
গণপিটুনিতে মৃত্যুর ব্যাপারটা আগেও ছিল, তবে গত এক বছরে সেটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ বা তাদের দোসর বলে স্বীকৃতদের গণপিটুনি দেওয়া পুণ্যের কাজ মনে করত বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি বা তাদের ঘনিষ্ঠরা। সরকারিভাবেও বলা হয়েছে এগুলো জনরোষ। আদালত প্রাঙ্গণে আসামিকে মারধরকেও জনরোষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তারা। মানে অপরাধীকে যেকোনো অবস্থায় মারা ঠিক আছে। শিক্ষকদের স্বৈরাচারের দোসর আখ্যা দিয়ে মারধর এবং পদত্যাগ করানোও তাদের কাছে উচিত কাজ। এখন তো আসলে হামলা, মামলা আর গ্রেপ্তারেরই সময়।
হৃদয়বিদারক একটা ঘটনা তুলে ধরছি। এ ধরনের ঘটনা ব্লগে আসবে না। কারণ এতে ভিউ কম। তাছাড়া এতে সরকারের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হয়।
গত ৯ আগস্ট (শনিবার) রাতে রংপুরের তারাগঞ্জে মুচি সম্প্রদায়ের রূপলাল তার ভাগ্নি জামাই প্রদীপকে নিয়ে বড় মেয়ে নুপুরের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে যাচ্ছিলেন। তিনি নিজের ভ্যান চালিয়ে আসছিলেন। তখন আল আমিন নামে এক ব্যক্তি প্রথমে ভ্যানটি আটকিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন। এ সময় মেহেদী হাসান নামে এক যুবক সেখানে এসে বস্তার ভেতরে ছোট ছোট বোতলে তাড়ি (দেশি মদ) দেখতে পেয়ে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় হইচই শুরু হলে মেহেদী হাসান এই বলে জনতাকে খেপিয়ে তুলতে বলে, ‘এই সব খাইয়ে ওরা ভ্যান ছিনতাই করার চেষ্টা করছিল’। পরবর্তীতে মব তৈরি করে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পাঁচ মিনিট ২১ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও তাদের উদ্ধারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। রূপলাল ও প্রদীপ দাসকে যখন গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছিল, খবর পেয়ে তারাগঞ্জ থানা থেকে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসার পরও দু’জনই বেঁচে ছিলেন। এমনকি তাদের যখন বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আনা হয়, তখনও পুলিশ তৎপর হলে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পারত- ফলে দু’জনই প্রাণে বাঁচতে পারতেন।
ভিডিওতে আরও দেখা যায়, রূপলাল দাস ও প্রদীপ দাসকে যখন আটক করে বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে একটি ভ্যানের ওপর বসিয়ে রাখা হয়েছে। চারদিকে কয়েকশ’ মানুষ। পুলিশের চারজন সদস্য ভ্যানটি ঘিরে বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছিলেন এবং হাত তুলে জনতাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছেন। এ সময় রূপলালকে ভ্যানের ওপর দাঁড়িয়ে সবার কাছে জীবন ভিক্ষা করার জন্য হাতজোড় করতে দেখা যায়। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ভ্যানের মধ্যেই তার পরনের খুলে যাওয়া লুঙ্গি ঠিক করতে দেখা যায়। পুলিশ জনতাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও মব সৃষ্টি করা মানুষেরা আরও উত্তেজিত হয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করলে পুলিশ গণপিটুনিতে গুরুতর আহতদের ফেলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে চলে যায়।
পুলিশ দেখল যখন তারা মাত্র চার জন, ঘটনা সামাল দিতে পারছে না। বিষয়টি থানার ওসিকে কল করে জানালে আরও ফোর্স নিয়ে এলে হয়তোবা রূপলাল ও প্রদীপ দাসকে জীবিত উদ্ধার করতে পারত। কারণ পুলিশ আসা, অবস্থান করা ও চলে যাওয়ার এক ঘণ্টা পরও তারা দু’জনই জীবিত ছিলেন।
পুলিশ চলে যাওয়ার পর রূপলাল মাথা তুলতেই কালো গেঞ্জি পরা এক যুবক তাকে ঘুসি মারেন। এতে আবারও লুটিয়ে পড়েন রূপলাল। এরপর ভ্যানের ওপর শোয়া অবস্থায় থাকা দু’জনকে কয়েকজন ব্যক্তি যে যেভাবে পারেন কিল, ঘুসি, লাথি, লাঠি ও রড দিয়ে মারতে থাকে। একপর্যায়ে ভ্যানের ওপর থেকে মাটিতে পড়ে যান প্রদীপ দাস। এ দৃশ্য মোবাইল ফোনের আলো জ্বালিয়ে অনেকেই ভিডিও করছিল। প্রদীপ দাস ভ্যান থেকে মাটিতে পড়ে গেলে তাকে অনবরত লাথি মারতে দেখা যায়।
একপর্যায়ে কয়েকজন রূপলাল ও প্রদীপকে রশি, জুতা, গাছের ডাল, ভ্যানের প্যাডেল দিয়ে মারধর করতে থাকে। এ সময় দু’জনই জ্ঞান হারিয়ে গোঙাতে থাকেন। এ সময় মৃত্যু নিশ্চিত করতে হলুদ, কালো, লাল গেঞ্জি পরা ৪-৫ জন রূপলালের পিঠে লাথি মারতে থাকে। হলুদ গেঞ্জি পরা দুই তরুণ দুই পা দিয়ে পিঠ বরাবর একাধিকবার লাথি দিতে থাকে- তারা উল্লাস করতে থাকে। এ সময় হলুদ গেঞ্জি পরা এক তরুণ গাছের ডাল দিয়ে আবারও দু’জনকে মারতে থাকে। ছাই রঙয়ের গেঞ্জি পরা এক যুবক রূপলালের মৃত্যু নিশ্চিত করতে বারবার গলায় পা তুলে দেয়। আশপাশের কয়েকজন তখন বলছিল, ‘পুলিশ পালাইছে’।
পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলে হাজার হাজার মানুষ ছিলেন। এর বিপরীতে সেখানে চার জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। তারা রূপলাল ও প্রদীপকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পেছন থেকে যখন পুলিশকে ধাক্কাধাক্কি, ঘুসাঘুসি শুরু হলে তখন তারা জীবনের ভয়ে সরে এসেছেন। পুলিশের করার কিছু ছিল না।
এ ঘটনায় রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী বাদী হয়ে ৫০০-৭০০ অজ্ঞাতের বিরুদ্ধে তারাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেছেন। পুলিশ এ পর্যন্ত চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:০৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



