বই লেখাকালীন বিভিন্ন ঘটনা, অনুভূতি, বই লেখার উদ্দেশ্য, বইয়ের বিষয়বস্তু ইত্যাদি তথ্য সম্বলিত অনুচ্ছেদ বা কবিতা, যা বইয়ের একদম শুরুতে থাকে তাকেই মুখবন্ধ বলা হয়। লেখক যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে চান, তাদের নাম এখানে লিখে থাকেন। মুখবন্ধ থেকে বইয়ের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে একে পুরো বইয়ের সারসংক্ষেপও বলা যায়। পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করাই মুখবন্ধের মূল উদ্দেশ্য। একটা নতুন বইয়ের মুখবন্ধ পড়ে পাঠক সিদ্ধান্ত নিতে পারে বইটা সে পড়া শুরু করবে কিনা। মূলত মুখবন্ধ হচ্ছে একটা বইয়ের প্রাথমিক পরিচয়।
পবিত্র আল কোরআনের প্রথম সুরার নাম হচ্ছে আল্ ফাতিহা। فاتحة শব্দের অর্থ হচ্ছে মুখবন্ধ, সূচনা, আরম্ভ, সূত্রপাত, ভূমিকা, উপক্রমণিকা। যা দ্বারা কোন কিছু খোলা হয় তাকে فاتحة বলা হয়। পবিত্র আল কোরআন খুলতেই যে সুরাটি সর্বপ্রথম আসে তা হলো সুরাতুল ফাতিহা। সুরাটি অবতীর্ণ হওয়ার প্রাক্কাল সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। অনেকে বলেন এটি মাক্কী সুরা, অনেকে বলেন মাদানি আবার অনেকে বলেন এটি একবার মক্কায় ও একবার মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছেন। যেহেতু এটি পূর্নাঙ্গ অবতীর্ণ প্রথম সুরা তাই বুঝা যায় এটি শুরুর দিকে অবতীর্ণ মাক্কী সুরাগুলোর মধ্যে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এর আগে অন্যান্য সুরার কিয়দংশ অবতীর্ণ হয়েছে, পূর্ণাঙ্গভাবে হয়নি। সুরাতুল ফাতিহা সালাতে প্রতি রাকাতে তিলাওয়াত করা হয়। সাত আয়াত বিশিষ্ট সুরাটি সম্পর্কে সুরা হিজরে ৮৭ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَلَقَدْ ءَاتَيْنَـٰكَ سَبْعًۭا مِّنَ ٱلْمَثَانِى وَٱلْقُرْءَانَ ٱلْعَظِيمَ
And We have certainly given you, [O Muḥammad], seven of the often repeated [verses] and the great Qur’ān.
— Saheeh International
আর আমি তো তোমাকে দিয়েছি পুনঃপুনঃ পঠিত সাতটি আয়াত ও মহান কুরআন।
— Rawai Al-bayan

আলেমদের মাঝে মতভেদ আছে যে, অনেকে বলেন, ﷽ " বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম " সুরাতুল ফাতিহার আয়াত, অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন। দ্বিমত করার ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হচ্ছে যেহেতু ﷽ সুরা নামল এর ৩০ নং আয়াতের অংশ এবং তা আল কোরআনের প্রতিটি সুরার পূর্বেই তিলাওয়াত করা হয় তাই তা সুরাতুল ফাতিহার আয়াত নয়। সাত আয়াত বিশিষ্ট সুরাটিতে বাক্য সংখ্যা মোট তিনটি। প্রথম তিনটা আয়াত মিলে একটা বাক্য, শেষের তিনটা মিলে একটি ও মাঝে একটি। প্রথম বাক্যটি একটি বিবৃতিমূলক বাক্য। শেষেরটি অনুজ্ঞাবাচক বাক্য। প্রথম তিন আয়াতে রয়েছে আল্লাহ তায়ালার পরিচয়, শেষের তিন আয়াতে আল্লাহর নিকট বান্দার প্রার্থনা ও প্রার্থনার বিষয়বস্তু, মাঝে চতুর্থ আয়াত হচ্ছে প্রথম ও শেষ ভাগের সংযুক্তি । মূলত পুরো কোরআনে এই বিষয়েই সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে, তাই সুরাতুল ফাতিহাকে "উম্মুল কোরআন বা কোরআনের মা" বলা হয় অর্থাৎ আল কোরআনের মূল বিষয়বস্তু বা সারসংক্ষেপ।

আয়াত :১
ٱلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلْعَـٰلَمِينَ
[All] praise is [due] to Allāh, Lord of the worlds -
— Saheeh International
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টিকুলের রব।
— Rawai Al-bayan
আয়াতের প্রথম শব্দ الحمد (আল হামদ), ال+حمد. কোন অনুগ্রহের জন্য বা অনুগ্রহ ব্যতিত ঐচ্ছিক ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করাকে حمد বলে। এক্ষেত্রে প্রশংসার যোগ্য ব্যক্তি কারো প্রশংসার মুখাপেক্ষী বা দাবীদার নয়। যেমন এ পৃথিবীর নিখুঁত সৌন্দর্য দেখে এবং আপনাকে সেই সৌন্দর্য দেখার জন্য যে দৃষ্টিশক্তি দেয়া হয়েছে তার জন্য যদি কোন প্রশংসা করা হয় সেক্ষেত্রে حمد শব্দটিই যথার্থ। কারণ উভয় কাজ করার জন্য সৃষ্টিকর্তা কারো আজ্ঞাবহ নন। স্বেচ্ছায় তিনি এ পৃথিবী সৌন্দর্যমণ্ডিত করে সৃষ্টি করেছেন এবং আপনাকে দর্শনের জন্য দৃষ্টিশক্তি দিয়েছেন। প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা উভয়টাই একটা শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এখানে حمد শব্দটির পূর্বে ال যুক্ত করে বিশেষ্যটিকে জাতিবাচক বা সমষ্টিগত বিশেষ্য হিসেবে আনা হয়েছে । অর্থাৎ সংক্ষেপে الحمد মানে সকল প্রকার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা যা ঐচ্ছিক কোন ভালো কাজের জন্য করা হয়। لله শব্দটি ل+الله এর সমন্বয়ে গঠিত যার অর্থ আল্লাহর জন্য। الحمد لله অর্থ সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্য, এ কথাটির মাধ্যমে সকল প্রকার حمد শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য যে, مدح (মাদ্হ) শব্দটি প্রশংসা জ্ঞাপনের জন্য ও شكر (শুকর) শব্দটি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয় কিন্তু حمد (হামদ) শুধুই আল্লাহর জন্য বরাদ্দ। حمد শব্দের বিপরীত শব্দ ذم (যাম্ম) নিন্দা/ তিরস্কার ।رب العالمين হলো পূর্বে উল্লেখিত الله শব্দের বিশেষণ। رب শব্দটির অর্থ ছয়টি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। السيد (আল সায়্যিদ) নেতা, সার্বভৌম; المالك (আল মালিক) অধিকারী; المربي ( আল মুরব্বি) পালনকর্তা ; القيم ( আল কায়্যিম) তত্বাবধায়ক; المرشد ( আল মুরশিদ) পথপ্রদর্শক,শিক্ষক ; المنعم ( আল মুনঈম) অনুগ্রহশীল, নেয়ামতদাতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে رب এর অর্থ প্রভুই লিখা হয়। অর্থাৎ এমন একজন প্রভু যিনি তার অধীনস্থদের উপর সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী পথ প্রদর্শন করে, অনুগ্রহ দান করে নিজের তত্বাবধানে রাখেন। পরের শব্দ العالمين এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা হয়েছে আল্লাহ কিসের বা কার رب বা প্রভু। عالمين শব্দটি বহুবচন, এর একবচন عالم। এর আক্ষরিক অর্থ হল এমন কোন বস্তু যার দ্বারা কোন কিছুর জ্ঞান লাভ হয় অর্থাৎ জানার মাধ্যম বা জ্ঞান লাভের উপায়। আর পারিভাষিক অর্থ হল সৃষ্টিজগৎ। অর্থাৎ عالم হচ্ছে এমন সৃষ্টিজগৎ যার মাধ্যমে স্রষ্টা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। عالم এর বহুবচনে ين যোগ করা হয়েছে আর ون বাين জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণীর বহুবচনে ব্যবহৃত হয়, যেমনঃ মানবজাতি । এক্ষেত্রে رب العالمين মানে হয় জ্ঞানসম্পন্ন প্রাণীকূলের প্রভু। অর্থাৎ আল্লাহ জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন সকল প্রাণীকুলের প্রভু। সহজভাবে গোটা আয়াতের অর্থ হয় " সকল প্রকার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্য, যিনি সকল জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন জাতির রব্ব "।

