অবশেষে মানতে হলো। বাসের টাইমটেবিল দেখে বুঝলাম, এর ভরসায় থাকলে আমাকে আর আমেরিকায় করেকম্মে থাকতে হবেনা। কোথাও বেরুলেই সারাদিন রাস্তাতেই কাটাতে হবে। ট্যাক্সির রেট দেখে মাথা ঘুরে গেলো। একদিন দুইদিন চড়া যায়, প্রতিদিন না। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের অপ্রতুলতা এবং ট্যাক্সির ব্যয়বহুলতা দেখে আমি পিছু হটলাম। সুতরাং DMV(Dipartment of Motor Vehicle) থেকে বই আনিয়ে শুরু হলো পড়াশুনা। বই পড়ি গাড়ি চালানোর জন্য না, নিয়ম-কানুন তথা ট্রাফিক আইন শেখার জন্য।
বই পড়ে আর কিছুই বুঝিনা। গাড়ি রাস্তায় লাল কার্বে পার্ক করা যাবেনা, সবুজ কার্বে সীমিত সময়ের জন্য, হলুদ কার্বে শুধুমাত্র যাত্রী উঠানো নামানোর জন্য, আরে বাবা কার্ব কি, তার এতো লাল-নীল রংই বা কেনো? পরদিন বিকালে বেরিয়ে কার্ব কি দেখে এলাম, রাস্তা আর ফুটপাতের সংযোগস্থল। এক জায়গায় লাল রং করা উদাহরনও চোখে পরলো।
ডায়মন্ড লেনে চলতে হলে গাড়িতে কমসে কম দুজন থাকতে হবে। ডায়মন্ড লেন? রাস্তাও হীরা দিয়ে বাধায় নাকি? প্র্যাকটিকালি দেখার সময় পেলামনা। বর ছবি একে বুঝানোয় বুঝলাম এ ডায়মন্ড সে ডায়মন্ড নয়। তাসের খেলায় ডায়মন্ডের যে চারকোনা ছবি দেখি, তাই রাস্তার মাঝে আঁকা। বেচারাকে অনেক কষ্ট করে বুঝাতে হলো। তখনো গুগলের গল্প শুনিনি। ইয়াহূ সবে হাটি-হাটি-পা-পা। আরও আছে। সবার জন্য স্টপ, এমন সাইনে যদি দুটি গাড়ি এক সাথে আসে, কে আগে যাবে। উফফ্, এর মানে কি? স্টপ হলে যাবে কেনো? যেতেই যদি হয়, আমি আগে যাবো, তবে লেখার বেলায় লিখবো অন্যজনকে আগে যাতে দিবো। সোজা, না? ভুল, সবই ভুল।
এরকম কিছু বুঝে, অনেক কিছু না বুঝে বইটা পড়ি। আমরা পড়া না বুঝে পড়ে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসায় অভ্যস্থ। বিজ্ঞানে প্রতি চ্যাপ্টারের শেষে 'এসো নিজে করি' বলে একটা সেকশন ছিলো। আমাদের পুরো চ্যাপ্টারের মত এটাও না করেই পড়তে হতো। গরুর রচনা লাইন বাই লাইন মুখস্ত, একটু এদিক ওদিক হলেই নম্বর কাটা। আর এতো গাড়ির রচনা। যাহোক, বুঝে বা না বুঝে পড়ে দুইদিনের মাথায় গেলাম পরীক্ষা দিতে। এবং টায়ে টায়ে পাশ করে লার্নার পারমিট নিয়ে বাসায় এলাম।
এবার শুরু হলো আসল শিক্ষা। এখানে ফাকি দেয়ার উপায় নাই। পথ-পরীক্ষায় পাশ করতে হলে ঠিকই পথে চালাতে হবে, পাশে বসে থাকবে ডি-এম-ভি এর এক্সামিনার। তার নির্দেশিত পথে চলতে হবে, সে দেখবে আমি সব নিয়ম মেনে নিরাপদে চালাই কিনা। গাড়ি পার্ক কারা, ব্যাক করা, প্যারালাল পার্ক, লেন চেন্জ, স্টপ সাইনে থেমে চারিদিক দেখা, ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা আছে কিনা তাও দেখবে। আ্যতো কিছু শেখা কি সোজা ব্যাপার?
