কনকনে শীতে দিনাজপুরের গ্রামের বাড়ি এলাম। বাড়িতেও নেট পাচ্ছি। আমেরিকায় ভাইবারে কথা হল। এখন গ্রামেও আছে চল্লিশ টা চ্যানেল সহ ক্যাবল টিভি। ২৪ ঘন্টা বিদ্যুত। তবু এক মিশ্র অনুভূতি।
আগে বাড়িতে এলেই সভ্যতার ভড়ংগুলো সব ঝেড়ে ফেলতাম বা ফেলতে বাধ্য হতাম। শহর থেকে ট্রেনে আসতাম। নির্দ্রিষ্ট স্টেশনে নেমেই গরুর গাড়িতে চড়তে হতো। তখন থেকেই আদিম জীবন, মোষের গাড়িতে হেলতে দুলতে ,হর্নের বদলে গাড়োয়ানের বিচিত্র সব বুলি, হর্ হর্ হট হট- মোষের সাথে মানুষের মত কথাবলা ।পশু হলেও সব ঠিকঠাক বুঝত যেন।
একসময় তৈলতৃষিত চাকার আর্তনাদ ছন্দে ছন্দে অনি:শেষ পথ শেষ হত। বাড়ি আসতে আসতে কখনো সন্ধ্যে হয়ে গেলে হারিকেন হাতে বাবা দাঁড়িয়ে থাকতেন, কদমবুসি করেই মা'র কাছে দৌড়। আদর নিয়েই বলতাম- 'মা ভোগ লেগেছে। সারা দিন কিছু খাইনি।
রাজ্যের খিদে নিয়ে রান্নাঘরেই বসে মা'র পোলাওযের শেষ রেসিপি বেরেস্তা -ভাঁজা পেয়াজের সাথে চিনি-সাবার হতো। তারপর খাবার ঘরের পাশেই দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে হারিকেনের মৃদু আলোয় সবাই মিলে একসাথে, মা বাদে-,খেতে বসা। বাড়ির কুকুর আর বিড়ালটাও পাশে বসে খেত এঁটোকাঁটা। মা খেতে বসতো তাদেরও পরে।
ততক্ষনে বড় ঘরের পেছনের বিশাল 'ঠাকুরভোগ' আমগাছের ফোকরের ভেতর থেকে ডেকে উঠতো লক্ষীপেঁচা, প্রথম প্রহরের ডাক। ওরা ঠিক ঘড়ির কাঁটার মত চার প্রহরে ডাকে। আর আমরা উঠোনের মধ্যেখানে জ্বালানো আগুন পোহান শেষে শরীরটা তাতিয়ে লেপের ভেতর।
তখন গ্রামে রেডিও ছিলনা, খবরের কাগজ না, অনুরোধের আসর শোনাও না। একবার 'বিনাকা গীতমালা' শোনার জন্য, পাড়ার চেয়ারম্যান এর ই-কাউন্সিলের সরকারি রেডিও এনে কত বিচিত্র কায়দায় রেডিও সিলোন (তখনও শ্রীলঙ্কা চালু হয় নি) ধরার চেষ্টা। তারপর যখন ঠিক ঠিক রেডিও ষ্টেশনটা পেলাম,আমিন সায়ানি কেবল বলা শুরু করছেন- ঠিক তখনই রেডিও টা ফেরত দিতে হয়েছিল,আর শোনা হয় নি। সেদিন গান শুনতে না পারার কষ্টটা বহুদিন ছিল।
আজ বাড়িতে এলাম গাড়িতে, একা। বাড়ির পাশ দিয়েই ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাকা রাস্তা। বাড়িতে বিজলি বাতি। হারিকেন হাতে বাবা নেই, মা'র রান্নাঘরটা ফাঁকা, টেবিলচেয়ারে বসে খাচ্ছি, টিভিতে জি-বাঙলার সারেগামাপা । পিছনের আমগাছটা নেই, লক্ষীপেঁচাগুলোও কোথায় যেন উধাও।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:১১