আয়াতঃ ২
ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
The Entirely Merciful, the Especially Merciful,
— Saheeh International
যিনি পরম করুণাময় অতি দয়ালু।
— Taisirul Quran
এ আয়াতটি দুটি শব্দ রয়েছে এবং দুটি শব্দই আগের আয়াতের আল্লাহ শব্দের বিশেষণ। লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে উভয় শব্দের মূলভিত্তি একই। দুটি শব্দেরই মূল হচ্ছে رحم ، যার অর্থ গর্ভ, দয়া, অনুগ্রহ । খুব সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে যে দয়া করে তাকে راحم ( রাহিম) বলে। আর যার মধ্যে দয়ার গুণটি বিদ্যমান অর্থাৎ যে সবসময় দয়া করে তিনি হচ্ছেন رحيم (রাহীম)। এটি আরবি ব্যাকরণে এক প্রকার বিশেষণের কাঠামো, যেমনঃ যে বড় তার বিশেষণ كبير (কাবীর), যে সব সময় সাহায্য করে তার বিশেষণ نصير ( নাসীর)। এটি একটি স্থায়ী বিশেষণ। একে اسم صفة ( ইসম সিফাহ) বলে।
কিন্তু رحمان (রাহমান) শব্দটি একটু ব্যাতিক্রম। এই কাঠামোকে আরবীতে اسم مبالغة (ইসম মুবালাগাহ) বলে। মাত্রাতিরিক্ত কোন কিছু বুঝাতে এই কাঠামো ব্যবহৃত হয়। যেমনঃ কেউ যদি একটা সময় অত্যাধিক মাত্রায় দয়া করে, তখন সেই সময় তিনি হবেন رحمان. এটি কোন স্হায়ী বিশেষণ নয় বরং তাৎক্ষণিক, আপেক্ষিক ঘটনা। যেমনঃ আরবীতে তৃষ্ণার্ত কোন ব্যক্তিকে বলেন عاطش ( আতিশ) ، কিন্তু যখন বলা হবে প্রচণ্ড পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তখন বলতে হবে عطشان( আতশান)। পিপাসা মিটে গেলে আর আতশান থাকবে না। আবার কেউ রাগ করলে তাকে বলা হয় غاضب( গাদিব) কিন্তু যদি বলা হয় প্রচণ্ড রাগে আক্রমনাত্মক অবস্থা তখন হবে غضبان ( গাদবান)। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে আর গাদবান বলা যাবে না। অর্থাৎ ইসম মুবালাগাহ কাঠামো অত্যাধিক পরিমাণ বুঝায় কিন্তু তা সাময়িক।
আয়াতটিতে আল্লাহ الرحمان শব্দটি আগে বলেছেন এবং الرحيم শব্দটি পরে বলেছেন। যদি কেউ ধারণা করে الرحمان এর দয়া তো ক্ষণস্থায়ী তবে পরের শব্দ উল্লেখ করে যে আল্লাহ الرحيم, তার দয়া চিরস্থায়ী। আল্লাহ কেন নিজেকে الرحمان বলেছেন, পবিত্র কোরআনের সুরা আর্ রাহমান তা ব্যাখ্যা করে। ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন, আল্লাহর الرحمان নামটি এই দুনিয়ার জন্য আর الرحيم নামটি পরকালের জন্য কারণ ইহকাল ক্ষণস্থায়ী আর পরকাল চিরস্থায়ী।
প্রথম আয়াতে " রব " শব্দটি পড়ে যদি শ্রোতা বা পাঠক ভীতসন্ত্রস্ত হন, দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তার ভয় দুর করে দিয়েছেন। খুব সাধারণতই রব কথাটা শুনলে দাস প্রথার মালিকের কথা মাথায় আসে, যে তার দাসের উপর কঠোর ও নির্দয়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলেছেন তিনি الرحمان, الرحيم ، অত্যাধিক দয়ালু, অশেষ দয়ালু।

আয়াতঃ ৩
مَـٰلِكِ يَوْمِ ٱلدِّينِ
Sovereign of the Day of Recompense.
