somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অন্ধকারের অভিবাদন

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.


ব্যাপারটা খুব অদ্ভুদ লাগে আফরার। মানুষটা চাঁদের মধ্যে কি পেয়েছে? আকাশে চাঁদ উঠলেই এমন করে চাঁদ দেখে। মানুষ এত অদ্ভুত কেন।

চার মাস হল আফরা আর তার মা এই বাসায় এসেছে। কাজের মেয়েটা সারাদিন টিভি দেখে, আর আফ্রা ফ্রিজ খুলে ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে রাতে বারান্দায় বসে গুন গুন করে গান গায়। এই বাসার বারান্দার গ্রিলগুলো খুব সুন্দর। ধবধবে শাদা বাড়ির বারান্দায় নীল রঙের গ্রিল। বারান্দায় ঘুলঘুলিতে চড়ুই পাখির বাসাটাও সুন্দর। আগে যারা ছিল তারা ঘুলঘুলিতে আবার একটা আইসক্রিম এর কারটন ঝুলিয়ে দিয়েছে। তাতে চড়ুই পরিবার নিয়ে থাকে। এই বাসায় আসার আগে আফরার মনে হত ঢাকা শহরে বোধহয় এখন আর চড়ুই পাখি বাসা বাঁধেনা।

আফরার ছোটবেলাটা খুব মনে পরে। পুরান ঢাকায় মামা বাড়িতে কেটেছে তার ছোটবেলা । কাঠের দোতলা বাড়িতে চড়ুই এর কারখানা। আফরার দোয়েল পাখিও খুব ভালো লাগে। একবার লুকিয়ে মায়ের কবিতার বই পরেছিল । তাতে লাল দাগ দেয়া দুটো লাইন তার খুব ভালোলেগেছিল-

যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের – মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা

মাকে অনেক বলে বাসায় দোয়েল পাখি এনেছিল আফরা। সারাদিন ওদের নিয়েই পড়ে থাকতো। একদিন সকালে উঠে দেখে পাখি দুটো মরে গেছে। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরত তখন দিনরাত।

যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের – মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা...


২.


আজ পূর্ণিমা। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আফরা ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে চলে এসেছে বারান্দায়। আজকাল চাঁদের হিসাব রাখে সে। কেন যেন ভালো লাগে ব্যাপারটা। লোকটাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। এইখানে আসার আগে আর অই লোকটাকে দেখার আগে আফরার কখনও মনেই হয়নি চাঁদ এত সুন্দর, এভাবে অপলক ভাবে তার দিকে তাকানো যায়। লোকটা মাঝে মাঝে অবশ্য আফরার দিকেও তাকায়। চোখে বিশাল চশ্মা। অদ্ভুদ সুন্দর। প্রতিদিনই ভাবে, আজই গিয়ে লোকটাকে থ্যাঙ্কস জানিয়ে আসবে কিন্তু যাওয়া হয়না।


সালমা, এই সালমা
জ্বে আপা, বলেন
কোথায় ছিলা তুমি?
ডরিং রুমে, টিবি দেকতাসিলাম
সারাদিন টিভি দেখ কেন?
ও আল্লাগো আপায় এডি কি কয়, আমি বলে সারাদিন টিবি দেহি, ও খালাম্মা...
হইছে থামো, আমি বললাম টিভি না দেখে তো চাঁদও দেখতে পারো
আপা যে কি কন। যাই আপা সিরিয়াল্ডা শেষ অইয়া যাইবো


সালমা নাচতে নাচতে চলে যায়। মেয়েটার বয়স ১৯। এর মধ্যে ২ টা বিয়ে হয়েছে। প্রথম স্বামী ২ লাখ টাকা যৌতুক নিয়ে তালাক দিয়ে দিয়েছে। আর দ্বিতীয়টা ৫ লাখ টাকা নিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছে। আবার মাস শেষে এসে সালমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়।


উফফ আসল কথাটাই বলা হয়নি। সালমা, এই সালমা
- জ্বে আপা বলেন
- তুমি ওই বাসায় চারতলায় কারা থাকে চেন?
- না আপা কেন কি অইছে? আপনেরে চোক মারে? ইশারা দেয়?
- না, আসো দেখ ওই যে ওই লোকটা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে ওকে চেন?
- ও খালাম্মা, খালাম্মা দেকছেন এক বুইড়া ব্যাডা আপার দিকে ড্যাবড্যাবাইয়া তাকাই আছে, কাইল সকালেই খবর করুম। আমাগো আপার দিকে কু নজর


