somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

আশরাফ আল দীন
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ৩০ বছর চাকরি করেছি; অবসর নিয়েছি কর্নেল পদবীতে ২০০৬ সালে। এরপর এযাবৎ প্রিন্সিপাল হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে; এখন অর্কিড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা-তে। ‘স্কুল সাইকোলোজি’ নিয়েও কাজ করছি।

আমাদের শৈশবের ঈদ

০১ লা জুন, ২০২০ রাত ১০:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের #শৈশবের ঈদগুলো ছিল অনেক বেশি প্রাণবন্ত এবং হৃদয়বোধ সমৃদ্ধ। তখনকার দিনে এখনকার মতো আনন্দোপকরণের অত বেশি ঝলমলে উপাদান হয়তো ছিল না কিন্তু যেটুকু ছিল তার মূল্য ছিল আমাদের কাছে অনেক বেশি। আমরা অনেকদিন আগে থেকেই ঈদের জন্য অপেক্ষা করতাম। এই #ঈদ মানে হলো #ঈদুলফিতর। অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে ঈদের আগে আসত #রমাদান। আমাদের গ্রামের বাড়ির পেছনে ছিল বিশাল বাগিচা। সেই বাগিচার প্রান্তসীমায় শুরু হয়েছে ফসলের অন্তহীন খোলা মাঠ। সেখান থেকে খোলা আকাশের পশ্চিম দিগন্তটা পুরোপুরি চোখে পড়তো। ওখানেই চাঁদ উঠবে! আকাশের পশ্চিম দিকে যেখানে সূর্য ডোবে সেখানটাতেই #নতুনচাঁদ দেখা যায়। তাই আমরা বাগিচার প্রান্তসীমায় গিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতাম চাঁদ দেখার জন্য, রমাদানের #চাঁদ।

খুব চিকন এক ফালি #চাঁদ হঠাৎ করে কেউ দেখে ফেলতো এবং আমরা ছোটরা গাছের ফাঁক দিয়ে হয়তোবা একটুকরো মেঘের পাশে, বড়রা আঙ্গুল উঁচিয়ে অনেকক্ষণ ধরে "ওই যে!" "ওই যে!" বলার পর হঠাৎ করেই ওই ধান কাটার কাস্তের মতো খুব পাতলা ও চিকন চাঁদটাকে দেখে ফেলতাম। কোন কোন সময় দেখার সুবিধার জন্য নিজের উচ্চতা বাড়ানোর প্রয়োজনে ছোট মামা বা বড় ভাইয়ের কাঁধে চেপে বসতে হতো! সেটা ছিল অসাধারণ আনন্দ! রোজার আর ঈদের চাঁদ আকাশে থাকতো খুব অল্প সময়ের জন্য। আমাদের মনে হতো মাত্র কয়েক মিনিট! ছোটদের মধ্যে কেউ যদি খানিকটা দেরি করে আসতো, তাহলে সে চাঁদ দেখতে পেতো না, কারণ ততক্ষণে চাঁদটা ডুবে যেতো। তার না দেখার দুঃখের কারণে আমাদের দেখার আনন্দটা যেন আরো বেশি বেড়ে যেতো! #চাঁদ দেখার বিজয়ের আনন্দ নিয়ে আমরা ঘরে ফিরে এলে আম্মা আমাদেরকে #সেমাই দিয়ে মিষ্টিমুখ করাতেন।

পরদিন থেকে রোজা রাখা শুরু হবে, আজ রাত শেষ হবার আগেই সেহরি খেতে হবে এবং পরদিন প্রথম রোজার ইফতারের আয়োজন করা হবে। সব মিলিয়ে রান্নাঘরের রমরমা অবস্থা! আর তাতেই আমাদের মনে আনন্দের ফুরফুরে হাওয়া। আমাদের ঘরে একটা নিয়ম ছিল যে, সাধারণভাবে প্রতিদিন মাগরেবের নামাজের পর পরই আমাদের সব ভাইবোনকে পড়ার টেবিলে বসে যেতে হতো। তাই, সাঁঝের বেলা বসে পাড়ার অন্যদের মতো খানিকটা গল্পগুজব করার সুযোগ আমরা কখনো পেতাম না। বাড়ির অন্য ঘরগুলোতে এই সুযোগ ছিল বলে আমরা শুনতাম। আব্বার উপস্থিতি এবং সচেতন দৃষ্টির কারণে আমাদের জন্য সেই সুযোগ ছিল না। সন্ধ্যা হতেই খেলার মাঠ থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে সরাসরি পড়ার টেবিলে বসে যাওয়া রোজ রোজ কার আর ভালো লাগে? তাই কামনা করতাম কখন যে এই নিয়মের ব্যত্যয় হবে!

