মাটির কান্না
রচনা : শাহজাহান শামীম
নির্দেশনা : জিকু আহমেদ
প্রথম প্রদর্শনী : ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৭
স্থান : নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় পৌর শহীদ মিনার
নাটকের দল : নাটুয়া
স্থান : কোন এক অখ্যাত স্মৃতিসৌধ
সময় : ভোর বা যে কোন মেঘলা দিন ।
(দীর্ঘলয়ে বিলাপ ও তার সাথে করুণ রাখালিয়া বাঁশী ভেসে আসে। কান্না ও বিলাপের মধ্যে কোন একটা গল্প বা কাহিনী বলা হচ্ছে মনে হয় । কিন্তু কান্নার দমকে ও বিলাপের ধাক্কায় সেই কাহিনী অস্পষ্ট করুণ ধ্বনিতে পরিণত হয়। করুণ সুর ও বিলাপ ছাপিয়ে ভেসে আসে একটি কণ্ঠস্বর ।
কণ্ঠস্বর : মাটির কান্না কি শুনতে পাও ? কান পেতে শোন মাটির কোটরে ফেনিয়ে ওঠা সেই কান্নার সুর । এখানে বাতাস মানে দীর্ঘশ্বাস, এখানে পানি মানে অশ্রুজল, এখানে মাটি মানে কান্নার সুর। শুনতে কি পাও?
(দূর থেকে ভেসে আসে গানের ও কান্নার সুর)
কোরাস : পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্তলাল, রক্তলাল ,রক্তলাল।
সময় এসেছে মহাযুদ্ধের
রক্তলাল, রক্তলাল, রক্তলাল।
(গানের শুরুতে চারজন মানুষ একটি পুষ্পস্তবক হাতে মঞ্চে আসে । তারা ধীর ধীরে হেঁটে যায় । গান শেষ হওয়ার আগেই তারা স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ দামামা বেজে ওঠে । লাফ দিয়ে মঞ্চে আসে কাফনের কাপড় পরা এক ব্যক্তি । পুষ্পস্তবকটি হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ।)
ব্যক্তি (১) : বেয়াদবগুলো কী মনে করে আমাদের ? সামান্য ফুল দিয়ে করুণা করলেই আমরা খুশিতে বগল বাজাব? বছর শেষে স্মৃতিসৌধে ফুল দেয়ার জন্যই কী আমরা এদেশটা স্বাধীন করেছিলাম ?
(পেছনে অন্য এক ব্যক্তি চিৎকার করে ওঠে )
ব্যক্তি (২) : এই চুপ কর । একদম কথা বলবি না । তোর মত মৃত মানুষের কথা কে শুনবে?
ব্যক্তি (১) : কে মৃত ? আমরা না ওরা ? আমরা জীবন দিয়ে অমর হয়ে গেছি। আর ওরা এক মৃত জীবন বয়ে নিয়ে চলছে। বোকার মত এ জীবন বয়ে চলার কোন মানে নেই, কোন ল্য নেই, কোন পথ নেই। কেবলই জীবনকে বয়ে নিয়ে মৃত্যুর কাছে সমর্পণ করা।
ব্যক্তি (৩) : ওই যে, আবার প্যাচাল পারবার লাগছে । আরে তুই ব্যাটা মইরা গেছস , তর তো মাথাই নাই । সেইটা কিনা এত ঘামাস । তর কথা কেঠা শুনবে ?
ব্যক্তি (১) : (ব্যক্তি ৩ কে) এই দেশের বেশির ভাগ মানুষ তোমার মতো । আগেই ভাবে কে তোমার কথা শুনবে, আর কে তোমার কথা শুনবে না । এসব ভেবে উচিত কথাটা বলে না । তাহলে কি এদেশ বাসযোগ্য থাকবে? সুস্থ ভদ্র মানুষ কি এদেশে বাস করতে পারবে ?
