somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক ইন্দোনেশিয়ান মেয়ের সাথে পরিচয়ের কাহিনী

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ রাত ২:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১/
প্রায় এক যুগ আগের কথা। সেই সময় মালয়শিয়াতে মাস্টার্স করতাম।

একবার এয়ার-এশিয়া এয়ারলাইন্স টিকেটের উপর বিশাল ছাড় দিল। মালয়শিয়া-টু-ভিয়েতনাম রিটার্ন টিকেটের দাম মাত্র এক রিঙ্গিট। সেই সময়ের হিসাবে বাংলাদেশি পঁচিশ টাকায় মালয়শিয়া থেকে ভিয়েতনাম প্লেনে করে ঘুরে আসা যাবে। এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চাইবে না।

উল্লাস ভাই আমাকে না বলে টিকেট কেটে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “চ, এইবার ভিয়েতনাম থেইকা ঘুইরা আসি।”

আমি টিকেটের দাম দিতে চাইলাম, কিন্তু উনি টাকা নিতে চাইলেন না। বললেন, “টাকা লাগবে না, পরে চা খাওয়াইয়া দিস।”

চা মানে তেতারে। সেই সময় এক গ্লাস তেতারের দাম এক রিঙ্গিট বিশ সেন। “সেন” মানে মালয়শিয়ান পয়সা আরকি! এদিকে টিকেটের দাম এক রিঙ্গিট। উল্লাস ভাইকে তেতারে খাওয়ালে পাক্কা বিশ সেন লস। আমি মনে মনে বললাল, “ধুশ শালা, বিশাল লস হয়ে গেল।”

এদিকে বাংগালিদের অবশ্য খালি প্লেনের টিকেট কাটলেই হয় না। ভিসা বলে একটা জিনিস আছে, সেটাও ম্যানেজ করতে হয়।

তাই একদিন সকালে উল্লাস ভাই আর আমি কুয়ালালামপুরের ভিয়েতনাম এম্বাসির উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম। কিন্তু এম্বাসির সামনে গিয়ে আর ভিতরে ঢুকার ইচ্ছা হল না। কারণ, এম্বাসির সামনের নোটিশবোর্ডে বিশাল হরফে লেখা ছিল, “বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নাইজেরিয়ার নাগরিকেরা দয়া করে নিজ নিজ দেশের এম্বাসি থেকে ভিসা এপ্লিকেশন জমা দিন।”

এর মানে ভিয়েতনামের ভিসা পেতে হলে আমাকে বাংলাদেশে এসে এপ্লাই করা লাগবে। উল্লাস ভাই আর আমি বললাম, “খাইয়া দাইয়া আমাদের আর কাম নাই! গেলাম না তোর ভিয়েতনামে।”

প্লেনের টিকেট ছিড়ে ফেলে দিলাম। সত্যি কথা কি, পাকিস্তান আর নাইজেরিয়ার পাশে বাংলাদেশের নাম দেখে সেদিন মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

২/
ইউনিভার্সিটিতে ফিরে এসে সোজা ভিসা সেকশনে গেলাম। আমার পাসপোর্টে মালয়শিয়ান ভিসা রিনিউ করতে ইউনিভার্সিটির ভিসা সেকশনে জমা দিয়েছি। সেটাও বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। এখনো সেটার কোন খবর নেই।

ভিসা সেকশনের ফ্রন্ট ডেস্কে একটা মেয়ে বসে ছিল। ওকে গিয়ে বললাম, “কি ব্যাপার, আমার ভিসা তোমরা কেন আটকিয়ে রাখছ? তোমাদের কি ধারণা আমাদের ভিসা নেওয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই?”

মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, “আমরা তো তোমাকে আলাদা ডকুমেন্ট দিয়েছি। ভিসা পেতে দেরী হলেও তো তোমার মালয়শিয়ায় থাকতে বা কাজ করতে কোন সমস্যা হবার কথা না?”

