-যাবেন?
রিক্সাওয়ালা সিটের উপর বসে আছে। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। গ্রীণ রোডে এই সময়টাতে প্রচন্ড ভীড় লেগে থাকে। রাস্তা পার হতে গেলে অপেক্ষা করতে হয় ১০-১৫ মিনিট। জ্যামের মধ্যে দিয়ে মানুষ কেন একটা মাছিও বের হতে পারেনা। সেই জ্যামে বসে থাকতে প্রথমে একটু তাড়াহুড়া, বিরক্তি লাগলেও পরে এক আশ্চর্য্য রকমের প্রশান্তি চলে আসে। ধুলো-বালি, ধোঁয়া,গাড়ির হর্ণ সবকিছুর মাঝেও এক নতুন জগৎ খুলে যায় চোখের সামনে। সবার হয়না এটা। শিমুলের হয় । সে খেই হারিয়ে গেলে হঠাৎ হঠাৎ। এক জায়গাতে বসেই অন্য জায়গায় চলে যায়। হুট করেই যেন এক মুহূর্ত থেকে অন্য মুহূর্তে। সময় পরিভ্রমণ বিজ্ঞানীরা এখনো হাতে কলমে প্রমাণ করতে পারেনি। অথচ ! সে পারে এটা। খুব সহজেই সময় পরিভ্রমণ করতে পারে। বিষয়টা সে কাউকে বলেনি। লোকে বুঝবেনা। কেউ উদ্ভট বলবে, কেউ ডাকবে পাগল!
আধুনিক যুগ এখন। সবাই বড় বড় বিষয় নিয়ে কথা বলে। টাইম ট্রাভেলের কথা বললে হয়ত ঘুরে তাকাবে, কিন্তু সে সময় ভ্রমণ করতে পারে শুনলে খবর আছে। একেবারে কুতুব মিনার দেখিয়ে ছাড়বে।
আজ বড্ড তাড়া আছে তার! স্টারে যেতে হবে। দুপুরে একজনের সাথে খাবার কথা ওখানে। বন্ধুর ছোট ভাইয়ের বান্ধবী। এক বিয়েতে পরিচয়। হলুদে নাচতে গিয়ে পাশপাশি নাচতে শুরু করেছিল। মেয়েরও বেশ আগ্রহ। এরপরে ফোন নাম্বার যোগাড় করতে কম ঝামেলা হয়নি। টাকা খসেছে বেশ কিছু। বন্ধুর ছোট ভাইকে তেলানো। খাওয়ানো। শেষ পর্যন্ত ফোনে দু'মাস কথা বলার পর আজ দেখা করতে যাওয়া।
মেয়ে দেখা করতে চায়না। অনেক টোপ ফেলেছে। পাস্তা, নুডলস থেকে শুরু করে বার্গার, স্যান্ডুইচ এমনকি ফ্রাইড রাইস পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত স্টারের কাচ্চি আর লেগ রোষ্টে এসে ঠেকেছে। ঢাকার বিখ্যাত খাবার। এই খাবার স্টারের চাইতে ভাল কোথাও নেই। মেয়ে নাকি খায়নি এখনো। শিমুল বলল আজ হরতাল আছে। দুপুরে খেয়ে আসা যায়।
- সিটি কলেজের সামনে, স্টার! কত?
- ৪০ টাকা!
মাথায় আগুন ধরে যায় তার। ধাই করে বা'হাতে চড় মারল সে। গ্রীণ রোড থেকে ১৫-২০ টাকার ভাড়া। আজ হরতালের দিনে এত বেশি চায় কোন সাহসে?
-তুই ভাড়া জানস্!
রিক্সাওয়ালা গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে।
শিমুল আবারো গর্জে ওঠে, " চোখ নামা!"
রিক্সাওয়ালা কথা বলে ওঠে, " না গেলে না যাবেন! মারেন কেন?
- না গেলে! তুই ভাড়া জানিস না তোরে রিকশা চালাইতে বলসে কে?
