সারাদিন বৃষ্টি থেমে থেমে ঝরছে। ভাবছি স্বপ্নগুলো কেমন জানি প্রতি মুহুর্তেই হাতছাড়া হয়ে যায়। যাকে একটি মুহুর্ত না দেখতে পেলে পৃথিবীটা অন্ধকার লাগতো। এক সময় সে দুরে চলে গেলেও, তারপরও জীবন সয়ে যায়। এই জীবন কি একটুকুও আত্মার সংস্পর্শ পায়না? হ্যা পায়। যখন সময় পার করে একটি নতুন প্রভাত রচিত হয় সে মুহুর্ত সামনে দাড়ায় কোনো একজন। সে তো সে ছিলোনা, তবে এ কে? জীবনের কাছে প্রশ্ন রাখি…সে উত্তর দেয়… সময়। সময়ইতো আছন্ন করে রাখে, সে যদি প্রনয় হয়, সমর্পণ হয়, তবে হৃদয় মনে রাখে… আজীবন আকরে ধরে। আর যা মোহ… তাতো সময়ের কালোপোক্ষণে মুছে দেয় মন।
মন কি সব মুছে দেয়? না… সব দেয়না।আমি তেমনই এক সময়ের কথা ভাবছিলাম, কিন্তু তা এই ভিনদেশের পাহাড়ের পদদেশে একটি ছোট্ট কুটিরের সামনে খুঁজে পাবো, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
কাজ করতে করতে তখন একঘেয়ে হয়ে উঠেছিলাম। এমন কি সাপ্তাহিক ছুটিটাও পাইনি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম সামনের ছুটিতে, আমার কৌশরের কলেজ লাইফের জীবন কাটানো দার্জিলিংয়ে এবার কিছুটা সময় কাটাবো, তাছাড়া কয়েকদিন সিকিমেও থাকবো। অফিসের কাজ কমে এলে সিদ্ধান্ত নিলাম, ছুটি নেবো। বস ছুটি দিলেন পনেরো দিনের। এর মধ্যেই ভিসা করে রাখলাম। ছুটির পরের দিনই যান্ত্রিক নগরী ঢাকা ছাড়লাম। সিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং এলাম।
জীবন হাতরে বেড়ানো কলেজ, সেন্ট পলস স্কুলের পাশে একটি হোটেলে কাটালাম দুদিন, তারপর সিকিম যাত্রা। উঠলাম বাসস্টান্ডের কাছে হোটেল সিকিমের পাশে তিস্তা কটেজে। এই নিয়ে দুবার এলাম এখানে। প্রথমবার নেহার সাথে এসেছিলাম, সঙ্গে নিয়ে একরাশ অনাবিল উচ্ছাস সাথে করে। পাহাড় আমার বরাবরই ভালো লাগে। উচু নিচু খাড়া পথ। আর সিমলা-মানলির থেকেও এটাই আমার প্রথম ভালোলাগা। এই কটেজ। সব স্মৃতির ধূম্রজালে আচ্ছন্ন করে রেখেছে নেহা। ভাগ্যক্রমে সেই ঘরটিই পেয়ে গেলাম কোলকাতার এক বন্ধুর সহায়তায়। কখনো টিপটিপ বৃষ্টিতে হাত ভিজিয়ে আলিঙ্গন করেছি একবুক ভালোলাগা, কখনো বা আমার চোখের জলে মুখ ভার করে আকাশ ভেঙ্গে নেমেছে বৃষ্টি। আসার পথে পাহাড় ধসের কারণে এখানে পৌঁছোতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো। কেয়ার টেকার খবর দিয়ে জানালো এবার পশ্চিমী ঝড়ের দাপটে পাহাড়ে তুষার বৃষ্টিও হয়েছে আজ। সঙ্গে হালকা বৃষ্টি হয়েছে, রাতে তাই বের হতে বারণ করলেন তিনি৷ টিভিতে দেখলাম লোদামা-সুখিয়াপোখরি এলাকার তাপমাত্রা প্রথম দিনেই নেমে গেছে দুই ডিগ্রির কাছে৷
নেহার সাথে আমার পরিচয় কোলকাতার পার্ক স্ট্রীটে হাটার পথে। ওর বান্ধবী মন্দ্রিতা আমার সহপাঠী। ও আমাদের কোলকাতা ভার্সিটিতে আমার সাথেই পড়ে। তারপর ওর সাথে পরিচয়। তারপর ভালো লাগা থেকেই ভালোবাসার সেদিনগুলো। কতদিন টালিগঞ্জে ছুটে গেছি তোমার বাসার পাশে আমার বন্ধু সাম্যর বাসায়। কতরাত কাটিয়েছি ওখানে তোমার জন্য, তোমাকে দেখবো বলে। যখন প্রথমবার সিকিমে এলাম নেহার সাথে। খুব মজা করেছিলাম।