আমি মেজাজ দেখিয়ে বললাম, “মালয়শিয়া ছাড়া কি আমাদের দুনিয়াতে আর কোন কাজ থাকতে পারে না? আমি ভিয়েতনাম যাবো। আমার পাসপোর্ট লাগবে। খুব আর্জেন্ট।” মেয়েটাকে ফাঁপড় মারার জন্য ইচ্ছা করে ভিয়েতনামের কথা বললাম।

মেয়েটা থতমত খেয়ে বলল, “তাহলে ভিয়েতনামের টিকেট সহ এপ্লিকেশন জমা দাও। ইমিগ্রেশন অফিসার তাড়াতাড়ি ভিসা প্রসেস করে দিবে।”

এদিকে আমার কাছে তো টিকেটই নেই, আমি টিকেট ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। তাই উল্টা ফাঁপড় মেরে বললাম, “তুমি যে আমার পাসপোর্ট প্রসেস করছ সেটার প্রমাণ কি আমি দেখতে চেয়েছি? তাহলে তুমি কোন হিসাবে আমার কাছে টিকেটের প্রমাণ চাও।”

ঝাড়ি খেয়ে মেয়েটা থতমত খেয়ে ভিতরে চলে গিয়ে আরেকটা মেয়েকে নিয়ে আসল। এই মেয়েটাকে আগের মেয়ের চেয়ে একটু বেশি ঝাঁড়ি মেরে বললাম, “পাসপোর্টের উপর বসে ডিম পাড়লে তো হবে না। আমার পাসপোর্ট আজকেই লাগবে।”

ভিতর থেকে আসা মেয়েটা অনেক ধৈর্য নিয়ে আমার সব কথা শুনে আমাকে বুঝাল যে বিভিন্ন কারণেই ভিসা পেতে দেরি হতে পারে। এতে চিন্তার কিছু নেই। সে আমার ভিসার আপডেট জেনে অতিশীঘ্রই পাসপোর্ট ফেরত দিবে।

ভিতর থেকে আসা সেই মেয়েটাকে ইমেইল এড্রেস আর আমার অফিসের ফোন নাম্বার দিয়ে চলে আসলাম (ছাত্র হলেও আমাদের আলাদা অফিস রুম ও ফোন নাম্বার ছিল। কারণ, মালয়শিয়ায় আমাদের পড়াশোনাটাই একটা রিসার্স জব হিসাবে করতাম। ফলে আমাদের পড়াশোনার কোন টাকা-পয়সাও লাগত না, আবার মাস শেষে বেতনও পেতাম। এছাড়াও নিজের বই, খাতা, ল্যাপটপ সহ প্রয়োজনীয় যেকোন রিসার্স রিলেটেড জিনিস অফিসের টাকায় কিনতে পারতাম।)।

যাইহোক, পরেরদিন ভিসা সেকশন থেকে ফোন পেলাম যে আমার পাসপোর্ট রেডি। আমি যেকোন সময়ে পাসপোর্ট নিয়ে আসতে পারব।

ভিসা সেকশনে গিয়ে দেখি আগের সেই ফ্রন্ট ডেস্কের মেয়েটা বসে আছে। আমাকে দেখে কোন কথা না বাড়িয়ে পাসপোর্ট হাতে ধরিয়ে দিল। আমি পাসপোর্ট নিয়ে খুশিমনে অফিসে চলে আসলাম। ভিসা সেকশনের ভিতর থেকে যে মেয়েটা আগের দিন বের হয়ে কথা বলেছিল, সেই মেয়েটাকে সেদিন কোথাও দেখলাম না।