ব্যক্তি (৩) : তুমি ভাগ্যবান যে তুমি মইরা গেছিলা । অনেক দুর্ভাগা অহনও বাইচ্যা আছে । শুধু বাইচ্যা আছে তাই না, গণ্ডায় গণ্ডায় পোলাপানও পয়দা করছে । তাগো সবাই মিল্যা এই দেশে থাকতে হইব। মরণ ছাড়া তাগো যাওনের জায়গা নাই।
ব্যক্তি (১) : এভাবে বিবেকহীন বেঁচে থাকার চেয়ে তো মৃত্যুই ভাল । এ জীবন মানে বন্দিত্ব। তার চেয়ে মৃত্যুই অনেক স্বাধীন।
ব্যাক্তি (২) : আবারও বাজে কথা বলছ ? একই ঘ্যানঘ্যান আর কতদিন করবে?
ব্যাক্তি (৩) : এই কথাই তো কইতে লাগছি, বেহুদা প্যাচাল পাইড়া মাথার সার্কিট গরম কইরা লাভ আছে ?
(একটি মেয়েলি বিলাপ ভেসে আসে)
ব্যাক্তি (৩) : (উৎকর্ণ হয়ে শোনে ) কেঠায় কান্দে ?
ব্যাক্তি (১) : চিনতে পারছ না, তোমাদের সবার বিবেক কাঁদে । বিচারের বাণী কাঁদে । শহীদের আত্মা কাঁদে।
( ব্যাক্তি ২ উৎসাহিত হয়ে খুঁজতে থাকে)
ব্যাক্তি (১) : খুঁজো না । ও তোমার ভেতরের কান্না - যা হারিয়েছ তার জন্য কান্না, যা চেয়েছ তার জন্য কান্না।
ব্যাক্তি (৩) : থাকো তোমার কান্না ফান্না লইয়া । আমি এই সবে নাই । বন্দুক ধরছি, যুদ্ধ করছি , দ্যাশ স্বাধীন করছি । আমার জীবনের বিনিময়ে এই দ্যাশ স্বাধীন, এইটা ভাবলেই শরীরের কঙ্কালটা মড়মড় কইরা উঠে । আজকে একটা বিশেষ দিন । পুলাপান যদি একটু স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়া মজা লুটে, লুটুক না, আমার কী ? নিজের জানটা দিয়া দ্যাশটা বানায়া দিছি, সেইটা দিয়া ওরা কি করব , সেইটা ওরা ভাবব ? আমরা ক্যান মাথা ঘামামু ?
ব্যাক্তি ১ দুঃখিত গণতান্ত্রিক নিয়মে আপনার সাথে একমত হতে পারলাম না। আপনার ব্যক্তিগত কবরকে ফুলশয্যা বানিয়ে সুখনিদ্রা দিন। আপত্তি নেই । কিন্তু আমার দাবি থেকে এক পা পিছিয়ে আসব না । এই কান্না আমি থামাবই।
ব্যক্তি ২ : পারবে না। এ কাজ কোন মৃত মানুষের নয় । তুমি তো মৃত । ১৯৭১ সালে তোমার জীবন থেকে রূপরসগন্ধ কেড়ে নিয়েছে।
ব্যক্তি ৩ : আমি যাই, তোমাগো ফালতু প্যাচালে আমি নাই। আবার একটা লম্বা ঘুম দিমু। খাওয়া পরার চিন্তা তো আর নাই। দয়া কইরা কবরের শান্তি নষ্ট কইর না তো।
(ব্যক্তি ৩ চলে যায় )
ব্যক্তি ১ : কাপুরুষ।
ব্যক্তি ২ : কাকে তুমি কাপুরুষ বলছ, ও একজন বীর ।
ব্যক্তি ১ : আমিও একজন বীর উত্তম । অবশ্য আমি তা মনে করি না । পুরো যুদ্ধটা শেষ করতে পারিনি। সিকিভাগ হওয়ার আগেই সরে পড়তে হয়েছে। তবু ওরা মানে ঐ জীবিত মানুষেরা আমাকে বীর বানিয়ে দিয়েছে।
ব্যক্তি ২ : ভালো করেছে। ওরা আপনাকে সম্মানিত করেছে। আমার ভাগ্যে তো কোন পদবি জোটেনি।
ব্যক্তি ১ : ( হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে) মরে গিয়েও পদবীর লোভ যায়নি।
ব্যক্তি ২ : (কিছুটা লজ্জা পায় ) সম্মান পেতে কে না চায় ? তুমি চাও না?
