স্পর্শের বাইরে…
░░░░░░আত্মজীবনী মূলক --স্পর্শের বাইরে… ░░░░
আমার জীবনের ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গল্পটি লেখা হয়েছিলো ২০১২তে। দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপাও হয়েছিলো সে সময়। আজ কিছুটা সংশোধন করে লিখলাম…………
সাল………২০০৬…
তখন আমি জয়িতাকে ভুলতে চেয়েছিলাম। এতটা বছরের সম্পর্ক, তারপর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পড়াও শেষ। এরপর শেষ আরো দু বছর জটিলেশ্বর মুখার্জীর কাছে গান শেখা। শুধু জয়িতার কাছে থাকবো বলে। তাও আর হলোনা। কারণ ও বাংলাদেশে আসতে চায়নি, দেশের পরিস্থিতিও তখন ভালো ছিলোনা। শেষ পর্যন্ত সম্পর্কের ইতি টেনে দেশে এলাম । এদিকে দেশে আসার পর, প্রায় সময়ই মন ভীষন খারাপ থাকতো। অন্যদিকে ট্রিটমেন্ট নিতে মানসিক ডাক্তার ফিরোজ সাহেবের কাছে প্রায়ই যাওয়া হতো। এই নিয়ে তিনবার ট্রিটমেন্ট নিয়েছি। ডাক্তারের কড়া ওষুধের কারনে জয়িতার ছবি কল্পনাতে না আনতে পারলেও ওর স্মৃতি গুলো মনে করতে পারতাম তখন শুধু । মাঝে মধ্যে অবাক লাগতো নিজেকে দেখে। এই আমি কি সেই আমি। জীবনের একটি অধ্যায়,,, কি করে ভুলতে পারছি সহজে। নাহ,,, সময় আমাকে সহজ হতে না দিলেও কেউ একজন এসেছিলো আমার জীবনে। যে আমাকে অনেকটাই ভুলতে সাহায্য করেছিলো সে সময় । তার গল্পই আজ বলছি।
তখন বাবা মা চাকরীর সুবাদে বরিশালে থাকতেন। আর সে কারণে বন্ধুদের সাথে একটি মেসে উঠতে হয় ঢাকার ইন্দিরা রোডে। তখন পর্যন্ত চাকরী না পাওয়ায় আমি একটি টিউশনি আরম্ভ করি বনানীতে। এক বন্ধুর কাছেই খোঁজ পাই এই টিউশনিটির। স্পর্শ নামে ইংলিশ মিডিয়াম এর এক ছাত্রীকে পড়াতে হবে । প্রথম দিন গিয়েই অবাক। মেয়েটির বাবা দেশের একজন সনামধন্য শিল্পপতি, সাথে বর্তমান সরকারী দলের রাজনীতিও করেন । মা ও একটা ইন্ডাস্ট্রি চালায় । আবার একটি টেলিভিশনের অর্ধেক মালিক। তারা অনেক ব্যস্ত । খুব কম কথা হলো। আমি থাকি কোথায় কি করি এ পর্যন্তই। এরপর মেয়েটির মুখ দর্শন। ঈশ্বর জেনো নিজের হাতে স্মৃষ্টি করেছন ওকে। মেয়েটির বয়স ১৬-১৭ বছর হবে তখন । নাম স্পর্শ। দ্বিধা নিয়েও শুরু করলাম টিউশনিটা। কারণ একদিকে জয়িতার স্মৃতি তারপর একটি মেয়ে পড়ানোর এই টিউশনি। ওকে দুঘন্টা পড়াতে হবে।
প্রথম দিন তেমন কোনো কথাও হলোনা। তবে বুঝতে পারলাম ওর চেহারার মধ্যে কেমন জেনো একটা মায়া আছে। তার জন্যই আমি ওর দিকে তাকাতাম কম। ওর স্বভাব ছিল একটু অন্য রকম, বোমা মারলেও মনে হয় একটি কথা মুখ থেকে বের করা সম্ভব হত না। প্রথম প্রথম ভাবতাম মেয়েটি বোধহয় কথা বলতেও জানে না, হাসিতো দুরের কথা। তবে কয়েকদিন পড়িয়েই আমি বেস হাফিয়ে উঠছিলাম। মনে হলো এই স্পর্শ নামক আজব পদার্থটিকে পড়িয়ে কোন লাভ নেই। কিন্তু ওর করুণ চোখের চাউনিতে স্পষ্ট দেখতাম ও কত একা আর দুখী একটা মেয়ে। খুব মায়া ও হতে লাগলো । ভাবলাম কি করে স্পর্শকে স্বাভাবিক করা যায়। আমি জানি ও মানি কাউকে কষ্টের কথা বলে কাছে টানা যায়। আমি ওকে কাছে টানতে চাইনি, শুধু বোঝাতে চেয়েছিলাম সে সময়। একটি ছোট্ট মেয়ে কেমন প্রাণহীন পরে আছে, তার মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছি তাই একদিন কি মনে করে, সময়ের অনেক আগেই পড়াতে গেলাম । ওর সামনে বসে ওকে বললাম, স্পর্শ , তুমি কি জানো আমি কতটা একা। আমার ভালোবাসার মানুষটি পৃথিবীতে থেকেও নেই। কাউকে কষ্টের কথা বলবো, তারও লোক নেই। মনে হয়না আমার চেয়ে তুমি বেশি কষ্টে আছো ? স্পর্শ বললো, স্যার । আপনার বোধহয় কষ্টের সংজ্ঞাটাই জানা নাই। আমি মৃদু হাসলাম । বললাম, বোধহয় তাই । এরপর জয়িতার ঘটনা সব বলে দিলাম ওকে। শেষে বল্লাম, দেখো এখনো জীবনের হাল ছাড়িনি আমি। স্পর্শ কাঁদছিলো। আমারও কোথ্থেকে জেনো চোখে পানি চলে এলো । স্পর্শ বল্লো, স্যার আপনার কষ্টের সাথে আমার কষ্টের তুলনা করতে চাই না । আপনার জীবনে না পাওয়ার কষ্ট আর আমার সবকিছু পেয়েও আমি অসুখী । বাবা দেশের সনামধন্য শিল্পপতি। মা ও তেমনই একজন। আমার কাছের আত্মীয় স্বজন মোটামুটি সবাই বিদেশে। আমার জন্মের পরই আমি দেখেছি আমার শুন্যতাকে। কোনো কিছুরই কমতি নেই ছোট বেলা থেকে। তবু আমি বড় হই বাবা মা ছাড়া বাড়ীর কাজের মানুষের কোলে কোলে । আমার অসুস্থতা আর মনখারাপ নিয়ে তাদের যেমন কোন মাথা ব্যথা নেই । মনে হয় আমার বাবা মায়েরও নেই। তাই নিজেকে কম্পিউটার আর পড়াশুনার মাঝে ডুবিয়ে রাখি । আমার পৃথিবী আমার ঐ ঘর, বই আর ইন্টারনেটে সীমাবদ্ধ । বাইরের দুনিয়ায় সাথে আমার কোন পরিচয় নেই। তাই আমি একটু অন্যরকম। স্পর্শ নি:শ্চুপ বসে আছে । আমি ওকে বললাম , তুমি আজ থেকে একা না, আমি তোমার বন্ধু । তুমি সব কিছু আমার সাথে শেয়ার করতে পারো। আমি শুনবো তোমার কথা । আমি লক্ষ্য করলাম কিছুদিন এর মধ্য ওর একটা আমুল পরিবর্তন ঘটেছে । ও হাসতে শিখেছে দেখে, অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করতে লেগেছিলো। আমরা পড়ার ফাঁকে গল্প করতাম, রাজনীতি, অর্থনীতি, জয়িতার প্রেম ভালোবাসাও বাদ পড়তো না আমাদের আলোচনা থেকে। এই ভাবে গল্প আর পড়ায় চলতে লাগল আমাদের দুটি মানুষের সময়।
এর মাঝে একদিন হঠাত এক রাতে স্পর্শ আমার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। আমি হতবাক । কয়েকদিন হলো তখন আমি গ্রীনরোডে উঠেছি পরিচিত এক দু:সর্ম্পের ভাইয়ের ফ্যামিলীর সাথে। ভূত দেখার মতই লাগছিলো। বললাম, স্পর্শ তুমি, এত রাতে ! ও বল্লো, মা বাবা ঘরে অশান্তি করছে । ভীষণ খারাপ লাগছিলো আর খুব একা একা লাগছিলো । তাই ছুটে এলাম তোমার কাছে । ও বল্লো, এর আগে সন্ধ্যার পর থেকে তিনবার এসেছিলাম ড্রাইভার চাচাকে নিয়ে, সাহস পাইনি তাই ঘরে আসিনি। পরে সিএনজি নিয়ে একাই চলে এলাম। ওকে ঘরে নিয়ে এলাম, দরজা লাগিয়ে ওকে বুঝাতে লাগলাম, ঘরে ফিরে যেতে। ও রাজী হলো তবে একটি সর্তে, একটি চুমু খেতে হবে। বল্লাম কেনো? স্পর্শের উত্তর, আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারিনা তাই। আমি বল্লাম, আমাদের পরিনাম জানো, স্পর্শ বল্লো, জানি। এরপর একটা গভীর চুমু দিয়ে, ওর বাড়ীর ঘরের দরজা পর্যন্ত দিয়ে এলাম।
