somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সহযাত্রী (পর্ব -৪)

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুমি আর কলির দৌলতে দাশনগর থেকে কোলাঘাট যেতে মন্দ লাগত না, কোলাঘাটে ওরা নেমে যাবার পর আবার দুঃসহ একাকীত্ব। মোবাইলে টাওয়ার থাকত না। এফ এমও ধরা যেত না। টাইমস অব ইন্ডিয়া মুখস্ত করতে করতে কোন মতে খড়গপুর পৌঁছত শিলালিপি। ফিরতি ট্রেনে বাড়ি ফিরে যাবার অদম্য ইচ্ছেটাকে কবর দিয়ে, চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে দুনিয়ার দীর্ঘতম প্লাটফর্ম পার হয়ে, সম্ভবত খাড়াইতম ওভার ব্রিজ টপকে, হাফ মাইল হেঁটে অটো স্ট্যান্ড। স্টেশনের সামনেই রিক্সাস্টান্ড, তবে রিক্সাওয়ালা গুলিকে স্বচ্ছন্দে ডাকাত বলা যায়, প্রত্যহ ওদের সাথে দরাদরি অথবা বচসা করা শিলালিপির দুঃস্বপ্ন মনে হত। সুতরাং অটো ছাড়া গতি ছিল না। অটোতে অবশ্য মিনিট সাতেকের বেশি লাগত না অফিস পৌছতে।
পোঁছেই বা কি লাভ হত? কোন অজ্ঞাত কারণে, সমস্ত কর্মযজ্ঞ থেকে শিলালিপি ছিল বঞ্চিত। কাজ বলতে এক আধো অন্ধকার ড্যাম্প ধরা, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে সারাদিন গালে হাত দিয়ে বসে থাকা। মাসে একবার একটা রিপোর্ট সই করে কলকাতা নিয়ে যাওয়া ছাড়া এক কথায় শিলালিপি সম্পূর্ণ বেকার। ঘরটিতে তিনটি জানালা, যার মধ্যে দুটি বাইরে থেকে ইট দিয়ে গেঁথে বন্ধ করা। তৃতীয় জানলাটি খোলে বটে, প্রচণ্ড বর্ষা আর তীব্র শীতেও তাকে খুলেই রাখতে হয়, উপায়ন্তর নেই, পাল্লা ভাঙা। চেম্বারে একটা ফোন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি, মাঝে মাঝে শিলালিপির মনে হত জগত বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে ওকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে।
বিকাল পৌনে পাঁচটা বাজলে, বন্দী দশা ঘুচত। সারা দিন বসে থাকার ক্লান্তি আর চূড়ান্ত হীনমন্যতা নিয়ে গুটি গুটি বেড়িয়ে পড়ত শিলালিপি। ফেরার মেদিনীপুর লোকালে সহযাত্রী বলতে যারা ছিল, প্রায় সকলেই ডাই ইন হারনেস কেসে চাকরী পাওয়া বিভিন্ন বয়সী রেলের চতুর্থ শ্রেণীর মহিলা কর্মচারী। অতি সাধারণ বেশভূষা, কাঁধে বা হাতে সস্তার ব্যাগ অথবা বাজারের চটের থলে। ট্রেন ছাড়লেই প্রত্যেকের ঝোলা থেকে বের হত, মস্ত এক প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট ভর্তি মুড়ি। একটু পড়েই ঝালমুড়ি, চপ আর চা ওয়ালারা উঠত। কেউ চপ কিনে, চটকে মেখে নিত মুড়ির সাথে, কেউ বা মুড়ি ওয়ালাকে পয়সা দিয়ে মাখিয়ে নিত, সাথে গরম চা। প্রাতকালে শিলালিপি যখন ঘুম থেকে ওঠে, তখন ওরা ট্রেন ধরে। দুপুরে রেলের ক্যান্টিনের ভাত আর সকাল বিকাল মুড়ি, বাঁধাধরা রুটিন। পরে একজন শিলালিপিকে জানিয়েছিল, শুধু দুই বেলা মুড়ি আনবার জন্য ওরা নিয়মিত প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট কেনে। যাইহোক, আপাত সাদাসিধে মানুষ গুলির সাথে শিলালিপির খুব কমই ভাব বিনিময় হত। ফেরার