দুই বছর আগে অর্থনৈতিক মন্দায় কাবু হয়ে পড়ে গোটা বিশ্ব। সংকট কাটিয়ে উঠতে শুরু হয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংস্কারের তোড়জোড়। প্রায় একই সময়ে বিশ্বজুড়ে শাসনব্যবস্থায়ও দেখা দেয় এক 'মন্দা'_গণতন্ত্রের মন্দা। গত দুই বছরে গণতান্ত্রিক হিসেবে পরিচিত দেশগুলোতে গণতন্ত্রচর্চায় উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটেছে। গণতান্ত্রিক সরকারগুলো বিরূপ হয়ে উঠেছে গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয় ও ভিত্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি। জনগণের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পড়েছে নাজুুক পরিস্থিতিতে। সরকারের কর্মসম্পাদন প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রবিরোধী উপাদান শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
এবার গণতন্ত্র সূচকে প্রথম স্থানে রয়েছে নরওয়ে। দ্বিতীয় আইসল্যান্ড, তৃতীয় হয়েছে ডেনমার্ক। গতবারের (২০০৮) প্রথম সুইডেন এবার চতুর্থ স্থানে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের মতো দেশে গণতন্ত্রচর্চায় অনেক অবনতি ঘটেছে। এদিকে বাংলাদেশের অবস্থানের আট ধাপ উন্নতি হয়েছে।
বিখ্যাত দি ইকোনমিস্ট পত্রিকার বিশেষ বিভাগ ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০১০ সালের গণতন্ত্র সূচকে (ডেমোক্র্যাসি ইনডেঙ্) এমন কথাই বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, সত্তরের দশকে সারা বিশ্বে গণতন্ত্রায়ণের ঢেউ ওঠে। সেই ঢেউ প্রবল আকার ধারণ করে ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর ভাঙার পর। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখন কোনো না কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বসবাস করে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণতন্ত্র পিছু হটতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেখা গেছে নেতিবাচক ধারা। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশগুলোতেও গণতন্ত্রচর্চায় ব্যাপক অবনতি হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা এর অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ১৬৭ দেশের বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। আগামীকাল (১৫ ডিসেম্বর) তারা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এটি প্রকাশ করবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, 'পূর্ণ গণতন্ত্র' রয়েছে মাত্র ২৬টি দেশে। ৫৩ দেশে 'খুঁতযুক্ত গণতন্ত্র', ৩৩টিতে 'সংকর শাসনব্যবস্থা' (হাইব্রিড রেজিম) আর ৫৫টিতে চালু রয়েছে 'কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা'।
প্রতিবেদন তৈরির আগে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পেতে পাঁচটি বিষয় নির্ধারণ করে গবেষণা জরিপ চালানো হয়। বিষয় পাঁচটি হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, জনগণের স্বাধীনতা, সরকারের কর্মপদ্ধতি, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি। প্রতিটি বিষয়ের জন্য নম্বর ছিল ১০। পরে এসব বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বরের গড় করে গণতন্ত্রের অবন্থান নির্ধারণ করা হয়। এতে দেখা যায়, বেশির ভাগ দেশেরই (৯১টি দেশের) প্রাপ্ত নম্বর ২০০৮ সালের প্রাপ্ত নম্বরের তুলনায় কমে গেছে।
তবে খুব সামান্য হলেও নম্বর বেড়েছে ৪৮টি দেশের। ২৮ দেশের কোনো পরিবর্তন হয়নি। গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে পূর্ব ইউরোপে। এখানকার ১৯টি দেশে গণতন্ত্রের অবনমন ঘটেছে। এর মধ্যে ১৩টিতে কার্যত শাসনব্যবস্থারই পরিবর্তন ঘটেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় ক্যাটাগরি অর্থাৎ 'সংকর শাসনব্যবস্থা'য়ই রয়েছে। তবে আট ধাপ উন্নতি হয়েছে। এবার গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ ৮৩তম স্থানে উন্নীত হয়েছে। ২০০৮ সালে অবস্থান ছিল ৯১তম। ১০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ৫ দশমিক ৮৭। ২০০৮ সালে নম্বর পেয়েছিল ৫ দশমিক ৫২।
যেসব দেশে অনিয়মিত নির্বাচন হয়, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রায়ই বাধা আসে, বিরোধী দলের ওপর সরকারের চাপ থাকে, নির্বাচনে প্রায় একই প্রার্থী অংশ নেয়; রাজনৈতিক সংস্কৃতি, জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও সরকারের কর্মপদ্ধতিতে ব্যাপক দুর্বলতা রয়েছে, প্রতিবেদনে সেই সব দেশকে সংকর শাসনব্যবস্থার অধীন বলা হয়েছে।
প্রথম ক্যাটাগরির নাম দেওয়া হয়েছে পূর্ণ গণতন্ত্র, দ্বিতীয় খুঁতযুক্ত গণতন্ত্র এবং চতুর্থ ক্যাটাগরি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা।
ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিস ও স্লোভেনিয়ার মতো দেশ পূর্ণ গণতন্ত্রের তালিকা থেকে বাদ পড়ে খুঁতযুক্ত গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় প্রবেশ করেছে। 'খুঁতযুক্ত গণতান্ত্রিক' তালিকার তিনটি দেশের এক ধাপ অবনতি হয়েছে।
এবার গণতন্ত্র সূচকে প্রথম স্থানে রয়েছে নরওয়ে। দেশটি নম্বর পেয়েছে ৯ দশমিক ৮০। দ্বিতীয় আইসল্যান্ড, তৃতীয় ডেনমার্ক। গতবারের (২০০৮) প্রথম সুইডেন এবার চতুর্থ স্থানে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ১৭, আর ব্রিটেনের অবস্থান ১৯ নম্বর স্থানে। ভারত রয়েছে খুঁতযুক্ত গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায়। ক্রম নম্বর ৪০। নম্বর পেয়েছে ৭ দশমিক ২৮।
এবারের সূচকে পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের তালিকার প্রায় তলানিতে স্থান পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। যুক্তরাষ্ট্রে জনগণের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে_বিশেষ করে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী এ দেশটিতে সরকারের কর্মসম্পাদন প্রক্রিয়ায় সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ব্রিটেনেও জনগণের স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খর্ব হয়েছে। তবে দেশটিতে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে। সেটা অনেক দিক দিয়েই_ভোট দেওয়ার হার, রাজনৈতিক দলের সদস্যত্ব এবং রাজনৈতিক কাজে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা_সব ক্ষেত্রেই।
মধ্যপ্রাচ্য ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদী ধারা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা চালু রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায়। সাব-সাহারীয় আফ্রিকায় গণতন্ত্রায়ণ থমকে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে পুরো বিপরীত শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। পূর্ব-মধ্য ইউরোপের রাজনৈতিক অস্থিরতা হতাশা তৈরি করেছে এবং ওই অঞ্চলে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের শক্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ আমেরিকায় সংবাদমাধ্যম গ্রাস করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের সব অঞ্চলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এতে মূলত ইলেকট্রনিক মাধ্যমগুলো আক্রান্ত হয়েছে। তাদের কঠোর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মুখে পড়তে হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে ৩৬টি দেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে। এর মধ্যে ফ্রান্স, ইতালি, তুরস্কের মতো পশ্চিম ইউরোপের দেশ রয়েছে। পূর্ব ইউরোপের আটটি দেশও এ তালিকায় রয়েছে। লাতিন আমেরিকার দেশ রয়েছে ৯টি, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার চারটি এবং এশিয়ার ও অস্ট্রেলিয়ার চারটি।
Click This Link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




