আমি কোনরকম দ্বিধা না দেখিয়ে হাঁটতেই থাকি, যখন ওদের থেকে আর মাত্র কয়েকহাত দূরে পৌছাই তখনি তারা আমাকে দেখতে পেয়ে তাদের কাজের জিনিসপত্র ফেলে মুহুর্তের মধ্যে সবাই কোথায় হারিয়ে গেলো। আমি বিশ্ময়ে বিমূঢ়, ঘটনা কি ওরা এভাবে পালালো কেনো। দেয়ালের কাছে গিয়ে দেখি যা লিখছিল তা ছিল সরকার বিরোধী কিছু স্লোগান, আর আমাকে মোবাইলে কথা বলতে বলতে তাদের দিকে আসতে দেখে সম্ভবত তারা পুলিশ বা সোর্স এমন কিছু ভেবেই দৌড়ে পালিয়ে যায়।
যাহোক ওর কাছ থেকে সঠিক রাস্তাটা জেনে নিয়ে আমি আবার উল্টো দিকে হেঁটে সঠিক রাস্তার সামনে আসি। বামে মোড় নিয়ে তাদের সেই গলিটার মধ্যে প্রবেশ করে প্রায় আধা কিলোমিটারের মতো হেঁটে সামনে দেখি বিশাল একটি খোলা মাঠ। এবার রাস্তা ছেড়ে মাঠের মধ্যে প্রবেশ করি। কিন্তু নতুন যায়গা বলে দিক ঠিক করতে পারছিলাম না, তবে চারদিকে তাকিয়ে দেখি একদিকে অনেক লম্বা একটি টিনের ঘর, সম্ভবত এটাই মাদ্রাসা। এবার তার উল্টো দিকে তাকাই, হ্যাঁ একটা বেশ বড় তিনতলা বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে বটে। আমি এবার সেদিকে হাঁটতে থাকি, একসময় বাড়িটির কাছাকাছি হই। ভালো করে চারদিকে তাকিয়ে বাড়ির সদর দরজা বা মেইন গেট খুঁজতে থাকি, কিন্তু তা না পেয়ে বুঝতে পারি এটা বাড়িটার পেছন দিক।
ব্যাপার কি মেয়েটা কেন আমাকে বাড়ির সামনের রাস্তার বদলে পেছনের রাস্তার বর্ণনা দিলো, ব্যাপারটা আমার মনে খটকা লাগল। একেতো একটু আগে একটা অপ্রীতিকর ঘটনার হাত থেকে বেঁচে ফিরেছি, তারপর এখন আবিষ্কার করি সে আমাকে বাড়ির সদর রাস্তার ডিরেকশন না দিয়ে পেছন দিকে পৌছানোর বর্ণনা দিল। পুরো বাড়ির কোন ঘরেই আলো জ্বলছে না, শুধুমাত্র একতলার একটা বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে হালকা একটা আলোর রেখা বাইরে বেরিয়ে আসছে। একটু পরেই তা বন্ধ হয়ে গেলো। আমি এবার তাকে ফোন করি। আর বাড়ির পেছন অংশ তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি কোন ঘরে আলো জ্বলে উঠে কি না।
একবার, দুবার রিং বাজার পরেও যখন কোন ঘরে আলো দেখলাম না বা ফোন রিসিভ হলনা। তখন কিছুটা হতাশা নিয়ে বাড়িটির কাছ থেকে একটু দুরে চলে আসি। আবার রিং দিতে থাকি। এবার রিসিভ হলো।
-হ্যালো, কি ব্যাপার এখনও ঘুমাও নি!
- নাহ, ঘুম আসছে না!
- তাই, তাহলে আমি ঘুমপাড়ানির গান শুনিয়ে দেই, অথবা তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই, তাহলে ঘুম আসবে।
- নাহ আসবে না, তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, না দেখা পর্যন্ত ঘুম আসবে না।
- তাই! তাহলে কাল চলে আসো।
- কেন, কাল না এসে যদি আজকে আসি।
- আজকে, কখন, কিভাবে?
- কেন এখন যদি আসি তোমার বাড়ির সামনে অথবা পেছনে অথবা বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকি তাহলে তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।
- হুম হবে, তবে বাবা আর দারোয়ান দুজনে চোর বলে তোমারে পেটাতে পারে, এতরাত্রে এভাবে বাড়িতে আসলে।
-তাই তাহলে এক কাজ কর তুমি একটু ছাদে যেতে পারবা ?
- উম, নাহ। ছাদের চাবি আব্বুর ঘরে অন্য সব চাবির গোছার সঙ্গে।
তখন খেয়াল করি নিচতলা ছাড়া প্রায় প্রতিটি রুমের সঙ্গেই একটি করে ব্যালকনি দেখা যাচ্ছে। যদিও গ্রিল দিয়ে ঘেরা দোতলার বেলকোনীগুলো, কিন্তু তিনতলারগুলো আবার অর্ধেকটা খোলা।
- ওহ হো, তাহলে তো এখন আর তোমাকে দেখা হচ্ছে না।
- বুঝলাম না, তুমি আছো সেই কতদুরে, আমি ছাদে গেলে কিভাবে দেখতে।
- কিভাবে দেখতাম! আকাশে চাঁদ আছে না, তুমি চাঁদের দিকে চাইতে আমিও চাঁদ দেখতাম, তাহলেই তো তোমাকে দেখা হয়ে যেতো।
- ও তাই! তাহলে এক কাজ করি খাটের পাশের জানালা খুলে চাঁদ দেখি?
