somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চায়ের পেয়ালার সঙ্গীত

০৩ রা মার্চ, ২০১০ দুপুর ২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গাছের ছায়ায় ধ্যানে মগ্ন এক চৈনিক সাধক। পাশের চুলোয় ফুটছে পাত্র ভর্তি পানি। বনে-বাদাড়ে ঢাকনা ছাড়া পাতিলে পানি ফোটালে যা হয় তাই হল। হাওয়ায় ভেসে দুটি পাতা চুপিসারে ঢুকে পড়ল পাত্রে। খানেক বাদেই হাই তুলে ধ্যান ভাঙ্গলেন কুতকুতে চোখ আর বোঁচা নাকের সাধু বাবা। ধ্যানের ভানে ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে বেজায় ক্লান্ত। 'জল' খেয়ে খানিকটা ভানহীন গড়াগড়ি না দিলেই নয়। চীনে মাটির পেয়ালায় তুলে নিলেন খানিকটা। যাব্বাবা, একি জলের রং! বিরস চোখে ধোঁয়া ওঠা লালচে (নাকি সব্‌জে?) তরল টুকোর দিকে চেয়ে রইলেন সাধক পুরুষ। নতুন করে ফোটাব আরেক পাত্র? কভি নেহি। নাক কুচকে ছোট্ট ছোট্ট সিপে সাবড়ে দিলেন পুরোটা। স্বাদটা কেমন কষ্টে--মন্দ নয় কিন্তু! স্নায়ু গুলো যেন খোঁয়াড়ি ছেড়ে বুকডন দিতে শুরু করেছে! কি খেলুম দাদা!!......পরের কাহিনী সহজেই অনুমেয়। সাধু হলেন শার্লক হোমস, হাতেনাতে ধরা খেয়ে গেল সেদ্ধ হয়ে যাওয়া পাতা দুটি, অতঃপর "ইউরেকা! পাইছি!!"। গাছতলা হতে উপাসনালয় পর্যন্ত 'ন্যাংটা দৌড়' হয়েছিল কিনা জানি না। হওয়া তো উচিত! চা-আবিষ্কার বলে কথা। যতদূর জানি আর্কিমিডিস 'ন্যাংটা দৌড়'-এর প্যাটেন্ট করিয়ে রাখেননি।

এভাবেই নাকি নিরাসক্ত এক চীনে-সাধু আপনার আমার হাতে তুলে দিয়েছেন আসক্তির আকড়--চা। স্রেফ চাপা! চৈনিক চাপাবাজি। চায়ে চুমুক দেয়ার সময় প্রায়ই এই চাপা-কাহিনীর চীনে-সাধুর মুখ ভেসে ওঠে। আফসোস হয়। চীনে দাদা, দুধ-চা তোমার চেখে দেখা হল না। চা পাতার সাথে খানিকটা দুধ-চিনিও যদি পড়তো পাত্রে---বর্তে যেতে। স্বর্গের বাগানে জুটছে তো? নাকি কেবল মোরগ সেজে হুর তাড়িয়ে বেড়াচ্ছো? যাই হোক, গোল্লায় যাও তুমি। প্রথম দুটো প্যারাই দখল করে নিলি ব্যাটা! X(

আজকাল টিভি খুললেই দেখতে পাই, জাঁহাবাজ সব খেলোয়াড়েরা দাঁত কেলিয়ে বুলি আওড়াচ্ছেন-"বুস্ট ইজ দা সিক্রেট অব্‌ মাই এনার্জি"। আমরা বাবা ছোটখাটো খেলিয়ে। জীবন নামের একটা ম্যারাথনে দৌড়াই। সে ম্যারাথনে নাকি কারা সব প্রথম-দ্বিতীয় হয়। অবাক কান্ড! আমাদের তো দৌড়ই শেষ হল না আজতক! এহেন আমাদের সিক্রেট অব্‌ এনার্জি হল চা। কপাল ভাল হলে মায়ের আর খারাপ হলে 'মামা'র হাতের চা।

