somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মালির ইতিহাস লিখেছিলো আর্কেয়বাস

২৬ শে আগস্ট, ২০১৮ ভোর ৪:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবি: মালির একমাত্র নদী নাইজার এর তীর জুড়ে মরুভূমির বালিয়াড়ি

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ, মালির ধুলাবালি রং অনেকটা লাল, ছবি তুললে এই রংটা আরো প্রকট হয়ে ধরা পড়ে । মাঝে মাঝে মনে হয় আসলেই তো এই মাটির রং লাল হয়ে যাওয়ারই তো কথা । সেই কয়েক শতাব্দী ধরে গোত্রে গোত্রে মারামারি লেগেই আছে । কে বলবে আজকের এই মালির যুদ্ধ বিধ্বস্ত রুপ দেখে , যে একদিন এই মালির রাজা মানসা মুসা কেইটা ২০ টন সোনা নিয়ে বিশাল হজ্ব কাফেলা সহকারে যাওয়ার সময় রাস্তার দুধারে সকল জনপদে এই সোনা মুক্ত হস্তে দান করেছিলেন, এমনকি তার এই বিশাল সোনার দানে সেই সময়কার কায়রোর বাজারে সোনার দরপতন হয়েছিল। পরে অবশ্য রাজা মানসা মুসা নিজের ভুল সংশোধনের জন্য সেই সোনা আবার নিজের পকেটের অর্থ আর বেশ কিছু অর্থ কায়রোর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ধার নিয়ে কিনে নিয়েছিলেন ।


ছবি: শিল্পীর চোখে মানসা মুসার বিশাল কাফেলা সহকারে হজ্বযাত্রা

রাজা মানসা মুসা কেইটা যখন হজ্ব শেষে ফিরে আসেন মক্কা থেকে সাথে করে নিয়ে আসেন ইসলাম সম্পর্কিত প্রচুর বই এবং সাথে নিয়ে আসেন বেশ কজন জ্ঞানী মুসলিম তপসীদের । এবং এই বই আর জ্ঞানী মুসলিম তপসীদের নিয়ে রাজা মানসা মুসা মালির আরেকটি প্রাচীন শহর টিম্বাকটুতে গোড়াপত্তন করেন সানকোরা মাদ্রাসা ।


ছবি: মালি সম্রাট মানসা মুসা শাসনামলে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে টিমবাকটু, মালিতে গ্রেট মসজিদ জেনে (Djenné) নির্মিত হয়েছিল

সেই বইয়ের বিশাল পাহাড়ের এক জ্ঞানভান্ডার গড়ে উঠে এই টিম্বাকটুর সানকোরা মাদ্রাসাতে । যদিও আগে থেকে শহরটি ছিলো মূলত লবন এবং দাস ব্যবসার প্রানকেন্দ্র। কিন্ত সানকোরা মাদ্রাসা টিম্বাকটুকে আমূলে বদলে দেয় , টিম্বাকটু শহর পরিচিত লাভ করে নতুন রুপে নতুন সাজে । পৃথিবীর আনাচে কানাচে থেকে জ্ঞানপিপাসুর দল ছুটে আসে এই টিম্বাকটুতে দূর্লভ বই কেনার জন্য আর সেই সব জ্ঞানীগুণীদের সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় এই সানকোরা মাদ্রাসায় ।


ছবি: সম্রাট মানসা মুসা শাসনামলে জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু টিমবাকটু শহরের অদূরে জ্ঞানপিপাসুদের কাফেলা

এইভাবে আমূলে বদলে যায় টিম্বাকটু নগরী, লবনের ব্যবসা থেকে রাতারাতি জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রানকেন্দ্রে পরিনত হয়। । কিন্ত মানসার রাজত্বের পরে ধীরে ধীরে খর্ব হতে শুরু করে মালি রাজত্বের শান-শওকত, কিন্ত একই সাথে সেই রাজত্বের বেশ কিছু অংশে ভাগ বসায় সোংগোই রাজত্ব । এদিকে সোনার গন্ধে ছুটে আসে মরক্কো থেকে সামরিক বাহিনীর নেতা জুদার পাশা ১৫৯১তে ১৩ ই মার্চ । ভয়ানক যুদ্ধ বাঁধে গাও শহর থেকে আনুমানিক ৫০ কি:মি: দূরে তনদিবী নামক জায়গায় । মরক্কোর এই সোনার লোভ পেয়ে বসে যখন বিভিন্ন দেনার দায়ে মরক্কো ডুবতে বসেছিলো তখন মরক্কোর সুলতান আহমেদ আল মনসুর সাদীর মাথায় খেয়াল চাপে মন্দ কি যদি মালির সোংগোই রাজত্ব দখল করে এর সোনার খনি হাতে পাওয়া যায় তাহলে সব দেনা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। একদিকে সোনার লোভ


ছবি: মালি অভিমুখে মরক্কো বাহিনীর বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধযাত্রার গতিপথ

