somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চায়না সিরিজ ৭ - ফিরে আসার গল্প (সমাপ্ত)

২২ শে জুন, ২০২২ বিকাল ৪:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


- হাই-স্পিড ট্রেনে জিবু শহর থেকে ফেরার পথে।

আগের পর্বের লিংকঃ চায়না সিরিজ ৬ - চায়নার উন্নতির রহস্য

২০/
দেখতে দেখতে চীন ছাড়ার সময় ঘনিয়ে আসল।

আমার দলের অনেকের ভিতর এইবেলা কর্ম-চাঞ্চল্য দেখা গেল চীনের মার্কেট থেকে বিভিন্ন জিনিস কেনার জন্য। কাউকে মোবাইল কিনতে হবে, কাউকে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক গেজেড কিনতে হবে। জিবু শহর সিরামিক শিল্পের জন্য বিখ্যাত। দলের একজন দুনিয়ার ডিনার সেট কিনে চলেছেন। সন্দেহ নাই যে ডিনার সেটগুলো অসম্ভব সুন্দর আর কারুকার্য-খচিত। কিন্তু এই জিনিস দেশে বয়ে নিয়ে যেতে যেতে প্লেনেই ভেঙ্গে যাবে কি না তা নিয়ে আমি সন্দিহান। কিন্তু যিনি কিনছেন তিনি নিশ্চিত জানেন কিভাবে প্যাক করলে জিনিসগুলো ভাঙ্গবে না। আর সিরামিকের ডিনার সেটের ওজনও কিন্তু কম না। উনার আগ্রহ দেখে অবাক হলাম বৈকি!

দলের আরো দুইজন শেষের দিকে ফলমূল কেনার ব্যাপারে বিশাল আগ্রহী হয়ে গেলেন। দেশের সব ফলেই নাকি ফরমালিন। চায়নার মত বড়, রসালো আর তরতাজা ফলমূল নাকি দেশে পাওয়া না। ওই দুইজন সত্যি সত্যি তাদের সুটকেস বিভিন্ন ফলমূল দিয়ে ভরে ফেললেন। এদিকে আমার ব্যাগ প্রায় খালি বলে আমাকেও কিছু ফলমূল উনাদের জন্য বহন করতে বললেন। আমি সবিনয়ে এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করলাম। উনারা আমাকে ফলমূলের অর্ধেক ভাগ দিতে চাইলেন। আমি তাও রাজী হলাম না।

আমি আমার ছেলের জন্য কিনলাম একটা সুন্দর কুকুরের পুতুল। ওটার নাম দিলাম টিটু। টিটু পরে আমার সাথে চায়না আর থাইল্যান্ডের ট্রানজিট ছাড়াও বাংলাদেশ, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া ঘুরে এখন ইংল্যান্ডে আছে। সেই হিসাবে টিটু তার পুতুল জীবনে প্রায় ছয়টা দেশ দেখে ফেলেছে।

চায়নাতে বেশ কিছুদিন থেকে আমি নিজেও চপস্টিক দিয়ে খাওয়া রপ্ত করে ফেলেছি। তাই বেশ কিছু সুন্দর কারুকার্য-খচিত দামী চপস্টিক সেট কিনলাম। সেটের ভিতরে আছে বারো জোড়া চপস্টিক। এটা দিয়ে দেশে গিয়ে ভাব মেরে কাউকে খাওয়া দেখানো যেতে পারে। আবার চাইলে কাউকে কাউকে এক জোড়া করে গিফট দেয়া যেতে পারে। কিন্তু উনারা চপস্টিক দিয়ে খেতে পারবে কি না জানি না। এই কারণে এই গিফট ফেলে দেবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। তবে নিঃসন্দেহে সাজিয়ে রাখার জন্য হলেও জিনিসগুলো সুন্দর।