শিমুল হাতা গোটাতে থাকে। কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে পড়েছে। এদেশের মানুষজনের আগ্রহের শেষ নেই। সবাই মিলে ব্যাপারটা সমাধান করে দিল।
___________________________
খাবার শেষে বিল দিয়ে উঠে দাঁড়ায় শিমুল। ওয়েটারকে বিশ টাকা বকশিশ দেয়। মেয়ের কাছে উদার এবং ভাল মনের মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে হবে নিজেকে। রাস্তায় কোন গরীব দেখলে পাঁচ টাকা বের করে দিতে হবে। কোন পথ শিশুকে খালি গায়ে দেখলে গল্প ফাঁদতে হবে শীতের সময় সে আর কয়েক বন্ধু মিলে উত্তরবঙ্গে কাপড় বিলি করেছিল। মুখটা কালো করে ফেলতে হবে। মেয়ে হয়ত তাকে বুঝ দেবার জন্য হাতের উপর হাত রাখবে। ব্যস! ঐ হাত আর সরাতে দেয়া যাবেনা।
শিমুলের অংক কষা ভুল হয়না। সে ধীরে ধীরে আগাবে। এমন তাড়াহুড়ার কিছু নেই। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আগাতে হবে। চট করে লেকের পাড়ের ভাসমান ফুলওয়ালা পেলে লাল গোলাপটা হাতে নিয়েও অন্য রঙের ফুল খুঁজতে হবে। মেয়ে কি করে দেখার ইচ্ছে। হাত বাড়িয়ে নিলেই হয়। নিজে থেকেই হয়ত টেনে নিবে। লালের প্রতি মেয়েদের অন্য রকমের দুর্বলতা আছে। এটাও কাজে লাগাতে হবে।
কথা বলতে বলতে লেকের পাড়ে সন্ধ্যা নামবে। অপরিচিত কোন কবির সুন্দর কোন কবিতা আবৃতি করতে হবে। তারপর বিদায়। বেশি ভাল হয় লম্বা কোন পথ পেলে। সে হেঁটে যাবে। মেয়ে চোখের আড়াল হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত তাকিয়ে থাকবে। কেল্লা ফতে
_________________________________
রাস্তায় কুকুরটা চমকে সরে গেল। একলা বাড়ি ফিরছে শিমুল। গায়ে কোট। টাইয়ের নব ঢিলে করা। হু হু বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে ফিরে এসেছে সে। হয়ত পৃথিবীর এই মুক্ত আলো বাতাস আর নেয়া হতনা। কিছুক্ষণ আগেও তার গলার কাছে একটা ধারালো চাকু ছিল। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এরকম কিছু হতে পারে। বড়ই হিসেবি এবং সাবধানী সে। ব্রিফকেসে করে দুই লাখ টাকা নিয়ে গিয়েছিল। কাস্টমসের কিছু স্বর্ণ ধরা পড়েছে। ওখান থেকে সরানো হয়েছে অনেকটুকু। তারা তিন বন্ধু মিলে স্বর্ণ কেনার কথা। দুই লাখ টাকার স্বর্ণ কিনে নিতে পারলে অনায়াসে ২০- ২৫ লাখ টাকায় বেঁচে দিতে পারবে। কিন্তু...
সেখানে গিয়ে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি। দুই বন্ধুর এক বন্ধু এসেছিল। কোন এক গোডাউনে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল। অন্ধকার সেই পথ দিয়ে যাবার সময় তার ভয় হচ্ছিলনা। একধরণের উত্তেজনা কাজ করছিল। কবে হাতে পবে সেই কাঙ্ক্ষিত স্বর্ণ।
কি থেকে কি হয়ে গেল। কোথাও তাদেরকে আটকে ফেলা হল। তাকে এবং তার বন্ধুর গলায় ছুরি ধরা হল। তাদের আরেক বন্ধুর কাছে নাকি ওরা ১০ লাখ টাকা পায়। ওটা না পাওয়া পর্যন্ত ছাড়বেনা। শিমুলের বুঝতে কষ্ট হলোনা। ফাসানো হয়েছে তাকে। তার পাশে বসে থাকা বন্ধুকেও মনে হল জড়িত। কিছু করার নেই।
বাসার কাছে এসে রিক্সা থেমে গেল। শিমুল নেমে পকেটে হাত দিল। নেই! মোবাইল, মানিব্যাগ সব নিয়ে গেছে ওরা।
- আমার ছিনতাই হয়েছে। আপনি কালকে সকালে এসে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন।
রিকশাওয়ালা নিজে থেকেই বলে, " মামা! থাক্! লাগবেনা। বিপদ আপদ আল্লাহ্ সবাইরেই দেয়। আপনি যান। সাবধানে বাসায় যান"
শিমুলের চোখের সামনে পৃথিবীতে পাল্টাতে থাকে।
- তোমারে একটু জড়ায়ে ধরতে পারি?
রিক্সাওয়ালা হেসে ফেল, " আমার গায়ে ঘাম! আপনার শার্ট নষ্ট হবে।"
শিমুল হাত বাড়িয়ে দেয়।
- হবেনা। নষ্ট হবেনা।
____________________
-দাদু! কমলাটা একটু ছিলে দাওনা।
হুইল চেয়ারে বসে থাকা বৃদ্ধ! পায়ের কাছে শেষ বিকেলের আলোটা এসে পড়েছে। আকাশের দিকে তাকান তিনি। মিষ্টি একটা রঙ। হাতে ধরা কমলাটার মতই তো।
পাশে থাকা ছেলেটা তাড়া দেয়, " ও দাদু! দাওনা!"
বৃদ্ধ কাঁপা হাতে কমলা ছিলতে থাকে। পাশে তার নাতীন। আলো কমে আসছে। সময় শেষ হয়ে আসছে একজনের। আরেকজনের শুরু।
বৃদ্ধের খেয়াল আসে হঠাৎ, সময় পরিভ্রমণ করা হয়ত সম্ভব! কিন্ত সময়কে কেউ বদলাতে পারেনা।
পারলে ভাল হত।
অনেক ভাল হত।