৩/
এই ঘটনার পর বেশ কয়েক সপ্তাহ চলে গেছে।

একদিন দুপুরবেলা আমি আর উল্লাস ভাই ফ্যাকাল্টির ক্যাফেতে লাঞ্চ করতে গিয়েছি।

আমাদের ইউনিভার্সিটিটা বিশাল এবং পুরো ইউনিভার্সিটিতে অন্তত পঞ্চাশটা ক্যাফে আছে। একেক ক্যাফের একেক থিম। কোনটাতে মালয়শিয়ান খাবার, আবার কোনটাতে ভারতীয়, কোনটাতে তামিল, কোনটাতে চাইনিজ, কোনটাতে ইন্দোনেশিয়ান, কোনটাতে ইরানি খাবার। বাংলাদেশেরও বেশ কয়েকটা দোকান ছিল। অনেকেই একেকদিন একেক ক্যাফেতে লাঞ্চ করে বেড়াত। আমি খাবারের ব্যাপারে সবসময় অলস হবার কারণে সবচেয়ে কাছের ক্যাফেতেই নিয়মিত যেতাম। সেটা ছিল এক মালয়শিয়ান ক্যাফে।

আমরা ক্যাফেতে লাঞ্চ টাইমের অনেক আগে আসতাম, যখন ক্যাফেটা বলতে গেলে ফাঁকা থাকত। উল্লাস ভাই আর আমি সেখানে আড্ডা দিতাম, তারপরে লাঞ্চ করতাম। লাঞ্চের পরে হয় জুস না হয় চা খেতাম। মালয়শিয়ান চা-কে বলে “তেরারে”। অতীব মিস্টি সেই পানীয়ের সাথে বাংলাদেশি চায়ের রঙ ছাড়া তেমন মিল নাই। আমাদের আড্ডাবাজী মাঝে মাঝে এত বেশি সময় চলত যে আমরা দেখতাম, খালি ক্যাফে লাঞ্চের কারণে ভরাট হয়ে আবার খালি হয়ে গেছে।

যাইহোক, সেইদিন যথারীতি উল্লাস ভাই আর আমি আগে আগে ক্যাফেতে চলে এসেছিলাম। লাঞ্চের সময় ধীরে ধীরে পুরো ক্যাফেটা ভরে গেল। উল্লাস ভাই আর আমি মুখোমুখি বসে খেতে খেতে গল্প করছিলাম।

এমন সময় ক্যাফের ম্যানেজার আমাদের টেবিলে এসে বলল দুটো মেয়ে নাকি বসার জন্য চেয়ার-টেবিল পাচ্ছে না। আমাদের দুইজনের দুই পাশের দুই চেয়ারে মেয়ে দুটো বসলে আমরা মাইন্ড করব না কি?

আমরা অবাক হয়ে বললাম, “মাইন্ড করব কেন?”

সেই দুটো মেয়ে আমাদের পাশে খাবার নিয়ে এসে বসল (ইউনিভার্সিটির ক্যাফেগুলো বেশিরভাগই ছিল সেলফ-সার্ভিস)। আমি খেয়াল করলাম, আমার পাশে বসা মেয়েটি হল সেই মেয়ে যে কি না ভিসা সেকশনে ভিতর থেকে বের হয়ে আমার ইমেইল এড্রেস আর অফিসের ফোন নাম্বার নিয়েছিল।

আমাকে দেখে মেয়েটা বলল, “তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।”

যারা মালয়শিয়ার কালচার জানেন না তাদের জন্য বলছি, মালয়শিয়ান ছেলে এবং মেয়েরা খুব সহজেই অপরিচিত মানুষের সাথে অনেক কথা বলে ফেলে। ওরা অনেকই অনেক বন্ধুভাবাপন্ন।

যাইহোক, আমি মেয়েটাকে মনে করিয়ে দিলাম যে আমি হলাম সেই বান্দা যে ভিসা সেকশনে গিয়ে ওকে ঝাড়ি মেরেছিলাম। মেয়েটা তখন হাসতে হাসতে বলল, আমি ফিরে আসার পরেই নাকি সে ইমিগ্রেশনের সাথে যোগাযোগ করে আমার ভিসার ব্যাপারটা সুরাহা করছিল।

আমিও পাসপোর্ট পেয়ে যে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ সেটা জানালাম। মেয়েটা খেতে খেতেই আমাকে বুঝালো কি কি কারণে পাসপোর্টে ভিসা পেতে দেরী হয় আর ইউনিভার্সিটির ভিসা সেকশন আসলে ইমিগ্রেশনের কোন ব্যাপারে নাক গলাতে পারে না। আমি “ব্যাপার না” টাইপ কিছু বলে পাশ কাটিয়ে গেলাম।

ইতিমধ্য, তার নাম জানা হয়েছে। তার নাম ভেনী অগাস্ট্রিন। সে ইন্দোনেশিয়ান। মালয়শিয়ায় আমাদের ইউনিভার্সিটিতে সে ইন্টার্নী করতে এসেছে।

আমিও জানালাম যে আমি বাঙ্গাল। আমার নাম আরাফাত।

কথায় কথায় মেয়েটার কাছে আরো জানলাম যে সে হিন্দী ছবির খুব ভক্ত। সে ইন্দোনেশিয়ার যে শহরে থাকে তার নাম “মেদান”। সেই মেদান শহরে “কামপুং মাদ্রাজ” বলে একটা এলাকা আছে যেখানে ইন্ডিয়ান কমিউনিটির বসবাস। সে যখন হাইস্কুলে পড়ত তখনো নাকি সে মোটর সাইকেল চালিয়ে কামপুং মাদ্রাজে আসত হিন্দি ছবির ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া করার জন্য। মালয়শিয়ার মত ইন্দোনেশিয়াতেও নাকি হিন্দি ছবির বিশাল ফ্যান বেজ আছে।

লাঞ্চ থেকে ফিরে যাওয়ার আগে মেয়েটার কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিলাম এই বলে যে এর পরে ভিসা সংক্রান্ত কোন সমস্যা হলে ওকে সরাসরি ফোন দিব। সাথে এটাও জানালাম, আমার খারাপ ব্যাবহারে সে যেন কিছু মনে না করে। উপমার জন্য তাকে বললাম, আমি আসলে নারিকেলের মত। উপরের আবরণটা খুব শক্ত হলেও ভিতরটা টলটলে সুমিষ্ট পানীয়তে ভরা। মেয়েটা হাসতে হাসতে বলল, আমাকে দেখেই নাকি সেটা বুঝা যায়।

আমি ব্যাপারটা আরো নিশ্চিত করার জন্য বললাম, “আগে যেহেতু খারাপ ব্যাবহার করছি, এর পরেরবার ভালো ব্যাবহার দিয়ে তার মনে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করে দিব।”

মেয়েটা হাসতে হাসতে “দেখা যাবে” বলে চলে গেল।

৪/
এখন কিছু কথা বলা দরকার তাদের জন্য যাদের বাংলাদেশি কালচারের বাহিরে তেমন জানাশোনা নেই।

মালয়শিয়াতে বা ইন্দোনেশিয়াতে ছেলে-মেয়েরা নিজেরা নিজেদের বিয়ে করার মানুষকে খুঁজে নেয়। বস্ততঃ “এরেঞ্জড ম্যারেজ” বলে যে একটা জিনিস আছে সেটা আমাদের উপমহাদেশ ব্যাতীত দুনিয়ার অন্য কোথাও নেই। বিদেশে অনেকেই “এরেঞ্জড ম্যারেজ”-এর কথা শুনে এত অবাক হয় যে সেটা বলার মত না। অনেকে হাসা-হাসিও করে যে ছেলের জন্য বউ ছেলের বাপ-মা খুঁজে এনেছে বলে। তাছাড়া মালয়শিয়ার ছেলে-মেয়েরা একে অপরকে অনেক বিশ্বাস করে। কাউকে ভালো লাগলে তার সম্পর্কে নিজে থেকে জানার চেষ্টা করে। নিজেরা নিজেদের চাওয়া-পাওয়া ঠিকঠাক করে বাবা-মাকে জানায়।

