একটা পুরনো লেখা দিলাম। ভালো না লাগলে বলবেন, কিন্তু গালাগালি করবেন না প্লিজ। ব্লগে নতুন, অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে।
চাঁদ, জোসনা ও সম্পর্কের কথকতা
যখন চাঁদের কথা ভাবি, কিংবা জোসনার কথা তখনই মনে পড়ে বহুকাল আগে কোনো এক চন্দ্রগ্রস্থ যুবরাজের কথা, কোনো এক জোসনাপ্লাবিত ভরা পূর্ণিমার রাতে যিনি রাজ্য-রাজপ্রাসাদ-স্ত্রী-পুত্র-পরিজন ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। সেই যুবরাজের নাম সিদ্ধার্থ, আরেকটি অজানা পূর্ণিমায় যিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন _ হয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। শুধু কি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া? তাঁর জীবনের সমস্ত প্রধান ঘটনাগুলো ঘটেছে পূর্ণিমার রাতে। একে কি কাকতালীয় বলবো? নাকি অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে এর? সে প্রসঙ্গে যাবার আগে বরং তাঁর রূপকথার মতো জীবনকাহিনীর দিকে চোখ ফেরানো যাক একবার।
রাজা শুদ্ধোধনের স্ত্রী রাণী মায়া একদিন স্বপ্নে দেখলেন _ স্বর্ণের পর্বতে পরিভ্রমণরত ছয় দাঁত বিশিষ্ট একটি সাদা হাতি কোনো ব্যথা না দিয়েই তাঁর শরীরের বাঁ পাশ দিয়ে ঢুকে পড়লো। তিনি জেগে উঠলেন, রাজাকে জাগিয়ে স্বপ্নটা জানালেন। রাজা স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে রাজ্যের সব জ্যোতিষিকে ডাকলেন। জ্যোতিষিরা ব্যাখ্যা দিলেন _ রাণী এমন একজন পুত্রের জন্ম দেবেন যিনি হয় জগতের সম্রাট হবেন অথবা হবেন জাগ্রত ও আলোকিত এমন একজন মানুষ যিনি মানবজাতির মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন।স্বাভাবিক প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজা চাইলেন রাজপুত্রের ভাগ্যে প্রথমটিই ঘটুক _ তাঁর পুত্র যেন জগতের সম্রাট হয়।
রাণী যে রাতে স্বপ্নটি দেখেছিলেন সেটি ছিলো পূর্ণিমার রাত।
নির্দিষ্ট সময়ে কোনো বেদনা ছাড়াই রাণী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। একটি ডুমুর গাছ আনত হয়ে তাঁকে সহায়তা করলো। শিশুটি রাণীর দাঁড়ানো অবস্থাতেই ভূমিষ্ট হলো এবং জন্মের পরপরই উত্তর, দণি, পূর্ব ও পশ্চিমে যথাক্রমে চার পা হাঁটলো এবং সিংহের স্বরে বললো _ আমি তুলনাহীন, এটিই আমার শেষ জন্ম।
শিশুটি যে রাতে ভূমিষ্ট হলো সেটিও ছিলো পূর্ণিমার রাত।
রাজা শুদ্ধোধন পুত্রের নাম রাখলেন সিদ্ধার্থ। তিনি তাঁর সন্তানকে নিয়ে একই সঙ্গে আশান্বিত এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। আশান্বিত কারণ তাঁর পুত্র জগতের সম্রাট হবার সম্ভাবনা নিয়ে জন্মেছে। চিন্তিত কারণ তিনি জ্যোতিষিদের কাছে জানতে পেরেছেন, তাঁর ছেলের গৃহত্যাগী হয়ে যাবার মতো বিপদজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ যদি বার্ধক্য, জরা, মৃতু্য এবং কঠোর তপশ্চর্যা _ জীবনের এই চারটি সত্য সম্বন্ধে জানতে পারেন তাহলে তিনি গৃহত্যাগী হয়ে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করতে পারেন এবং জগতের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পারেন।