— Saheeh International
যিনি প্রতিফল দিবসের মালিক।
— Taisirul Quran
এ আয়াতটিও প্রথম আয়াতের আল্লাহ শব্দের বিশেষণ। مالك অর্থ অধিকারী। যার মালিকানায় কোন জিনিস রয়েছে তাকে সেই জিনিসের مالك (মালিক) বলে। মূলকথা কোন বস্তুর একচ্ছত্র অধিকারী হচ্ছে সেই বস্তুর মালিক। এই আয়াতে আল্লাহ নিজেকে يوم الدين (ইয়াওমিদ্দীন) এর মালিক বলেছেন। يوم (ইয়াওম) শব্দের অর্থ দিন বা সময়। আর دين (দীন) আভিধানিক অর্থ ধর্ম, প্রথা, বিচার, প্রতিদান, আনুগত্য। সেই হিসেবে يوم الدين অর্থ দাঁড়ায় বিচার / আনুগত্যের / প্রতিদান দিবস/ সময়। কিন্তু মহান আল্লাহ সুরা ইনফিতারে স্বয়ং يوم الدين এর ব্যাখ্যা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা সুরা ইনফিতারের ১৭,১৮ নং আয়াতে জিজ্ঞেস করেছেন, " তুমি কি জানো ইয়াওমিদ্দীন কি? আবার বলি তুমি কি জানো ইয়াওমিদ্দীন কি? " অতঃপর ১৯ নং আয়াতে আল্লাহ নিজেই উত্তর দিয়েছেন,
يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌۭ لِّنَفْسٍۢ شَيْـًۭٔا ۖ وَٱلْأَمْرُ يَوْمَئِذٍۢ لِّلَّهِ ١٩
It is the Day when a soul will not possess for another soul [power to do] a thing; and the command, that Day, is [entirely] with Allāh.
— Saheeh International
সেদিন কোন মানুষ অন্য মানুষের জন্য কোন কিছুর ক্ষমতা রাখবে না। আর সেদিন সকল বিষয় হবে আল্লাহর কর্তৃত্বে।
— Rawai Al-bayan
দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ যে الرحمان الرحيم, তা জানতে পেয়ে যদি কেউ যাচ্ছেতাই আচরণ করে তাদের জন্য সতর্কতা বাণী এই তৃতীয় আয়াতে। আল্লাহ এমন দিনের একচ্ছত্র অধিকারী যেদিন কোন প্রাণীর কিছুমাত্র আধিপত্য থাকবে না, সকল কর্তৃত্ব সেদিন আল্লাহরই থাকবে।

আয়াতঃ ৪
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
It is You we worship and You we ask for help.