#রমাদান এলে #ইফতার আর #তারাবীর নামাজের কারণে আমাদের ঘরের এই নিয়মটা পরিবর্তিত হয়ে যেতো। খেলার মাঠ থেকে আগেভাগেই বাসায় ফিরে এসে হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে আমরা ছোটরা খাওয়ার টেবিলে #ইফতারির চতুর্দিকে ঘিরে বসে যেতাম। উচ্চস্বরে আমরা দুরুদ পড়তাম আর আড়চোখে দেখতাম কোন কোন আইটেম আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। অবশ্য অন্যান্য দিনগুলোতেও সন্ধ্যা হলেই বড়রা যখন মগরেবের নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন আমরা ছোটদেরকে ঘরের মূল দরোজার কাছে বসে উচ্চস্বরে দরুদ পড়তে হতো। বলা হতো, এতে নাকি ঘরে ফেরেসতারা আসে, আর শয়তান প্রবেশ করার সুযোগ পায় না। নিয়ম মোতাবেক বুট পেঁয়াজু হালিম ছাড়াও বেগুন ফুলকপি ডিম আলু ইত্যাদি দিয়ে তৈরি নানা পদ; কয়েক পদের মিষ্টান্ন ও সুজির তৈরি নাস্তা। কয়েক প্রকারের সেমাই হলো অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ। টেবিলে যেন বাটি রাখার জায়গা হতো না!

আমরা মোট নয় ভাইবোনে ভরা ঘরের মধ্যে সব বয়সের সদস্যই ছিলাম। প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল, কলেজ, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন এমন, আবার পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন এমন, আবার এখনো পড়াশোনা শুরুই করেনি এমন সদস্যও ছিল। ফলে, আমাদের রোজা পালনের ধরন ছিল নানা প্রকারের। আমাদের মধ্যে খুব ছোট যারা সারাদিন অভুক্ত থাকার কষ্ট সহ্য করতে পারবে না তাদেরকে বড়রা শিখিয়ে দিতেন রোজাটা কিভাবে কলা গাছের কাছে জমা রেখে এসে খাওয়া-দাওয়া করা যায়। এটা করা হতো আমাদের ছোটদের মধ্যে বড়দের অনুকরণ করে রোজা রাখার প্রচন্ড আগ্রহটাকে চাঙ্গা রাখার জন্য। #সেহরি খাওয়ার পর ছোটদের কেউ আর #রোজা ছেড়ে দিতে রাজি হতাম না। ক্ষুধায় শুকনো মুখে ঘোরাঘুরি করছে তবু রোজা ভাঙ্গবে না, আগ্রহ এতটাই বেশি! তাই মুরব্বীরা আড়ালে ডেকে এই বুদ্ধিটা শিখিয়ে দিতেন।

পদ্ধতিটা এমন যে কলাগাছের কাছে গিয়ে বাকলের কোন একটা অংশে একটা কামড় দিয়ে বলতে হবেঃ "কলাগাছ ভাই! তোমার কাছে আমার রোজাটা জমা রেখে গেলাম। একটু পরেই এসে নিয়ে যাবো।" বাতাসে কলাপাতা নড়ে উঠাটাই ওর সম্মতি! পুকুর পাড়ের কলা বাগান থেকে বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করে আবার গিয়ে কলাগাছে আরেকটা কামড় দিয়ে রোজাটাকে আমরা ফেরত নিয়ে আসতাম। ব্যাপারটা খানিকটা গোপনে করারই নিয়ম ছিল। কারণ, রোজাদারদের দেখিয়ে কিছু খাওয়া যে গোনাহর কাজ এই কথা কিভাবে যেন আমরা জানতাম। আসলে, বেলা বাড়ার সাথে সাথে যখন ক্ষুধার কামড়ও বাড়তে থাকতো তখন আমাদের কাছে এই পরামর্শটা খুব মনে ধরতো। এতে আবার আমরা ছোটদের রোজার সংখ্যাও বেড়ে যেতো। বন্ধুদের মধ্যে কে কতটা রোজা রাখলো এই নিয়ে হিসেব-নিকেশের সময় এটা বড্ড কাজে আসতো! একদিনে যখন বড়দের একটা রোজাই হয় তখন একদিনেই ছোটদের কারো দুইটা, কারো তিনটা, আর কারোবা চারটা পর্যন্ত রোজা হয়ে যেতো।