ব্যক্তি ১ : চাই । কিন্তু তার আগে সম্মান পাওয়ার যোগ্য হতে চাই এবং যাদের কাছ থেকে সম্মান পাচ্ছি তারাও সৎলোক হওয়া চাই।
ব্যক্তি ২ : তুমি এক ছাত্র হয়ে একজন অধ্যাপককে জ্ঞান দিচ্ছ?
ব্যক্তি ১ : মৃত্যুরাজ্যের এই তো মজা । এখানে সবাই সমান । মৃত্যু সবাইকে সমান করে দেয় ।
(ব্যক্তি ৪ আসে )
ব্যক্তি ৪ : সমান আর হতে পারলাম কোথায় ? তুমি যেমন করে ভাবতে পার আমি কি তেমন করে ভাবতে পারি ? মৃত্যুরাজ্যে তো বটেই, জীবিত রাজ্যেও লোকেরা কি ভাবতে পারে তোমার মতো?
ব্যক্তি ২ : তাতে ওর লাভটা কি হলো ? মাথাটা গরম হওয়া ছাড়া ?
ব্যক্তি ৪ : শোনেন অধ্যপক যেই বয়সে আপনি মরেছেন মানে শহীদ হয়েছেন সেই বয়সে আসতে আসতে অনেক নোংরা বুদ্ধির খেলা আপনি দেখেছেন। কিন্তু এই মাথা গরম লোকটি , যে কিনা আপনার বিশ্ববিদ্যালযে ভর্তি হলে আপনারই ছাত্র হতো , সে তখনও জীবনের এতসব নোংরা খেলা দেখেনি ।
ব্যক্তি ১ : আপনার সাথে একমত নই । নোংরা খেলা জানা আর নোংরা খেলায় মেতে ওঠা এক কথা নয় ।
ব্যক্তি ২ : কী বলতে চাও তুমি ?
ব্যক্তি ১ : আমি বলতে চাই , জীবনের সব নোংরা খেলা জানি। এজন্যই এসব নোংরা খেলার দাঁতভাঙা জবাব দিতে চাই।
ব্যক্তি ৪ : কী করবে তুমি ?
ব্যক্তি ১ : এই স্মতিসৌধে আর কখনও ওদের ফুল দিতে দেব না।
ব্যক্তি ২ : পাগল হয়েছ ?
ব্যক্তি ১ : পাগল কে ? আমি নাকি ওরা ? ওরা যে হতে ফুল দেয় , সেই হাতেই তো ব্যালট পেপারে সিল মারে। যে হাতে ফুল দেয় , সেই হাতে যুদ্ধাপরাধীকে মালা পরায় । যে হতে ফুল দেয় , সেই হাতেই রাজাকারকে
সালাম দেয়। যে হাতে ফুল দেয় , সেই হাতে আলবদরের হাতে হাত মেলায়। যে হাতে ফুল দেয় , সেই হাতেই স্বাধীনতা বিরোধীকে জড়িয়ে ধরে । তারপরও আমিই পাগল ,ওরা নয় ?