— Saheeh International
আমরা কেবল তোমারই ‘ইবাদাত করি এবং কেবলমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
— Taisirul Quran
এই আয়াতটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশ إياك نعبد ( ইয়্যাকা না'বুদু)। إياك অর্থ শুধুই আপনার/ আপনাকে । আর نعبد অর্থ আমরা দাসত্ব করি / করবো। আরবী ব্যাকরণে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ কাল এক কাঠামোতে আসে। সেই হিসেবে এই অংশের অর্থ দাঁড়ায় "আমরা শুধুমাত্র আপনারই দাসত্ব করি / আমরা শুধুমাত্র আপনারই দাসত্ব করবো / আমরা শুধুমাত্র আপনারই দাসত্ব করি, আপনারই দাসত্ব করবো "। অর্থাৎ বর্তমানেও আপনার দাসত্ব করছি এবং ভবিষ্যতেও করবো। نعبد শব্দটার ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য যদি عبادة (ইবাদাহ্/ ইবাদত) হয়, তখন অর্থ হয় " দাসত্ব/ উপাসনা / সেবা করা"। ইবাদত শব্দের অাভিধানিক অর্থ হলো অতিশয় বিনয় ও নম্রতা এবং অতীব লাঞ্ছনাবস্থা প্রকাশ করা। আবার যদি نعبد শব্দের ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য عبودة، عبودية ( উবুদাহ্, উবুদিয়্যাহ্) হয়, তখন অর্থ হয় "পূর্বপুরুষ থেকে দাস হওয়া " অর্থাৎ উত্তরাধিকার সূত্রে দাসত্বের বৈশিষ্ট্য পাওয়া। উভয় ক্ষেত্রে ক্রিয়ামূল হচ্ছে عبد (আবদ) যার অর্থ দাস। আর উভয় ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য সংমিশ্রণ করলে إياك نعبد এর অর্থ হয়, " পূর্বপুরুষ হতে আমরা একমাত্র আপনারই দাসত্ব করছি এবং আপনারই দাসত্ব করবো "। একটা উদাহরণের সাহায্যে বাক্যগঠন রীতিআরেকটু পরিস্কার হওয়া যায়। যেমনঃ
১. সে লাল কলম দ্বারা লিখে।
২. লাল কলম দ্বারাই সে লিখে।
এখানে প্রথম বাক্যে নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, সে অন্য কলম দ্বারা লিখে না। কিন্তু দ্বিতীয় বাক্য এটা নিশ্চিত করে যে, সে যখনই লিখে কেবল লাল কলম দ্বারাই লিখে, কখনই অন্য কলম নেয় না।
এই আয়াতটি দ্বিতীয় বাক্যের রীতি অনুসারে এসেছে। অর্থাৎ দাস কেবলমাত্র আল্লাহরই দাসত্ব করে। অন্য কারো নয়, কস্মিনকালেও নয়। এর বিপক্ষে সব ধরনের দাসত্ব অস্বীকৃত, এমনকি নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণও। কারণ একজন ক্রীতদাস তার মনিবের মালিকানাধীন। মনিব চাইলে তার দাসকে বাঘের খাঁচায় দিতে পারে, চাইলে তার দাসীকে অবগুণ্ঠনে আবদ্ধ করতে করতে পারে। দাস/ দাসী দ্বিমত করার কোন সুযোগ নেই কারন দাসের কোন স্বাধীন ইচ্ছা থাকে না, মনিবের ইচ্ছে মত তার জীবনযাপন করতে হয়।
আয়াতের শেষ অংশটুকু إياك نستعين। এ অংশটুকুও প্রথম অংশের ধারা অনুযায়ী হয়েছে। نستعين ( নাসতাঈন) অর্থ আমরা সহযোগিতা প্রার্থনা করি / করবো । এ শব্দটির ক্রিয়ামূল হচ্ছে عون ( আউন)। عون অর্থ সহায়তা বা সহযোগিতা। এ ধরনের সহযোগিতা দুই প্রকার, অত্যাবশ্যকীয় সহযোগিতা ও অনাবশ্যকীয় সহযোগিতা। কোন কর্ম সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি ও সক্ষমতা দিয়ে সহযোগিতা করাকে অত্যাবশ্যকীয় সহযোগিতা বলে। আর কর্মকে সহজভাবে সম্পন্ন করার জন্য যে সহযোগিতা করা হয় তা অনাবশ্যকীয় সহযোগিতা। উভয়ক্ষেত্রে