রোজার মাসটা আমাদের জন্য বেশ অন্যরকম আনন্দের সময় ছিলো। অনেকক্ষণ খেলাধুলা করেও যেন সময় শেষ হয় না! খেলাধুলা এবং নানা পদের খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি এটা ছিল আমাদের জন্য একপ্রকার প্রশিক্ষণের মাস। নামাজ শেখা, কোরআন শেখা, গল্পের মত করে বড়দের মুখে ইসলামের বিভিন্ন বিধি-নিষেধ এবং ইতিহাস জানার অনেক সময় পাওয়া যেতো। একবার তো ছোটমামার কথা শুনে আমরা থ’! মামা বল্লেন,

: “জানিস! এই যে আমরা এতো হৈ-হুল্লোড় করে রোজা রাখি, এই শব্দটাই কোরআন বা হাদিসের কোথাও নেই? কোরআন-হাদিসের কোথাও ‘রোজা’ শব্দটা নেই, আছে ‘সওম’বা #সিয়াম। যদিও রোজা নাম দিয়ে আমরা #সিয়াম পালনের এবাদতটাই করছি।” ঘাবড়ে যাওয়ার মতো কথা! আমি তো বলেই ফেল্লাম,

: “সর্বনাশ! সারাদিন না খেয়ে খেয়ে যে এতো কষ্ট করলাম, সবই কি তবে বৃথা!” মামা বিজ্ঞের মতো আমাদের সাহস আর সান্তনা দিয়ে বলেন,

: “ঘাবরাস নে! আমাদের এবাদত ঠিকই হচ্ছে, তবে ভিন্ন নামে আর কী!” আমার মনের খুঁতখুঁতে ভাব যে যায় নি, তা শেজভাই ঠিকই বোঝেন। উনিও পন্ডিতের মতো, আমাকে একটা টিপ দিয়ে বল্লেন,

: “বুঝিস না? তোর যেমন দু’টা নাম, একটা ডাকনাম আর অন্যটা ভালোনাম! সেরকম আর কি!” উনার মতো চট করে বুঝা আমার হয়ে ওঠে না! খানিকটা হাবা-ই ছিলাম বলা যায়। মামাকে মিনমিন করে বল্লাম,

: “কোরআন-হাদীসে যা নেই তা এতো যত্ন করে লালন করার দরকার কি? আমরা রোজা না বলে সওম বল্লেই তো পারি! নিশ্চয় আল্লাহ এতেই খুশি হবেন!”

: “একই ধর্ম ইসলাম পৃথিবীর নানা অঞ্চলে নানাভাবে নানা পরিবেশে প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছে। এজন্যেই তোরা দেখবি মূল তওহীদের ব্যাপারটা ঠিক থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে ব্যবহারিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু এতে কোন অসুবিধা নেই। এইসব পার্থক্যের জন্য এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে ঘৃণা করবে না। এসব অমিলকে বিরোধ নয়, বরং সৌন্দর্য হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। উদারতা দিয়ে ইসলাম এসবকে গ্রহণ করে।” মামার কথা শুনে বল্লাম,

: “রোজা শব্দটা তাহলে কীভাবে এলো?” শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
: “আরে! ও বলে কী? আমরা তো জন্ম থেকে এটাই শুনে আসছি! রোজা না বললে কেউ কি বুঝবে?” কেউ একজন বললো এবং সবাই আবারো হেসে উঠলো। মামা কিন্তু আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বল্লেন,

: “তোকে তো মামা আমার তাহলে অনেক দীর্ঘ ইতিহাস শোনাতে হবে! আমার কি এতো সময় হবে?” এবার শেজভাই-ই আবদার করে বসলো,

