somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনসঙ্গী

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ১২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মানবজাতির মাঝে সর্বপ্রথম যে সম্পর্কটি সৃষ্টি হয় তার নামই জীবনসঙ্গী । কোন পথে হাঁটার সময় যদি কেউ পাশে থাকে তখন পথটা যতই কঠিন আর অপরিচিত হোক না কেন স্বাচ্ছন্দে কেটে যায়, তেমনি জীবনপথে চলতে গেলে একজন জীবনসঙ্গীও জীবনকে সহজ করে দেয়। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর বুকে একজন উত্তম জীবনসঙ্গীর সাহচর্য চিরস্থায়ী সুখের স্থান জান্নাতের পথ সুগম ও সহজ করে, জরাজীর্ণ পৃথিবীর হাজারো অশান্তির মাঝে উত্তম জীবনসঙ্গী যেন তীব্র গরমে এক পশলা ঝুম বৃষ্টির মত, যা হৃদয় ও পরিবেশ স্নিগ্ধ শীতল করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা প্রথম নর আদমকে সৃষ্টি করার পর , তার একাকিত্ব দুর করার জন্য তার জীবনসঙ্গী হিসেবে প্রথম নারী হাওয়াকে সৃষ্টি করেন, যারা আমাদের আদি পিতামাতা (আলাইহিমাস্সালাম), তাদের বংশ বিস্তারের ফলে আজ মানবসভ্যতা এ পর্যন্ত এসেছে। বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে এক যুগল নারী পুরুষ একসঙ্গে জীবন কাটানোর জন্য দাম্পত্য জীবন শুরু করে। Samuel Johnson এর মতে,
"Marriage has many pains but Celibacy has no pleasure".

নারী ও পুরুষ একদমই ভিন্ন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন দুটি সত্তা এবং তাদের বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন। উভয়ের সৃষ্টি প্রক্রিয়া থেকে তা আরো সুস্পষ্ট হয়। প্রথম সৃষ্ট মানবই একজন পুরুষ। পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব করার জন্যই পুরুষের সৃষ্টি হয়। তার দেহাবয়ব, অভ্যন্তরীণ গঠন প্রক্রিয়া, স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, মনমেজাজ নারীদের চেয়ে ভিন্ন। আর নারী হচ্ছে স্রষ্টার সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি। একজন পুরুষের জীবনে পূর্ণতা এনে দেয় একজন নারী, তেমনি একজন পুরুষ একটি মেয়েকে নারীতে রূপান্তর করতে বিশেষ ভুমিকা রাখে। পবিত্র কোরআনে নারীকে পুরুষের জন্য শস্যক্ষেত বলা হয়েছে। Dr.Myles Munroe এর ছোট্ট ক্লিপটি এই রূপকটির চমৎকার ব্যাখ্যা করে।

পুরুষ সৃষ্টিগতভাবেই নিজের আনুগত্য করাকে পছন্দ করে, নারী পছন্দ করে আদর, যত্ন, প্রশংসা। পরিস্থিতি যতই বিরূপ হোকনা কেন, হৃদয়গ্রাহী কথন নারীর হৃদয়কে পুলকিত করে। পুরুষ নারী বলতেই মুগ্ধ। নারী হতে পারে রূপবতী কিংবা গুণবতী কিংবা জ্ঞানবতী। একের মাঝে তিনের সমাহার না মিললেও কোন একটিতো সে অবশ্যই। নারীর পায়ের নখের থেকে শুরু করে মাথার চুল অবধি সৌন্দর্য মণ্ডিত। সে হাসলে যদি মুক্তা ঝরে তবে তার অশ্রু হৃদয়ে ঝড় এনে দেয়। তার রূপের মোহে যদি কেউ বিমোহিত হয়ে পড়ে, গুনের বদৌলতে সে চিত্ত হরণ করে, আর জ্ঞানের আলোতে কারো জীবন আলোকিত করে। এক্ষেত্রে Alexander Pope এর The Rape of the lock এর পংক্তিটি প্রণিধানযোগ্য:
" Beauties in vain their pretty eyes may roll;.
Charms strike the sight, but merit wins the soul.".




বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে মানুষের বহুবিধ কল্যাণ সাধিত হয় । তদ্রূপ দাম্পত্য জীবন মানুষের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা পূরণ করতে নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মানুষের শারীরিক চাহিদা, মানসিক চাহিদা, সামজিক চাহিদা ও আধ্যাতিক চাহিদা।

শারীরিক চাহিদা পূরণ :

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক চাহিদার মতই মানুষের দৈহিক বা শারীরিক চাহিদা। সৃষ্টির নিয়ম অনুযায়ী একটা বয়সে নারী পুরুষ একে অপরের চাহিদা অনুভব করে আর এই চাহিদা পূরণ করাই বিবাহ বন্ধনের অন্যতম মূখ্য উদ্দেশ্য।

যারা নিজ লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে, নিজেদের স্ত্রী ও তাদের মালিকানাধীন দাসীদের ছাড়া অন্য সকলের থেকে , কেননা এতে তারা নিন্দিত হবে না। তবে কেউ এদেরকে ছাড়া অন্য কিছু কামনা করলে তারাই হবে সীমালঙ্ঘনকারী।
(আল কোরআন-২৩:৫, , ৭)
(অনুবাদ— মুফতি তাকী উসমানী)

এই সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মানবসভ্যতা বংশবিস্তারের ফলে পৃথিবীর বুকে টিকে আছে। সুখী দাম্পত্য জীবনে শারীরিক সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সুস্থ শারীরিক সম্পর্ক স্বামী স্ত্রীর মাঝে যে কোন কলহ দুর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে উভয়ের বোঝাপড়া ও সহনশীলতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ থেকে বুঝা যায়, ' বৈবাহিক ধর্ষণ ' কথাটি পুরোপুরি অবান্তর। নারী পুরুষ ভেদে শারীরিক চাহিদার তীব্রতার সময়সীমা ভিন্ন হয়ে থাকে, যদিও ব্যক্তিভেদে খাদ্য চাহিদার মত দৈহিক চাহিদাও ভিন্ন রকম। সময়ের কালক্রমে পৃথিবীর সব কিছুই তার পূর্বের জৌলুশ হারায় তদ্রূপ এক্ষেত্রেও একই ঘটে। তবে সার্বিকভাবে সুস্থ থাকলে একেবারে নিঃশেষ হয় না। ৮০ বছরের বৃদ্ধ যেমন বিয়ে করার সক্ষমতা রাখে, তেমনি বয়োঃবৃদ্ধ নারীও আকাঙ্খা অনুভব করতে পারে। তবে তা যৌবনের সময়ের মত তীব্র হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে পুরুষের চাহিদা বেশি থাকে ১৮ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত, কিন্তু এ বয়সে নারীদের মাঝে লাজুকতা বেশি থাকে। আরেক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২৭ থেকে ৪৫ বছরের নারীদের মাঝে চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে (MedicineNet), যে সময়ে পুরুষরা কাজকর্ম নিয়ে অধিক ব্যস্ত থাকে। এতে এক প্রকার অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয় , যার ফলে উভয়ের মাঝে বোঝাপড়ার ও সহনশীলতার অভাবে তিক্ততা সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে তারা 'পরকিয়া' নামক ব্যধির দিকে ঝুঁকে পড়ে। যেটি দাম্পত্য জীবনে ভয়াবহ মরণব্যাধি ক্যান্সারের অনুরূপ। এই ব্যাধি থেকে পরিত্রাণের সর্বোত্তম প্রতিষেধক হচ্ছে দৃষ্টির সংরক্ষণ।

মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।(আল কোরআন-২৪:৩০)
(অনুবাদ— Rawai Al-bayan)

আর মুমিন নারীদেরকে বলে দাও তাদের দৃষ্টি অবনমিত করতে আর তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করতে, আর তাদের শোভা সৌন্দর্য প্রকাশ না করতে যা এমনিতেই প্রকাশিত হয় তা ব্যতীত। তাদের ঘাড় ও বুক যেন মাথার কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভাই-এর ছেলে, বোনের ছেলে, নিজেদের মহিলাগণ, স্বীয় মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনামুক্ত পুরুষ আর নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া অন্যের কাছে নিজেদের শোভা সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজেদের গোপন শোভা সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবাহ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (আল কোরআন-২৪:৩১)
(অনুবাদ— Taisirul Quran)



মানসিক চাহিদা পূরণ :