চেঁচাতে চেঁচাতে চলে যায় সালমা। বারান্দায় বসে চাঁদ দেখে আফরা আর ওপাশের জানালায় এক পরিচিত আগন্তুক।

৩.
লোকটা কি ছবি আঁকে? ঝলমলে ঘরের ভেতরে কত ছবি দেখা যায়। নিশ্চয়ই ছবি আঁকে নয়তো এত সুন্দর করে তাকিয়ে থাকে কিভাবে। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর করে দেখার ক্ষমতা কেবল চিত্রকরদেরই হয়। সম্ভবত নীল রঙ খুব পছন্দ লোকটার। সবসময় নীল শার্ট। কেমন যেন গাড় নীল। দেখলেই সব শীতল হয়ে আসে। ইশশ আমি যদি ছবি আঁকতে পারতাম।
বিকালে একা একা ছাদে হাঁটে আর ভাবে আফরা।আচ্ছা লোকটা কখনও দিনের আলোয় জানালায় আসেনা কেন? কিংবা চাঁদ না উঠলে ? আচ্ছা উনার সাথে দেখা হলে কি বলব?কেমন আছ? নাহ, আপনি করে বলতে হবে, প্রথমেই তুমি বললে উনি রেগে যেতে পারেন।

হঠাৎ দৌড়ে মায়ের ঘরে চলে যায় আফরা। মায়ের চোখের চশমা নিয়ে এসে লোকটার মত তাকাতে চেষ্টা করে।
উহু হচ্ছেনা, ধুর এটাতে হবেনা। নাহ কালই একটা চশমা কিনতে হবে। একদম অই লোকটার মত কালো, মোটা গোল চশমা। আর হ্যাঁ অবশ্যই একটা নীল জামা। তারপর নীল জামা আর চশমা পরে লোকটার সামনে গিয়ে বলতে হবে, এভাবে তাকিয়ে থাকেন কেন? খুব জোরে ঝাড়ি দিয়ে বলতে হবে যাতে লোকটা ভয় পায়। ভয় পেলে সাথে সাথে হেসে ফেলতে হবে। উমমম নাহ থাক দরকার নাই, লোকটা কষ্ট পেলে পরে আরেক ঝামেলা।

কেমন আছেন?
হুম ভালোআমাকে চিনেছেন?
না
আমি কিন্তু আপনাকে চিনি
ভালো
শুধু ভালো? আর কিছুনা?
উহু
নাহ, লোকটা নিশ্চয়ই এত কম কথা বলবেনা। এটা কেমন যেন প্রফেসর মার্কা হয়ে যাচ্ছে। উনি তো চিত্রকর, প্রফেসর না।
এই যে চিত্রকর সাহেব, কেমন আছেন?
খুব ভালো, আপনি?
আমিও খুব ভালো, আচ্ছা আপনার চোখ এত সুন্দর কেন?
আমার চোখ?
হু, আপনার চোখ, আর আপনি এত সুন্দর করে তাকিয়ে থাকেন! উফ !
কি বলছেন এসব? হা হা হা
জ্বি না সত্যি, আপনার চোখ দেখার জন্য আমি বাইনোকুলার কিনেছি বুঝেঝেন?

নাহ, বাইনোকুলার এর ব্যাপারটা বলা যাবেনা, তবে কাল চশমার সাথে বাইনোকুলারটাও কিনে ফেলতে হবে। সাথে লোকটার জন্য একটা গিফট। কি গিফট কেনা যায় এটা ভাবার বিষয়।

৪.


নতুন চাঁদ উঠতে কেন এত দেরি হয়? তাহলে হয়তো ওই লোকটা আর চাঁদ দেখতো না, হয়তো চেনাই হতোনা একজোড়া নিকষ কালো চোখ আর অপলক দৃষ্টি। তবু এখন অপেক্ষা খুবি ক্লান্তিকর, কষ্ট হয় খুব। সময়গুলো কাটতে চায় না। লোকটা খুব খারাপ। যেদিন জানালায় আসেনা সেদিন জানালায় ভারী পর্দা দিয়ে রাখে। আর বাইনোকুলারটাও ভালো হয়নি, কেমন ঘোলা ঘোলা দেখা যায়। তবে চশমাটা সুন্দর হয়েছে। ইশশ চোখে সমস্যা থাকলে ভালো হত, এই চশমা পরে ক্লাসে যাওয়া যেত। ধুর মা আরেকটু বেশি টাকা দিলেই একটা ভালো বাইনোকুলার কেনা যেত। আর গভীর হত কালো ফ্রেমে বন্দী কালো চোখ।