(দীর্ঘ বিলাপের সুর ভেসে আসে । ওরা কান পেতে শোনে)
ব্যক্তি ১ : শোনেন ঐ কান্না, যতদিন স্বাধীনতা বিরোধীর মার্কায় ভোট পড়বে, ততদিন এ কান্না থামবে না । যতদিন এদেশের মানুষ ভণ্ড প্রতারককে নেতা মানবে, ততদিন এ কান্না থামবে না। যতদিন মানুষ
দুর্নীতিবাজদের ভোট দেবে, ততদিন এ কান্না থামবে না।
ব্যক্তি ২ : আমরা জানি সেটা । এদেশের মানুষ বার বার ভুল করে। ১৯৭১ এর ফসল ঘরে তুলতে গিয়ে ভুল করেছে , ১৯৯০ এর ফসল ঘরে তুলতে গিয়ে ভুল করেছে এবং ২০০৮ এও ভুল করবে। জনগণের
বিজয়ের ফসল বার বার তারা তুলে দিয়েছে দুর্নীতিবাজদের হাতে, ভণ্ডের হাতে, প্রতারকের হাতে । ভীষণ রকম বোকা এদেশের লোক। সমাজের সবচেয়ে খারাপ, সবচেয়ে জঘন্য, সবচেয়ে নোংরা, সবচেয়ে টাউট লোকটাকে ভোট দিয়ে নেতা বানিয়ে দেয়।
ব্যক্তি ৪ : দুঃখে বুকটা ফেটে যায়। এই জন্য বন্দুক হাতে তুলে নিয়েছিলাম ? ভাবতে পারেন, এই দেশের লোক এক যুদ্ধাপরাধীকে ভোট দিয়েছে , এদেশের লোকের ভোটে একজন ধর্ম ব্যবসায়ী , স্বাধীনতা বিরোধী সংসদে বসেছে। মন্ত্রী হয়েছে। স্বাধীন দেশের পতাকা উড়েছে একজন রাজাকারের গাড়িতে।
(ব্যক্তি ১ পাগলের মত হাসতে থাকে । দীর্ঘলয়ে বিলাপের সুর ভেসে আসে ।)
ব্যক্তি ৪ : ভেবেছিলাম ওটা সাময়িক ভুল । অল্প কিছু লোকের বোকামি । কিন্তু যে দিন রাজাকারের গাড়িতে এ দেশের পতাকা উড়ল , একটা আগুন মিছিল নামল না রাজপথে, কোন বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ ধ্বনি উঠল না, একটা বজ্রমুষ্ঠি বাতাসে জেগে উঠল না । লজ্জায়, অপমানে আমার হাড়ে হাড়ে কিলবিল করে উঠল । হায় আমাদের স্বাধীনতার কী জঘন্য অপমৃত্যু!
(নেপথ্যে থেকে নারীকণ্ঠের বিলাপ ভেসে আসে । একজন নারী আসে।)
মহিলা ১ : ওরা ভুলে গেছে ওদের জীবনে কোন '৭১ ছিল । ওরা ভুলে গেছে ৩০ লক্ষ শহীদের কথা । ওরা ভুলে গেছে ২ লক্ষ বীরাঙ্গনার কথা । ওরা ভুলে গেছে সংবিধানের ৪টি মুক্তি সনদের কথা । ওরা এখন অন্ধ, ওরা এখন বোবা, ওরা এখন কালা। ওরা এখন মৃতের চেয়েও বেশি মৃত। পৃথিবীতে এত বোকা জাতি একটিও নেই। বিজয়ী হয়ে পরাজিতের শাসন মেনে নেয়ার এমন নজীর পৃথিবীতে আর একটিও নেই। আমরা মরে গিয়ে যতটুকু জীবিত আছি, ওরা বেঁচে থেকে তার চেয়ে বেশি মরেছে। ওদের বিবেক মরেছে। ওদের সততা মরেছে। ওদের দেশপ্রেম মরেছে। ওরা একটি মৃত জাতি।
ব্যক্তি ১ : প্রথমে ওরা বলল , পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। যারা পাকিস্তানের পক্ষে নয় তারা মুসলমান নয়। '৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝলাম , ধর্ম কায়েম নয়, শোষণ কায়েমই ওদের লক্ষ্য। '৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা সেই বেড়াজাল ভাঙলাম। কিন্তু ইসলাম নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ হল না । ইসলাম কায়েমের নামে তারা গণতন্ত্রকে তুলোধুনো করল । কিন্তু গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার স্বাদ নেয়ার জন্য তারা ভোল পাল্টাল। নারী শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলল । কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ নেয়ার জন্য নারীর পদলেহন করল । ইসলাম কায়েম এদের কাছে মূল বিষয় না । ক্ষমতায় গিয়ে ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়ানোই এদের টার্গেট। যে কোন দুর্নীতিবাজের মতো এদেরও ল্ক্ষ্য নগদ সম্পদ । তাই তারা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েও ইসলামের পক্ষে একটি কথাও বলেনি।
(ব্যক্তি ৩ আসে । বিরক্ত )
ব্যক্তি ৩ : কবরের শান্তি নষ্ট করবার লগছ ক্যান? দ্যাশটা স্বাধীন কইরা কি বিরাট কাম কইরা ফালাইছ নাকি ?