: “মামা! কিছুটা হলেও বলো না! তা’নাহলে ও তো আমাকে আজ ঘুমাতে দেবে না; খালি প্রশ্ন করবে!” শুনে মামা বল্লেন,

: “হুম। এতো কথা বলে শেষ করা যাবে না। তোদেরকেই বই পড়ে জানতে হবে। তবে, এখন খানিকটা শোনাই।” এবার মামা খুব গুছিয়ে কিছু ইতিহাস বল্লেন। আমরা গল্প শোনার মতো মনোযোগ দিয়ে নিঃশব্দে শুনতে থাকলাম।

“বহু পুরাতন কাল থেকেই আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে একটি পৌরাণিক সভ্যতা বিরাজ করছিলো। পৌরাণিক গল্প-ভিত্তিক যে লোকাচার এখানে এতদঞ্চলে প্রচলিত ছিল তাকে সুনির্দিষ্ট কোন ধর্ম বলা যায় না; তবে, হাজার বছরে গড়ে ওঠা এই ধর্মাচারের রূপ ছিলো একেক অঞ্চলে একেক রকম। সমাজগুলোতে চরম বৈষম্যমুলক শ্রেণীভেদ ছিলো, নরবলি ও সহমরণের মতো নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রথা চালু ছিল ধর্মের নামে। জ্ঞান চর্চা ও বিতরণের ব্যবস্থা ছিলো অত্যন্ত সীমিত ও বিদ্বেষমুলক। শুদ্র ও অপরাপর নিন্ম শ্রেণীর মানুষের কোন অধিকার ছিল না জ্ঞানার্জনের। গুরু-শিষ্যের যে নিয়ম চালু ছিলো তাতে একজন গুরু সারা জীবনে মাত্র একজন শিষ্যকেই মন্ত্র শিখিয়ে যেতেন। এই পরিস্থিতিতে ইসলাম এসে এই অঞ্চলের মানুষকে উপহার দিলো সামাজিক সুবিচার এবং জ্ঞান অর্জনের ও জ্ঞান বিতরণের দরোজাকে করে দিলো অবারিত, উম্মুক্ত। সাধারণ মানুষের চরম আগ্রহে তাদের ইসলাম বিষয়ক ও অন্যান্য জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার জন্য দলে দলে যে সকল শিক্ষক-গবেষক ও জ্ঞানী পুরুষরা এসেছিলেন তাদের অধিকাংশই এসেছিলেন মধ্য এশিয়া ও পারস্য (আজকের ইরান) থেকে। পারস্যের ভাষা ছিলো পার্সী এবং লোকেরা ছিলো শিয়া মুসলমান। তাই এখনো এই উপমহাদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় রীতি-নীতি ও আচরণের মধ্যে পার্সী ভাষার অনেক শব্দ এবং শিয়া মুসলমানদের অনেক রীতি ও আচরণ মিলেমিশে আছে। যদিও এই অঞ্চলের সকল মুসলমানই দাবী করে যে তারা ‘সুন্নী মুসলমান’। আমরা যে ‘খোদা’ বলি এই শব্দও কোরআন-হাদিসে নেই, আছে ‘আল্লাহ’। তেমনি ‘নামাজ’ নেই, আছে ‘#সালাত’। এই যে রোজা, নামাজ, খোদা- এ সবই ইরান থেকে আসা! এই সব তোদের জানার জন্যে বল্লাম, কোন বিতন্ডা করার জন্য নয়! বুঝলি?” এই কথা বলে ছোট মামা সাঁই করে বেরিয়ে গেলেন। আমরা কেবল তন্ময় হয়ে বসে রইলাম।