- উম, আচ্ছা তোমার রুমের সঙ্গে বেলকোনী নেই?
- হুম আছে তো।
- তাহলে একটু বেলকোনীতে আসো না।
- আচ্ছা ঠিক আছে, আসছি।
কোন রুমেরই আলো জ্বলল না, তবে লক্ষ করি তিনতলার মাঝামাঝি একটি বেলকোনীর সঙ্গে লাগোয়া রুমের দরজাটি খুলে গেলো। আর সালোয়ার কামিজ পরা একটু মোটামত এবং কিছুটা খাট সাইজের একটি মেয়ে বা মহিলা বেরিয়ে এলো হাতে মোবাইল নিয়ে। আর বেলকোনীর রেলিংয়ে হাত রেখে সম্ভবত কোন টুল বা চেয়ারে বসল। এতদুর থেকে তার চেহারা বা গায়ের রং অথবা বয়স কোনটাই আমি বুঝতে পারছি না। আর সে যেনো আমাকে দেখতে না পারে সেজন্য আমি একটা গাছের ছায়ায় চলে যাই।
-হ্যালো, আসছি তো বেলকোনীতে এবার কি করব।
- এবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখোতে চাঁদ দেখতে পাও।
- হুম পাচ্ছি।
-তাহলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকো। আমিও তাকাচ্ছি।
খেয়াল করলাম মেয়েটা এবার ঘাড়টা একটু ওপরে তুলে আকাশের দিকে চাঁদের দিকে তাকাল। আমি এবার আরো একটু এগিয়ে গেলাম বাড়িটার কাছাকাছি। এরপর ও যে বেলকোনীতে বসে আছে তার যতটুকু সম্ভব কাছাকাছি গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম দেখতে কেমন মেয়েটা। কিন্তু চাঁদের অপর্যাপ্ত আলতো আলোয় ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না তার চেহারা। হঠাৎ মনে পড়ল আচ্চা বেলকোনীতে তো লাইট থাকে কিন্তু ও তো লাইট জ্বালেনি। আমি এবার তাকে তার অজান্তে আরও একটু ভালো করে দেখার জন্য সুযোগটা নিলাম।
- কি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?
- নাহ, তুমি যেই কালো তোমার চেহারা সুন্দর চাঁদে ভাসছে না, এক কাজ করো না বেলকোনীর লাইটটা জ্বালাও না।
- এখন আলো জ্বালাতে পারবো না, যদি কেউ আমাকে দেখে এতরাতে এভাবে আমি বেলকোনীতে আলো জ্বেলে ফোনে কথা বলছি তাহলে ঠিক কালকে আমার বাবার কাছে বলে দিবে আর বাবা আমারে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।
- অসুবিধা কি, তুমি তো বাবাকে বলেই দিয়েছো আমার সঙ্গে বিয়ে না দিলে তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে। তো ভালোই হবে তুমি বেরিয়ে সোজা আমার কাছে চলে আসবে, তাহলে আর আমার কষ্ট করে তোমার কাছে যাওয়া লাগবে না।
- তাই, তাও তো ঠিক। কিন্তু তবুও আমি আলো জ্বালাতে পারবো না।
- কেনো ?
- আমি ঘুমানোর সময় ওড়না পরে ঘুমাই না, আর এখন ওড়না ছাড়াই বেলকোনীতে আসছি।
-ঠিক আছে ঘরে যাও গিয়ে ওড়না নিয়ে এসে এর পর বেলকোনীতে এসে আলোটা একটু জ্বেলে দিও মাত্র এক মিনিটের জন্য।
- উহ, তুমি না একটা যাচ্ছে তাই। আলো জ্বালাতে পারবো না।
- তাহলে নিচে আসো, মাঠের মধ্যে আমি চাঁদের আলোয় চেয়ে দেখি তুমি দেখতে কেমন।
- মানে কি বলছো!
বলে সে আকাশের দিক থেকে চোখ নামিয়ে মাঠের দিকে তাকালো, প্রথমেই আমাকে দেখতে পেলো না কিন্তু একসময় সে আমার অবয়বটা অস্পষ্টভাবে বুঝতে পারল। নিশ্চিত হওয়ার জন্যই হয়তবা মোবাইলের কলটা কেটে দিয়ে আবার রিং করল। তার রিংয়ের কারণে আমার মোবাইলে আলো জ্বেলে উঠতেই আমি তা লুকানোর চেষ্টা করি। কিন্ত সে আবারও কল দিল, এবার রিংটোন আর মোবাইলের আলো কোনটাই না লুকিয়ে আমি ফোনটা রিসিভ করে ফেলি।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১:৫১