বার্ধক্য, জরা, মৃতু্য এবং কঠোর তপশ্চর্যা_এই চারটি জিনিসের সঙ্গে যেন সিদ্ধার্থের কোনোভাবেই দেখা না হয় রাজা তার যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পন্ন করলেন। পুত্রের জন্য রাজপ্রাসাদে একটি হেরেম তৈরি করলেন এবং সিদ্ধার্থকে এসব নিয়ে মেতে থাকার ব্যবস্থা করলেন। ষোল বছর বয়সে তাঁর বিয়ের ব্যবস্থাও করা হলো।
রাজকুমার খুব সুখে জীবনযাপন করছেন _ তিনি জানেইনা যে, জীবনে দুঃখকষ্ট নামক কোনো ব্যাপার আছে। তাঁকে বার্ধক্য, জরা, মৃতু্য এবং কঠোর তপশ্চর্যা এসব থেকে দূরে রাখা হয়েছে।
একবার সিদ্ধার্থ বাইরে বেড়াবার বাসনা প্রকাশ করলেন। দিনও নির্ধারিত হলো, তাঁর বেড়াবার যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পন্ন হলো এবং তাঁর বেড়াবার পথে ঐ চারটির কোনোটিই যেন কোনোভাবেই তাঁর সামনে না আসতে পারে সেজন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো।
পূর্ব নির্ধারিত দিনে তিনি আয়তাকার রাজপ্রাসাদের চারটি গেটের একটি দিয়ে, ধরা যাক উত্তরের গেট দিয়েই, বাইরে বেরুলেন। কিছুণ ভ্রমণের পর তিনি ভিন্ন রকমের একটি জীব দেখতে পেলেন _ জীবটি সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়া এবং কুঞ্চিত, আর তার মাথায় কোনো চুল নেই। লাঠির ওপর ভর দিয়ে হাঁটে বলে সেটাকে কোনোভাবেই হাঁটা বলা যায় না। এই ধরনের কোনো জীব রাজপুত্র ইতিপূর্বে দেখেননি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন _ এটি কোন ধরনের জীব! গাড়োয়ান তাকে জানালো _ সে মানুষ, তবে বৃদ্ধ মানুষ, বার্ধক্য তাকে আক্রান্ত করেছে _ আর আমরা বেঁচে থাকলে সবাই একদিন তার মতোই হবো। কারণ মানুষের জীবনে বার্ধক্য এক অনিবার্য সত্য।
রাজকুমার প্রাসাদে ফিরে এলেন। তার মাথায় নানা চিন্তা। বলাবাহুল্য, রাজার এত চেষ্টার পরও সিদ্ধার্থের চোখে এই বার্ধক্য ধরা পড়ার পেছনে দেবতাদের কারসাজি ছিলো।
এর ছয়দিন পর তিনি আবার বেরুলেন _ এবার ধরা যাক দেিণর গেট দিয়ে। এবার তিনি একটি ডোবার মধ্যে একজন লোককে দেখতে পেলেন _ লোকটির মুখ বিকৃত আর সারা শরীরে সাদা সাদা দাগ, লোকটি ছিলো কুষ্ঠরোগী। যথারীতি রাজকুমার এরকম কোনো ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না এবং জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন _ লোকটি জরাগ্রস্থ, এবং আমাদের সবাইকেই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এরকম জরার মুখোমুখি হতে হবে। রাজকুমার প্রাসাদে ফিরে এলেন। তাঁর মাথায় নানা জটিল চিন্তা।
এর ছয়দিন পর তিনি আবার বেরুলেন । এবার তিনি দেখলেন একজন মৃত ব্যক্তিকে। এবার তিনি জানলেন প্রতিটি মানুষকেই একদিন মরতে হবে। মৃতু্যর সঙ্গে পরিচয় ঘটলো তাঁর। রাজকুমার প্রাসাদে ফিরে এলেন। তাঁর মাথায় নানা জটিল চিন্তা।
এর ছয়দিন পর তিনি বেরিয়ে দেখা পেলেন এমন একজন লোকের যিনি জীবনের সকল বৈষয়িক সুখ পরিত্যাগ করে সাধনার পথ বেছে নিয়েছেন। তাঁর মুখে এক আশ্চর্য দীপ্তি ও সুখ দেখে প্রাসাদে ফিরলেন সিদ্ধার্থ।