রোজার মাসে আমরা বড়দের পাশাপাশি দাড়িয়ে নামাজ পড়ার সুযোগ পেতাম। যাদের মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হতো তারা মসজিদে যেতো রীতিমতো পাঞ্জাবী-টুপি লাগিয়ে পাক্কা মুসল্লী সেজে । অন্যরা ঘরে আম্মাদের সাথে নামাজে দাঁড়াতো। আব্বা আমার জামায় ও হাতে খানিকটা আতর লাগিয়ে দিতেন। বাড়ীতে ফেরার পরও অনেক্ষণ হাত উল্টে আমি তা শুঁকে শুঁকে দেখতাম। এখোনকার মতো এতো দীর্ঘ তারাবী আমাদের ছোটবেলায় হতে দেখিনি বা শুনিনি। তখোন সব মসজিদেই সুরা #তারাবীহ হতো। কদাচিৎ শোনা যেতো কোন এক মসজিদে খতমে তারাবীহ হচ্ছে। আজকাল তো একটি মসজিদও খুঁজে পাওয়া যায় না যেখানে সুরা তারাবীহ হচ্ছে; সব মসজিদেই খতমে #তারাবীহ! এটি একালের একটি নতুন উদ্ভাবন, সন্দেহ নেই। বৃদ্ধ ও ছোটদের জন্য এটা যে কষ্টকর একথা আজকালকার বড়রা ভাবতে চায় না! আমাদের শৈশবে নামাজের পোষাক পরে দীর্ঘ সময় ঘুরাঘুরি করার মধ্যে অন্যরকম আমেজ ছিল।
সারাদিন বাড়িতে একটা গমগমে অবস্থা, কারণ স্কুল-কলেজ এবং অফিস ছুটি থাকায় আব্বা এবং বড় ভাইয়েরা সবাই বাড়িতেই উপস্থিত থাকতেন।
শেষ রাতে ঘুম ভেঙ্গে উঠে #সেহরি খাওয়ার মধ্যে ছিল আরেক ধরনের আনন্দ ও উত্তেজনা! আমি আর সেজো ভাই একসাথে ঘুমাতাম। আমি ছিলাম খানিকটা ঘুমকাতুরে। কিন্তু সেজো ভাইয়ের ধাক্কাধাক্কিতে আর কানের কাছে 'আম-ভাত ও ঘি-ভাত শেষ হয়ে যাচ্ছে' বারবার বলার কারণে হুড়মুড়িয়ে উঠেই পড়তাম। খাওয়া-দাওয়ার পর আব্বা-আম্মা চাইতেন আমরা শুয়ে পড়ি এবং ঘুমিয়ে যাই। কিন্তু তখন তো আর চোখে ঘুম আসে না! দুই ভাই লেপের ভেতর ঢুকে নিজেদের মধ্যে সে কি হাসাহাসি আর গল্প! মুরুব্বীরা সকলেই ফজরের নামাজ শেষ করে আবার ঘুমিয়ে পড়তেন।

শবে কদরের রাতে রেওয়াজ ছিল ঘরের সবাই রাত জেগে ইবাদত করবে। আমরা পিঠেপিঠি দুই ভাই আম্মার পাশে নামাজ পড়তে দাঁড়াতাম এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নামাজ পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম যেনো। আমাদের অবস্থা দেখে আম্মা হাসতে হাসতে আমাদের জন্য ব্যাপারটাকে আমাদের জন্য আরো সহজ করে দিতেন। আমাদের অত্যন্ত বৃদ্ধা নানি যেভাবে নামাজ পড়েন, বসে বসে বালিশের উপর সেজদা দিয়ে, তিনিও আমাদের জন্য সেই পদ্ধতি অনুসরণের অনুমতি দিতেন। আমরা দুই ভাই মহানন্দে ইয়া বড় দুই বালিশ নিয়ে এসে আম্মার পাশে বসে পড়তাম। নরোম বালিশের উপর আমাদের সিজদা দীর্ঘ হতে হতে একসময় আমরা দু’জনই ঘুমিয়ে পড়তাম। আমাদের জাগানো হতো সেহরির সময়। পরদিন অবশ্য আমরা বন্ধুদের সাথে সারারাত এবাদত করার কত যে গল্প করতাম!