এক ছুটির দিনে অফিস পাড়ার খালি পার্কিংলটে হাতে-ষ্টিয়ারিং হলো। কোথায় আমার ঠিক মনে নেই। সবে ক্যালিফোর্নিয়াতে এসেছি, কিছুই চিনিনা। শুধু মনে আছে এক বড় বিল্ডিংএর পাশে বিরাট পার্কিং লট, একটাও গাড়ি নেই। পাশের চওড়া রাস্তায় মাঝে মাঝে কিছু গাড়ি যাচ্ছে। প্রথম দিন শেখার জন্য আদর্শ পরিবেশ। শুনলাম এর চেহারাই পাল্টে যায় অফিস-দিনে। ঠিক যেন ঢাকা, ঈদের সময় আর অন্য সময়।
লার্নার পারমিটে চালাতে হলে পাশে একজন অভিজ্ঞ চালককে বসতে হয়। একা একা চালানো যায়না। এবং সেই অভিজ্ঞ চালক তথা ইন্সট্রাক্টর বাদে অন্য কোনো যাত্রী গাড়িতে থাকবেনা। আমার ইন্সট্রাক্টর জনাব স। সে স্টার্ট দেয়া শেখানোর পরে আমি প্রথমেই দেখে নিলাম কিভাবে ব্রেক করে। মনে মনে প্ল্যান, গাড়ি উল্টা-পাল্টা চললেই ব্রেক কষে দেবো! তখনো বুঝিনি উল্টা-পাল্টা অবস্থায় শুধু ব্রেকে কাজ হয়না। প্রতি সপ্তাহন্তে চলতে থাকলো প্রাকটিস। স-বাবুর ছুটির দিন ছাড়া সময় কোথায়? এছাড়া শেখার মত ফাকা জায়গাও লাগে। বেশ কয়েক সপ্তাহ শেখার পরে নামলাম রাস্তায়, ট্রাফিকের সাথে চালানোর জন্য।
জনাব স এর পরিচয় নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। না পারলে নেই। সে আড়ালে থাকতে চাইছে তাই নাম বললামনা। আর ছদ্দনামে ভালো লাগেনা। বলতে বসেছি সত্যি গল্প, বানানো তো নয়। তাই বন্কিমবাবুর ইন্দিরার পরামর্শ শুনে আদ্যাক্ষরের এই নাম।
আসল গল্পে ফিরি। কিছুদিন রাস্তায় চালানোর পরে ঘটলো এক ঘটনা। দুর্ঘটনাও হতে পারতো, হয়নি। তাহলে আজকে এই গল্প বলতে পারতামনা। তখন সবে বামে মোড় নেয়া শিখেছি। প্রাকটিস করছি ইউ-টার্ন নেওয়ার। নিতে যেয়ে আর সামলাতে পারলামনা। সামনেই হাইওয়ে এন্ট্রেনস, ঢুকে পরলাম সেখানে। থামার উপায় নেই। আমি তখন পর্যন্ত ঘন্টায় পঁচিশ মাইলের উপর চালাইনি। হাইওয়েতে গাড়ি চলে সত্তুর-আশি মাইল বেগে, নিয়ম ষাট মাইল বেগে যাওয়ার, আর চল্লিশের নীচে গেলেই পুলিশ জরিমানা করে দিবে। তার চেয়েও বড় কথা, আশে-পাশের গাড়ির চেয়ে বেশী ধীরে চালালে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গ্রন্থগত বিদ্যাটি এখন হাড়ে হাড়ে বাস্তবে বুঝছি। বুঝলে কি হবে? আমি জোরে চালালে গাড়ি আর লেনে থাকেনা। প্যাসেন্জার সীট থেকে জনাব স হাত বাড়িয়ে ষ্টিয়ারিং ধরলো। আমাকে বললো শুধু গ্যাস প্যাডেলে চাপ দিতে। এখানে পেট্রোল ডিজেলের মতো তরল জ্বালানিকে গ্যাস বলে, গ্যাসোলিনের সংক্ষেপ। আমি সেই লিকুইড গ্যাস যতই দেই, তবু পাশের লেনের গাড়িগুলো যেন সাই সাই করে ঝড়ের বেগে চলে যাচ্ছে। সামনে একটা এক্সিট, নিতে চাইলে স বললো ওটা আরেকটা হাইওয়েতে নিয়ে যাবে। সুতরাং সেই ভাবেই চলতে থাকলাম পরের এক্সিট না আসা পর্যন্ত। মাগো, এখান থেকে বেঁচে ফিরবো কিভাবে? সামনে আরেকটা এক্সিট, স এর কথায় সেইটা নিলাম। খুব বেশি হলে হয়তো পাঁচ মিনিট ছিলাম হাইওয়েতে, কিন্তু মনে হচ্ছিলো অনন্তকাল।
ছোট রাস্তায় তো বেরুলাম, কিন্তু এটা এ কোথায় এলাম? পিছনের সীট থেকে ম্যাপ আটলাসটা বের করে স-বাবু দেখলো কিভাবে বাসায় যেতে হয়, আমিও শিখলাম। তখনও জিপিএস যুগ অনেক দুরে। এবার আর আমি ড্রাইভিং সীটে বসলামনা। শুধু সেদিন না, বেশ কিছুদিনের জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ৯:২২