পরের দিন জানতাম না যে আমার জন্য বড় একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। স্পর্শ এর বাবা মা দুইজন এই বসার ঘরে অপেক্ষা করছে।রস্পর্শের আব্বু আমাকে একটি খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ওকে আর পড়াতে হবে না আপনার, আমরা ওকে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি এখন আসতে পারেন। স্পর্শ আমার দিকে অপরাধীর মত তাকিয়ে ছিলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে খামটা রেখে চলে এলাম। ঐ দিন আসার পর বুঝলাম আমি স্পর্শকে খুব মিস করছি, ওর কষ্ট গুলো বারবার আমায় ছুঁয়ে যাচ্ছিল । এর মধ্যেই আমার একটি টেলিভিশনে চাকরী হলো। সালটা ২০০৭। অফিসটা ছিলো ওর এক আত্মীয়ের বিল্ডিং এ-নিকেতনে । ও এর মধ্যেই হঠাত একদিন এসে হাজির, তাও আবার ঐ বিল্ডিং এর ছাদে। ও নাকী তিন ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে আমার জন্য । আমি ওকে অনেক বুঝালাম। কাছে এসে ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত কান্না শুরু করলো । অফিসের সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে, দেখে লজ্জাও পাচ্ছিলাম । অনেক কথাই হলো। ওকে ধৈর্য ধরতে বল্লাম। আর বিদেশে যেতে বল্লাম। আমি অপেক্ষা করবো বলেও জানালাম।ওকে পাঠিয়ে দিলাম, হাজার কষ্ট সত্ত্বেও। অফিস থেকে বাসায় এলাম, ভীষন মন খারাপ করে বসে আছি। কিছুই করতে পারছি না এই দুঃখী মেয়েটার জন্য। একদিন জানতে পারলাম, ওকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে কানাডাতে। দুই দিন আমার সাথে কথাও হলো, ও জানালো দেশে চলে আসবে। তারপর আর খবর নেই। আমার কেমন জেনো খটকা লাগলো। কয়েকদিন পর একজনের মারফত খবর পেলাম দেশে নাকি ফিরে নাই। আমি অবাক হলাম। অনেকবার খবর নেয়ার চেষ্টাও করেছি,তবে লাভ হয়নি কোনো। দুটো হারানোর ব্যাথা আমার মনকে পাথর বানিয়ে দিলো। ভীষন মন খারাপ থাকতো বিধায় মা কে ঢাকা নিয়ে এলাম। ওর মুখটা চোখের সামনে ভাসতো। কষ্ট হলেও মনকে সান্ত্বনা দিতাম । এর মধ্যে প্রায় পাঁচ বছর গড়ালো, ২০১২ এর মে তে, আমি সবে মাত্র ইনডেপেন্ডেন্ট টেলিভিশনে যোগদান করলাম। বাসা নিলাম গুলশান ২ এর কাছে, বনানীতে। ছুটির দিনগুলোতে মার্কেটে ঢু মারতাম। হঠাত একদিন ওর এর কাজিনের সাথে দেখা পিংক সিটিতে। ও যা বল্লো ,তাতে আমার মাথা ঘুড়তে লাগলো। ওর কাজিনের কাছ থেকে জানতে পারলাম, ও সে সময় কানাডা থেকে দেশে এসেছিলো ঠিকই, তারপর থেকে স্পর্শকে ঘরের বাইরে বের হতে দেয়নি। আমার সাথে যোগাযোগ করার নাকী অনেক চেষ্টা করেছিলো, পারেনি, তাই একদিন ও কানাডা ফিরে গিয়েছিলো। আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টাও করেছে অনেক, হয়নি, কারণ ঐ অফিসটা তখন ছেড়ে দিয়েছিলাম ততদিনে। ওর কাজিন জানালো, ওহ সুইসাইড করেছে কানাডাতে কোথাও, কারণ ওর লাশটাও পাওয়া যায়নি । একটা চিঠিও লিখে গেছে শুনলাম, সুইসাইড নোট ।ওখানকার পুলিশ অনেক খুঁজেছে, একটুকরো চিহ্ন পর্যন্ত পায়নি।
আমার চোখ থেকে পানি অঝরে ঝড়তে লাগলো। একটা মানুষ আমার সব জেনেও এতটা ভালোবাসতো আমাকে, এতটা গভীরভাবে আমাকে চাইতো, আমি তার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। আমি নিজেকে সামলে নিতে পারছিলাম না। কেনো এমন হলো জীবনটা, যাকে পেলাম, সেও চলে গেলো স্পর্শের বাইরে............
২৩ মে ২০১৫ ঢাকা….গ্রীনরোড… সকাল ৭ টা ৫০
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৫ সকাল ৮:৫১