শবে কদরের আগে-পরের দিনগুলোতে আমাদের ঈদের কেনাকাটা হতো। তাই অনেক সময় খুব ভালো জামা কাপড়র জন্য শবে কদরের নামাজে আমরা অনেক দোয়া করতাম। তবে, ঈদ এলে নিশ্চিতভাবেই নতুন জামা পাবো, এটা ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় বিষয়। একজোড়া নতুন জুতা-মোজা আর জামা (পাজামা-পাঞ্জাবী অথবা প্যান্ট-শার্ট) প্রত্যেক ছেলের জন্য অবধারিত ছিল। যদিও আমরা ছিলাম অনেকগুলো ভাই-বোন এবং মধ্যবিত্ত পরিবার! অবশ্য মেয়েদের জন্য সাজুগুজু করার অনেকগুলো উপকরণ ছিলো বলে আমরা ছেলেদের মনে হতো ওদের ঈদ-আনন্দটা আমাদের চেয়ে একটু বেশিই! ঈদের জামা-জুতা কিনতে বাজারে যাওয়ার আকর্ষণটা ছিল ভিন্ন রকম। আব্বার সাথে কোন একদিন বাজারে যেতাম এবং জুতা-মোজা আর জামা (শার্ট- প্যান্ট অথবা পাজামা-পাঞ্জাবী যেটাই বরাদ্দ থাকনা কেন) কিনে নিয়ে আসতাম। কাপড় কেনা হলে দর্জির কাছে যাওয়ার সুযোগ পেতাম। কখনো কখনো শার্ট বা প্যান্ট অথবা পাজামা-পাঞ্জাবি রেডিমেড কিনে আনা হতো। সবকিছু নির্ভর করত আব্বার ঈদ-বাজেটের উপর।

আমরা কাপড়গুলোকে অত্যন্ত যত্নের সাথে ইস্তিরি করে ঈদের জন্য রেখে দিতাম। #ঈদের আগে সেটা পরার তো প্রশ্নই উঠে না! এমনকি, অন্যদেরকে দেখানোর কোনো আগ্রহ আমাদের কারো থাকতো না। আমরা বরং প্রত্যেকে নিজের জামাকাপড়কে অন্যদের চোখ থেকে আড়াল করে রাখতাম, যেন ঈদের দিন নতুন জামা দেখানোর আনন্দটুকু অমলিন থাকে।

সাধারণতঃ সকালবেলা আমরা ছোটদের ঘুম থেকে তুলতে বড়দের অনেক কষ্ট হতো! কিন্তু ঈদের দিন সেই চিত্র বদলে যেতো। অনেক আগেই আমাদের ঘুম ভেঙে যেতো, নতুন কাপড় পরার উত্তেজনায় হয়তো! সকাল সকাল গোসল সেরে আমরা সবাই নতুন জামা কাপড় পরে একসাথে ঈদের জামাতে শরিক হওয়ার জন্য আব্বার পিছু পিছু #ঈদগাহের দিকে রওনা হতাম। আমাদের বাড়ির নিকটবর্তী স্কুলের মাঠে ঈদের জামাত হতো। আমার আব্বা ছিলেন এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং সমাজের সম্মানিতদের একজন। তাই আমাদের জন্য প্রথম কাতারে জায়গা রেখে দেয়া হতো। আব্বার সাথে আমরা ঈমামের কাছাকাছি প্রথম কাতারে গিয়ে বসতাম। চতুর্দিকের সব মহল্লার লোকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে নামাজ শুরু হতো। নামাজ শেষ করে দীর্ঘ সময় ধরে খোতবা হতো, এর মধ্যে চাঁদা তোলা হতো এবং সব শেষে মোনাজাত হতো। এরপর সবাই উঠে দাঁড়িয়ে একে অপরের সাথে কোলাকুলি শুরু করে দিতো। অদ্ভুত লোভনীয় এক দৃশ্য! ছোটদের সাথে কোলাকুলি করতে হলে বড়দেরকে ঝুঁকে নিচু হতে হয়! আমাদের সাথে সেটুকু আমোদ কেউ কেউ করতেন। অবশ্য আমরা ছোটরা নিজেদের মধ্যে বেশ কোলাকুলি করতাম। এই জড়াজড়িটা ছিল এক আনন্দের ব্যাপার।

