অনেকদিন পর আজ খুব লিখতে ইচ্ছা করছে কিছু একটা .....কিছু একটা ..... কাজ শেষে বাড়ি ফিরে ডিনার সেরে বসলাম মাত্র। দিন শেষে মনে শান্তি শান্তি ভাবটা আস্তে আস্তে ফিরে আসছে ...... অনুভবে, মনে, সত্তায় শান্তি শান্তি শিশির গুলো একটু একটু করে পরছে .......ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে যা ছিলো কষ্টের, যা ছিলো এলোমেলো, যা ছিল মন ভাল না থাকার আলুথালু ভাব।
যেদিন ওখানে প্রথম গেলাম যা দেখব বলে ভেবে গিয়েছিলাম ঠিক তার থেকে পুরোটাই অন্যরকম কিছু দেখে নিজেই চমকে গেলাম। আমার গায় বেয়ে ভয়ের একটা স্রোত নেমে গেল শির শির করে। মনে পরে খুব ছোট বেলায় আমি একসময় মানসিক প্রতিবন্ধীদের দেখলে খুব ভয় পেতাম। এটা এক ধরনের ফোবিয়ার মত ছিল আমার। অনেক আগের একটা লেখায় বলেছিলাম এক পাগলীর কথা। খুলনায় আমার নানা বাড়ির নিচতলাতে লিভিং রুমের লাল কার্পেটের উপর লাল শাড়ি পরে কোকড়া কোকড়া চুল ছড়িয়ে উপুর হয়ে পরে পরে সারাদিন ঘুমাত সে .......যার মুখ আমার কোনদিনই দেখা হয় নাই, শুধু কোকড়া চুলের ফাক দিয়ে ফর্সা মুখের একটা পাশ আমি দেখতে পেতাম জানালার এপাশ থেকে, লম্বা লম্বা চোখের পাপড়ি, কোকড়া কোকড়া এলোমেলো চুল গুলো কপালের অনেকটাই ঢেকে রাখত, যাকে দেখে আমি ভীষণ ভয় পেতাম। মনে মনে ভাবতাম বড় হয়ে আমি ঠিক এই পাগলীর মতনই একজন রূপবতী মেয়ে হবো .... মালি চাচা, দারোয়ান চাচা ....সবাইকে বলতে শুনেছি সে নাকি খুব সুন্দর দেখতে। বড় হয়ে আমার আর পাগলী হওয়া হয়নি।
ভয় পেতাম যে বোবা ফকিরটাকে আমার নানুমনি রোজ ভাত খাওয়াত। এত ভয় পেতাম যে একদিন সে আমাকে ছুয়ে দেয়ায় আমি সেন্স হারিয়ে ফেলে দোতলার সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে নিচে পরে গেছিলাম।
আমার নতুন কাজ, নতুন জীবন, নতুন এক্সপেরিয়েন্স এর শুরু হলো এমন সব মানুষদের নিয়েই ...................ওখানে পৌছে Kurt এর সাথে আমার দেখা করবার কথা। একটা বাড়ি ........ড্রাইভ ওয়ে তে পায়ের ছাপ আঁকা। আমি ভেতরে ঢুকে Kurt এর সাথে দেখা করতে পারি কিনা তা জানতে চাইতেই একজন আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। এবার আমি ঘরের চার পাশটা দেখবার সুযোগ পেলাম। সারা ঘরে মানসিক প্রতিবন্ধীদের দিয়ে ভরা। কারো হাত পা কান মুখ .......সারা শরীরটাই দোমড়ানো মোচড়ানো, কেউ পাগল, কেউ আধা পাগল। কেউ........ "আমাননি" নামের মেয়েটা আমার কাছে জানতে চাইল, "চা বা কফি খাবে? বানিয়ে দেব?" আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম, "না থাঙ্কস, আমি ঠিক আছি". আমানি মিষ্টি একটা মেয়ে বয়েস কত বোঝার উপায় নাই - মানসিক প্রতিবন্ধী সে। নাক দিয়ে ক্রমাগত সর্দি পরছে, অন্য কোনো beheaviour নেই তবে শারীরিক গরনে বোঝা যায় সে মানসিক প্রতিবন্ধী। আমি সোফায় বসে অপেক্ষা করছি। হঠাত আমানি এসে আমাকে হাগ করলো .......আমার হার্ট বিটের শব্দ এবার আমি নিজেই শুনতে শুরু করেছি, মাথার ভেতর বো বো শব্দ হচ্ছে। সে আমার পাশে এসে আমার হাত ধরে বসলো। আমি আস্তে আস্তে নিজেকে শান্ত করছি .....মনে মনে বলছি I am alright, I am alright, I am alright.
