অ্যাঞ্জেল অফ ডেথ – ডঃ জোসেফ রুডলফ মেঙ্গেলে
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
শিক্ষা
১৯৩৫ সালে জোসেফ রুডলফ মেঙ্গেলে ২৪ বছর বয়সে University of Munich থেকে Anthropology'র উপর PhD করেন । সুতরাং এটা থেকে বোঝা যায় তিনি সমাজের এলিট ক্লাসের অংশ ছিলেন । শিক্ষা দীক্ষা ভালই পেয়েছেন ।
১৯৩৭ সালের জানুয়ারিতে, ফ্রাঙ্কফুর্টের Institute for Hereditary Biology and Racial Hygiene-এ তিনি Dr. Otmar Freiherr von Verschuer এর সহকারী হন । Dr. Otmar Freiherr von Verschuer এর বিশেষত্ব হল জেনেটিক্স-এ । এছাড়াও মেঙ্গেলে Theodor Mollison এবং Eugen Fischer এর অধীনে স্টাডি করেন । এই দুজনের বিশেষত্ব হল তারা দক্ষিন-পশ্চিম আফ্রিকার (বর্তমানের নামিবিয়া) হেরেরো উপজাতির উপর মেডিকেল এক্সপেরিমেন্ট চালান ।
কর্মজীবন
১৯৩৭ সালে নাৎসি পার্টিতে যোগদানের এক বছরের মধ্যেই SS বাহিনীতে সদস্যপদ পেয়ে যান । প্রথমে মিলিটারিতে ছিলেন, যুদ্ধ করেছেন, বীরত্বসূচক আয়রন ক্রস মেডেল পেয়েছেন । যুদ্ধে আহত হলে আনফিট ঘোষণা করা হয় তাকে । বার্লিনে Race and Resettlement Office-এ তাকে পোস্টিং দেওয়া হয় ।
১৯৪৩ সালে একজন অসুস্থ ডাক্তারের বদলি হিসেবে Nazi extermination camp, Birkenau তে আসেন । মে মাসের মধ্যে তিনি অউশউইটয-বারকিনাউ (Auschwitz-Birkenau) এর জিপসি ফ্যামিলি ক্যাম্প এর মেডিকেল অফিসার হন । ১৯৪৪ এর আগস্টে ক্যাম্পটি গুটিয়ে ফেলা হয় এবং সব বন্দীকে গ্যাস প্রয়োগ করে মেরে ফেলা হয় । এর পরে মেঙ্গেলে বারকিনাউ এর প্রধান ক্যাম্পে চীফ মেডিকেল অফিসার হন ।
হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট
মেঙ্গেলে অন্যান্য SS ফিজিসিয়ান দের সাথে নতুন বন্দীদের রিসিভ করতেন । কে কাজ করবে, কে গ্যাস চেম্বারে যাবে আর কে পরীক্ষার গিনিপিগ হবে !!! মেঙ্গেলে খুঁজতেন যমজ, পাওয়া গেলেই চিৎকার "Zwillinge heraus!" ("Twins out!") । একবার একটা ব্লকে উকুন বেড়ে গেলে মেঙ্গেলে’র হুকুমে ওই ব্লকের ৭৫০ জন মেয়ের সবাইকে গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হয় ।
মেঙ্গেলে অউশউইটয এর বন্দীদের উপর প্রধাণত বংশগতি বিষয়ক গবেষণা চালিয়েছিলেন । বিশেষভাবে তার আগ্রহ ছিল যমজদের ব্যাপারে । তাদেরকে বিশেষভাবে বাছাই করে স্পেশাল ব্যারাকে রাখা হত ।
মেঙ্গেলের এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে ছিল
- চোখের রং পরিবর্তনের জন্য শিশুদের চোখে বিভিন্ন রাসায়নিক সরাসরি ইনজেক্ট করে দেওয়া,
- বিভিন্ন স্থানের অস্থিসন্ধি অপারেশন করে অপসারন করা,
- অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়া বিভিন্ন রকম সার্জারি, যেমন কিডনি অপসারন,
- মেয়েদের উপর বিভিন্ন উপায়ে স্টেরালাইজেশন এবং শক ট্রিটমেন্ট ।