ভাবতে ভাবতে ঘুম পায় আফরার। কাল ছুটি, তবুও ঘুম পায়। আজকাল বড্ড ঘুম পায়। আবার ঘুম থেকে উঠতেও দেরি হয়।

এ্যাম্বুলেন্সের কান ঝালাপালা করা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়।সালমা, এই সালমা
জ্বে আপা
কি হইছে? এত হইচই আর এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ কেন?
আপা আপনি তো ঘুমায় ছিলেন, ঘটনা তো ঘইটা গ্যাছে
কি ঘটছে?এক ব্যাটা গলায় দড়ি দিছে
কি বল এইসব
জ্বে আপা, আবার চিডি লেইখ্যা গলায় দড়ি দিছে
কিসের চিঠি, কাকে লিখছে?
চিডি না আসলে, গান লেইখ্যা গ্যাছে
মানে কি? কি বল উলটাপালটা?
জ্বে আপা, সইত্য। কি জানি বিলাসী মুন নাপাক জোসনা- এইসব কতাবাত্রা
ধুর, তুমি যাওতো। আমি নিচে গিয়ে দেখে আসি।
জ্বে না আপা, আপনার বের হওন মানা, খালাম্মা বইলা গ্যাছে

বারান্দায় দাড়িয়ে অপলক তাকিয়ে থাকে আফরা। ভয় হতে থাকে। তার ওই চাঁদ দেখা মানুষটা যে বাসায় থাকে সেই বাসার সামনেই ভিড়। অনেক মানুষ, পুলিশ। আচ্ছা ওই মানুষটা নয়তো?ধুর কি সব ভাবছি, উনি কেন হবে, উনি শিল্পী মানুষ। এসব ফালতু কাজ উনি করবেন না। কিন্তু যদি করে? কালতো জানালায় আসেনি। কিন্তু কাল তো আকাশে চাঁদ ছিলোনা, কিন্তু তবুও তো আস্তে পারতো...

মাথা ভারী হয়ে আসে আফরার, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে। মনে হচ্ছে সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে। তার ঘরটা নিজের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে দুমড়ে মুচড়ে। এমনকি সি নিজেও।সালমা, সালমা...


৫.


মরে যাওয়া খুব সাধারণ ব্যাপার। আর অসাধারণ হচ্ছে নিজেকে মেরে ফেলা। খুব সাহসী লোকেরাই কেবল আত্মহত্যা করতে পারে।
আচ্ছা।
না শুধু আচ্ছা না, তোমার উনার জন্য কষ্ট পেতে হবেনা, উনি জেনেছিলেন উনার মৃত্যুতেই সুখ, তাই সুখের কাছে গিয়েছেন। সবাই কি পারে?
না পারেনা। কিন্তু মরে যাওয়া কেন সুখ হবে?
দেখ মানুষ বেঁচে থাকে স্বপ্ন দেখার মধ্য দিয়ে। যখন সে আর স্বপ্ন দেখতে পারেনা তখন সে মৃত্যুতে সুখ খুজে পায়। কোন মানুষের সব স্বপ্ন পূরণ হয়ে যায় আর নতুন কোন স্বপ্ন থাকেনা তখন সে মৃত্যুতে সুখ খুজে পায়। আবার কোন মানুষের কোন স্বপ্নই পূরণ হয়না আবার সে এটাও বুঝে ফেলে যে তার কোন স্বপ্নই পূরণ হবেনা তাই সে আর স্বপ্ন দেখতে পারেনা। তাই মৃত্যুই তার কাছে পরম সুখ। পার্থক্য শুধু এটাই যে একজন নতুন স্বপ্ন খুজে না পেয়ে মৃত্যুর কাছে যায় আরেকজন যায় মুঠো মুঠো ব্যর্থ স্বপ্ন নিয়ে।
আমি কোনদিন পারবো না
আমি জানি তুমি পারবে না। আমিও পারবো না। ওটা শুধু সাহসীদের জন্য। পৃথিবীতে শুধু ভীরুরাই রাজত্ব করবে। এটাই নিয়ম।
মা
বলো মা
আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো, আমার বুকের ভেতর কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে
এইতো ধরলাম
আচ্ছা মা, আবার পূর্ণিমা কবে হবে?
কেন? পূর্ণিমা দিয়ে কি হবে রে পাগলী? বনে যাবি নাকি?
পূর্ণিমা হলে বনে যায় নাকি?
যায় তো, রবীন্দ্রনাথ অবশ্য যেতে পারেননি। তিনি ঘর মোছার জন্য যেতে পারেননি। তাকে রেখে সবাই চলে গিয়েছিল বনে।
মা, একটা কবিতা শোনাও না
কি কবিতা শুনতে চাও বল
একটা সুন্দর কবিতা বল
"কিনেছি অনেক দামি উপহারবহু মনোহর কাগজের ফুলভালোবাসা দিয়ে হয়নাই কেনাএকখানি মেঘ একটি বকুল
জমাজমি আর গৃহ আসবাবঅধিক মুল্যে করে রাখি ক্রয়
শুধু কিনি নাই কানা কড়ি দিয়েএকজোড়া চোখ একটি হৃদয়"
কি সুন্দর কবিতা, এটা কার কবিতা?
বলা যাবেনা, তুমি খুজে বের করবে কাল। এখন ঘুমাও মা।