সে বছর বর্ষা নেমেছিল একটু আগেই। সারাদিন ঝুমঝুম বৃষ্টি, তুষার বৃষ্টি, গুড় গুড় করে মেঘের অস্তিত্ব সারা আকাশ জুড়ে। তিস্তা নদী যেন সেবার একটু আগেই ফুলে ফেঁপে তার অস্তিত্ব জানান দিতে লাগলো। বৃষ্টি আমার সবসময়ই ভাললাগে। বৃষ্টির একটা আলাদা ভাষা আছে, আছে প্রিয়জনকে খুব কাছে ডেকে তার কানে ফিসফিস করে আবেগঘন কিছু কথা বলার আবেদন। একাকি এই ভাষা, নেহার প্রতি আমার এই সমর্পন। ওর হাসিটা ছিলো অদ্ভুত সুন্দর। এই উষ্ণ হাসির মাঝে একধরনের নেশা আছে, যা ড্রাগের প্রতি মানুষের আসক্তিকেও হার মানায়। প্রচণ্ড নির্ভরতায় নেহার প্রতি আমার বা আমার প্রতি নেহার ভালোলাগা ডানা মেলে চলছিল দিনের পর দিন। এক বর্ষায় যে ভালোলাগার বৃষ্টি আমার মনকে ভিজিয়ে দিয়েছিল, আর এক বর্ষায় সেই বৃষ্টি আমার মনকে নেহার ভালোবাসার মাতাল হাওয়ায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছিল। হ্যাঁ আমি নেহাকে ভালবেসেছিলাম... আজ ভাবি, এই একাকী হবার যে অনুভূতি, তা কি কোনদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম? আমার সমস্ত আবেগ, অনুভূতির প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে নেহার বিচরণ ছিল অবারিত। বাইরের কোন আরোপিত সৌন্দর্য যেমন আমাকে মুগ্ধ করতো না, তেমনি কোন দুশ্চিন্তা আমাকে বিচলিত করতে পারতো না। কি এক অমোঘ আকর্ষণ ছিল নেহার সঙ্গ, তা উপলব্ধি করে আজও, এতো দিন পর আমি শিহরিত হই। অস্বীকার করবো না, নেহা যখন আমার সামনে বসে হাত নাড়িয়ে, উচ্ছল হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে গল্প করতো, আর দশটা প্রেমিকের মতো আমিও অনুভব করতাম ওই মুহূর্তের যেন কোন সমাপ্তি না ঘটে, এভাবেই যেন কেটে যায় যুগ-যুগান্তর। একসময় আমার ঘোর কাটতো, আর আমি দেখতাম খুব সুন্দর একটি মুখ আমার সামনে কিছুটা অবাক, কিছুটা বিচলিত ভাবে ঝুঁকে এসেছে। স্তম্ভিত আমি একই সাথে বাস্তব ও পরাবাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে যেতাম। ইচ্ছে করতো সামনে থাকা মানুষটিকে একটু ছুঁয়ে দেখি, হাত ধরে বলি, চলো না কোথাও হারিয়ে যাই । হারালাম ঠিকই,তোমার সঙ্গ ছিন্ন করে। জানি এ পৃথিবীর কোনো প্রান্তে হাজারো খুঁজলেও তোমাকে পাবোনা। কোথাও না। সেবার তাই আচমকা পালিয়ে এসেছিলাম সিকিমে। পাহারের ঘন জঙ্গল পেরিয়ে সেই ছুটে চলা মঙ্গন, চুংথাম, লাচেন এর পথে। মনে পরে সিকিম আসতে আমাদের সাত দিন পথ অতিক্রম করতে হয়েছিলো তোমার বাবার দাপটের কারণে।সেই দিনগুলোর কথা মনে পরলে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনা।
আজকের মত তেমনি এক সকাল ছিলো সেদিন , অঝরে বৃষ্টি ঝরছিল মেঘ সারা শহর অন্ধকার করে। কোলকাতায় আমাদের ফেরার দুদিন পর খবর পেলাম, তোমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে লাখনৌয়ে, তোমার মামার বাড়িতে। টেলিফোনে মাঝে মধ্যে তোমার সাথে কথা হতো। একদিন শুনলাম, তোমার বিয়ের খবর। জুনের ১৭ তারিখ। এদিনটি আমার জীবনের কালো একটি অধ্যায়। অনেক কষ্ট করে ঠিকানা জোগার করে যখন আমি তোমার মামার বাড়িতে পৌঁছালাম, তখন সব শেষ। তোমার চিতায় পোড়ানো দেহের শেষ আগুনটুকুও নিভে গেছে। জানো নেহা, তোমার দেহের সেই শেষ চিহ্নটুকু এখনো আমার কাছে স্বযতনে আছে।মাঝে মধ্যে সেই ছাই গায়ে মেখে তোমার স্পর্শ খুঁজে বেড়াই। তুমি আছো, থাকবে আমার সকল ভালোবাসায়…..জীবন যেখানের জীবনের দায় রাখেনা, মানুষ কি রাখবে আকরে ধরে।আমি তোমাকেই রাখি নির্ভয়ে…এক অপার বিশ্বাসে……এক অনাবিল ভালোবাসায়। জানো তো… সেটুকুই আমার যে সর্ব সুখ…..
১৭জুন ২০১৫ঢাকা….গ্রীনরোড…সকাল ৮ টা ২০