somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চারটি দেশে যাপিত জীবন (গল্পটি করোনাকালের)

০৯ ই মে, ২০২২ রাত ১২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার দুই ছেলে যখন ইংল্যান্ডে আসার ভিসা পেল তখন বড়টার আনন্দ দেখার মত ছিল। কথায় কথায় সে তার মাকে বারবার বলছিল, “উই আর গোয়িং টু পাপা প্লেস।” দিন নাই, রাত নাই, সবসময় একটা কথা “লেটস গো নাউ। হোয়াট উই আর ওয়েটিং ফর? পাপা প্লেস ইজ সো ফার। উই নিড টু গো বাই এরোপ্লেন।”

ছোটজন আলারিক তার বড় ভাই আরকাকে ফুর্তি করতে দেখে ভাবছিল আসলে এটা হয়ত মজার কোন ব্যাপার-স্যাপার হবে। তাই সেও তার ভাইয়ের সাথে লাফালাফি করছিল। দেশ-দূরত্ব এইসব বুঝার মত বয়স আলারিকের হয় নাই।

আরকা এমনিতে একটু দুস্ট কিসিমের, তবে সে ইচ্ছা করে কিছু না বুঝার ভান ধরে থাকে। যেমন এই করোনাকালে এমনিতেই ভিসা পাওয়া, প্লেনের টিকেট কাটা এবং ফ্লাই করা অনেক ঝামেলার। এর মাঝে যখন মালয়শিয়াতে তারা ভিসা আবেদন করতে গেল তখন আরকা ইচ্ছা করেই ভিসা অফিসারের সাথে দুষ্টামি করছিল। ভিসা অফিসার ওর ভিসার ছবি তোলার জন্য ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে বলছিল, “নাউ লুক এট দ্যা ক্যামেরা।” এটা শুনে সে চেয়ার থেকে নেমে ক্যামেরার কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিল। ভিসা অফিসার ওকে যতই বারবার বলছিল, “প্লিজ গো টু ইউর সিট”, সে নাকি ততই বলছিল, “আই এম লুকিং এট দ্যা ক্যামেরা। ইউ আক্সড মি টু লুক এট দ্যা ক্যামেরা”। ভিসা অফিসারের ক্যামেরার দিকে তাকানোর কথাটা সে ইচ্ছা করেই লিটারিলি নিয়ে দুস্টামি করছিল। পরে ওর মায়ের ধমক খেয়ে সে সিধা হইছিল।

অনেক ঝক্কি-ঝামেলার পর ভিসা পাওয়ার পরেও কয়েকবার প্লেনের টিকেট চেঞ্জ করতে হয়েছিল। কারণ, প্রথমবার টিকেটের ট্রানজিট ছিল কাতারের দোহাতে। এই দিকে কাতার আবার করোনার কারণে ইংল্যান্ডে রেড লিস্টেড দেশ হিসাবে নথিভুক্ত হয়েছে। মানে কাতারে এক সেকেন্ডের জন্য নামলেও ইংল্যান্ডে এসে সরকারী ব্যবস্থাপনায় হোটেলে কোয়ারেন্টাইন করা লাগবে যার পুরো খরচ আমাকে বহন করতে হবে। তারচেয়েও বড় কথা, ওরা লন্ডনে আসলেও এগারো দিনের আগে ওদের সাথে আমার কোন সাক্ষাৎ হবে না। পরে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা করে একটা ডাইরেক্ট ফ্লাইট ম্যানেজ করি। মালয়শিয়া থেকে সরাসরি আসলে বাসাতেই কোয়ারেন্টাইন করা যাবে।

ওদের মা যখন লন্ডনে আসার জন্য ব্যাগ গুছাচ্ছিল তখন আমি সিসি টিভি দিয়ে ওদের মালয়শিয়ার বাসাতে কি করছিল দেখছিলাম। আরকা ওর সাইকেল, খেলনা, লেগো সেট নিয়ে সুটকেসগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর ধারণা ছিল ওর সাথে ওর সবকিছুই লন্ডনে আসবে। ও ভেবেছিল ওর সাইকেলটা হয়ত একটা পর্যায়ে গিয়ে ব্যাগে জায়গা করে নিবে, খেলনাগুলো ব্যাগের কোথাও ঢুকে যাবে, লেগো সেটগুলো সে হাতে ক্যারি করবে। ওর মা কষ্টটা বুঝতে পেরে ওকে বারবার সান্তনা দিচ্ছিল যে এভাবে একটা সাইকেল ব্যাগে করে বিদেশে নিয়ে যাওয়া যায় না। আর ব্যাগেও অতটা জায়গা নেই যে ওর খেলনা বা লেগো সেট সবকিছুই সেখানে ঢুকে যাবে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যই সে বুঝে গেল যে তার সাইকেল, খেলনা অথবা লেগো সেট কোনটাই তার সাথে লন্ডনে আসছে না। সব কিছুই তাকে মালয়শিয়াতে রেখে আসতে হবে। সেই বাসা, সেই পরিচিত ঘোর-দোর সবকিছু ছেড়েই ওকে লন্ডনে আসতে হবে। ওর থমথমে মুখটা ছিল দেখার মত। মায়া বড়ই অদ্ভুত জিনিস। একদিকে পাপার কাছে আসার আকুলতা আরেকদিকে নিজের সবকিছু ফেলে আসার মত যন্ত্রণা ওকে অনেক আহত করছিল।