৬.


শুধু কিনি নাই কানা কড়ি দিয়েএকজোড়া চোখ একটি হৃদয়

নাহ, হৃদয় পাই না পাই আমার ওই চোখ লাগবেই লাগবে। বুকের মধ্যে কেমন একটা তাড়না অনুভব করে আফরা। তবে সাথে হৃদয়টা পেলে একটু বেশিই ভালো হয়। শুধু চোখ তো নইলে খেলনা হয়ে যাবে। কাল জছনা। আবার একসাথে চাঁদ দেখা, ধোঁয়াটে আলোয় নিশ্চুপ কথোপকথন। কাল মা জামা কেনার টাকাটা দিলেই উনার সাথে দেখা করা হয়ে যাবে।উফফ রাত এত ফালতু কেন? একদম ফালতু। তাড়াতাড়ি শেষ হলে কি হয় একদিন! যত্তোসব

আর কিছুক্ষণ, এরপর সরে যাবে ভারী পর্দা। জানালার মাঝে চলে আসবে সেই চিরচেনা মুখ। চোখে সেই চশমা আর অপলক দৃষ্টি।প্রতিটা মুহূর্ত যেন সেকেন্ডের কাঁটার মত আটকে আটকে যাচ্ছে।
কিন্ত এখনও আসছেনা কেন? রাত দশটা বাজে। ঘরেতো আলো জ্বলছে, ভারী পরদার ওপাশে একজন বসে আছে। কিন্তু জানালায় আসছেনা কেন?
তাহলে কি সেদিনের সেই গলায় দড়ি!! না এটা কখনই হতে পারেনা।
কিন্তু উনি তো আসছেনা
আসছে না তাতে কি? ব্যাস্ত হয়তো একটু। হয়তো ছবি আঁকছে।
নাহ, উনি সেই লোক। নইলে এত সুন্দর চাঁদ না দেখে বসে বসে ছবি আঁকতেন না।
সব সময় চাঁদ দেখতে হবে এমন কোন কথা আছে নাকি? আর উনি ওই যে পর্দার ওপাশে।
ওপাশে অন্য কেউ, উনি আর চিকন আর আরও লম্বা।
ফালতু কথা।
না, ঠিক কথা। উনি মরে গেছেন। উনি সাহসী।
না উনি ভীরু। অবশ্যই ভীরু, ভীরু হতেই হবে।
কিন্তু উনি সাহসী, শিল্পীরা সাহসী হয়, যেমনটা ঈশ্বর।
না উনি ভীরু, কাপুরুষ, সব কিন্তু সাহসী না।
কিন্তু উনি তো শিল্পী।না উনি শিল্পীও না।

ভোর হয়ে আসছে। নিজের সাথে যুক্তি দেখাতে দেখাতে নিথর হয়ে যাচ্ছে আফরা। মাতাল মাতাল লাগছে। মনে হচ্ছে খুব ভারী একটা কিছুর নিচে চাপা পড়ে আছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

নাহ আজই যেতে হবে উনার বাসায়। একটু পরেও যেতে হবে। সূর্য উঠলেই চলে যাবো। বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে নিজের সাথে কথা বলে আফরা।

৭.