বেশীরভাগ বন্দী এক্সপেরিমেন্টের সময় অথবা পরে ইনফেকশনে ভুগে মারা যেত । একবার মেঙ্গেলে ১৪ জোড়া যমজদের রাতে ঘুমিয়ে যাবার পরে হৃদপিণ্ডে ক্লোরোফর্ম ইনজেক্ট করে মেরে ফেলেন, তারপর দেহ ব্যাবঃচ্ছেদ করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে নোট লিখে রাখেন ।
মেঙ্গেলে বিশেষভাবে যমজদের প্রতি আগ্রহী ছিলেন । এদের নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছেন । সাধারণত এক্সপেরিমেন্ট হয়ে গেলে তাদেরকে মেরে ফেলা হত এবং দেহ ব্যাবঃচ্ছেদ করা হত । একবার Conjoined Twins বানানোর জন্য একজোড়া যমজকে সার্জারি করে দেহ জোড়া লাগানো হয়েছিল, তাদের হাতের veins এর জায়গাতে ইনফেকশন এবং পরে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায় ।
প্রেগন্যান্ট মহিলাদের উপরও মেঙ্গেলের এক্সপেরিমেন্ট চলত । মেঙ্গেলে যাদের উপর এক্সপেরিমেন্ট করতেন তারা অউশুউইটজ-এর অন্যদের তুলনায় ভাল খাবার এবং থাকার সুবিধা পেত ।
Lucette Matalon Lagnado এবং Sheila Cohn Dekel এর যৌথভাবে লিখিত Children of the Flames বই অনুযায়ী, মেঙ্গেলে সব মিলিয়ে ১৫০০ জোড়া যমজ দের উপর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছিলেন ।
পলাতক জীবন
১৯৪৫ এর জানুয়ারিতে SS অউশউইটজ বন্ধ করে দেয় । মেঙ্গেলে বিভিন্ন ফন্দি-ফিকির করে বিভিন্ন ইউনিটে কাজ নিয়ে মে মাসে Wehrmacht (জার্মান সেনাবাহিনী)-'র একটা মেডিকেল ইউনিটে যোগ দেন । এই ইউনিট পশ্চিমে সরে যায় সোভিয়েত বাহিনীর হাতে ধরা পড়া থেকে বাঁচার জন্য । এবং আমেরিকান বাহিনীর হাতে আটক হয় । তাকে জুন মাসে ছেড়ে দেওয়া হয় কারন তার কাছে পরিচয়পত্র হিসেবে যে কাগজ পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় তার নাম ফ্রিটজ হোলম্যান । এই পরিচয় নিয়ে তিনি ১৯৪৯ পর্যন্ত জার্মানির ব্যাভারিয়াতে, লুকিয়ে নয়, প্রকাশ্যে চাষবাস করে খেতেন !!! এরপরে পুরোন বন্ধু হানস সেডলমেয়ার এর সহায়তায় আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যান । ধারনা করা হয় এই পালানোতে ওডেসা নেটওয়ার্ক এরও হাত ছিল ।
আর্জেন্টিনায় মেঙ্গেল বেশ সুখে শান্তিতে ছিলেন । সেখানেও তিনি প্র্যাকটিস করতেন । তবে জানা যায় মূলত তিনি অ্যাবরশন করাতেন, যা ওই সময় আর্জেন্টিনা সহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই নিষিদ্ধ ছিল । একবার এক পেশেন্টকে অ্যাবরশন করাতে গিয়ে মারা গেলে মেঙ্গেলেকে অল্প দিনের জন্য জেল খাটতে হয়েছিল ।
কিন্তু সব সময়ই তিনি ভয়ে ছিলেন কখন না জানি ধরা পড়েন । বিশেষ করে ১৯৬০ সালে অ্যাডলফ আইখম্যান ধরা পড়ার পর মেঙ্গেলে ১৯৬২ সালে প্যারাগুয়ে পালিয়ে যান ।