চায়নাতে মানুষেরা চায়ের সাথে বিভিন্ন ফুলের শুকনো কলি মিশিয়ে পান করে। একেক ফুলের একেক ফ্লেভার। পান করতে খারাপ লাগে না। তাই চায়ের সাথে পান করার জন্য গোলাপ, ডেইজি সহ হরেক নাম না জানা ফুলের শুকনো কলি কিনলাম। আর কিনলাম বেশ দামী কারুকার্য-খচিত বক্সে রাখা চা-পাতার একটা সেট। দিনের বিভিন্ন ক্ষণ আর মুডের উপর ভিত্তি করে চা-পাতা সাজানো রয়েছে ওতে। ভাবলাম, গানের যেমন রাগ আছে, একের রাগ দিনের এক-এক সময়ের জন্য, তেমনি হয়ত চায়েরও রাগ আছে। এইসব, হাই-লেভেলের ব্যাপার-স্যাপার আমি কম বুঝি। কিন্তু কনসেপ্টটা ভালো লাগল।

এর বাহিরে পরিবারের জন্য সামান্য কেনাকাটা করলাম যার কোনটাই তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু না। এই ছিল আমার চায়নাতে কেনাকাটার ফর্দ।

২১/
এদিকে বাংলাদেশে ফেরার কথা ভাবলেই আমার রক্ত হিম হয়ে আসছে। কারণ, এই জার্নিটা বিশাল বড় ও ঝামেলাপূর্ণ। পুরটা পড়লে হয়ত ব্যাপারটা বুঝা যাবে।

আমরা ছিলাম জিবু শহরে। আগেই বলছি জিবু prefecture লেভেলের শহর। অর্থাৎ প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক ক্ষমতার বিচারে এটা চীনের দ্বিতীয় সারির শহর। এমনকি শানডং প্রভিন্সের প্রভিন্সিয়াল রাজধানী জিনান থেকে জিবু শহর প্রায় একশত কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। এটা থেকেই বুঝতে পারার কথা জিবু শহরটা কতটা বিচ্ছিন্ন।

আমাদেরকে জিবু থেকে বেইজিং-এ আবার আসতে হবে প্লেন ধরার জন্য। আর জিবু থেকে বেইজিং-এ যেতে হবে হাই-স্পিড ট্রেনে করে। সেই ট্রেন স্টেশন আবার আমাদের হোটেল থেকে যথেষ্ট দূরে। অন্তত জিবু শহরে ট্রেন স্টেশনে চায়নার পাবলিক সার্ভিসের উপর ভিত্তি করে একা একা যাওয়াটা আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব। সাধারণ মানুষজন এখানে ‘ইয়েস-নো’ পর্যন্ত বুঝে না।

এই অবস্থায় আমাদের ত্রাণ কর্তা হিসাবে আবির্ভূত হলেন ডঃ ইয়ু। উনি উনার কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের দায়িত্ব দিলেন আমাদের ট্রেন স্টেশনে পৌছে দেবার জন্য। কিন্তু, এখানে আরো একটা সমস্যা আছে। আগেই বলছিলাম যে আমাদের দলে আছেন বাংলাদেশের এক স্বনামধন্য ইন্ড্রাস্ট্রির মালিক, যার নাম আমি কখনোই আর কোন অবস্থাতেই মুখে আনব না। কারণ তাঁর নাম বললে আমার চাকরি থাকবে না। তাঁর ইন্ড্রাস্ট্রির বার্ষিক রেভেনিউ হাজার কোটি টাকার উপরে। উনার ইন্ড্রাস্ট্রি বাংলাদেশে সবাই এক নামে চেনে, উনাকেও সবাই চিনে। এখন কথা হল, আমরা মার্সিডিজ, বি-এম-ডাব্লিউ এসব সস্তা গাড়িতে চড়ে ট্রেন স্টেশনে যেতে পারলেও উনার মত ভি-আই-পি, সি-আই-পি মানুষ লিমুজিন, রোলস-রয়েস বা এই ক্লাসের গাড়ি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারবেন না। এমনকি প্লেনেও উনি আমাদের সাথে যাবেন না। উনার জন্য বরাদ্দ রয়েছে বিশেষায়িত বিজনেস ক্লাস। আর আমরা যাচ্ছি ইকোনমি ক্লাসে। আমাদের ভ্রমণের টাকা দিচ্ছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। চাইলেও আমরা বিজনেস ক্লাসে যেতে পারব না। আর উনি যাচ্ছেন উনার নিজের টাকায়। ওতে আমাদের কি বা বলার থাকতে পারে।