পথে মন খারাপ করে বসে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি, সবে ট্রেন খড়গপুর প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়েছে, মহিলারা যে যার মুড়ির প্যাকেট বার করবে করবে করছে, হটাৎ তীব্র গোলযোগ। হইচই, চিৎকার, সপাটে চড় মারার শব্দ এবং অবশেষে ভেউভেউ কান্না। কৌতূহলী হলেও সিট ছেড়ে উঠল না শিলালিপি, পার্শ্ববর্তীনী নিত্যযাত্রীরা দৌড়ল। মহিলা কামরায় ঝগড়াঝাঁটি কালেভদ্রে হয় না। নারদের নিত্য বসবাস। তবে মারামারি আজ অবধি দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি শিলালিপির। একটু পরেই মহিলারা যে যার সিটে ফিরল, সাথে এক ক্রন্দনশীলা তরুণী। দেখলেই বোঝা যায়, নির্ঘাত বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, নতুবা হবু ছাত্রী। সেদিন ট্রেনে বেশ ভিড় ছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিন জনের জায়গায় চার জন কষ্টেসৃষ্টে বসেছিল। এই নিয়েই ঝগড়া এবং হাতাহাতি। জনৈক ডেইলি পাষণ্ড মহিলা ঐ তরুণীকে সাঁটিয়ে এক চড় কশিয়েছেন। ঘটনাপ্রবাহের আকস্মিকতায় হতভম্ভ হয়ে বেচারি মেয়েটি রণে ভঙ্গ দিয়ে করুণ সুরে কাঁদছিল। “আমাকে আমার মা বাবাই কোনদিন মারেনি। সামান্য একটু সিটের জন্য এভাবে কেউ মারে?” শিলালিপির আশে পাশের সহযাত্রীরা নানা ভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। একজন চা কিনে দিল, মেয়েটি তবু ফুঁপিয়েই চলেছে, শিলালিপি, খানিক পরে অবিশ্বাসের সুরে পার্শ্ববর্তিনীকে জিজ্ঞাসা করল, “সত্যই মেরেছে?কে মারল দিদি?”
মহিলা ঠোঁট মুচড়ে বলল, “ঐ দেখছু না, ঐ মেয়েছেলেটা। কেউ মারে বল? আহা কেমন ফোঁপাচ্ছে দেখছনি। ওকে কাঁদতে দেখে, আমার মেয়েটার কথা মনে পড়ছে গো।” বৃদ্ধার অঙ্গুলি অনুসরণ করে শিলালিপি দেখল, দূরে এক ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ মহিলা, আহত জন্তুর মত, ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার আবছায়া আলোতে কপালে লাল টিপটা জ্বলজ্বল করছে, দেখেই মনে হবে, স্বয়ং মা শিতলা, ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। গা ছমছমিয়ে উঠল শিলালিপির।
দিন কয়েক পরের কথা, সকালের ট্রেনটা সবে মেচেদা ছারিয়েছে,মহিলা কামরা মোটামুটি খালি, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে, কিছু নিত্যযাত্রী বসে আছে, শিলালিপি যথারীতি টাইমস মুখস্ত করার বৃথা চেষ্টা করছিল, অকস্মাৎ সেদিনের সেই রণচণ্ডী মহিলা এসে ধপ করে ওর পাশে বসল। এই সিটে সাধারণত আট জন বসে, বর্তমানে মাত্র শিলালিপিকে নিয়ে মাত্র জনা তিনেক মহিলা বসে আছেন। ঠেসাঠেসি বা মারামারি হবার সম্ভবনা ক্ষীণ তবু শিলালিপি একটু জানলার দিকে চেপে বসল। মহিলা অবশ্য দিব্যি খোশ মেজাজে উল্টো দিকে বসা নিত্যযাত্রীনীর সাথে গল্প জুড়লেন। না না বিষয়ে কথা হচ্ছে, হাসির ফোয়ারা ছুটছে মাঝে মাঝেই, হঠাৎ মহিলা ওকে কনুই এর খোঁচা মেরে বলল, “ কি বল, ভাই তাই না?”