রাজপুত্রের জীবন থেকে সকল সুখ বিদায় নিয়েছে। বার্ধক্য, জরা, মৃতু্য এবং কঠোর তপশ্চর্যা এই চারটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছে। রাজপ্রাসাদের সুখ তাঁর সহ্য হচ্ছে না _ মানুষের চিন্তায় তিনি ব্যাকুল। ঘরে মন টিকছেনা তাঁর। এমনই এক সময়ে তিনি খবর পেলেন _ তাঁর স্ত্রী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সংবাদ শুনে তিনি বললেন _ রাহুলের জন্ম হলো। রাহুল মানে শেকল, পুত্রের জন্মকে তিনি শেকলের জন্ম হিসেবে দেখেছিলেন। এর কিছুদিন পরই তিনি ঘর ছেড়ে গোপনে বেরিয়ে গেলেন। বেরুনোর আগে তিনি স্ত্রী-পুত্রকে দেখতে গেলেন এবং রাহুলকে চুম্বন করলেন। ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও স্ত্রীকে স্পর্শ করলেন না তিনি _ করলে এদের ছেড়ে চলে যেতে পারবেন না এই ভয়ে।
যে রাতে তিনি গৃহত্যাগ করলেন সেটা ছিলো পূর্ণিমার রাত।
এরপর তিনি কঠোর তপস্যায় নিয়োজিত হলেন। তপস্যার এক পর্যায়ে তিনি একবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। স্বর্গের দেবতারা ভয় পেলেন যে, তিনি মারা গেছেন কী না। একটি বানর মধু দান করে তাঁকে বাঁচিয়ে তুললো।
সেটিও ছিলো পূর্ণিমার রাত।
সাধনা করতে করতে এলো এক দীর্ঘ রাত। এই রাতের পরই সিদ্ধার্থ আর সিদ্ধার্থ থাকলেন না, হয়ে গেলেন বুদ্ধ। জগতের সকল প্রাণীর দুঃখ নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে যিনি সবার জন্য সুখ কামনা করলেন।
যে রাতে তিনি এই বুদ্ধুত্ব অর্জন করলেন বা নির্বাণ লাভ করলেন সেটিও ছিলো পূর্ণিমার রাত। শুধু তাই নয় তিনি মৃতু্যবরণও করেছিলেন পূর্ণিমার রাতে।
একজন মহাপুরুষের জীবনে এতসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কেবল পূর্ণিমার রাতেই ঘটার কারণ কি, ব্যাখ্যাই বা কি? সত্যিই সেগুলো পূর্ণিমার রাতেই ঘটেছিলো কী না _ এ প্রশ্নও অবশ্য কেউ কেউ তুলতে পারেন। কিন্তু সত্যিই ঘটেছিলো কী না সেটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেগুলো যদি পূর্ণিমার রাতে না-ও ঘটে থাকে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, বুদ্ধ এভাবেই তাঁর জীবনের ঘটনাগুলোকে বর্ণনা করেছেন। এর মানে কি? এর মানে কি এই নয় যে, বুদ্ধের কাছে পূর্ণিমা একটা বিশেষ ব্যাপার ছিলো? আমার তো মনে হয় বুদ্ধ ছিলেন পুরোপুরি চাঁদে পাওয়া একজন মানুষ। এই ধরনের মানুষগুলো চাঁদ দেখলে ভাবুক হয়ে যায়, পূর্ণিমায় হয়ে পড়ে ঘোরগ্রস্থ। সম্ভবত বুদ্ধও হতেন। কোনো এক পূর্ণিমার রাতে তাঁর ঘর ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। ঘর ছাড়ার প্রবণতা তার মধ্যে আগে থেকেই ছিলো, জোসনা হয়তো তাকে এই ব্যাপারে আরো বেশি ইন্ধন জোগাতো, আর পূর্ণিমা তাকে করে তুলতো ঘোরগ্রস্থ-পাগলপ্রায়। জীবনের কোনো এক সময়ে এই ঘোর এত ভয়ংকরভাবে ক্রীয়াশীল হয়ে ওঠে যে, ঘর-সংসার-স্ত্রী-পুত্র-পরিজন-রাজ্য-রাজপ্রাসাদ সবই তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়, তিনি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। শুধু তাই নয়, তাঁর জন্ম-মৃতু্য ও বুদ্ধুত্ব লাভ সবই ঘটেছিলো পূর্ণিমায় _ এমনকি বৌদ্ধদের সমস্ত ধর্মীয় উৎসব কোনো না কোনো পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করেই ঘটে। এর