অন্যদিকে মরক্কো থেকে মালি আসার রাস্তায় বিশাল বিস্তৃত মরুভূমি সাহারা , যেখানে নেই এক ফোঁটা পানি । যদিও সুলতানের অনেক উপদেষ্টা তাকে এক মুসলিম দেশ হয়ে অন্য মুসলিম দেশ বিনা কারনে দখল করতে নিষেধ করেছিলেন । কিন্ত উনি মরুভুমির সমস্যা, উপদেষ্টাদের সকল অনুরোধ পায়ে ঠেলে জুদার পাশার নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী পাঠালেন মালি অভিমুখে। সেনাবাহিনী নিয়ে মরক্কো থেকে জুদার পাশা ঠিক করলেন বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে উত্তরে থেকে মালির, গাও শহরের দিকে তিনি অগ্রসর হবেন । কারন মালি অভিমুখে আসার সময় তিনি পশ্চিমে পাবেন নাইজার নদীকে আর এই নদী লাইফ সাপোর্ট হবে তার বিশাল বাহিনীর জন্য। অন্যদিকে গাও এর উত্তরে রয়েছে বিশাল ফাঁকা চারনভূমি যা কিনা একদিকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ভাল জায়গা অন্যদিকে বাহিনীর সাথে আসা ঘোড়া, উট ও অন্যান্য পশুদের জন্য ভাল ঘাস পাওয়া যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ , জুদার পাশা অবশেষে দীর্ঘ ৪ মাস সেই ভয়ানক সাহারা মরুভুমি অতিক্রম করে কোন ধরনের বড় রকমের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া বিশাল বাহিনী নিয়ে এসে উপস্থিত হয় গাও এর সন্নিকটে । জুদার বাহিনী থেকে গাও তথা সোংগোই রাজত্বকে বাচাঁনোর জন্য রাজা আসকিয়া ইশহাক (২য়) ছুটে আসে গাও থেকে তনদিবী নামক জায়গায়, বেঁধে যায় প্রচন্ড যুদ্ধ । একদিকে জুদার পাশা মরক্কো বাহিনীর ১৫০০ অশ্বারোহী বাহিনী আরও ছিল সাথে ৫০০জন তীরন্দাজ বাহিনী। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন যে শক্তি সাথে ছিলো মরক্কো বাহিনীর তা হল বারুদের ব্যবহার। তারা ২৫০০ পদাতিক বাহিনীকে প্রথমদিকে তৈরী একধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আর্কেয়বাস (Arquebus) দ্বারা সজ্জিত করেছিলো আর সেই সাথে ছিলো ৬টি কামান ।


ছবি : প্রথমদিকে তৈরী একধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আর্কেয়বাস (Arquebus) দ্বারা সজ্জিত ছিল মরক্কো বাহিনী

অন্যদিকে ৯৭০০ পদাতিক বাহিনী , ১২,৫০০অশ্বারোহী বাহিনী এবং ১০০০ গবাদি পশু নিয়ে রাজা আসকিয়া ইশহাক (২য়) তনদিবী নামক স্থানে ঘাঁটি গাড়লেন জুদার পাশাকে প্রতিহত করার জন্য। যুদ্ধে অভিনব কায়দায় আক্রমন করার পরিকল্পনা করেন রাজা আসকিয়া ইশহাক (২য়) , তিনি সাথে আনা বিশালকায় আকৃতির ১০০০ গরু কে উত্তেজিত করে মরক্কো বাহিনীর দিকে লেলিয়ে দিলেন যেন প্রথম ধাক্কায় গবাদি পশুর পালের স্রোতে যেন জুদার পাশার বাহিনী ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্ত বিষয়টা টের পেয়ে বুদ্ধিমান জুদার পাশা তার বিশেষ আগ্নেয়াস্ত্র আর্কেয়বাস (Arquebus) দ্বারা সজ্জিত ২৫০০ পদাতিক বাহিনী আর ৬টি কামান দ্বারা বারুদের যে ভীষন বিস্ফোরন ঘটান তার শব্দে আর কামানের গোলার আঘাতে ভীত হয়ে সেই গবাদি পশুর দল উল্টো ঘুরে সোংগোই বাহিনীর দিকে ছুটে যায় আর সোংগোই বাহিনী নিজেদের অস্ত্রে নিজেরাই ধরাশায়ী হয়ে পড়ে । রাজা আসকিয়া ইশহাক (২য়) নেতৃত্বে সোংগোই পদাতিক বাহিনী ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করলেও জুদার পাশার বিশেষ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র "আর্কেয়বাস (Arquebus)" এর নিকট পেরে উঠতে না পেরে অবশেষে সোংগোই বাহিনী পরাজিত হয়ে ছত্রভংগ হয়ে পড়ে ।


ছবি: শিল্পীর তুলিতে তনদিবী যুদ্ধে সোংগোই পদাতিক বাহিনী বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র আর্কেয়বাস (Arquebus) দ্বারা সজ্জিত আক্রমনরত মরক্কো বাহিনী

এবং এই যুদ্ধের পরাজয়ের সাথে সাথেপশ্চিম আফ্রিকার বিশাল সাহেল প্রদেশে সংগোই রাজত্বের সমাপ্তি হয় । কিন্ত মরক্কো বাহিনী শুধু গাও দখল করে বসে থাকেনি । বরং তারা গাও এর পরে টিম্বুকটুর দিকে অগ্রসর হয় এবং একে একে তারা গাও , টিম্বুকটু সহ বেশ কটি গুরুত্বপূর্ন নগর দখল করে নেয় । বিশেষ করে জেনি যুদ্ধের মাধ্যমে টিম্বুকটু দখলের সাথে সাথে সেখানে মালি রাজত্বেরও পরিসমাপ্তি ঘটে এবং মরক্কোর দখলে চলে যায় অধিকাংশ এলাকা । মরক্কোর বিজয় এবং সেই সাথে গাও ও টিম্বুকটু পতনের মাধ্যমে যথাক্রমে সংগোই এবং মালি রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে । এই যুদ্ধে মরক্কো বাহিনীর বিজয়ের মূলে ছিলো বিশেষ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র "আর্কেয়বাস (Arquebus)" ব্যবহার যা কিনা পশ্চিম আফ্রিকার এই মালির ইতিহাসের মোড় ঘুড়িয়ে দেয় ।



নোট:পোস্টে ব্যবহৃত ১ম ছবিটি ব্যাতীত বাকী ছবিগুলো বিষয়ের সাথে মিল রেখে ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।


সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৮ ভোর ৫:১২
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×