের 'সেক শুভোদয়া'। এই যুগের পরের সাহিত্যিক রত্নসম্ভার হল বডু চন্ডীদাসের 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন', পরবর্তীতে বিভিন্ন মহৎ কবিদের (বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, চণ্ডীদাস, বলরাম দাস) দ্বারা রচিত 'বৈষ্ণব পদাবলী'।

এরপর আসে 'মঙ্গলকাব্য’। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী এর 'চণ্ডীমঙ্গল', ভারতচন্দ্র রায়গুনাকর এর 'অন্নদামঙ্গল', কানাহরিদত্তের 'মনসামঙ্গল', ময়ূরভট্ট এর 'ধর্মমঙ্গল’ সহ আরও অনেক কবির লেখা এ জাতীয় মঙ্গলকাব্য ছিল মধ্যযুগের আরেক শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই ধরনের কাব্যে কবিরা বিভিন্ন কাহিনীকে আশ্রয় করে নিজেদের কথা, সমাজের কথা, আচারের কথা বর্ননা করতেন। বলা যায় নিজের কথা অন্যের মুখ দিয়ে প্রকাশ করতেন, ধর্মকে আশ্রয় করে (এখানে একটা আলাদা ইনফরমেশন দিয়ে রাখি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী, যিনি কিনা তার প্রায় সমবয়সী ছিলেন, তাকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। সে ভালবাসত বিহারীলাল চক্রবর্তী নামের এক কবির কবিতা। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেন অন্য কবিরা যেখানে নিজের মনের কথা ধর্মের আবরণে প্রকাশ করেছে, সেখানে প্রথম এই বিহারীলাল নিজের মনের কথা নিজেই প্রকাশ করেছেন কবিতায়। যার ফলে তা হয়ে উঠেছে জনসাধারন এর মনের কথা। তিনি বেশ আকৃষ্ট হয়ে পড়েন সেই কবিতাগুচ্ছ দ্বারা। নিজে আগে থেকে কিছু লেখালেখি করলেও বিহারি লাল এর কবিতা দ্বারা তিনি আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে কাব্যচর্চা আরম্ভ করেন। বিহারীলাল চক্রবর্তী কে তিনি 'ভোরের পাখি' বলে উপাধি দেন। এখনো বাংলা সাহিত্যে তাকে ভোরের পাখি বলে ডাকা হয়।)

মঙ্গলকাব্যের পাঁচটি অংশ থাকে: বন্দনা, আত্মপরিচয়, দেবখন্ড, মর্ত্যখন্ড ও শ্রুতিফল। ব্যাস!! অনেক লেকচার হইছে। এবার কাহিনী তে আসি।

কাহিনী এর শুরুতেই দেখা যায় যে গৌড় থেকে এক সেনাপতি সুলতানের আদেশে এক মন্দির ধ্বংস করতে এসে সেটা না পেয়ে তারপর পাশের এক বৌদ্ধ বিহারের অজস্র পুথি আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলে।

এরপর কাহিনী একলাফে চলে আসে ১৯৯৬ সালে পাঁচমুড়ো এর পুরানো জমিদারবাড়িতে। সেখানে জমিদার উত্তরসূরি সদানন্দ ভটচাজের বাড়িতে প্রাচীন পুথি বিক্রির চেষ্টারত কালাচাঁদ চোর কে দেখা যায়। ড. অংশুমান ধাড়া নামক এক বিলাতি সাহেবের জন্য পুথি আসল না নকল সেটা পরীক্ষার কাজ করে সদানন্দ। এরপরে সেখানে খবর আসে চয়নবিলের তলা থেকে লিপিখোদাই করা এক পাথরের সাথে শিকলে বাধা কংকাল উদ্ধার করা হয়েছে।

কালাচাঁদ এরপর পাঁচমুড়ো থেকে উদ্ধার হওয়া এক পাথরের লিপি থেকে টোকা কাগজ নিয়ে আসে হরু ঠাকুর এর কাছে যে কিনা লিপির জাল করার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত এক লোক। সেখানেই দেখা মেলে হরু ঠাকুরের ভাগ্নে বদন এর, যে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছে। সে কালাচাঁদ এর আনা কাগজ থেকে লিপির কবিতা পড়ে বের করে যে কবিতার আড়ালে অংকের সুত্র বিবৃত আছে। সাথে সাথে কালাচাঁদ বুঝে যায় এক স্বর্ণখনি এর খোজ পাওয়া গেছে।