ব্যক্তি ১ : জোর করে শান্তি বজায় রাখার মতো অশান্তি আর নেই। সমুদ্রের উপরটা শান্ত থাকলেও ভেতরের স্রোত কিন্তু থেমে থাকে না।
মহিলা ০১ : তাই তো ইসলাম কায়েমের নামে আমরা পেলাম আত্মঘাতী বোমা। ইসলাম কায়েমের নামে দেশ ভরে গেল ভয়ঙ্কর জঙ্গীবাদে। ইসলাম কায়েমের নামে মরে গেল কত নিরপরাধ মানুষ। ইসলাম কায়েমের নামে কত মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেল। ইসলাম - এই পুরোনো অস্ত্রে এ দেশের মানুষ বার বার ঘায়েল হয়েছে। এই পুরোনো অস্ত্রে এদেশে বারে বারে অশান্তি এসেছে। অথচ ইসলাম মানে তো শান্তি। আহ, শান্তি , তুমি কোথায় ?
কোরাস : পূর্ব - দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্তলাল রক্তলাল রক্তলাল ।
সময় এসেছে মহাযুদ্ধের
রক্তলাল রক্তলাল রক্তলাল ।
ব্যক্তি ৪ : ওই যে , ওরা আবার আসছে । ওদের হাতে পুষ্পস্তবক।
ব্যক্তি ১ : ওদের এই করুণা আর অপমান আমরা মেনে নেব না । ওদের নোংরা হাতের ফুল নেব না।
ব্যক্তি ২ : কী করবে তুমি ?
ব্যক্তি ১ : কিছুই যদি না করতে পারি কমপক্ষে তো ঘৃণায় থু থু ছিটাতে পারব ।
ব্যক্তি ৩ : ( লাফ দিয়ে হাঃ হাঃ করে হাসতে থাকে) যার শইলে রক্ত মাংসই নাই, তার আবার থু থু ।
ব্যক্তি ৪ : আমার হাড়ের ভেতর যেটুকু আগুন আছে , সেটুকু আগুন ওদের রক্তেও নেই।
(ব্যাক্তি ২ চলে যেতে থাকে )
ব্যাক্তি ১ : কোথায় যাচ্ছেন ?
ব্যক্তি ২ : তোমাদের এই হাঙামার মধ্যে আমি নেই ।
ব্যক্তি ৩ : উনি জ্ঞানী গুণী বুদ্ধিজীবি মানুষ, কুলি কামলার মতো পাছড়া পাছড়ি করব নাকি ?
( দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকে ব্যক্তি ৩ )
ব্যক্তি ২ : অসহ্য একটা লোক ।
(ব্যক্তি ২ চলে যায় )
মহিলা ১ : ঐ যে ওরা আসছে ।
কোরাস : পূর্ব - দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্তলাল রক্তলাল রক্তলাল ।
সময় এসেছে মহাযুদ্ধের
রক্তলাল রক্তলাল রক্তলাল ।
(গান গাইতে গাইতে পুষ্পস্তবক হাতে ঢোকে ৩ জন পুরুষ ও একজন নারী । পুরুষদের গায়ে পাঞ্জাবি ও নারীটির পরনে শাড়ি । তারা সবাই গান গাইতে গাইতে পুষ্পস্তবক নিয়ে এগিয়ে যায়। মৃত ৪ জন তাদের ঘিরে একটি বৃত্ত রচনা করে । বাজনার তালে তালে তারা ৪ জন মৃত মুক্তিযোদ্ধা শুরু করে তাণ্ডব নৃত্য । তাণ্ডব নৃত্যের বাজনার তালে জীবিত ৪ জনের গান হারিয়ে যায়। ওরা যখন পুষ্পস্তবক বেদীতে দিতে যায়, সেই মুহূর্তে ৪ জন মৃত মুক্তিযোদ্ধা পুষ্পস্তবক ধরে ফেলে । ওরা চেষ্টা করে পুষ্পস্তবক বেদীতে রাখতে । পারে না । মৃত ৪ মুক্তিযোদ্ধার সাথে ওরা কিছুতেই পেরে ওঠে না । ওরা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় । )
নারী ১ : (ভয় পেয়ে) ও মাগো !