গাড়ির ব্যাপারটা হয়ত অনেকের কাছেই বাড়াবাড়ি লাগতে পারে। তবে আমারো মনে হয়, এই ক্লাস মেইনটেইনের দরকার আছে। কারণ, উনাদের মত ভি-আই-পি এবং সি-আই-পি মানুষকে দুনিয়ার কত মানুষ জায়গামত ঠিকই চিনতে পারে সেটা আমাদের ধারণারও বাহিরে। সাধরণ লোক উনাকে না চিনলেও হয়ত দেখা যাবে জিবু শহরের মেয়র বা বিশাল কোন মাফিয়া ডন উনাকে ঠিকই চিনেন। কিভাবে চিনেন, কেন চিনেন এসব আমার ধারণারও বাহিরে। তাই প্রশ্ন করবেন না। এমনকি উনার সাথে প্রতিদিন ডিনার করার পরেও, এক হোটেলে থাকার পরেও উনি কেন চায়নাতে এসেছিলেন তা আমি নিশ্চিত বলতে পারব না। তো উনার মত লোকেরা যদি মার্সিডিজ, বি-এম-ডাব্লিউ টাইপ সস্তা গাড়িতে চড়েন তাহলে উনাকে যারা চিনেন তারা যদি দেখে ফেলে তাহলে হয়ত উনার ক্লাস-ঘটিত কোন সমস্যা হতে পারে। এমনকি উনার গাড়িতে কে বসবেন, কিভাবে বসবেন, এবং কোথায় বসবেন সব কিছুই ঠিক করা থাকে। ওসব নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। কারণ, আমাদের টাকাতে উনারা চলছেন না। বরং, দেশের অনেক মানুষের আয়-রোজগার উনাদের টাকাতে হচ্ছে। এখন অনেকেই অনেক তীর্যক কথা বলতে পারেন, তবে একটা কথা সবাইকে মানতে হবে। সেটা হল, মাথাতে জিনিস না থাকলে এই লেভেলে আসা সম্ভব না। তাই, আমি উনাদের মাথাটাকে সম্মান করি। ওটাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশ ও দশের উপকার হবে।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম সেই স্বনামধন্য ইন্ড্রাস্ট্রির মালিক এবং উনার সাঙ্গ-পাঙ্গরা জিবু শহরেও ম্যানেজ করে ফেলল উনার ক্লাসের সাথে যায় এমন একটা গাড়ি। কিভাবে করলেন, কোথা থেকে করলেন আমি কিছুই জানি না। ডঃ ইয়ু বা অন্য কারো সাহায্যের মুখাপেক্ষী উনি নন। উনাদের জন্য দুনিয়ার হিসাব-নিকাশ আলাদা। তবে উনি আমাদের একদিন আগেই বাংলাদেশের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিয়েছিলেন। আমি হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে গাইলাম ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে গেলে। আমার বলার কিছু ছিলো না।’

যাইহোক, আমি কথা শুরু করলে প্রায়ই বে-লাইনে চলে যাই।

২২/
আমাদের বেইজিং-এ যাওয়ার ট্রেন ছিল সকাল আটটার সময়। এর মানে আমাদের হোটেল থেকে বের হতে হবে সকাল ছয়টায়। কারণ, আমাদের হোটেল থেকে ট্রেন স্টেশন বেশ দূরে ছিল। তাছাড়া আগে বলেছি যে সে সময় চীনের জাতীয় নির্বাচনের তোড়জোড় চলছিল। তাই, সব জায়গাতেই ছিল নিয়মের খুব কড়াকড়ি।

তাই যাবার দিন ভোর পাঁচটার সময় উঠেই গোসল করে নীচে নেমে দেখি ডঃ ইয়ুর দুইজন ছাত্রী দুটো গাড়ি নিয়ে এসে হাজির। কোনমতে নাস্তা করে হোটেল থেকে চেক-আউট করে গাড়িতে চেপে বসলাম। প্রায় এক ঘন্টার মত লাগল স্টেশনে পৌছাতে। স্টেশনে গিয়ে দেখি পুলিশের বেশ কড়া পাহারা। অনেক চেক-পোস্ট পার হয়ে যখন স্টেশনে ঢুকতে যাবো তখন একটা ডিটেকটরে ধরা পড়ল যে আমার ব্যাগে আছে একটা বডি স্প্রে। চীনের এই হাই-স্পিড ট্রেনগুলোতে প্লেনের মত বাহির থেকে আলাদা কোন লিকুইড কেবিনে নেয়া যায় না। কিন্তু প্লেনে লিকুইড আছে এমন ব্যাগ কেবিনে নেয়া না গেলেও অন্ততঃ চেক-ইনে দেয়া যায়। কিন্তু, হাই-স্পিড ট্রেনে চেক-ইন করার কোন উপায় নাই। সব ব্যাগই কেবিনে যাবে। পুলিশ মেয়েটা অনেক দুঃখ প্রকাশ করে আমাকে ব্যাগ খুলে বডি স্প্রেটা ফেলে দিতে বলল। ভাগ্যিস আমি দেশের মানুষের জন্য তেল, শ্যাম্পু, লোশন কিনি নাই। কিনলে আজ সবই এই জিবু শহরের ট্রেন স্টেশনে ফেলে যেতে হত। যাইহোক, আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ডঃ ইয়ুর এক ছাত্রী। ওর নামটা ভুলে গেছি। সে আমার ব্যাগ থেকে বডি স্প্রে-টা নিয়ে বলল, ‘আরাফাত তুমি যখন পরেরবার আবার জিবু শহরে আসবে তখন আমার কাছ থেকে এই বডি স্প্রে-টা ফেরত নিও।’

এই জীবনে কি আর কখনো জিবু শহরে যাওয়া হবে? আর গেলেও কি সেই মেয়েটাকে আমি খুঁজে বের করতে পারব? মাঝে মাঝে আমার সেই বডি স্প্রে-টার কথা মনে হয়। আহারে, মেয়েটা হয়ত এখনো সেই বডি স্প্রে-টা আগলে রেখেছে। কি এক মায়ার বাঁধনে জিবু শহর জড়িয়ে রেখেছে আমায়।

২৩/
যাইহোক, ভালোয় ভালোয় আমরা সবাই ট্রেনে চেপে বসলাম। এই প্রথম চায়নাতে আমরা একেবারে একা। এতদিন সবখানেই আমাদের সাথে কোন না কোনভাবে হোস্টরা ছিল।

ট্রেন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সকাল আটটায় ছাড়ল। এই ট্রেনে বিমানের বিমানবালার মত আছে ট্রেনবালা। উনারা খাবার দিচ্ছেন, স্যুভেনির বিক্রি করছেন। বেইজিং জিবু থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে। হাই-স্পিড ট্রেনে সময় লাগবে প্রায় তিন ঘন্টা।

আমরা বেইজিং পৌছালাম সকাল এগারোটার দিকে। ট্রেন থামল বেইজিং সাউথ রেলওয়ে স্টেশনে। এদিকে এয়ারপোর্ট বেইজিং-এর আরেক মাথায় অবস্থিত। এখানে থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। বাসে করে যেতে সময় লাগবে প্রায় দুই ঘন্টা। বেইজিং শহরটা আসলে বিশাল। আমাদের ঢাকার প্রায় পঞ্চাশগুন বড়। বেইজিং-এর আয়তন প্রায় সাড়ে ষোল হাজার বর্গকিলোমিটার। এদিকে আমাদের ঢাকার আয়তন মাত্র তিনশ বর্গকিলোমিটার। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে বেইজিং-এর এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাওয়া বলতে কি বুঝায়।