সদানন্দের বিশ্বাস এই পাথরগুলো হল সেই লোকমুখে শুনে আসা রহস্যময় 'পঞ্চাননমঙ্গলকাব্য', যেটা অনেক আগে হারিয়ে গিয়েছিল কোন সুত্র না রেখেই। এখানেই কাহিনী জটিল হয়ে পড়ে।

এক বিদেশী ফ্যানাটিক এসে পড়ে কাব্যটা দখল করার জন্য। তার জালে ফেঁসে যায় কালাচাঁদ সহ বাকি দুইজন। এরপর কালাচাঁদ এর বিভিন্ন তৎপরতায় ও কূটচালে কাহিনী সমাপ্তির দিকে এগোয়। সদানন্দ এর গভীর জ্ঞান আর মাঝে হরু ঠাকুরের সাথে ঘটা কিছু রহস্যময় ঘটনা পাঠককে অতীতের সাথে সংযোগ করিয়ে দেয়।

অন্ধকার যুগ কেন এসেছিল তার কিছু কারণ পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়। সাথে পুরো কাহিনী জুড়েই মঙ্গলকাব্যের বলা যায় একপ্রকার ব্যবচ্ছেদ চলে।

আমার পাঠ্যানুভূতি:
আমি পুরোই চমৎকৃত হয়েছি বইটা পড়ে। লেখক প্রাচীন বাংলা লিপি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এক স্কলার, তাই কাহিনীজুড়েই তার গভীর জ্ঞানের পরিচয় পেয়েছি। কাহিনী তে যে পঞ্চাননমঙ্গলকাব্য তৈরি করা হয় তা লেখকের নিজের লেখা। প্রাচীন কথ্য বাংলা আর লিপিভাষার মিশ্রনে তিনিই সেটা লিখেছেন, যা কিনা বেশ কঠিন একটা কাজ।

কাহিনী বর্ননা আর বাক্যগঠনে লেখক দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আমি সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়েছি লেখকের সুক্ষ্ম রসবোধের প্রতি। প্রায় প্রতি পাতাতেই গভীর সব তত্ত্বালাপের ভীড়ে এমন করে হিউমারকে মাখিয়েছেন যে তা নিউমার্কেট থেকে কেনা এবং কালাচাঁদ এর রান্না করা হরিনের মাংসের মত সুস্বাদু হয়ে উঠেছে। তত্ত্বের আর ইতিহাসের ভীড়ে বিন্দুমাত্র বোর হবার সুযোগ দেন নি। কালাচাঁদ, হরু ঠাকুর আর সদানন্দ তিনজনেই সমানে তাদের কথার ভিতর দিয়ে 'কমিক রিলিফ' বা 'ব্রিদিং স্পেস' দিয়েছে।

সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে কালাচাঁদ চোরের ক্যারেক্টার, কাহিনী এর মেইন প্রোটাগনিস্ট সে। রসিক, ক্ষেত্রবিশেষে চাটুকার, সুযোগ সন্ধানী, ঝুঁকি নেবার মানসিকতাওয়ালা, পরোপকারী- এইসব গুন তাকে ভাল-খারাপের মাঝামাঝি 'গ্রে ক্যারেক্টার' এ পরিণত করেছে।

লেখকের মনে হয় বাংলার মুসলিম শাসকদের প্রতি ক্ষোভ আছে। অন্ধকার যুগ বাংলা সাহিত্যে কেন এসেছিল তা একটা তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার। এই নিয়ে একাডেমিক মহলে তর্কবিতর্ক হয়েছে। এই বইতে লেখক মুসলিম শাসকদের দায়ী করেছেন। জাতিগত শ্রেষ্ঠতার আকাঙ্ক্ষাকে কাহিনীর যূপকাষ্ঠে ফেলে ইতিহাসের আলোকে কাহিনীকে দাড় করিয়েছেন।

যদি জিজ্ঞাসা করেন বইটা পড়ে আমি কতটুকু সন্তুষ্ট, আমি বলব ৯৮.৫ পারসেন্ট। ২.৫ হাতে রেখে দিলাম এই কারনে যে, পৃথিবী তে কোন কিছুই পারফেক্ট না। যেমন: নেপোলিয়ন বেটে ছিলেন!! হা হা হা।

৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×