“অ্যাঁ? তাই কি? শুনিনি সরি।” মারের ভয়ে সরি বলল বটে, মনে মনে বলল, তোমাদের ভ্যাজোর ভ্যাজোর খামোখা শুনতে যাব কেন বাপু। মহিলা হাসতে হাসতে বলল, “এই সব রঙ, তোমাদের মানায়, আমাদের বয়সে কি চলে? কি করব ভাই, ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে পুজোয় দিয়েছে, তাই পরা।” শিলালিপি জবাবে দেঁতো হাসি হাসল। কিছু পরে ট্রেন আরও ফাঁকা হয়ে গেল। উল্টো দিকের নিত্যযাত্রীনীও নেমে গেলেন। খড়গপুর আসতে তখনও এক ঘণ্টা, মা শীতলা বকেই চলেছে, শিলালিপিরও মন্দ লাগছিল না, বেশ গ্রাম্য সরল মনে হল মহিলাকে। এক চপওয়ালা উঠল, প্রায় খালি ঝুড়ি নিয়ে, মা শীতলা তার সাথে দরাদরি করে, ঠাণ্ডা ডিমের চপ কিনল, আলুর চপের দরে। মুড়িও কেনা হল এক ঠোঙা, অতঃপর ওনার উপরোধে শিলালিপিকে খানিক খেতেও হল, মন্দ লাগছিল না, সময়টা বেশ দ্রুত কাটছিল। ট্রেন যখন খড়গপুর ধুকছে, শিলালিপি অবশেষে জিজ্ঞেস করল, “ দিদি আপনার নাম কি?’’
মহিলা লাজুক হেসে বলল, “ঊষাঙ্গিনি। সবাই ঊষাদি বলেই ডাকে। তুই এত দূর থিকে আসিস, আমার নম্বরটা রেখে দে, দরকারে বলিস।” এভাবেই ঊষাঙ্গিনির সাথে, শিলালিপির আলাপ, তবে বন্ধুত্ব দ্রুত জমেনি, জমতে সময় লেগেছে। লিপিলেখার সাথে দেখা হয়েছিল, এরও বেশ কিছুদিন পর, সৌজন্য ঊষাঙ্গিনি। লিপিলেখা ডেইলি পাষণ্ডগিরি শুরু করার দিন দুয়েকের মধ্যেই কি ভাবে যেন, ঊষাঙ্গিনির সাথে আলাপ জমিয়ে ফেলে, শিলালিপি তখন ছুটিতে। ঊষাঙ্গিনি লিপিলেখাকেও নিজের নম্বর দিয়ে একই ভাবে বলেছিলেন, বিপদে আপদে ওনাকে ফোন করতে। ওনার এই আপেক্ষিক উদারতায়, শিলালিপি না গললেও লিপিলেখা গলে যায়। ঊষাঙ্গিনি অচিরেই হয়ে ওঠে লিপিলেখার ঊষা কাকিমা।পরে যদিও শিলালিপি এবং লিপিলেখা আবিষ্কার করে, যে ঊষাঙ্গিনি ওদের নম্বর তো দিয়েছিল, কিন্তু ফোনটা সঙ্গে না এনে প্রায়দিনই বাড়িতেই রেখে আসেন, এই নিয়ে শিলালিপি এবং লিপিলেখার যুগ্ম আক্রমণের সামনে, উনি অসহায় ভাবে শুধু বলেছিলেন, “কি করব বল? নাতির আব্দার কি ফেলা যায়। তাতে কি? তোরা আমার অফিসে ফোন করবি, বড় সাহেবের ঘরে বটে ফোনটা, ও উনি ডেকে দিবেন। ”

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:১৫
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×