বেইজিং সাউথ রেলওয়ে স্টেশন লোকে-লোকারণ্য। কিন্তু সবাই চাইনিজ। এইখানে আমরাই হলাম বিদেশ থেকে আসা কিছু চিজ। কোথাও ইংরেজিতে কোন দিক নির্দেশণা নাই। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে কেউ বুঝতে পারে না। বিভিন্ন লোক বিভিন্ন দিকে যাচ্ছে। আমরা যাবো বাস ধরতে এয়ারপোর্টে যাবার জন্য। কিন্তু বাস স্টেশন পর্যন্ত কিভাবে যাবো, কোনদিক দিয়ে যাবো কিছুই বুঝতে পারছি না।

এইসময় একজন কুলি-টাইপ লোক এসে আমাদের দলের একজনের ব্যাগ হ্যাচকা টান দিয়ে নিয়ে নিল। কোন কথা না বলে লোকটা হনহন করে হেঁটে একটা এক্সিলেটরে চড়ে বসল। আমরাও হই-হই করে উঠলাম আর লোকটাকে ফলো করলাম। এক্সিলেটরে এক তলা উপরে উঠেই লোকটা ব্যাগটা নামিয়ে রেখে টাকার জন্য হাত পেতে দিল। কথা না বাড়িয়ে লোকটাকে কিছু টাকা দেবার পর সে আরো বেশি চাইল। কি আর করা। উনাকে উনার চাহিদা মত টাকা দেয়া লাগল ব্যাগটা মাত্র এক তলা উপরে উঠানোর জন্য, তাও আবার এক্সিলেটরে। টাকা পেয়ে লোকটা ইশারাতে বাস কোথায় পাওয়া যাবে সেই রাস্তা দেখিয়ে দিল। এতগুলো টাকা নিয়েও সে আমাদের ব্যাগটা আর বাস পর্যন্ত নিয়ে গেল না, এমনকি রাস্তাটা দেখিয়ে দেবার জন্য হেঁটে গেল না।

অবশেষে নিজেরাই কষ্ট করে বাস খুঁজে বের করে চড়ে বসলাম। বাস ছাড়বে দুপুর বারোটায়। সেই বাস এয়ারপোর্টে পৌছাতে পৌছাতে দুপুর দুইটা বেজে যাবে।

পাঠকেরা হয়ত খেয়াল করছেন যে আমি এই সফরে বেইজিং শহরে তিনবার আসলেও, বেইজিং এর মাটিতে তেমনভাবে হাঁটা হয়নি। এয়ারপোর্ট আর বেইজিং সাউথ রেলওয়ে স্টেশনের আশেপাশে হাঁটাহাঁটি ছাড়া আমার বেইজিং শহর দেখা হয়েছে গাড়ি বা বাসের জানালা দিয়ে। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। পথে যেতে-আসতে দূর থেকে চীনের সেই মহা-প্রাচীর বহুবার দেখলাম। কিন্তু সেখানে যাবার আর সুযোগ হল না।

২৪/
এয়ারপোর্টে এসে দেখি বিশাল ভিড়। লোকে লোকারণ্য। ইমিগ্রেশন সব বিদেশীদের কড়া জিজ্ঞাসাবাদ করছে। চায়নাতে ঢুকার সময় দেখলাম কোন প্রশ্ন না করেই ইমিগ্রেশন সবাইকে ঢুকতে দিচ্ছে, কিন্তু বের হবার সময় কেন এত জেরা করছে বুঝতে পারলাম না। বিশেষ করে, আফ্রিকান কাউকে দেখলে পাসপোর্ট চেকিং যেন শেষই হচ্ছে না। এমনকি পাসপোর্টটাও উনারা বিশেষ এক গ্লাস দিয়ে কি যেন চেক করছে। তবে আমাদের কোন ঝামেলা হল না, কিন্তু ইমিগ্রেশন লাইনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যাথা হয়ে গেল। বিকাল চারটার দিকে আমরা ইমিগ্রেশন পার হলাম। এদিকে আমাদের ফ্লাইট বিকাল পাঁচটার দিকে। দুপুরে কিছু খাইনি। খিদার চোটে মাথা ঘুরছে।