Kurt আসলো, আমাকে Alisha র কাছে নিয়ে গেল, ইন্টারভিউ হয়ে গেলো। আমি এখানে কাজ করতে এসেছি, আমার নতুন জব। জেনে এসেছিলাম এইটা একটা age care organisation, এখন শুনছি এটা disability care organisation. একটা কাজ আমার সেই মুহুর্তে খুব দরকার ছিল, খুবই! সিডনিতে মুভ করে আসার পরে তখনো কোনো কাজ জোটে নাই. Kurt যখন আমাকে ইনডাকশন দিচ্ছিল হঠাত অনুভব করলাম কেউ একজন শক্ত হাতে আমার কনুইয়ের ভেতর দিয়ে হাত গলিয়ে আমার হাতটা শক্ত ভাবে ধরে আমার গায়ে ভর দিয়ে দাড়ালো, আমি জীবনে এত ভয় কোনদিন পাই নাই। ঘার ঘুরিয়ে দেখলাম কদাকার চেহারা একটা মুখ, যার ঠোট গুলো বীভত্স হয়ে উল্টে আছে, কান দুটো বিকৃত ভাবে দুমড়ে মুচড়ে আছে যার অর্ধেকটাই নেই। মাথায় কোনো চুল নেই, কোনো সেন্স নেই, কথাও বলতে পারে না, একটা বিভত্স চেহারার মানুষ। ভয়ে আমার সারা শরীর হিম হয়ে গেল। আমি অনেক কষ্টে আমার গলা দিয়ে বের হয়ে আসতে চাওয়া চিত্কার টা গিলে ফেললাম। Maichel, - পেছন থেকে এসে আমার একটা পাশ জড়িয়ে ধরে শরীরের পুরো ভার আমার উপর দিয়ে দাড়িয়ে আছে, একরকম আমার গায়ে ঝুলে আছে বললে ভালো হয়। আমি আমাকে মনে মনে ঠান্ডা করে ওর হাতের উপর আমার হাত বুলিয়ে দিলাম। হাতের উপর তার তার অসংখ ক্ষত। হাত বুলাতে বুলাতে আমি Kurt এর induction নিচ্ছিলাম। আমার কানে কিছু যাচ্ছিল কিনা জানি না তবে মনে মনে আমি বলে চলেছি - I will be fine, I will be fine, I will be fine......I can take this challange ..........I am a very brave girl.