বড়োসড়ো এই কপালটা সবসময়ই খুব খারাপ ছিল তা বলা যাবে না। মায়ের হাতের চা তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেয়েছি অনেক দিন। কড়া লিকারের মন মাতানো গন্ধে ভরা চা। ক্লান্তি আর গ্লানি সে চায়ের ধোঁয়ায় মিশে পালায়, সুখ আর সতেজতা ক্যাফেইনে মিশে স্নায়ুতে-স্নায়ুতে জড়ায়। চা-পাগল পরিবার আমাদের। বড় একটা মগে চুমুক দিতে দিতে আম্মু রুমে এসে বলতেন (ছুটিতে বাসায় গেলে এখনো বলেন)-"বাবু, চা খাবি?"। দাঁত কেলিয়ে, প্রবল বেগে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতাম। খাব না আবার? সকালে চা, দুপুরে চা, বিকেলে চা, রাতেও চা। আব্বুর সাথে আলাপ জমানোর উছিলাও ছিল চা। মাগ্‌রিবের পরে চার ভাই চারটে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হাজির হতাম আব্বুর ঘরে। আরো দুই কাপ নিয়ে চলে আসতেন আম্মু। আব্বুর চোখ-মুখ হেসে উঠত। "বাবু, শুইনছো নি? এই মাসে স্কেল চেইঞ্জ হবে।" চায়ে চুমুক দিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বলতাম-"তাই নাকি আব্বু?!"সেই শুরু। চায়ের কাপে এক-একটা চুমুকের সাথে এসে পড়ত ইদ্রিস আংকেলের চেয়ার ছুড়ে মারা, জবাবে প্রিন্সিপাল আংকেলের জুতো নিক্ষেপ, বাসে ঘুমিয়ে পড়ে ইকবাল আংকেলের কাপ্তাই চলে যাওয়া, চৈত্রের অসহ্য গরম, নাদু-মৌলবির জমির ঝামেলা, তারেক জিয়া, সজীব ওয়াজেদ জয়, দূর্নীতি, দূরাশা, সাকা চৌধুরীর বাগাড়ম্বর, হোমার, ইলিয়াড, ইউলিসিস, জেমস জয়েস, লংফেলো, চাশার আরো কত কি। চা আমাদের চাপায় জোর জোগাত, নাকি চাপার ব্যায়াম চায়ের চার্ম বাড়াতো-এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

'সেদিন কবেই গেছে'। গত তিন বছর ধরে থাকছি ঢাকার গোটাকয় ইট-পাথরের বস্তিতে। চায়ের নেশা মাথায় চাপলে ভরসা এখন মামারা। ময়লা কাপের কড়া মিষ্টি চা। না খেয়ে উপায় নেই। বউ বাপের বাড়ি চলে গেলে বিবাহিত পুরুষদের বিছানায় অস্বস্তিতে এপাশ-ওপাশ করতে দেখেছেন? দিনটা যদি শুরু হয় চা-বিনা, এই অধমের অবস্থা হয় ঠিক তেমনটা। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বায়েজীদের একটা তত্ত্ব (থিওরি) আছে এ বিষয়ে। ওই শালার মামারা নাকি চায়ে আফিম মেশায়! আর 'মফিজ'রা নেশায় বুঁদ হয়ে বারে বারে টং-এর দরজায় পৌছে যায়। হবেও বা /:)

দুধে-ভাতে বড় হওয়া চা-বিমুখেরা যে যায় বলুক, তপ্ত রংধনু-পানীয় আমার গিলতেই হয়। মন ভালো করে দেয়া ঝলমলে দিনে, মন-উদাসী মেঘলা বেলায়, ব্যস্ত অফিস-তাড়ার সকালে, অফিস-ফেরা শ্রান্তি ভরা সন্ধ্যা বেলায়, পথ ফুরোবার আগেই ভাড়া মিটিয়ে রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে --হাজির হয়ে যাই মামাদের টং-এর দোরগোড়ায়। "মামা, একটা চা। কড়া কইরা।" টুং-টাং শব্দ ভেসে আসে চামচ আর পেয়ালার ঠুকোঠুকিতে। ইচ্ছে করে গলা মেলাই চায়ের পেয়ালার সঙ্গীতে।




সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১০ সকাল ১০:২৯
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেসবুক বিপ্লবে সেভেন সিস্টার্স দখল—গুগল ম্যাপ আপডেট বাকি

লিখেছেন মহিউদ্দিন হায়দার, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩০




কিছু তথাকথিত “বাংলাদেশি বিপ্লবী” নাকি ঘোষণা দিয়েছে—ভারতের সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে! সহযোগী হিসেবে থাকবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আর পাকিস্তানি স্বপ্ন।শুনে মনে হয়—ট্যাংক আসবে ইনবক্সে। ড্রোন নামবে লাইভ কমেন্টে। আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×