ঈদগাহ থেকে ফিরে বাড়িতে আম্মা এবং পাশের ঘরগুলোতে চাচীদের কার আগে কে সালাম করতে পারে সেটাই ছিল প্রতিযোগিতা! সকলেই জড়িয়ে ধরতেন আর মাথায় হাত রেখে দোয়া করতেন। এরপর ঘরে কিছু মিষ্টিমুখ করে আমরা দল বেঁধে বের হতাম পুরো পাড়ার, এমনকি পার্শ্ববর্তী পাড়াগুলোরও, সবগুলো ঘরে এক এক করে উপস্থিত হয়ে ঈদের সালাম করার জন্য। মুরুব্বীরা হাসিমুখে আমাদের 'ঈদ মোবারক' বলে গ্রহণ করতেন এবং নানা রকমের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। চাকরিজীবী পুরুষ মুরুব্বীরা আমাদের পকেটের ঈদ-সেলামি খুঁজে দিতেন। এটাই ছিলো ছোটদের জন্য অনেক আনন্দের ব্যাপার! আমরা পরে হিসেব করতে বসতাম কার পকেটে কত ঈদ-সেলামী জমা হয়েছে তা দেখার জন্য। তখন ছিল এক আনা দুই আনার যুগ! কেউ আমাদেরকে চার আনার একখানি সিকি দিলে সেটা হতো অনেক বড় পাওয়া। আমাদের মেজ মামা ছিলেন তৎকালীন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের বড় একজন অফিসার। তিনি এলে আমি নিশ্চিতভাবেই জানতাম যে একখানি সিকি আমি পেয়ে যাবো। যদিও আনন্দ হতো অনেক কিন্তু অনেক হাঁটাহাঁটি করে আমরা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম এবং প্রত্যেক বাড়িতেই সেমাই খেয়ে তাদের সন্তুষ্ট করা খুব কষ্টকর হয়ে যেতো। আমার এখনো মনে পড়ে, আমাদের একজন চাচাতো বোন ছিলেন, বয়সে আমাদের চেয়ে অনেক বড়! প্রায় আম্মার সমবয়সী। তাঁর ছোট ছেলে ছিলো আমার সমবয়সী। আমরা তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি আমাদের সেমাই বা পিঠা জাতীয় কোন মিষ্টি খাবার না দিয়ে, ঝাল মাংসসহ গরম ভাত এনে হাজির করতেন। সারাদিন মিষ্টি খাওয়া মুখ আর পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে সেই খাবার যে আমাদের কাছে কতটা স্বাদু লাগতো তা এখন বর্ণনা করে বুঝাতে পারবো না।

ঈদের দিনে আমাদের শেষ গন্তব্য হতো আমাদের নানাবাড়ি। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে কিন্তু কখনো আমরা সেখানে একা একা যাওয়ার অনুমতি পেতাম না। কিন্তু #ঈদের দিন সেই অনুমতি পেতাম। কয়েকজন একসাথে মিলে এবাড়ি-ওবাড়ি, কাছেপিঠে সবগুলো আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি, ঘুরতে ঘুরতে আমরা শেষ পর্যন্ত নানার বাড়িতে পৌঁছাতে প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যেতো। আমাদের সবগুলো খালা এবং মামাদের ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই শেষ বিকেলে বা সন্ধ্যা নাগাদ নানা বাড়িতে এসে উপস্থিত হতো। সেখানে আমরা অনেকগুলো কাজিন অর্থাৎ মামাতো-খালাতো-ফুফাতো ভাই-বোনদের এক জমজমাট আসর বসতো প্রতিটি ঈদুল ফিতরে। বয়স অনুযায়ী ছোট ছোট অনেকগুলো দলে বিভক্ত হয়ে শুরু হয়ে যেত গল্প-গুজব। আমাদের তো গল্প ছিল কার কীভাবে ঈদের দিন কাটলো তা নিয়ে! গল্পে গল্পে আমাদের রাত কাবার হয়ে যেতো প্রায়। আর, ক্লান্ত-শ্রান্ত ছোট ছোট মানুষগুলো কে যে কীভাবে কোথায় ঘুমিয়ে পড়তাম তা আমি আজও মনে করতে পারিনা!