মানে কি এই নয় যে, চাঁদকে তিনি বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসতেন, চাঁদকে কেন্দ্র করেই তার সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো? পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মে তো চাঁদের এই আধিক্য দেখা যায় না! শুধু বুদ্ধ কেন, এরকম চাঁদে পাওয়া মানুষ আমাদের আশেপাশেও দেখতে পাওয়া যায়। সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান মমিনুল মউজউদ্দীন সাহেব নাকি পূর্ণিমার রাতে শহরে কয়েক ঘণ্টার জন্য ইলেকট্রিসিটি বন্ধ দেন _ যেন নাগরিকরা প্রাণ ভরে পূর্ণিমার রূপ দেখতে পারেন। নাগরিকরা পূর্ণিমা দেখবে কী না সেটা তো তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার, চেয়ারম্যান সাহেবের এ নিয়ে এত আগ্রহ কেন? তিনি কেন এই ব্যবস্থা করেন? বলা বাহুল্য যে, তিনি ওই পূর্ণ চাঁদ আর তার ভরা জোসনার প্রেমে পড়েছেন। এই প্রেম আবার এত গভীর যে, একা একা সেই রূপ দেখে সাধ মেটে না, শহরের সমস্ত মানুষকে তা দেখাতে ইচ্ছে করে। শহরবাসীও যে ব্যাপারটিকে আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করেছে, সেটাও বোঝা যায় মউজউদ্দীন সাহেবের অভাবিত জনপ্রিয়তা দেখে। আসলে চাঁদ ও জোসনা এমন এক ব্যাপার যে এর প্রেমে না পড়ে উপায় নেই। সেই যে ছোটবেলায় _ আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা _ বলে মানুষের জীবনে চাঁদের প্রবেশ ঘটে, কারো কারো সারা জীবনেই তার প্রভাব থেকে যায়। চাঁদ থেকে তার মুক্তি মেলে না। এই ধরনের চাঁদে পাওয়া মানুষদের জীবন কখনো স্বাভাবিক-সামাজিক খাতে প্রবাহিত হয় না। কোথায় যেন তারা ব্যতিক্রম, একটু যেন মিসফিট সামাজিক জীবনে।
এখন এই শহরে চাঁদ, জোসনা, পূর্ণিমা এসব একটা বিরল ব্যাপার। আকাশ- ছোঁয়া সব অট্টালিকার ওপার থেকে কখন যে চাঁদ ওঠে আর কখন যে ডুবে যায় তা টেরই পাওয়া যায় না। ঝলমলে নাগরিক আলোয় হারিয়ে যেতে বসেছে মায়ামায়- মোহনীয় জোসনার রূপ। তবু কেউ কেউ তার খোঁজ রাখেন হয়তো। আর কেউ না হোক প্রেমিক, ভবঘুরে আর রাতজাগা মানুষের দল চাঁদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন হয়তো, নইলে এতসব বাধাবিপত্তি এত অবহেলা সত্ত্বেও চাঁদ তার আলো ছড়ায় কেন? গ্রামে কিন্তু এখনও চিত্রটি ভিন্ন। পূর্ণিমার রাত এখনও সেখানে এক বিশেষ ব্যাপার। মানুষগুলো যেন কবি হয়ে যায় তখন।
কেন এই এত এতসব প্রতিক্রিয়া তৈরি করে চাঁদের মতো সামান্য এক উপগ্রহ মানুষের মধ্যে? আমার মনে হয় _ এর নাম হচ্ছে সম্পর্ক। জীবনের অন্য নাম সম্পর্ক। কিংবা সম্পর্ক মানেই জীবন _ বলা যায় এভাবেও। নানা ধরনের সম্পর্কের ভেতর দিয়ে জীবন কাটায় মানুষ। মানুষের অনেকগুলো সম্পর্ক নিয়তি-নির্ধারিত বা প্রকৃতি প্রদত্ত। মা-বাবা-ভাই-বোন-আত্নীয়স্বজন ছাড়াও যে দেশটিতে যে সমাজে যে সময়কালে সে জন্মগ্রহণ করে, এর কোনোকিছুই সে নিজে বেছে নেয় না। প্রকৃতি তাকে এই সম্পর্কগুলো উপহার দেয়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক, আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী-সহমর্মী এবং এই ধরনের আরও অনেক