কোন মানুষই একা থাকতে চায় না। যৌবনের শুরুতে আঘাতপ্রাপ্ত হৃদয়টাও পরিপক্ব বয়সে একটা বিশ্বস্ত হাত/কাঁধ খুঁজে পেতে চায়। পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষই চায় তার জীবনে এমন একজন বন্ধু থাকুক যার সাথে অকপটে সব কিছু শেয়ার করা যায়। যে তার না বলা ব্যথাটাও বুঝতে পারবে। যার সাথে যে কোন বিষয় পরামর্শ করা যাবে, সমস্যায় কোন সমাধান না দিতে পারলেও অস্থির চিত্তে প্রশান্তি আনতে পারবে। তার পাশে বসলেও এক প্রকার স্বস্তি অনুভূত হবে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য তার সঙ্গী নির্ধারণ করেছেন যাতে তার সংস্পর্শে সে শান্তি লাভ করতে পারে। শারীরিক চাহিদা কালক্রমে কমতে থাকে কিন্তু মানসিক প্রশান্তির চাহিদা মানুষের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলবৎ থাকে। জীবনসঙ্গীর সংস্পর্শে যত বেশি মানসিক প্রশান্তি মেলে তত বেশি দাম্পত্য সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। বর্তমান যুগে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, মানুষ কেবলই দাম্পত্যকে বয়ে বেড়ায়, রিপুর তারণায় শারীরিক সম্পর্ক থাকলেও মনের জগতে একে অপরের উপস্থিতি বিরল। সোশ্যাল মিডিয়ায় কিংবা বন্ধু মহলে মানুষ যতটা সরব তার অর্ধেকটা সময় যদি পরস্পরের সাথে গল্পগুজব, খুনসুটি কিংবা দৈনন্দিন জীবনের ভালোমন্দ শেয়ার করে কাটাতো তবে দাম্পত্য সম্পর্ক অনেক মজবুত হতো। কোন মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, ভুলত্রুটির সন্নিবেশেই মানুষ। এক জনের কাছে অপরজনের সবকিছুই মনঃপুত হবে তা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। তারপরও একে অপরের ভালোলাগার দিকগুলোর প্রতি অধিক মনোযোগ দিয়ে অন্যদিকগুলো উপেক্ষা করতে পারলে উভয়ের জন্য সহজ হয়।

তাদের সাথে দয়া ও সততার সঙ্গে জীবন যাপন কর, যদি তাদেরকে না-পছন্দ কর, তবে হতে পারে যে তোমরা যাকে না-পছন্দ করছ, বস্তুতঃ তারই মধ্যে আল্লাহ বহু কল্যাণ দিয়ে রেখেছেন। (আল কোরআন-৪:১৯)
(অনুবাদ— Taisirul Quran)



তাঁর নিদর্শনের মধ্যে হল এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের সঙ্গিণী সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তার কাছে শান্তি লাভ করতে পার আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এর মাঝে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে।(আল কোরআন-৩০:২১)
(অনুবাদ— Taisirul Quran)

একজন সঙ্গী ব্যতিত জান্নাতেও মানুষ বিষন্ন অনুভব করে। একজন পুরুষের জীবনে একজন নারীর আর নারীর জীবনে পুরুষের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য , একের জীবনে শান্তির জন্য অপরের উপস্থিতি অপরিহার্য। জীবনের কঠিন মুহূর্তে জীবনসঙ্গীর মনভোলানো কথা, অনুপ্রেরণা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লড়াই করার এক প্রকার মানসিক শক্তি যোগায়। দাম্পত্য জীবনে এই মানসিক প্রশান্তি কেবল চাইলেই পাওয়া যায় না। তার জন্য স্রষ্টার নিকট প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করে যেতে হয়। উস্তাদ নোমান আলী খান এর দুই মিনিটের এই ভিডিওটি বেশ সুন্দরভাবে তা বুঝিয়ে দেয়।

(আল কোরআন-২৫:৭৪)
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَٰجِنَا وَذُرِّيَّـٰتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍۢ وَٱجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا


"Our Lord, grant us from among our wives and offspring comfort to our eyes1 and make us a leader [i.e., example] for the righteous."
(অনুবাদ— Saheeh International)
হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান কর যারা আমাদের চোখ জুড়িয়ে দেয় আর আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দাও।
(অনুবাদ— Taisirul Quran)




সামাজিক চাহিদা পূরণ :