এয়ারপোর্টে একটা পিজার দোকান পেয়ে কোনমতে ঢুকে পেট ঠান্ডা করলাম। এদিকে প্লেনের বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে। কোনমতে খেয়ে থাই এয়ারওয়েজের প্লেনে উঠার জন্য দৌড় দিলাম।

আমাদের প্রথম গন্তব্য থাইল্যান্ডের ব্যাংকক। বেইজিং থেকে প্রায় পাঁচ ঘন্টার জার্নি। প্লেনে দুবার খেতে দিয়েছে। আমার পাশে এক থাই মেয়ে বসেছে। হালকা কথা-বার্তা হল, একসাথে মুভি দেখা হল। বলতে পারেন কিভাবে একটা অচেনা মেয়ের সাথে মুভি দেখলাম? কারণ, আমাদের সবার সিটে ট্যাব থাকলেও সেই মেয়েটা নাকি ট্যাব কিভাবে চালাবে বুঝতে পারছিল না। কি আর করা। আমি প্লেনে এমনিতেই ঘুমাতে পারি না, তাই মুভি দেখেই সময় কাটালাম। এদিকে মেয়েটাকে ওর নামটাও জিজ্ঞেস করা হয় নাই।

প্লেন ভালোয় ভালোয় ব্যাংককের Suvarnabhumi এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করল। লোকাল টাইম তখন রাত নয়টা। বেইজিং হিসাবে তখন রাত দশটা।

এখন আমাদের আরো তিন ঘন্টা ট্রানজিট। শরীর অসম্ভব টায়ার্ড হয়ে গেছে। কোনমতে ট্রান্সফার ডেস্ক পার হয়ে একটা বেঞ্চিতে শরীর এলিয়ে দিলাম। দুই ঘন্টা লিটারালি চোখ বন্ধ করে থাকলাম। যখন বাংলাদেশে আসার প্লেনটাতে চেপে বসলাম তখন বেশ কিছু বাংলাদেশি মানুষ হুইল চেয়ারে বসা অবস্থায় দেখলাম। বুঝলাম, উনারা চিকিৎসা নিতে থাইল্যান্ড এসেছিলেন।

ব্যাংকক থেকে প্লেন ছাড়ল রাত বারোটায়। বেইজিং-এর হিসাবে তখন পরের দিনের রাত একটা। ব্যাংকক থেকে ঢাকা আসতে লাগে প্রায় আড়াই ঘন্টা। কিন্তু যখন ঢাকা পৌছালাম তখন ঢাকার ঘড়িতে বাজে রাত দেড়টায়। ব্যাংককের ঘড়িতে তখন রাত আড়াইটা। আর বেইজিং-এর ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে তিনটা। ঢাকাতে কোন ঝামেলা ছাড়া ইমিগ্রেশন পার হয়ে একটা ট্যাক্সি নিলাম। এই গভীর রাতেও ঢাকার রাস্তাতে জ্যাম।

বাসার দারোয়ান ভাইকে আগে থেকেই বলা ছিল যে আমি অনেক রাতে ফিরব। ঢাকার সময়ে যখন রাত প্রায় সাড়ে তিনটা তখন বাসাতে পৌছালাম। শরীরের আর কোন এনার্জি অবশিষ্ট নেই। বেইজিং-এর সময়ে তখন সকাল সাড়ে পাঁচটা। এর আগেরদিন সকাল পাঁচটায় আমরা জিবু শহর থেকে রওয়ানা দিয়েছিলাম। এখন পরেরদিনের সকাল পাঁচটা বাজে সেখানে। মাঝখানে পুরো একদিন আর এক রাত একটা জার্নিতে চলে গেল। এই জার্নিতে এত চেঞ্জ আর চড়াই-উৎরাই ছিল যে সেটা শরীরের উপর বিশাল চাপ তৈরি করছে। টানা জার্নি হলে হয়ত এমন হত না।