আইখম্যানকে ধরেছিল মোসাদ । আইখম্যানকে ধরার সময়ই মেঙ্গেলের অবস্থান তারা জানতে পেরেছিল । কভার্ট অপারেশন হওয়ায় সময় স্বল্পতার জন্য মোসাদ মেঙ্গেলে পর্যন্ত পৌছাতে পারেনি । আইসার হারেল, ইসরায়েল সিক্রেট সার্ভিসের চিফ এক্সিকিউটিভ পরে বলেন, তাদের হাতে সময় থাকলে একই প্লেনে আইখম্যান আর মেঙ্গেলে কে আনতে পারা যেত ।
প্যারাগুয়ে থেকে মেঙ্গেলে ব্রাজিলে পালিয়ে যান সম্ভবত ১৯৬৭ সালের দিকে । ১৯৭৯ সালে সাঁতার কাটার সময় পানিতে ডুবে মারা যান, ধারনা করা হয় সেসময় তার স্ট্রোক হয়েছিল । তবে আমার ধারনা এটা ইসরায়েলের কাজ । সাঁতার কাটতে গিয়ে কেউ পানিতে ডুবে মারা যায় নাকি?
এভাবে ৩৪ বছর বিচারকে ফাকি দিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই তার মৃত্যু হয় ।
শেষ কথা
অ্যালেক্স ডেকেল, অউশউইটজ-এর এক সাবেক বন্দীর ভাষ্যঃ
আমার কখনই মনে হয় নি যে মেঙ্গেলে তার রিসার্চ বা গবেষণার জন্য এগুলো করেছে । সে তার ক্ষমতার চর্চা করেছে । মেঙ্গেলে ছিল কসাই। বড় বড় সার্জারি গুলো করা হত অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়া । একবার আমি একটা পাকস্থলী অপারেশন দেখেছিলাম, কোন অ্যানেস্থেশিয়া ব্যাবহার করা হয়নি । আরেকবার হৃদপিণ্ড অপসারন করা হয়েছিল, ওটাও অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়া । শুধুমাত্র অপরিসীম ক্ষমতার জন্যই মেঙ্গেল ডাক্তার হওয়া সত্বেও উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল । সে বিজ্ঞানের নামে এগুলো করত, কিন্তু তা ছিল অসুস্থতা ।
অউশউইটজ-এর একজন সাবেক বন্দী ডাক্তারের ভাষ্যঃ
মেঙ্গেলে বাচ্চাদের প্রতি কোমল আচরণ করত । তাদেরকে চকলেট দিত, তাদের সাথে ভাব জমাত, তাদের প্রতিদিনের ছোট ছোট ব্যাপার লক্ষ করত । আর পর দিন? তাদেরকেই কাজ শেষ হলে ক্রেম্যাটোরিয়া তে ধোঁয়া বানানোর জন্য পাঠিয়ে দিত।
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
হেঁটে আসে বৈশাখ
বৈশাখ, বৈশাখের ঝড় ধূলিবালি
উঠন জুড়ে ঝলমল করছে;
মৌ মৌ ঘ্রান নাকের চারপাশ
তবু বৈশাখ কেনো জানি অহাহাকার-
কালমেঘ দেখে চমকে উঠি!
আজ বুঝি বৈশাখ আমাকে ছুঁয়ে যাবে-
অথচ বৈশাখের নিলাখেলা বুঝা বড় দায়
আজও বৈশাখ... ...বাকিটুকু পড়ুন
ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি
পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন
বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।
ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন
মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?
কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।
এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন
একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!
ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন