''হুজুরের পানিপড়া''
(আখতার মাহমুদ)
মাছ কুটতে কুটতে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছল অপর্ণা। মরার চোখেও এত জল থাকে। দরদর জল গড়াচ্ছে গাল বেয়ে। চিবুক চুইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝবছে মাছের এঁটো পানিতে। মাছ আধকুটা অবস্থায় রেখে হাত ধুয়ে উঠল সে। ড্রয়িংরুমে উঁকি দিয়ে দেখল ফায়সাল গম্ভীর মুখে হোমওয়র্ক করছে। কেজি ওয়ানে পড়ে, এইটুকুন ছেলে এত গাম্ভীর্য পায় কোথায় কে জানে। বাথরুমে ঢুকে পানির কল ছেড়ে দিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদল অপর্ণা। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ফায়সাল শুনে ফেলবে এই ভয়ে প্রাণপণে নিজেকে সামলাল। চোখের জল সীমাহীন, শেষ নেই যেন এর। টুকরো টুকরো কিছু মধুর স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে আর চোখের জল আরো উচ্ছসিত বেগে বইছে। প্রাণপণ চেষ্টা করছে সে চোখের জল রুখে দেয়ার। পারছে না। বাঁধভাঙা জলের মত হুড়মুড়িয়ে উঠে আসছে কান্না একেবারে ভেতর থেকে; যেখানে কোথাও একটা ব্যথা তীব্র হয়ে বিঁধছে। অনেক কাঁদল অপর্ণা। এত বেশি আর কখনো কাঁদেনি। একসময় আপনা আপনিই থামল উথলে ওঠা অশ্র“। চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে এসে ওয়ারড্রবের ভেতর কাঁপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা ছোট্ট শিশিটা হাতে নিল। ভেতরে স্ফটিকের মত স্বচ্ছ পানি টলটল করছে। হুজুর বলেছেন একশিশি পানিই যথেষ্ট। এই পানিপড়াটুকু খাওয়ালে নাকি পুরুষের মন ঘরে ফিরবে। স্ত্রী রেখে পরনারীর দিকে চোখ দেবে না। বড় কামেল হুজুর। অনেক প্রশংসা শুনেছে সে এই হুজুরের। অনেকে তাঁকে পীর বলে মানে। কিন্তু তিনি নিজেকে দাবী করেন আল্লাহ তাআলার খেদমতগার হিসেবে।
অপর্ণা যথেষ্ট আধুনিকা- চালচলন, মানসিকতায়। একজন উচ্চ শিতি মানুষ হয়েও এইসব বুজুরুকি বিশ্বাস করবে এটা তার নিজের কাছেই ছিল অচিন্ত্যনীয়। আসলে মানুষের সামনে যখন দ্বিতীয় কোন পথ খোলা থাকে না, সে তখন নিজেকে প্রবোধ দেয় কিছু অদ্ভুত বিশ্বাসে নির্ভর করে। অপর্ণা বিশ্বাস করতে চায় না এসব। তবুও তার বারবার মনে হচ্ছে, যদি ফল হয়? অলৌকিক কিছুতো ঘটতেও পারে!