বিবাহ বন্ধনের ফলে মানুষের জীবনসঙ্গীর সাথে সামাজিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। সমাজে সে বিবাহিত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিবাহিত নারী পুরুষের প্রতি অন্য মানুষের বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়, যেদিকে অবিবাহিতদের মানুষ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। Francis Bacon এর মতে, "single men, though they may be many times more charitable, because their means are less exhaust, yet on the other side, they are more cruel and hardhearted".
দাম্পত্য জীবন মানুষের সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধি করে। সামাজিক রীতিমতো বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে মানুষ তার জীবনসঙ্গীর সংস্পর্শে বংশবৃদ্ধির ফলে মানবসভ্যতার বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি মানুষের উপরই কতিপয় দায়িত্ব ন্যাস্ত থাকে। দাম্পত্য সম্পর্কের ফলে পরস্পর পরস্পরের দায়িত্ব পালনে সাধ্যমত সাহায্য করে থাকে। এতে তাদের সম্পর্ক আরো সুন্দর হয়। বিবাহের মাধ্যমে একজন পুরুষ একজন নারীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়। সেই সাথে তার আদর যত্নের কোন অবহেলা না করার অঙ্গীকার করে। তদ্রূপ একজন নারীও তার স্বামীর অনুগত থেকে নিজের দায়িত্ব কর্তব্য পালনে সচেষ্ট থাকে। চলার পথে একজনকে পথের দিশারি ও অন্যদের তার অনুসারী হতে হয়, সকলেই যদি অধিনায়কত্ব করার চেষ্টা করে তবে গন্তব্যে পৌঁছানো অসম্ভব। ইসলাম তাই দাম্পত্য জীবনে পুরুষকে দিশারি ও নারীকে অনুসারীর দায়িত্ব দিয়েছেন। দিশারি যদি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেয় তখন অনুসারীর কর্তব্য তাকে সঠিক পরামর্শ দেয়া এবং দিশারীর উচিত তার পরামর্শ যথাযথ মূল্যায়ণ করা।

পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক, এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু তারা নিজদের সম্পদ থেকে ব্যয় করে। সুতরাং পুণ্যবতী নারীরা অনুগত, তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে হিফাযাতকারিনী ঐ বিষয়ের যা আল্লাহ হিফাযাত করেছেন। (আল কোরআন-৪:৩৪)
(অনুবাদ-Rawai al- bayan-)

বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িত মানুষকে সমাজ তীর্যক দৃষ্টিতে দেখে, তাদের কোন সামাজিক মর্যাদা থাকে না, নারী পুরুষ উভয়ই একটি অরক্ষিত সম্পর্কে জড়িত থাকে। সমাজে বিবাহবন্ধন প্রতিষ্ঠিত না হলে মানুষ নিজের কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্য পশুপাখির মত আচরণ করতো। ফলশ্রুতিতে অজ্ঞাতকুলশীল সন্তানের জন্ম বেড়ে যেত এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো।

আর মুমিন সচ্চরিত্রা নারী এবং তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের সচ্চরিত্রা নারীদের সাথে তোমাদের বিবাহ বৈধ। যখন তোমরা তাদেরকে মোহর দেবে, বিবাহকারী হিসেবে, প্রকাশ্য ব্যভিচারকারী বা গোপনপত্নী গ্রহণকারী হিসেবে নয়। (আল কোরআন-৫:৫)
(অনুবাদ— Rawai Al-bayan)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যখন এমন কোনো ব্যক্তি তোমাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করে, যার দ্বীনদারি ও চারিত্রিক দিক তোমাদের মুগ্ধ করে, তখন তোমরা ওই ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দাও। যদি তোমরা তা না করো তাহলে সমাজে বিরাট ফিতনা-ফাসাদ ও বিপর্যয় দেখা দেবে।’ (তিরমিজি: ১০৮৪)



আধ্যাতিক চাহিদা পূরণ :