২৫/
বাসাতে এসে কোনমতে গোসল করে কিছু খেয়ে নিলাম। ছেলে ঘুমিয়ে আছে। ইন্দোনেশিয়ান মায়েরা বাচ্চাদের নিয়মানুবর্তিতার উপর খুব খেয়াল রাখে। রাত আটটার পর বাচ্চাকে কোন অবস্থাতেই ওদের বেড-রুমের বাহিরে যেতে দেয় না আর লাইট বন্ধ রাখে। বাচ্চারা যদি না ঘুমায় তাহলে ওরা বাচ্চাদের গল্প শোনায়, বাচ্চাদের সাথে খেলে। কিন্তু ইমার্জেন্সি ছাড়া কোন অবস্থাতেই ওরা লাইট জ্বালায় না, আর বাচ্চাদেরও রুম থেকে বের হতে দেয় না। বাচ্চা কান্না-কাটি করলেও দেয় না। ওরা বাচ্চাদেরকে বলে, ‘তুমি ঘুমাবা না – সমস্যা নাই। খেলতে চাও – সমস্যা নাই। কিন্তু যাই করো, এই রুমের ভিতর করো। খেলতে চাইলে মায়ের সাথে খেলো। দুষ্টামি করতে চাইলে মায়ের সাথে করো। কিন্তু বাহিরে যেতে পারবা না।’

ইন্দোনেশিয়ান বাচ্চা প্রতিপালনের এই ব্যবস্থার সুফল আমি হাঁড়ে-হাঁড়ে টের পাচ্ছি। এখন আমার বাচ্চাও দেখি রাত নয়টার ভিতর একেবারে সারারাতের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে, কারণ এটা তার অভ্যাসের ভিতর চলে এসেছে। সে বুঝে গেছে রাত আটটার পরে ‘ফান-টাইম’ শেষ। বাকি সময় পুরোটা ঘুমানোর জন্য। আর বাচ্চা আগে আগে ঘুমানোর ফলে স্বামী-স্ত্রীর ভিতরেও সময় কাটানোর সুযোগ থাকে যেটা বাচ্চার ঘুম অনিয়মিত সময়ে হলে সম্ভব হয় না। কিন্তু, এই সহজ বিষয়টা বাংগালি সমাজ কেন যেন মেনে নিতে পারে নাই। কারণ, বাংলাদেশে মানুষেরা অন্য মানুষের বাসাতে রাত নয়টা, দশটা এমনকি রাত এগারোটাতেও যায়। অথচ, বিদেশে রাত আটটার পরে কাউকে ফোন দেয়াটাও একটা অভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে। অবশ্য, মানুষের দোষ দিয়েও লাভ নেই। অনেকে তো অফিস থেকে দেরিতে বের হয় জ্যাম ঠেলে-ঠুলে বাসাতে আসতে আসতেই রাত দশটা বেজে যায়। তো, উনাদের সামাজিকতা তো রক্ষা করতে হলে এই সময়ের পরেই করতে হবে। তো এমন অনেক মানুষ আছে যারা রাত নয়টার পরে আমাদের বাসাতে এসে বাচ্চাকে একটু দেখতে চায়। আমার বউ এবং আমি বিনয়ের সাথে এটা প্রত্যাখান করি। অনেকেই নিজেকে বিশাল কেউকেটা ভাবে যে যেহেতু উনি দেখতে চাইছেন তাই বাচ্চাকে এখন ঘুম থেকে তুলে উনাকে দেখাতে হবে। অথচ, সন্ধ্যা সাতটায় আসতে বললে উনারা সেটাকে গ্রাহ্য করেন না। উপরুন্ত বলেন, রাত নয়টা কোন রাত নাকি? হতে পারে, সেটা উনার হিসাবে রাত না, কিন্তু আমাদের জন্য অনেক রাত। অনেকেই এতে মনঃক্ষুন্ন হয়, অনেকে ভাবে আমরা ভাব দেখাচ্ছি। আমার পরিবারের লোকেরাও এমন ভাবে। কিন্তু, কি আর করা। দুনিয়াতে সবাইকে সবসময় সুখী করতে হবে এমন নিয়ম কোথাও লেখা নাই। আর আমরা আগে আগে ঘুমাইলে অন্যরা কেন অসুখী হবে সেটাও আমরা জানতে চাই নাই।