কর্তা নিজেই কর্মসম্পাদনে সচেষ্ট ভুমিকা পালন করে। সাহায্যকারী তাকে শুধু কর্মসম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সহজ পদ্ধতি দিয়ে সহযোগিতা করেন। অতএব إياك نستعين মানে হয় " আমরা কেবল আপনারই কাছে সক্ষমতা ও সহজ সাধনের সহযোগিতা প্রার্থনা করি, করবো"। আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারার ৪৫ ও ১৫৩ নং আয়াতে তার নিকট সহযোগিতা চাওয়ার পদ্ধতি ব্যক্ত করেছেন।
وَٱسْتَعِينُوا۟ بِٱلصَّبْرِ وَٱلصَّلَوٰةِ ۚ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى ٱلْخَـٰشِعِينَ ٤٥
And seek help through patience and prayer; and indeed, it is difficult except for the humbly submissive [to Allāh]
— Saheeh International
তোমরা ধৈর্য্য ও সলাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর, আর তা আল্লাহভীরু ব্যক্তিবর্গ ছাড়া অন্য সকলের কাছে নিশ্চিতভাবে কঠিন।
— Taisirul Quran
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱسْتَعِينُوا۟ بِٱلصَّبْرِ وَٱلصَّلَوٰةِ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّـٰبِرِينَ ١٥٣
O you who have believed, seek help through patience and prayer. Indeed, Allāh is with the patient.
— Saheeh International
হে মু’মিনগণ! ধৈর্য ও সলাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।
— Taisirul Quran
প্রথম তিন আয়াতে আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারে, চতুর্থ আয়াতে শুরুর অংশে দাস বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য আল্লাহর একক দাসত্ব গ্রহন করে নেয় এবং শেষ অংশে দাসত্ব করার জন্য তারই নিকট সহযোগিতা প্রার্থনা করে/ করবে বলে ঘোষণা দেয় । এক্ষেত্রে বুঝা যায় কোন বিষয়ে বারবার কোন ব্যক্তির কাছে সহায়তা কামনা করাও সমীচীন নয়। দুই একবার সাহায্যের কথা মনে করে দেয়া যেতে পারে কিন্তু বারবার একই বিষয়ে সাহায্য কামনা করা মানে আল্লাহ ব্যতিত সেই ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া।

আয়াত ঃ৫
ٱهْدِنَا ٱلصِّرَٰطَ ٱلْمُسْتَقِيمَ ٦
Guide us to the straight path -
— Saheeh International
আমাদেরকে সরল পথ দেখান। পথের হিদায়াত দিন।
— Rawai Al-bayan
এ আয়াতে আল্লাহর নিকট পথের সন্ধান প্রার্থনা করা হয়েছে। اهدنا ( ইহদিনা) শব্দের ক্রিয়ামূল হচ্ছে هدي ( হাদয়ুন) অর্থ পথ, দিক নির্দেশনা, পদ্ধতি, চরিত্র, ধরন, হেদায়েত। আর ইহদিনা অর্থ আমাদের পথ দেখান/দিক নির্দেশনা দিন/ পদ্ধতি / চরিত্র দেখান। صراط অর্থ পথ / রাস্তা / পদ্ধতি এবং مستقيم অর্থ সরল / সোজা/ ঊর্ধ্বমুখী / সঠিক/ প্রতিষ্ঠিত । صراط مستقيم এমন পথ / পদ্ধতিকে বলে যা সরল/ সোজা / সঠিক প্রতিষ্ঠিত । অর্থাৎ আয়াতের অর্থ হয় " আমাদের পথ/ পদ্ধতি / চরিত্র দেখান / দিক নির্দেশনা দিন যা সরল, প্রতিষ্ঠিত পথ / পদ্ধতি "। আল্লাহ তায়ালা সুরা ইয়াসিন এর ৬১ নং আায়াতে বলেন,
وَأَنِ ٱعْبُدُونِى ۚ هَـٰذَا صِرَٰطٌۭ مُّسْتَقِيمٌۭ ٦١
And that you worship [only] Me? This is a straight path.