আপা কত তলায় যাবেন?
চারতলায়
ওহ যে তলায় গলায় দড়ি দিছে?
হ্যাঁ ওই বাসায়
আপনি কি উনার কিছু হন? মানে আত্মীয় ?
হ্যাঁ, আমি উনার খালাতো বোন, এখন কি যেতে পারি?জ্বি আপা যান

কিন্তু আফরা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারেনা। তার পা আটকে যায় বারবার। কার কাছে যাচ্ছে সে? যে মানুষটা মরে গেছে তার কাছে? কেন যাচ্ছে?? দোতলার সিঁড়িতে বসে কেঁদে ফেলে আফরা। লোকটা চলে গেলো? চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে আফরার। কিন্তু পারেনা। গলার মধ্যে কান্না আটকে যায়। কার জন্য এত আয়োজন, কার জন্য সারারাত বারন্দায় দাড়িয়ে থাকা?

দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় আফরা। নক করার আগেই খুলে যায় দরজা। যেন কেউ অনেকক্ষণ ধরে তার জন্য অপেক্ষা করছিল।

ভাইজানের কাছে আসছেন?
দ্রুত চোখ মুছে তাকায় আফরা। তাহলে কি উনি বেঁচে আছেন?
হ্যাঁ উনার কাছেই এসেছি।

আফরাকে একটা আবছা অন্ধকার ঘরে বসিয়ে রেখে ভিতরে যায় মহিলা। সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগে। কোন কিছু চিন্তা করাও থেমে যাচ্ছে। পালিয়ে যেতে পারলে ভালো হত। কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। তাহলে কে মারা গেছে? আর সেইবা কার কাছে এসেছে? ভাবতে ভাবতে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায় আফরা। পর্দা সরালেই ভেসে উঠে তার বারান্দা।

আপনি আমার কাছে এসেছেন?
সকালের রোদ জানালার ফাঁক গলে লোকটার মুখে পড়েছে। সেই লোকটা। সেই মুখ, সেই চুল, গোঁফ, খোঁচা দাড়ি, শার্ট। শুধু চশমাটা নেই। একটা কালো সানগ্লাস পরা। হঠাত সব স্তব্ধ হয়ে যায় আফরার।
আমি জিজ্ঞেস করছি আপনি কি আমার কাছে এসেছেন?
হ্যাঁ, না। হ্যাঁ, না মানে হ্যাঁ
যেকোনো একটা বলুন
না
ঠিক আছে আসুন তাহলে। যার কাছে এসেছেন তিনি নেই আর আসবেন ও না।
মানে, আমি আপনার কাছে এসেছিলাম।
কি ব্যাপার বলুন
অনেককথা, বসে বলি?
হুম বলুন
আপনি কি আমাকে চেনেন নি?
না, তবে গন্ধটা চিনেছি।
মানে?
মানে বহুকাল আগে এই গন্ধ আমার সারা শরীরে থাকতো।
খুলে বলবেন?
আমার মা, তার শরীরে আমি এই গন্ধ খুজে পেতাম তখন, যখন আমি এক উলঙ্গ শিশু।
উনি এখন নেই?
সবার সবসময় থাকতে হয়না, আপনার কথা বলুন
আমি সেই মেয়ে যে সবসময় আপনার সাথে চাঁদ দেখে, আপনাকে দেখে, আপনার চোখ দেখে। হয়তো আপনিও
আমি দেখিনা
দেখেন নিশ্চয়ই, হয়তো খেয়াল করেন না। এই যে আজ আমি আপনার মত চশমা পড়ে এসেছি। আচ্ছা আপনি কি ছবি আঁকেন?
না
ওহ, আমি ভেবেছিলাম আঁকেন।আচ্ছা আপনার চোখ এত সুন্দর কেন?
কারন নিজের চোখ আয়নায় দেখা হয়নি
মানে, কখনো আয়নার সামনে দাঁড়ানো হয়নি
আমি আপনার চোখ দুটো খুব ভালোবাসি।
আর আমাকে?
উম্মম্ম বলা যাবেনা এখন
আচ্ছা আপনি কখনো আয়নার সামনে দাঁড়াননি কেন?
যে চোখে কখনো সূর্যের আলো ঢোকেনি সে চোখে কি আর প্রিজমের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে?
মানে?
মানে আমি একজন জন্মান্ধ

নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে আফরা। তার আর কিছুই হয়তো করার নেই, কিংবা বলার কিংবা অন্যকিছু। কি বলবে সে?


৮.