পুরুষ ১ : অবাক কাণ্ড !
পুরুষ ২ : ওটা ঐভাবে শূন্যে ঝুলে আছে কেন ?
পুরুষ ৩ : এরকম অদ্ভুত কাণ্ডতো কখনো দেখিনি !
নারী ১ : চল , আমরা চলে যাই ।
পুরুষ ১ : ওটা কি ওভাবেই ঝুলে থাকবে ?
পুরুষ ৩ : থাক না, সমস্যা কী ?
পুরুষ ২ : দাঁড়াও , ওটাকে আমি স্মৃতিসৌধে নামিয়ে রাখব ।
নারী ১ : ওখানে যেও না
(পুরুষ ২ পুষ্পস্তবকের কাছে যায় । ওটাকে ধরার চেষ্টা করে । পুষ্পস্তবকটি সরে যায় । পুরুষ ২ ভয় পেয়ে যায়। )
কোরাস :
ব্যক্তি ১ : আমরা ফুল নেব না ।
ব্যক্তি ৩ : আমরা ভুল নেব না ।
ব্যক্তি ৪ : আমরা ফুল নেব না ।
মহিলা ১ : আমরা ভুল নেব না ।
(তিন পুরুষ ও এক নারী ভয়ে কুকড়ে যায় । ব্যক্তি ১,৩,৪ ও মহিলা ১ পুষ্পস্তবক তুলে ধরে।)
কোরাস : আমরা চাই না করুণার ফুল
আমরা চাই না নোংরা হাতের ফুল
আমরা চাই না অপমানের ফুল
আমরা চাই না ভুল লোকের ফুল
পুুরুষ ২ : তোমরা কারা?
ব্যাক্তি ১ : আমরা মুক্তিযোদ্ধা ।
পুরুষ ২ : আমরা তোমাদের দেখতে পাচ্ছি না কেন ?
ব্যাক্তি ১ : কারণ তোমাদের দৃষ্টিতে আমরা মৃত্যুবরণ করেছি। তোমরা আমাদের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বল ।
পুরুষ ১ : আপনারা কি মৃত ?
ব্যাক্তি ৪ : আমরা অমর । প্রতিটি মুক্তিপাগল মানুষের বুকে রয়েছে আমাদের নাম ।
নারী ১ : ফুলটা ওরকম ঝুলে আছে কেন ?
মহিলা ১ : আমরা ফুল নেব না । তোমাদের দেয়া এই ফুল সম্মানের নয়, ভণ্ডামির ।
পুরুষ ৩ : আমরা আপনাদের সম্মান জানাতে চাই ।
(ব্যাক্তি ১ হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে ।)
ব্যাক্তি ১ : গত ছত্রিশ বছর ধরে সবাই সম্মান জানাতে গিয়ে আরও অপমানিত করেছে । আমাদের স্বপ্ন, সংগ্রাম, অগ্নিযুগের কথা সবাই ভুলে গেছে ।
ব্যাক্তি ৩ : মানে ব্যপারটা হইল গিয়া আপনেরা আমাগো একদিকে ফুল দ্যান, অন্যদিকে রাজাকারগো ভোট দ্যান - এইটা তো হইবার পারব না ।
পুরুষ ২ : আমরা তো রাজাকারকে ভোট দেই না ।
ব্যাক্তি ৩ : তাইলে রাজাকারেরা সংসদে গিয়া ঐ জায়গাটা অপবিত্র করল ক্যামনে ? মন্ত্রী হয়া দেশের পতাকার অপমান করল ক্যামনে ? তারা কি জ্বীন ভুতের ভোটে পাস করছে ? আপনেরা কি ভোট দ্যান নাই ?
(ওরা চারজন পরষ্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে)
ব্যাক্তি ৩ : তারপর ধরেন গিয়া, শান্তি কমিটির লোকগুলানরে ভোট দিয়া চেয়ারম্যান মেম্বার বানাইছে ক্যাডা? আপনেরা না ? এইসব হালুয়ারুটির লোভী লোকজনরে বার বার ভোট দিয়া দ্যাশটারে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানাইছে ক্যাডা ? আপনেরা না ? আপনেরা কি কোনদিন সৎলোকেরে ভোট দিছেন ? পাশ করাইছেন তাগো ?