আরো একটা উপমহাদেশিয় জিনিস শুনে বিদেশীরা খুব হাসা-হাসি করে। সেটা হল বিয়ের সময় পাত্র-পাত্রী পক্ষ “বিয়ের সিভি” নামক এক উদ্ভট জিনিস আদান-প্রদাণ করে যেটাতে বাপ-চাচা ছাড়াও চৌদ্দ গুস্টির কে কোন পজিশনে আছে সেটা লেখা থাকে। অনেক বিদেশীর চোখে এটা “নিজেদের প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাস আর অনাস্থা”, আবার কারো মতে “হাস্যকর”। আমার মতে এটা এক ধরণের বড়াই বা লোক দেখানো। কারণ সেই সিভিতে বেকার কারো নাম না থাকলেও “ক্ষমতাবান” পজিশনে যারা থাকে তাদের নাম ঠিকই থাকে আর লতায়-পাতায় তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক দেখানো হয়।

আমাদের দেশে একসাথে ছেলে-মেয়ে আড্ডা দিলে যেমন খারাপ চোখে দেখা হয়, মালয়শিয়াতে ব্যাপারটা তেমন না। এমনকি, ইউনিভার্সিটির একই ডর্মিটরিতে পাশাপাশি ব্লকে ছেলে-মেয়েরা একসাথে থাকলেও সেখানে এসবের কারণে কখনো খারাপ কিছু হয়েছে বলে শুনিনি। বরং, ডর্মিটরির ছেলেদের এরকম বলতে শুনছি যে, “আমাদের ডর্মিটরিতে যদি আমার সহপাঠিনি যদি নিরাপদ না থাকে, তাহলে আমার দেশে ওরা কিভাবে নিরাপদে থাকবে?”

৫/
যাইহোক, দুইদিন পরে ভেনীকে ফোন দিয়ে বললাম, “আগের খারাপ ব্যবহারের প্রতিদান স্বরুপ আমি তাকে সিনেমাতে নিয়ে একটা হিন্দী ছবি দেখাতে চাই।”

সে আমাকে পরে তার মতামত জানাবে বলে ফোন রেখে দিল।

যাইহোক, ইতিমধ্য আরো বেশ কয়েকদিন চলে গেছে। এর মাঝে আমরা কেউ কাউকে আর ফোন দেইনি। তারপরে একদিন আমি বা ভেনী (ইচ্ছা করেই ব্যাপারটা ধোঁয়াশা রাখলাম) অন্যজনকে ফোন দিয়ে ছবি দেখার দিন-ক্ষণ ঠিক করলাম।

নির্দিষ্ট দিনে অফিস শেষে সিনেমাতে গিয়ে হিন্দী ছবির যেই পোস্টার দেখি সেটাই আমার পছন্দ হয় না। আমি আবার হিন্দী ছবি একেবারেই পছন্দ করতাম না। অবশেষে, আমার পছন্দ হল ইংরেজি সাইন্স ফিকশন “এভাটার” এবং ভেনীকে বললাম, “আমি এই মুভিটাই দেখব। তুমি চাইলে অন্য মুভি দেখতে পারো।”

ভেনী বলল, তাহলে সে টিকেটের টাকা দিবে।

আমি বললাম, “তাহাই সই।“

৬/
এরপরে আমাদের জীবনে আরো অনেক ঘটনাই ঘটেছে। অনেক চড়াই-উৎরাই আমাদের একসাথে পার হতে হয়েছে। সময় এসেছে-দুঃসময় এসেছে। সে ইন্টার্নী শেষে আবার ইন্দোনেশিয়া ফিরে গেছে। আমরা ফোনে যোগাযগ রেখেছি। আর সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের বিয়েটাও হয়ে গেছে ২০১২ সালে মালয়শিয়াতে।