আপনি আছেন?
হ্যাঁ আছি
কিছু বলবেন? নাকি চলে যাবেন?
বলবো, আপনি অন্ধ তাহলে ওই জানালায় তাকিয়ে চাঁদ দেখতেন কেন?
চাঁদ দেখা... আচ্ছা আপনি কখনো হোমার পড়েছেন? ইলিয়ড, ওডেসী?
হ্যাঁ পড়েছি
আমি পড়িনি, শুনেছি। একজন অন্ধ কবি এঁকে গিয়েছেন সহস্র ছবি, শত নাটক, যুদ্ধের দামামা কত ভালোবাসা আর নিষ্ঠুরতা। সে কিভাবে পেরেছিল? যে কখনো দেখেনি আকাশের রঙ, কখনো দেখেনি নোনা জলের উত্তাল ঢেউ সে কি করে পারলো এই ছবি আঁকতে? কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ছবি আঁকতে চাইনি। কাব্যও লিখতে চাইনি। আমি তো চেয়েছিলাম শুধু চাঁদ দেখতে।

আমি আসলে ওখানে বসে থাকতাম না। আমি মডেল দিতাম। ও আমার মুখে, চোখে চাঁদ ধরতে চেয়েছিল। আঁকতে চেয়েছিল চাঁদের স্বরুপ। আঁকতে চেয়েছিল ক্যানভাসে। হয়তো পেরেছিল। কিন্তু আমি চাঁদ দেখতে পাইনি।

আমি জানিনা স্নিগ্ধ ভোর কেমন হয় কিংবা বনলতা সেন কেমন ছিলেন। আমার কাছে পৃথিবীর সমস্ত রঙ সমস্ত সত্তা, উঁচু কিংবা হেলে পরা মন্দির সবই এক। এখানে নেই কোন অন্ধকার নেই কোন আলো। এটা একটা শুন্য জগত। যেমনটা আকাশের ওপাশে। আমার কখনো আকাশ দেখা হয়নি, তবে শুনেছি আকাশ নীল হয়। আচ্ছা আপনার জামাটা কি আকাশের মত নীল?

আচ্ছা, উনি কি আপনার ভাই?
হ্যাঁ, বড়। ও ছবি আঁকত। শুধু আমার ছবি আঁকত। বলত শিল্পী আর ঈশ্বর শুধু দু জায়গায় দুটো নাম, মুলত তারা একই।আচ্ছা ইশ্বরেরা কি মরে যায়? ও চেয়েছিল আমাকে দেখাবে। সব, সবকিছু। নুড়ি পাথরের বুকে আছড়ে পড়া নদী, গভীর সুরের রমণী, অসীম আকাশ, কৃষ্ণচূড়া। আমি দেখিনি কিছুই। ক্যানভাসে আটকে থাকা জমাট রঙে থেমে গেছে আমার হাত। খসখসে হাতে তেলের গন্ধ নিয়ে আমি দেখতে চেয়েছিলাম পৃথিবীর সমস্তকিছু অন্তত সবচেয়ে কুৎসিত হলেও। পারিনি। ছবি এঁকে আমায় বলতো, এই যে হাত বুলিয়ে দে সব দেখতে পাবি। সত্যি বলছি আমি কিছুই দেখিনি। তারপর একদিন বলেছিলাম, বড় তুই আমাকে চাঁদ দেখাবি? সেই চাঁদ, যে চাঁদের মায়ার সন্ধ্যা হয়, নীরবতা নামে চারিদিকে। যে চাঁদের ভালোবাসায় মুখ লুকায় শুকতারা।

ও বলেছিল। তারপর অনেকগুলো দিন। আমি বসে থাকলাম জানালার পাশে রাতের পর রাত। তারপর একদিন আবার গাড় তেল রঙের প্রলেপ এ আটকে গেলো আমার আঙুল। আমি ভেবেছিলাম চাঁদ বুঝি খুব কষ্ট দেয়।

আপনি কি আমাকে চাঁদ দেখাবেন? কাস্তের মত বাঁকা চাঁদ না, পঞ্চমীর চাঁদ।জীবনানন্দ দশের মত আমার জানতে ইচ্ছে করে,
কেন চাঁদ ভেসে ওঠেঃ সোনার ময়ূরপঙ্খী অশ্বত্থের শাখার পিছনে
কেন ধুলো সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে শিশিরের চুমু খেয়ে- গুচ্ছে গুচ্ছে ফুটে ওঠে কাশ

নাকি আপনিও বলবেন- অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক জোছনায় পাক সামান্য ঠাই ?
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:৫১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×