নারী ১ : এসব বিষয় নিয়ে নেতারা ভাববে । আমরা তো সাধারণ জনগণ ।
ব্যক্তি ৩ : এই তো ভুল বললেন । নেতা বানানোর যাদুমন্ত্র আপনের হাতে । আপনের ভোট ছাড়া কেউ নেতা হইবার পারব না । আপনের ভোট ছাড়া কেউ কোনদিন সংসদে বসতে পারব না।
ব্যাক্তি ১ : এই সব কথা ওরা জানে । এবার আসল কথাটা বলেন।
ব্যাক্তি ৩ : আসল কথা , আসল কথা আবার কেনডা ?
ব্যাক্তি ১ : আসল কথা হল যতদিন পর্যন্ত এই দেশে একটা যুদ্ধাপরাধী থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আমরা ফুল নেব না । আমাদেরকে বার বার অপমান করতে দেব না । নিয়ে যান আপনাদের ফুল ।
(ব্যাক্তি ১ ফুলটা ছুড়ে মারে । ধরে পুরুষ ২ )
ব্যাক্তি ৪ : যেই সব রাজাকারদের নেতা বানিয়েছেন, এ ফুল নিয়ে তাদের গলায় ঝুলিয়ে দিন, আপত্তি নেই । কিন্তু ওদের সাথে সম্পর্ক রেখে আমাদের সম্মান জানানোর ভণ্ডামি আর করবেন না ।
ব্যাক্তি ৩ : আমরা সাড়ে তিন হাত কবরে শুইয়া মাটির কান্না শুনি । আমাগো কবরের শান্তি নষ্ট হইয়া যায় ।
ব্যাক্তি ১ : কান পেতে শুনুন বাংলা মায়ের কান্না । তার সন্তান হত্যার বিচার আজও হয়নি । খুনীদের বিষাক্ত নিশ্বাসে বাতাসে গুমোট হাহাকার ।
(ভেসে আসে দূরাগত বিলাপ ধ্বনি)
ব্যাক্তি ১ : ওই যে মা কাঁদছে । বিচারহীনতার লজ্জায় তার এই বিলাপ । তবু আপনারা খুনিদের বিচার করবেন না । যুদ্ধাপরাধীদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না ?
ব্যাক্তি ৪ : আর কত অপেক্ষা করবেন? আমাদের ঠাণ্ডা হাড়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে অথচ আপনাদের সতেজ রক্তে কোন বিষ্ফোরণ নেই । কী হয়েছে আপনাদের ? বিবেক মরে গেছে ? সত্য ভুলে গেছেন ? অন্ধের চেয়েও বেশি অন্ধ, বোবার চেয়ে বেশি বোবা, কালার চেয়ে বেশি কালা । কী হয়েছে আপনাদের ?
পুরুষ ২ : আমরা ভুল করেছি । আগাছা পরিষ্কার না করলে ফসল মরে যায় । পঁচা অঙ্গ না ফেললে মানুষ মরে যায় । আমাদের সমাজের সেই পঁচা মানুষগুলোকে ভাল মানুষের দল থেকে বের করে দিতে হবে, নইলে তারা গোটা সমাজটাকে পঁচিয়ে ফেলবে।
ব্যাক্তি ১ : সাবাশ । আপনি এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা । আমরা দেশকে স্বাধীন করেছি , আপনারা দেশকে রাজাকারমুক্ত করুন । নইলে এ দেশে শান্তিতে থাকতে পারবেন না । আস্তিনের সাপ আপনাকে ছোবল দেবেই ।
মহিলা ১ : যেদিন দেশ রাজাকারমুক্ত হবে, যুদ্ধাপরাধীমুক্ত হবে, সেদিন এদেশ প্রকৃত স্বাধীন হবে । সেদিন থেমে যাবে মাটির কান্না, বাংলা মায়ের দীর্ঘশ্বাস । সেদিন তোমরা ফুলের ডালি নিয়ে এসো, আমরা হাততালি দিয়ে তোমাদের স্বাগত জানাব। ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে এই পবিত্র স্মৃতিসৌধ ।
নারী ১ : আমরা কথা দিচ্ছি, যেদিন দেশ যুদ্ধাপরাধী মুক্ত হবে, এই স্মৃতিসৌধে সেদিন ফুল নিয়ে আসব। সেই ফুল হবে শ্রদ্ধার, সম্মানের ; ভণ্ডামির নয়।
পুরুষ ১ : আজ থেকে শুরু হল যুদ্ধাপরাধীদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ । শান্তির জন্য যুদ্ধ ।
ব্যাক্তি ৪ : পৃথিবীর সব সভ্য দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে । জার্মানীতে, যুগোশ্লাভিয়ায় , কম্বোডিয়ায় - যুদ্ধাপরাধীরা কখনো মুক্তি পায়নি । কক্ষণো নয়। আমরা কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব না ? আমরা কি সভ্য জাতি নই ?