— Saheeh International
আর আমারই ইবাদাত কর। এটিই সরল পথ।
— Rawai Al-bayan
এই আয়াতে আল্লাহর দাসত্বকে সিরাত্বাল মুসতাকীম বলা হয়েছে। সুরা আনআম এ রাসুলুল্লাহ ﷺ কে উদ্দেশ্য করে বলেন,
قُلْ إِنَّنِى هَدَىٰنِى رَبِّىٓ إِلَىٰ صِرَٰطٍۢ مُّسْتَقِيمٍۢ دِينًۭا قِيَمًۭا مِّلَّةَ إِبْرَٰهِيمَ حَنِيفًۭا ۚ وَمَا كَانَ مِنَ ٱلْمُشْرِكِينَ ١٦١
Say, "Indeed, my Lord has guided me to a straight path - a correct religion - the way of Abraham, inclining toward truth. And he was not among those who associated others with Allāh."
— Saheeh International
বল, ‘নিশ্চয় আমার রব আমাকে সোজা পথের হিদায়াত দিয়েছেন। তা সুপ্রতিষ্ঠিত দীন, ইবরাহীমের আদর্শ, সে ছিল একনিষ্ঠ এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ ছিল না’।
— Rawai Al-bayan
আল কোরআনে (৪২ঃ৫২) (৩৬ঃ৪) (৪৩ঃ৪৩) আয়াত সমূহ লক্ষ্য করলে উপলব্ধি করা যায় যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ ছিলেন সিরাতাল মুস্তাকীমের প্রাণবন্ত সংজ্ঞা । অর্থাৎ সুরাতুল ফাতিহা এর পঞ্চম আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লাহ তায়ালা তার একক দাসত্ব করা ও নবীজীর জীবনাদর্শকে সিরাতাল মুস্তাকীম বলে উল্লেখ করেছেন।
আয়াতঃ ৬
صِرَٰطَ ٱلَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ
The path of those upon whom You have bestowed favor,
— Saheeh International
তাদের পথ, যাদের উপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন।
— Rawai Al-bayan
এ আয়াতে أنعمت শব্দের ক্রিয়াবিশেষ্য إنعام (ইনআম), যার অর্থ দান, অনুগ্রহ, পুরস্কার। দাস তার মনিবের নিকট ঐ পথ প্রদর্শন করার আহ্বান করছেন, যে পথে চলার কারণে মনিব তার দাসদের ইতোপূর্বে অনুগ্রহ করেছিলেন / পুরস্কৃত করেছিলেন অর্থাৎ দাসের উপর সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সুরা নিসার ৬৯ নং আয়াতে আল্লাহ তার অনুগ্রহপ্রাপ্ত দাসদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন।
وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ مَعَ ٱلَّذِينَ أَنْعَمَ ٱللَّهُ عَلَيْهِم مِّنَ ٱلنَّبِيِّـۧنَ وَٱلصِّدِّيقِينَ وَٱلشُّهَدَآءِ وَٱلصَّـٰلِحِينَ ۚ وَحَسُنَ أُو۟لَـٰٓئِكَ رَفِيقًۭا ٦٩
And whoever obeys Allāh and the Messenger - those will be with the ones upon whom Allāh has bestowed favor of the prophets, the steadfast affirmers of truth, the martyrs and the righteous. And excellent are those as companions.