ধীরে ধীরে সে আরো বুঝে গেল আসলে তার বাসা, বাসার সামনের মাঠ বা নদী, রাস্তা-ঘাট কোন কিছুই তার সাথে লন্ডনে আসছে না। সে তার সরলতা দিয়ে বুঝতে পারেনি আসলে ফেলতে ফেলতেই জীবন বয়ে চলে। যেটা ফেলে আসা হয়, সেটা স্মৃতি হয়ে থাকে। সেটা আর কখনো ফিরে আসে না।

একদিনের ভিতর আরকা বুঝে গেল তার অতি প্রিয় আন্টি “মামা-সারি” অথবা পাতানো বোন “কাকা-ডিলা”-ও লন্ডনে আসছে না। সে বারবার ফোনে আমাকে ওদেরকে লন্ডনে আনার কথা বলছিল। ওর পাশের বাসার খেলার সাথী, বাসার নীচের আইসক্রিম বিক্রেতা, ডোনাট খাবার দোকানি কেউ তার সাথে লন্ডনে আসছে না।

আমি নিজেও জীবনে অনেক কিছু ফেলে চলে এসেছি। তাই আমি আরকার আবেগটা বুঝি। কোন কিছু ফেলে আসলে দাবী ছেড়ে দিয়ে আসতে হয় সেটা আমি শিখলেও আরকা এখনো শিখেনি। এভাবে পাওয়া আর না পাওয়ার হিসাবে, ছেড়ে আসা আর ফিরে পাওয়ার হিসাবেই আমরা এক একজন স্বতন্ত্র মানুষে পরিণত হই। আমরা সবাই এক জায়গা থেকে আসলেও আমাদের ফেলে আসাটা একেকজনের জন্য একেক রকম। আবার আমাদের প্রাপ্তির খাতাটাও ভিন্ন। জীবন আসলে চাওয়া-পাওয়া আর না পাওয়ার এক অদ্ভুত অসম সমীকরণ। আমাদের সবার সমীকরণ আলাদা, তাই আমরা এক একজন আসলে খুব আলাদা মানুষ।

জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমি বুঝি দেশ-কাল-চেতনা আসলে খুব আপেক্ষিক। যেখানে যার আপনজন থাকে সেটাই তার দেশ। যেমন আমার স্ত্রী আর আমি দুই দেশের নাগরিক হলেও আমাদের বাচ্চা জন্ম নিয়েছে আরেক দেশে। এখন হয়ত তাদের বেড়ে উঠা হবে আরেক দেশে। তাই তাদের মাতৃভূমি ইন্দোনেশিয়া হলেও, জন্মভূমি হবে মালয়শিয়া। যেই মাতৃভূমিতে তারা কখনো দীর্ঘদিন সেভাবে থাকেনি আর যে জন্মভূমির নাগরিক তারা না, সেইসব নিয়ে অনেক আবেগ হয়ত তাদের ভিতর সেভাবে থাকবে না। কিন্তু কিছুটা পিছুটান তো থাকবেই। তাদের নিজের দেশ হবে সেটাই যেটাতে ওদের আপনজনেরা থাকবে। ঠিক এই রকম কোন কারণেই হয়ত গত ছয়মাসে আমি বাংলাদেশ নিয়ে যতটা না ভাবতাম তার চেয়ে বেশি ভাবতাম মালয়শিয়া নিয়ে, কারণ সেখানে আমার ছেলেরা থাকে। আমি বাংলাদেশে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে মালয়শিয়াতে পাঠাতাম, কারণ সেখানেই ছিল আমার পরিবার।

তাও আমিও যেহেতু স্বতন্ত্র একজন মানুষ, আমারো কিছু আবেগ আছে, কিছু স্মৃতি আছে। লন্ডনের ব্যাস্ত পথে হাঁটার সময় আমারো মাঝে মাঝে মনে পড়ে প্রায় তিন দশকের বেশি সময়ের আগের ঢাকার সি-এন-বি কোয়ার্টারের গোরস্তানের পাশের ছোট্ট এক বাসার কথা, ঢাকা শহরে ঘটঘট করে চলা সেই সময়ের পুরাতন ভক্স ওয়াগন গাড়িগুলো অথবা মুড়ির টিনের মত ছয় নাম্বার বাসের কথা, সেই শহরের রিকশার টুংটাং আর হকারের আওয়াজ, মাঠ পেরানো এক চিলতে শৈশব আর বৃষ্টিভেজা কিশোরবেলা, আমার অলস দুপুরের নিঃসঙ্গতা, তারাভরা আকাশের নীচে জোসনার তান্ডব অথবা নিজের কিছু একান্ত গোপন কথা।

সময়ের সাথে জীবনের অনেক কিছুই ঝাপসা হয়ে আসে, চলে যায় অনেক দূরে। জীবনের অন্য পথে অন্য কোনদিন হাঁটতে গিয়ে হয়ত একদিন আজকের কথাগুলোও এভাবেই মনে পড়বে।
---------------------------------------------------------------------------------
সমাপ্ত, তবে চাইলে হয়ত চলবে। যাপিত জীবনের কাহিনী পড়তে চাইলে নিচের লিংকগুলোতে ঢু মারতে পারেন।

এক ইন্দোনেশিয়ান মেয়ের সাথে পরিচয়ের কাহিনী

ইন্দোনেশিয়া সিরিজ - ১ঃ মেদানের পথে পথে

সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০২২ রাত ১২:২১
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×