সে আরেক বিশাল কাহিনী। দুই জন দুই দেশের নাগরিক তৃতীয় একটা দেশে লিগ্যালভাবে বিয়ে করা সহজ কথা না! ডকুমেন্টেশনের শেষ নেই। বাংলাদেশের আইন মন্ত্রণালয়, পররাস্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সার্টিফিকেট, মেজিস্ট্রেটের জবানবন্দী, চেয়ারম্যানের জবানবন্দী, বাবা-মায়ের স্ট্যাম্পে সাক্ষর, কি নেই সেখানে! আমার এহেন বীরোচিত কাজ দেখে আমার ছোট বোন খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিল। সেটা হল, “অকর্মরা একটা কর্মই ভালোভাবে করতে পারে। সেটা হল বিয়ে।”

আমি নিজেই আমার পিছনের দিকে তাকালে নিজের সাহসের তারিফ না করে পারি না। এখন চাইলেও এত সাহসের কাজ আমি করতে পারব না।

৭/
তবে এত কিছুর বাহিরেও যে জিনিসটা আমাকে ভাবায় সেটা হল সেই ক্যাফের ঘটনাটা।

আসলে সেই দিনটাই ছিল আমাদের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। সেই দিন অন্য কিছু হবার সম্ভাবনা এত বেশি ছিল যে সেগুলোর একটা কিছু হলেও আমাদের জীবন আজকের মত হত না। যেমন, সেদিন ভেনী অন্য কোন ক্যাফেতে খেতে যেতে পারত, আমি অন্য কোন টেবিলে বসতে পারতাম, অথবা সেইদিন ক্যাফেতে যারা এসেছিল তারা এমন পার্মুটেশন-কম্বিনেশন করে বসত যে অন্য কোথাও দুটো চেয়ার খালি থাকত, অথবা সেই দিন সেই সময়ে ক্যাফেতে পুরো একটি টেবিল খালি থাকত।

কিন্তু, সেদিন এসবের কোনটিই হয়নি। হয়নি বলেই, ভেনী হয়ত আজ ইন্দোনেশিয়াতে না থেকে শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আমার সাথে লন্ডনে আছে। সেই দিন অন্য কিছু হয়নি বলেই আমিও আজ অন্য কোথাও না থেকে ভেনীর সাথে একসাথে আছি।

সেই দিন অন্য কিছু হলে আমরা হয়ত কোনদিও জানতাম না, ভেনী বলে একটা মেয়ে ইন্দোনেশিয়াতে জন্ম নিয়েছিল, আরাফাত বলে একটা ছেলে বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছিল। আমাদের দুইজনের জীবন হয়ত হত ভীষণভাবে আলাদা। আমরা কেউ কাউকে কোনদিন চিনতাম না, জানতাম না। হয়ত জানতাম না আমাদের কখনো দেখা হবার কথা ছিল, কথা হবার কথা ছিল। জীবনে চলার পথে হয়ত মাঝেমধ্যে আমাদের মনে পড়তঃ ভিসা সেকশনে একদা একটা ছেলে একটা মেয়েকে ঝাড়ি দিয়েছিল। জীবনের আরো হাজারো স্মৃতির ভিতরে এই স্মৃতিটাও একটা মামুলি স্মৃতি হিসেবে থেকে যেত। আমরা হতাম খুব আলাদা দুইজন মানুষ।

কিন্তু এসব কিছু হয়নি বলেই আজকে আমরা এক দশক ধরে সংসার করছি।
______________________________________________________________________________
সমাপ্ত। ইন্দোনেশিয়া নিয়ে আরো লেখা পড়তে চাইলে নিচের সিরিজটা পড়তে পারেন।

ইন্দোনেশিয়ায় প্রথম শ্বশুড়বাড়ি ভ্রমণ (ইন্দোনেশিয়া সিরিজ - ১ঃ মেদানের পথে পথে)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ রাত ২:৫৫
১৭টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×