— Saheeh International
আর যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে তারা তাদের সাথে থাকবে, আল্লাহ যাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীলদের মধ্য থেকে। আর সাথী হিসেবে তারা হবে উত্তম।
— Rawai Al-bayan
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ব্যাখ্যা করেছেন, যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করবে, তারাই তার অনুগ্রহ পাবে। এবং অনুগত দাসরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত দাসদেরই সাথী হিসেবে পাবে।

আয়াতঃ ৭
غَيْرِ ٱلْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا ٱلضَّآلِّينَ ٧
not of those who have earned [Your] anger or of those who are astray.
— Saheeh International
যাদের উপর (আপনার) ক্রোধ আপতিত হয়নি এবং যারা পথভ্রষ্টও নয়।
— Rawai Al-bayan
এ আয়াতে দাস তার মনিবের নিকট ঐ সমস্ত দাসদের পথ না দেখানোর ফরিয়াদ করেছেন, যারা مغضوب (মাগদূব) ও ضال (দল্লীন)। দুটি উদাহরনের মাধ্যমে শব্দ দুটি বিশ্লেষণ করা যাক।
১. রহিম করিমের উপর রাগ করেছে, এখানে রহিম হল غاصب ( গাদিব) আর করিম হল مغصوب ( মাগদূব)।
২. রহিমকে তার শিক্ষক করিমের বাড়ি যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পথ দেখিয়ে দিলেন, কিন্তু রহিম ভুলক্রমে বা ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য পথ ধরে চললেন, এখন রহিম হল ضال ( দল্লীন)।
কতিপয় আয়াতে আল্লাহ তার ক্রোধে আপতিত দাসদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন,
সীমালঙ্ঘনকারী (৩ঃ১১২) (২০ঃ৮১)
আত্মাবিক্রেতা (২ঃ৯০)
মুমিন হত্যাকারী(৪ঃ৯৩)
স্বেচ্ছায় কুফর অবলম্বনকারী(১৬ঃ১০৬)
তাগুতের পূজারী (৫ঃ৬০)
বাছুর পুজারী (৭;১৫২)
আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণকারী (৪৮ঃ৬)
আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ককারী (৪২ঃ১৬)
আল্লাহর নিদর্শন অস্বীকারকারী (২ঃ৬১)(৭ঃ৭১,৭২)(৩ঃ১১২)
যুদ্ধের ময়দান থেকে পলাতক (৮ঃ১৬)
মূসার সম্প্রদায় (২ঃ৬১)
হুদের সম্প্রদায় (৭ঃ৭১)
সুরা আলে ইমরান এর ৯০ নং আয়াতে আল্লাহ ضال এর পরিচয় তুলে ধরেছেন।
إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ بَعْدَ إِيمَـٰنِهِمْ ثُمَّ ٱزْدَادُوا۟ كُفْرًۭا لَّن تُقْبَلَ تَوْبَتُهُمْ وَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلضَّآلُّونَ ٩٠
Indeed, those who disbelieve [i.e., reject the message] after their belief and then increase in disbelief - never will their [claimed] repentance be accepted, and they are the ones astray.
— Saheeh International
নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনার পর কুফরী করল, অতঃপর তাদের কুফরী বেড়েই চলল, তাদের তাওবাহ কক্ষনো কবুল করা হবে না এবং এ লোকেরাই পথভ্রষ্ট।
— Taisirul Quran
Special thanks to:
Ustad Nouman Ali Khan
Dr. Israr Ahmed
Tafsir -a- baidawi
Al wafi dictionary
Muslim Bangla app
Quran.com ৷
ছবিঃ কাটছাট from Google
[বি.দ্র. পোস্টে যদি সঠিক ও কল্যানকর কিছু লিখে থাকি, তবে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আর যদি ভুল ও মিথ্যা কিছু লিখে থাকি তা আমার অজ্ঞতা। পাঠকের গঠনমূলক সমালোচনা আমার ভুল সংশোধনে সহায়তা করবে বলে আশা পোষণ করছি। ]
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ১২:৩১