আমি পৃথিবীর যত শহর দেখছি তার মধ্য বাংলাদেশিদের অকারণে রাত জাগতে দেখছি। চীনের লোক, মালয়শিয়ার লোক, ইন্দোনেশিয়ার লোক, সিংগাপুরের লোক, এমনকি এই ইউরোপের মানুষজনও রাত নয়টা-দশটার ভিতর ঘুমিয়ে পড়ে। ক্লাব-বার খোলা থাকে বটে, কিন্তু সেখানে তো সাধারণ মানুষেরা প্রতিদিন যায় না। ইনফ্যাক্ট, খুব কম সংখ্যক প্রফেশনাল মানুষই এসব জায়গায় নিয়মিত যায়। এই লন্ডনেও বিকাল পাঁচটা-ছয়টার পরে বেশিরভাগ দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যায়। রাত নয়টার ভিতর বড় বড় বিপণিবিতানও বন্ধ হয়ে যায়। রাত দশটার দিকে রাস্তা-ঘাটে মানুষের দেখা পাওয়াই দুস্কর।

যাইহোক, আবার গল্প বলতে বলতে অনেক বে-লাইনে চলে গেলাম।

গোসল করে আর কিছু খেয়ে শরীর আর চলছিল না। ছেলের মাথার কাছে টিটুকে রেখে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়লাম। বউ আর বাচ্চাকে পাশে পেয়ে জীবনটাকে অনেক সুন্দর লাগছিল।

২৬/
এবার কিছু ছবি আর ক্যাপশনঃ


- বেইজিং-এর পথ-ঘাট। বাস থেকে তোলা ছবি।


- বেইজিং-এর পথ-ঘাট। বাস থেকে তোলা ছবি।


- বেইজিং-এর পথ-ঘাট। বাস থেকে তোলা ছবি।


- বেইজিং-এর পথ-ঘাট। বাস থেকে তোলা ছবি।


- বেইজিং-এর পথ-ঘাট। বাস থেকে তোলা ছবি।


- বেইজিং এয়ারপোর্ট।


বেইজিং এয়ারপোর্ট।


- বেইজিং এয়ারপোর্টের ভিতর।


- ব্যাংককের এয়ারপোর্ট
___________________________________
সমাপ্ত। এবারের মত চায়না সিরিজ শেষ হল। হয়ত, ভবিষ্যতে আবার চায়না গেলে এই সিরিজের পর্ব যুক্ত হবে। এই চায়না সিরিজের সময়কাল ছিল ২০১৭ সাল। এই সিরিজের পর সিংগাপুর সিরিজ বা আয়ারল্যান্ড সিরিজ করলে কেমন হয়? মন্তব্য করে জানাবেন। ভালো থাকবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০২২ রাত ৯:৪১
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

পঁচে যাওয়া বাংলাদেশ আর্মি

লিখেছেন রিয়াজ হান্নান, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:২৫


একটা দেশের আর্মিদের বলা হয় দেশ রক্ষা কবজ,গোটা দেশের অব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে বহিরাগত দুশমনদের আতংকের নাম। ছোটবেলা থেকে এই ধারণা নিয়ে কয়েকটা জেনারেশন বড় হয়ে উঠলেও সেই জেনারেশনের কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×