পুরুষ ৩ : আমরা কথা দিচ্ছি, দেশকে যুদ্ধাপরাধীর কবল থেকে মুক্ত করব । সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দেব , আমরাও সভ্য জাতি ।
ব্যাক্তি ১ : আমরা বিশ্বাস করলাম, আপনারা আমাদের স্বপ্ন , সংগ্রাম ও দিন বদলের সাধনাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন । আজকের প্রজন্মের আপনারা আমাদের প্রতিনিধি । আসুন আমরা সেই স্বপ্ন , সংগ্রাম ও দিন বদলের সাধনায় একাত্ব হই ।
(ব্যাক্তি ১, পুরুষ ২কে , ব্যক্তি ৩ পুরুষ ১ কে, ব্যাক্তি ৪ পুরুষ ৩ কে এবং নারী ১ মহিলা ১ কে জড়িয়ে ধরবে । তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে এমন এক ভঙ্গি করে যাতে বোঝা যায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের দেহে ঢুকে গেল । তারপর শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা চলে যায় ।
এখন পুরুষ ২ ব্যাক্তি ১ এর মত করে , পুরুষ ১ ব্যাক্তি ৩ এর মতো করে , পুরুষ ৩ ব্যাক্তি ৪ এর মতো করে এবং নারী ১ মহিলা ১ এর মত করে কথা বলবে । )
পুরুষ ২ : এই মৃত পঁচা জীবন আমরা চাই না ।
পুরুষ ১ : আবার যুদ্ধ করমু । এইবার আগাছা সাফ করার যুদ্ধ । রাজাকার মুক্ত করার যুদ্ধ ।
পুরুষ ৩ : হাড়ের মধ্যে যে আগুন আছে, সেই আগুনে পুড়িয়ে মারব ওদের ।
নারী ১ : আমরা ভুলিনি ৫২,৭১, ৯০ । আবার এক ভোট বিপ্লবে ভেসে যাবে সকল ধান্দাবাজ, দুর্নীতিবাজ ও যুদ্ধাপরাধী। প্রতিটি ভোট আমাদের জন্য একটি বিপ্লব। এই বিপ্লবে ক্ষমতায় আসবে সৎ, কর্মঠ ও দেশপ্রেমিক নেতা।
পুরুষ ২ : দুর্নীতিবাজ, যুদ্ধাপরাধী ভাই ভাই , এক দড়িতে ফাঁসি চাই ।
পুরুষ ১ : আগাছামুক্ত জমিতে আমরা সোনালি ফসল ফলামু । গোলা ভইরা উঠব সুখ আর শান্তিতে ।
পুরুষ ৩ : একটি ভোট বিপ্লবের আগুনে পুড়ে সোনার মত খাঁটি হয়ে উঠবে এই দেশ ।
নারী ১ : আমাদের ভোট বিপ্লব অরাজকতার বিরুদ্ধে , দুর্নীতির বিরুদ্ধে, ভণ্ডামির বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে । এসো আমরা সবাই এই বিপ্লবে হাতে হাত রাখি ।
(ওরা সবাই হাতে হাত রাখে)
সমাপ্ত।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০০৮ দুপুর ২:৫৯