প্রত্যেক মুসলমানের জীবনের চূড়ান্ত সফলতা হচ্ছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও আল্লাহর সন্তুষ্টিস্বরূপ জান্নাতের অতুলনীয় বাসস্থান লাভ করা। ঈমানবিধ্বংসী এই যুগে যেদিকে দ্বীনের পথে অটল থাকা প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর চেয়ে কঠিনতর, সেদিকে ইসলাম বিবাহকে দ্বীনের অর্ধেক বলে আখ্যায়িত করেছে। বিবাহের সময় জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে দ্বীনদারীতাকে প্রাধান্য দিতে বলা হয়েছে। বিবাহ সম্পন্ন করে বংশবিস্তার করা ইসলামের উপদেশ এবং নবীজীর ﷺ সুন্নাত। বৈরাগ্যবাদকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করেছে এবং মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জীবনসঙ্গীর সান্নিধ্য লাভ করাকে উৎসাহিত করেছে। নবীজীর জীবনে তার জীবনসঙ্গী উম্মুল মুমিনীন খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহা এর অবদান অপরিসীম। নবুওয়াতের প্রথম দিনগুলোতে বিবি খাদিজার সাহচর্য , বিশ্বাস ও অনুপ্রেরণা নবীজীর মনোবল বৃদ্ধি ও ধর্মপ্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, শত্রুদের ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ ও অত্যাচারের সামনে খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহার অগাধ ভালোবাসা দুর্গের মত কাজ করে। নবীজীর কঠিন সময়ে তিনি ছায়ার মত পাশে ছিলেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা আরো স্পষ্ট হয় ব্যভিচারের ভয়াবহ শাস্তি থেকে। একজন উত্তম জীবনসঙ্গীর সান্নিধ্যে মানুষ এহেন পাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের বলেছেনঃ হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যে বৈবাহিক জীবনের ব্যয়ভার বহনে সক্ষম সে যেন বিয়ে করে। কারণ তা দৃষ্টিকে নিচু করে দেয় এবং লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করে। আর যে (ভরণ-পোষণে) সমর্থ না হয়, সে যেন রোযা পালন করে। কারণ তা তার যৌন কামনা দমনকারী।
—সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩২৭০ (আন্তর্জাতিক নং ১৪০০-৩)


আল্লাহ তায়ালা কোরআনে তার বান্দাদের ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করতে বলেছেন। আর জীবনসঙ্গীর চেয়ে অধিক সহযোগী কে হতে পারে যার সাথে ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করা যায়?
আবু হুরায়রা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেনঃ আল্লাহ ঐ ব্যক্তির উপর রহম করুন, যে রাত জেগে নামায আদায় করে; অতঃপর সে স্বীয় স্ত্রীকে ঘুম হতে জাগ্রত করে। আর যদি সে ঘুম হতে উঠতে না চায় তখন সে তার চোখে পানি ছিটিয়ে দেয় ( নিদ্রাভঙ্গের জন্য)। আল্লাহ ঐ মহিলার উপর রহম করুন যে রাতে উঠে নামায আদায় করে এবং স্বীয় স্বামীকে জাগ্রত করে। যদি সে ঘুম হতে উঠতে অস্বীকার করে, তখন সে তার চোখে পানি ছিটিয়ে দেয়।
-সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ১৩০৮
জীবনসঙ্গী মানুষের সবচেয়ে কাছের মানুষ কারণ তার সাথেই সে সবচেয়ে বেশি উঠাবসা করে। ফলে তার আধ্যাতিক জগতে জীবনসঙ্গীর প্রভাব সবচেয়ে বেশি প্রতিফলিত হয়।
আবু মুসা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেনঃ সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর উপমা হল, কস্তুরী বহনকারী ও কামারের হাঁপরের ন্যায়। মৃগ-কস্তুরী বহনকারী হয়ত তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তার কাছ থেকে তুমি কিছু খরিদ করবে কিংবা তার কাছ থেকে তুমি লাভ করবে সুবাস। আর কামারের হাঁপর হয়ত তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে কিংবা তুমি তার কাছ থেকে পাবে দুর্গন্ধ ।
—সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫১৩৬ (আন্তর্জাতিক নং ৫৫৩৪)



দাম্পত্যকে একেকজন একেকভাবে সংজ্ঞায়িত করে। সাহিত্যে জীবনসঙ্গীকে ব্যাখ্যা করার জন্য অনেক উপমা ও রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু মহান আল্লাহ জীবনসঙ্গীর জন্য যে রূপক ব্যবহার করেছেন তা অতুলনীয়। আল কোরআনে জীবনসঙ্গীকে পরস্পরের পোশাক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

তারা তোমাদের জন্য পোশাক, তোমরাও তাদের জন্য পোশাক। (আল কোরআন-২:১৮৭)
(অনুবাদ--মুফতি তাকী উসমানী)

মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্যের পরই পোশাকের স্থান। একজন সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষের কাছে খাদ্যের চেয়ে পোশাকের গুরুত্ব অনেক বেশি। পোশাক মানুষের বিবিধ উদ্দেশ্য সাধন করে থাকে।
* পোশাক পরিধানের মূখ্য উদ্দেশ্য তা লজ্জা নিবারণ করে,
* শরীরকে ঢেকে রাখে,
* শালীনতা বজায় রাখে,
* বিভিন্ন আবহাওয়ায় সুরক্ষা বজায় রেখে আরাম প্রদান করে,
* শরীর থেকে সংক্রামক ও বিষাক্ত পদার্থ দুরে রাখে,
* ময়লা আবর্জনা, ধুলাবালি, কালি, নোংরা পানি থেকে শরীরকে রক্ষা করে,
* শরীরের ক্ষত বা ত্রুটি ঢেকে রাখে,
* পরিহিত পোশাক মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে,
* ব্যক্তিত্ব ও রুচির বহিঃপ্রকাশ করে,
* সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে,
* সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক বহন করে,
* ঐতিহ্য তুলে ধরে,
* মানুষ ও পশুর মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে,
* পছন্দসই পোশাক মানুষকে প্রফুল্ল রাখে,
* উপযুক্ত পোশাক মানুষের আত্মবিশ্বাস ও কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি করে।

হে আদম সন্তান! আমি তোমাদেরকে পোষাক-পরিচ্ছদ দিয়েছি তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করার জন্য এবং শোভা বর্ধনের জন্য। আর তাকওয়ার পোশাক হচ্ছে সর্বোত্তম পোশাক। ওটা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। (আল কোরআন-৭:২৬)
(অনুবাদ— Taisirul Quran)
পরিহিত পোশাকের যত্ন নেয়া, ময়লা পরিষ্কার করা, পরিচ্ছন্ন রাখা, ত্রুটি দুর করা, সৌন্দর্য বজায় রাখা ইত্যাদি কাজও পরিধানকারীর করতে হয়। তদ্রুপ জীবনসঙ্গীর যত্ন নেয়া, ভুলত্রুটি সংশোধন করা, তার দোষগুলো লোকচক্ষুর আড়াল করা আরেক জীবনসঙ্গীর কর্তব্য।জীবনসঙ্গী যদি এক অপরের পোশাক হয় তাহলে জীবনসঙ্গীবিহীন মানুষ বিবস্ত্রের মত। কোরআনের এই রূপক দ্বারা একজন মানুষের জীবনে জীবনসঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা কত বেশি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।



মানবজাতির পথিকৃৎ মহানবী ﷺ জীবনের প্রতিক্ষেত্রে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রেখে গেছেন। দাম্পত্য জীবন সুখকর করতে জীবনসঙ্গীর সাথে কেমন আচরণ করতে হবে তাও নবীজীর জীবনী থেকে পাওয়া যায়।
* জীবনসঙ্গীকে স্বান্তনা প্রদান করা। ( আস সুনানুল কুবরা, নাসাঈ : ৯১১৭)
* জীবনসঙ্গীর প্রশংসা করা। ( সহীহ মুসলিম ; ২৪৩৫)
* একপাত্রে পান করা। ( নাসাঈ :৭০)
* একসাথে স্নান করা। ( নাসাঈ :২৪০)
* সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সম্মানজনক আচরণ করা। (বুখারী :১/২৭৩)
* পারস্পরিক মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। (বুখারী :১/৩৮০)
* পারিবারিক কাজে সহযোগিতা করা। (মিশকাত :৫২০)
* জীবনসঙ্গীর মনোরঞ্জন করা। (বুখারি :৫১৯০)
* ধৈর্য্য ও বিচক্ষণতার সাথে সমস্যার সমাধান করা। (তিরমিজি : ৩৮৯৪)
* অহেতুক সন্দেহ পরিহার করা। (বুখারি :২/৫৯৫-৫৯৬)
* জীবনসঙ্গীকে ব্যক্তিগত কাজে স্বাধীনতা দেওয়া। (বুখারি :৬১৩০)
* পারস্পরিক গোপনীয়তা রক্ষা করা। (মুসলিম :১৪৩৭)

আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি মানুষের দাম্পত্য জীবন শান্তিময় করুক ও প্রত্যেককে নিজের দায়িত্বগুলো নিষ্ঠার সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করার তৌফিক দান করুক এবং জীবনসঙ্গীকে পরস্পরের ইহকাল ও পরকালের জন্য মঙ্গলময় করুক।

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫০
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×