এরপর অনেক গুলো দিন পেরিয়ে মাসও পেরিয়ে গেছে। আমার দীর্ঘ জমকালো গ্রাফিক ডিজাইনারের কেরিয়ার ছেড়ে আমি এখন ডিসেবিলিটি সাপোর্ট ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করি. আমি কাজুয়াল থেকে পার্মানেন্ট স্টাফ হয়ে গেছি, Condell পার্ক ছেড়ে Ashfield placement হয়েছে। এখন আমি আর ভয় পাই না, এখন এদের মতো আরো অনেককে নিয়েই আমার দিন কেটে যায় কখন আমি নিজেও টের পাই না. আমার দিনগুলো কাটে ঠিক এইভাবে -
সকালে কাজে পৌছে অফিস এর কাজ গুলো গুছিয়ে নিতেই নুর্গুল চলে আসে. আমি কাছে গিয়ে মর্নিং বলতেই সে এসে আমার বুকে মুখ গুজে দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে দাড়ালো। একটা হাত দিয়ে আমার পিঠে চিমটি কেটে যাচ্ছে কঠিন মনোযোগের সাথে। আমি careful হলাম যেকোনো মুহুর্তেই সে আমার পেটে কামড়ে দিতে পারে জেনে। এটাই ওর behavior. সারাক্ষণ গলা ছেড়ে নানান সুরে সে চিত্কার করতে থাকে। মাঝে মাঝে ওর চিত্কারের পিচ মাথার ভেতরে ঢুকে ঘিলুতে নাড়া দিয়ে দেয়. আবার মন ভালো থাকলে সে কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ ডুবিয়ে আদর নেবে, ঠিক পরের মুহুর্তেই সে বুকের মধ্যে একটা কামড় বসিয়ে দেবে বা পিঠে বা হাতে কঠিন একটা চিমটি কেটে দেবে। আজ সারাদিন নুর্গুল আমাকে একটু পর পর এসে বুকে মুখ গুজে জড়িয়ে ধরেছিল একবারও চিমটি কাটেনি কামড় দেয়নি বা থাপ্পর দেয় নাই. মেয়েটা আজ নরম হয়ে ছিল. ২৭ বছরের মেয়েটা ৫ বছরের বাচ্চার ব্রেইন নিয়ে চলছে। এমন আরো অনেক অনেক আছে আমাদের সাইটে। কেউ verbal কেউ nonverbal, কেউ physical, কেউ mental, কেউ আবার both Disable.
এলেস্ক, ২৯ বছরের বিশাল সাইজের ছেলেটার মাথার ভেতরে ৪ বছরের একটা ব্রেইন। আমাকে দেখেই সে বলে ওঠে "Did you take your watch to the hospital"? কদিন পর পর সে যেখানে সেখানে পরে গিয়ে কঠিন কঠিন ভাবে ব্যথা পায়. এম্বুলেন্স তার খুব পছন্দ তাই কদিন পর পর ব্যথা পেয়ে সে খুশি হয়ে যায় এম্বুলেন্সে উঠে হসপিটাল যেতে পারবে জন্য। সে ছবি আঁকে - এলেক্স হসপিটালের বিছানায় শুয়ে আছে জানালা দিয়ে দেখা যায় পুলিশ এর গাড়ি যাচ্ছে, এম্বুলেন্স যাচ্ছে।
এই মানুষ গুলোর সাথে আমার দিন কাটে এখন. এদের Take Care করা, স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে চলতে শেখানো, আর সবার মত নরমাল জীবন যাপন করতে শেখানোই আমার কাজ. এদের নিয়ে এক একদিন এক এক program এ যাই. সব প্রোগ্রাম গুলোই ওদের goal এর উপর বেস করে প্লান করা হয়. যার যেই দিকটা Achieve করতে হবে তার Personal life plan সেভাবেই করা হয় আর আমরা সেটা ফলো করে ওদের take care করি. আমার এই নতুন জীবন নতুন কাজ আমার ভালো লাগা, আমার ভালবাসা এখন. জীবনের কাছে চাইবার আর কিছু নেই, নেই কোনো কমপ্লেইনও। বিধাতা আমাদের কতটা ভালোবেসে কতটা ভাগ্য দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তা এই মানুষ গুলো আর তাদের পরিবার দের দেখলে realize করা যায়.
পৃথিবীরে অনেক অনেক অসুখী মানুষের মাঝে আমি একজন অনেক অনেক সুখী মানুষ এখন
আমার কম্পিউটার এ আবার সেই আগের একবারের মত বাংলা ফন্ট লেখায় ঝামেলা হয়ে গেছে তাই বাংলা অক্ষর গুলো ঠিক মত আসছে না. এর জন্য অতন্ত্য দুক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:০৯