স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত এটা সে জানে। কিন্তু এ সমস্যা সমাধানের কোন পথ তার কাছে খোলা নেই। আবার বিষয়টা এমনই স্পর্শকাতর যে কারো সাথে আলাপ করে পরামর্শও চাওয়া যাচ্ছে না। তার উপর সাব্বির কাজ করে ঢাকায়, সে থাকে চট্টগ্রামে। তাই সাব্বির কি করছে কোথায় যাচ্ছে কার সাথে মিশছে এ সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই। ফোনে কথা হয় প্রায়ই, কিন্তু ফোনে একটা মানুষকে কতটা বোঝা যায়, না দেখে? সাব্বির অবশ্যই প্রতিমাসে দুইবার করে আসে। দুদিন করে থেকে যায়।
সে নিজেও একটা স্কুলে পড়ায়। টাকা বড় কঠিন বাস্তব। আজকাল একজনের আয়ে সংসার চলে না। যদি চলত তাহলে যে করেই হোক অপর্ণা সাব্বিরের কাছাকাছি থাকত।
পানিপড়া টুকু একটা বোতলে অন্য পানিতে মিশিয়ে ফ্রিজে রাখল। আজ সাব্বির আসছে। রওনা দিয়েছে সেই দুপুরে। সে ঘরে ঢুকেই প্রথমে ঠান্ডা পানি খেতে চাইবে জামা-কাপড় না ছেড়েই। তখন অপর্ণা এই বোতলটা এগিয়ে দেবে। হুজুর বলেছেন শিশির পানি যতটুকু পানিতে মেশানো হবে ঠিক ততটুকুই খাওয়াতে হবে। তাই করবে অপর্ণা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অপর্ণা। সে দীর্ঘশ্বাসে মিশে অসহায়ত্ব-শূন্যতা।
বিগত ছয়মাস ধরে যন্ত্রণাটা ভোগাচ্ছে ওকে। ছয়মাস আগে সাব্বিরের এক কলিগ ফোন করে জানিয়েছিল সাব্বির নাকি তাদেরই এক সুন্দরী কলিগের সাথে খুব অন্তরঙ্গ হয়ে মিশছে, যা খুবই দৃষ্টিকটু। মহিলা নাকি অভূতপূর্ব সুন্দরী। স্বামীর সাথে লিগ্যাল সেপারেশন চলছে। বাচ্চা-কাচ্চা নেই। যথেষ্ট স্বাধীনচেতা। হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল অপর্ণা। সাব্বির এমনটা করছে? মোটেই না! সে কখনোই এমন কাজ করবে না। কিন্তু কোথাও অবিশ্বাস-সন্দেহ একবার শেকড় ছড়ালে তা উপড়ে ফেলা কঠিন। অপর্ণা গোপনে খোঁজ নিতে শুরু করল। খোঁজ নিয়ে এমন কিছু সে জেনেছে যা তার জন্যে মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। সেই মহিলারও নাম্বার যোগাড় করে ফেলেছে সে। সাব্বিরের ফোন যখন ওয়েটিংয়ে পায় তখন ভিন্ন একটি নাম্বার থেকে সেই মহিলার নাম্বারে ট্রাই করে সেটাও ওয়েটিংয়ে পাওয়া যায়। এ থেকে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোতো কোন কঠিন ব্যাপার নয়। এছাড়া গত মাসেই, যখন সাব্বির এসেছিল ওর মানিব্যাগ ঘেঁটে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল অপর্ণা। সেই মহিলার ছবি তার মানিব্যাগে। মহিলা সত্যিই অনন্য সুন্দরী।
সাত বছরের সংসার ওদের। প্রেম করে বিয়ে। কত কষ্টের পর ওরা এক হয়েছিল সেটা কি ভুলে গেছে সাব্বির? একসময় প্রচন্ড মার খেয়েছিল অপর্ণা বাবার হাতে, অজস্রবার। তবু সে ভাঙেনি। ঘর থেকে পালিয়ে এসে ঠিক সংসার পাতিয়েছে সাব্বিরের সঙ্গে। এত এত সুখস্মৃতি জমা হয়ে আছে এই কয় বছরে! অথচ এ কোন ঝড় আসছে তার সাজানো জীবনে? অপর্ণা অবশ্যই সাব্বিরকে ওই মহিলার বিষয়ে একটা প্রশ্নও করেনি। রুচিতে বেঁধেছে।
রান্নাবান্নার পাট চুকিয়ে ফায়সালকে নিয়ে পড়ল সে। ছেলেটা গোঁ ধরে আছে, বাবা আসলে খাবে। কিন্তু রাত দশটা বেজে গেছে এখনো এসে পৌঁছায়নি সাব্বির। জোর করে ফায়সালকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। কাল আবার স্কুল আছে। এরপর ড্রেসিং টেবিলে বসল নিজেকে সাজাতে। আয়নায় নিজের শ্যামলা মুখখানি দেখল। অনেককাল আগের সেই কোমলতা ছাপিয়ে এখন রুতাই প্রাধান্য পাচ্ছে। চোখের নিচে কালি। চুলগুলো প্রাণহীন। অথচ এক সময় সাব্বির ওর চুল পছন্দ করত বলে চুলের কি যতœ যে সে নিত!
জলপাই রঙের গত ঈদের কেনা জামদানি শাড়িটা পড়ল অনেক সময় নিয়ে। আয়নায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজের ছিপছিপে দেহখানি দেখল। জানে সে অতি সুন্দরী নয়। তবুতো সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে সাব্বির ওকে পছন্দ করেছিল। এখন কি আর করছে না? কেন?