মানবিক সম্পর্ক প্রায় নিয়তি-নির্ধারিত ভূমিকা পালন করে মানুষের জীবনে। শুধু কি তাই? সম্পর্ক স্থাপিত হয় জড় জগতের সঙ্গেও। যে প্রিয় কলমটি দিয়ে আমি লিখি তার সঙ্গেও কি একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি আমার? নইলে ওটা ছাড়া লিখতে আমি অস্বস্তি বোধ করি কেন? খাবার টেবিলে সবসময় কেন একটি নির্দিষ্ট চেয়ারেই বসি অন্য সব চেয়ার খালি থাকলেও! এমন তো নয় যে, ওই চেয়ারটিই আমার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে কেউ! যে কাপটিতে আমি চা খাই, যে গ্লাসটিতে পানি, যে প্লেটে ভাত, ঘুমানোর সময় যে বালিশটি মাথায় দেই, যে ঘড়িটি হাতে পড়ি, যে দোকান থেকে সিগারেট কিনি _ এসবকিছুর সঙ্গেই একটি সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে আমার। চাঁদের সঙ্গেও মানুষের, বিশেষ করে বাঙালির এক আশৈশব সম্পর্ক রচিত হয়। গৌতম বুদ্ধের েেত্র সম্পর্কটি নিছক সাদামাটা ছিলো না, পেঁৗছেছিলো প্রেম পর্যন্ত। দেখা যাচ্ছে একটা উপগ্রহ হলেও শুধু বন্ধুত্বই নয়, চাঁদের সঙ্গে প্রেম পর্যন্ত হতে পারে। মানুষের সম্পর্ক যে শুধু মানুষের সঙ্গেই না হয়ে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গেই হয় সে তো আমরা অহরহই দেখি। গাছের সঙ্গে হয় _ বৃপ্রেমিক মানুষ কি আমরা কম দেখেছি? বা পাখির সঙ্গে _ পীপ্রেমিকও তো কম নেই এ পৃথিবীতে। হয় নদীর সঙ্গেও, (ব্র্রপুত্রের সঙ্গে কি জয়নুলের কোনোই সম্পর্ক ছিলো না?) কিংবা বৃষ্টির সঙ্গে। বৃষ্টি দেখলে যে কিছু কিছু মানুষ পাগল হয়ে যায়, তার কারণ কি? কিছু লোক সবসময়ই বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করে _ এটাকে স্রেফ রোমাঞ্চ হিসেবে বিবেচনা করলে বিষয়টিকে খণ্ডিত করে দেখা হয়। বরং বলা উচিৎ ওই লোকটাও বৃষ্টিকে ভালোবাসে _ বৃষ্টিতে ভেজা তাই তার কাছে বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করার মতো। ছোটবেলায় একটা ঘাসফড়িঙের পেছনে কতগুলো দুপুর আর বিকেল ব্যয় হয়ে গেছে তার কি হিসেব আছে! ফড়িঙের জন্য কেন এই টান ছিলো? যে পতঙ্গটিকে ধরতে পারলেও সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দিতে হয় ওর বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই, তাকেই ধরার জন্য এত চেষ্টা ছিলো কেন? এ-ও কি এক ধরনের সম্পর্ক নয়? শুধু কি তাই, সম্পর্ক জন্মায় স্থানের সঙ্গেও। একই জায়গায় একসঙ্গে অনেকদিন থাকলে সে জায়গাটার প্রতি নাকি একটা মায়া জন্মায়। এর মানে কি? মায়া তো একটা মানবিক ব্যাপার _ মানুষ কেবল অন্য একজন মানুষের জন্যই তা সঞ্চয় করে রাখে, তাহলে জায়গার প্রতি মায়া জন্মাবার কারণ কি? কারণ হচ্ছে সম্পর্ক। ওই জায়গার সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক জন্মায়। যেমন জন্মায় গৃহপালিত জীব কিংবা নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের সঙ্গেও। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এসব জড় পদার্থ কেন মানুষের মধ্যে এমন প্রভাব ফেলে বলা মুশকিল। হয়তো ব্যাখ্যা জানবার খুব একটা দরকারও নেই। প্রেম এবং ভালোবাসার আবার ব্যাখ্যা কি?