এগারটা বেজে গেলে অস্থির হয়ে পড়ল অপর্ণা। পুরুষগুলো কেন এমন হয়? জানে কেউ একজন অপো করে আছে তবু আসার নাম নেই। ফোনও রেখেছে বন্ধ করে।
সাড়ে এগারটায় এল সাব্বির। কান্ত বিধ্বস্ত চেহারায় ঘরে ঢুকেই ঠান্ডা পানি চাইল। অপর্ণা দুরু দুরু বুকে ফ্রিজ থেকে সেই বোতলটা বের করে দিল। সাব্বির একনিঃশ্বাসে হাফলিটার পানি শেষ করে গোসল করতে ঢুকে গেল। এই ফাঁকে টেবিলে খাবার সাজাল অপর্ণা। বোতলে আরও অর্ধেক পানি আছে। তাই টেবিলে পানির জগ না রেখে বোতলটাই রাখল। গোসল করে বেরিয়ে টুকটাক কথা বলল সাব্বির। সবই সাংসারিক কথা। টেবিলে বসে দুজন নিঃশ্বব্দে খেয়ে নিল। খেয়ে নিয়ে বোতলের অবশিষ্ট পানি নিঃশেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল সাব্বির। গোপনে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে টেবিল গোছাতে লেগে গেল। সাব্বির ছেলের রুমে গিয়ে তার ঘুমন্ত মুখে চুমু খেল। ওর ঘন চুলে বিলি কেটে দিল কিছুণ। এরপর নিজেদের রুমে চলে এল।
অপর্ণা ততণে আজ রাতের মত সমস্ত কাজ শেষ করে ফেলেছে। ওয়ারড্রোবের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এখন সে। হাত দুটো পেছনে। ঘামছে ওগুলো উত্তেজনায়। সাব্বির বিছানায় আধশোয়া হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল অপর্ণার। অনেকদিন... যেন যুগ যুগ আগে ঠিক এইরকম ঘোরলাগা চোখে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকত সাব্বির। তারপর আড়মোড়া ভেঙে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতো। কাছে এসে শক্ত করে কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে বুকে পিষে ফেলত। চুলে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিত। আশান্বিত হয়ে উঠল অপর্ণা। তবে কি জিনিসটা কাজ করছে?
ঠিক সেই আগের মতন অনেকণ তাকিয়ে থেকে আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠল সাব্বির। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। অপর্ণার শরীরের সমস্ত শক্তি যেন কেউ শুঁষে নিয়েছে। পড়েই যেত, নেহাত সাব্বির শক্ত করে ধরে আছে বলেই পড়ে যায়নি। সাব্বির অপর্ণার চুলে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিল। গাঢ় স্বরে বলল, ‘চুলের যতœ নাও না? কত সুন্দর ছিল তোমার চুল।’
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না অপর্ণা। তার চুলের দিকে চোখ গেছে সাব্বিরের? তাহলে পানিপড়া সত্যিই মনেহয় কাজ করছে। হুজুরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ছেয়ে গেল মন। হঠাৎ হাই চাপল সাব্বির। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অপর্ণা বলল, ‘তুমি টায়ার্ড।’ প্রশ্ন নয় মন্তব্য।
‘হ্যাঁ ঘুম পাচ্ছে। ঘুমোবো।’
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল অপর্ণার। পাশে তাকিয়ে দেখে সাব্বির নেই। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে ঘড়ি দেখল। রাত সাড়ে তিনটা। ল্যাম্প অফ করে বিছানা থেকে উঠল। বাথরুমে নেই, থাকলে লাইট জ্বলত। ফায়সালের রুমে উঁকি দিল একবার। সেখানেও নেই। হঠাৎ একটা সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই পা টিপে টিপে বেলকনির দিকে এগোল। বেলকনির দরজা ভেজানো। খুব সাবধানে দরজায় কান পাতল অপর্ণা। সাব্বিরের নিচু কন্ঠ শুনতে পেল।
‘এমন করলে চলে? মাত্রতো দুটো দিন। এই দুটো দিন নাহয় একাই থাকলে।’
.....................
‘কি করব বল ছেলেটার জন্যে আসি।’
.....................
‘তুমি অবুঝের মত করছ কেন?’
....................
‘আচ্ছা বাবা আচ্ছা, ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমি কালই ফিরে আসছি, ঠিক আছে?’
অপর্ণা আর দাঁড়াল না সেখানে। নিঃশ্বব্দ পায়ে সরে এল। ছেলের রুমে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকল খর চোখে।
*সমাপ্ত*