মিরপুর ঢাকা ০৫/০৪/২০২০

গফমাদের শৈশবের ঈদ ।। আশরাফ আল দীন

আমাদের #শৈশবের ঈদগুলো ছিল অনেক বেশি প্রাণবন্ত এবং হৃদয়বোধ সমৃদ্ধ। তখনকার দিনে এখনকার মতো আনন্দোপকরণের অত বেশি ঝলমলে উপাদান হয়তো ছিল না কিন্তু যেটুকু ছিল তার মূল্য ছিল আমাদের কাছে অনেক বেশি। আমরা অনেকদিন আগে থেকেই ঈদের জন্য অপেক্ষা করতাম। এই #ঈদ মানে হলো #ঈদুলফিতর। অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে ঈদের আগে আসত #রমাদান। আমাদের গ্রামের বাড়ির পেছনে ছিল বিশাল বাগিচা। সেই বাগিচার প্রান্তসীমায় শুরু হয়েছে ফসলের অন্তহীন খোলা মাঠ। সেখান থেকে খোলা আকাশের পশ্চিম দিগন্তটা পুরোপুরি চোখে পড়তো। ওখানেই চাঁদ উঠবে! আকাশের পশ্চিম দিকে যেখানে সূর্য ডোবে সেখানটাতেই #নতুনচাঁদ দেখা যায়। তাই আমরা বাগিচার প্রান্তসীমায় গিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতাম চাঁদ দেখার জন্য, রমাদানের #চাঁদ।

খুব চিকন এক ফালি #চাঁদ হঠাৎ করে কেউ দেখে ফেলতো এবং আমরা ছোটরা গাছের ফাঁক দিয়ে হয়তোবা একটুকরো মেঘের পাশে, বড়রা আঙ্গুল উঁচিয়ে অনেকক্ষণ ধরে "ওই যে!" "ওই যে!" বলার পর হঠাৎ করেই ওই ধান কাটার কাস্তের মতো খুব পাতলা ও চিকন চাঁদটাকে দেখে ফেলতাম। কোন কোন সময় দেখার সুবিধার জন্য নিজের উচ্চতা বাড়ানোর প্রয়োজনে ছোট মামা বা বড় ভাইয়ের কাঁধে চেপে বসতে হতো! সেটা ছিল অসাধারণ আনন্দ! রোজার আর ঈদের চাঁদ আকাশে থাকতো খুব অল্প সময়ের জন্য। আমাদের মনে হতো মাত্র কয়েক মিনিট! ছোটদের মধ্যে কেউ যদি খানিকটা দেরি করে আসতো, তাহলে সে চাঁদ দেখতে পেতো না, কারণ ততক্ষণে চাঁদটা ডুবে যেতো। তার না দেখার দুঃখের কারণে আমাদের দেখার আনন্দটা যেন আরো বেশি বেড়ে যেতো! #চাঁদ দেখার বিজয়ের আনন্দ নিয়ে আমরা ঘরে ফিরে এলে আম্মা আমাদেরকে #সেমাই দিয়ে মিষ্টিমুখ করাতেন।

পরদিন থেকে রোজা রাখা শুরু হবে, আজ রাত শেষ হবার আগেই সেহরি খেতে হবে এবং পরদিন প্রথম রোজার ইফতারের আয়োজন করা হবে। সব মিলিয়ে রান্নাঘরের রমরমা অবস্থা! আর তাতেই আমাদের মনে আনন্দের ফুরফুরে হাওয়া। আমাদের ঘরে একটা নিয়ম ছিল যে, সাধারণভাবে প্রতিদিন মাগরেবের নামাজের পর পরই আমাদের সব ভাইবোনকে পড়ার টেবিলে বসে যেতে হতো। তাই, সাঁঝের বেলা বসে পাড়ার অন্যদের মতো খানিকটা গল্পগুজব করার সুযোগ আমরা কখনো পেতাম না। বাড়ির অন্য ঘরগুলোতে এই সুযোগ ছিল বলে আমরা শুনতাম। আব্বার উপস্থিতি এবং সচেতন দৃষ্টির কারণে আমাদের জন্য সেই সুযোগ ছিল না। সন্ধ্যা হতেই খেলার মাঠ থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে সরাসরি পড়ার টেবিলে বসে যাওয়া রোজ রোজ কার আর ভালো লাগে? তাই কামনা করতাম কখন যে এই নিয়মের ব্যত্যয় হবে!

#রমাদান এলে #ইফতার আর #তারাবীর নামাজের কারণে আমাদের ঘরের এই নিয়মটা পরিবর্তিত হয়ে যেতো। খেলার মাঠ থেকে আগেভাগেই বাসায় ফিরে এসে হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে আমরা ছোটরা খাওয়ার টেবিলে #ইফতারির চতুর্দিকে ঘিরে বসে যেতাম। উচ্চস্বরে আমরা দুরুদ পড়তাম আর আড়চোখে দেখতাম কোন কোন আইটেম আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। অবশ্য অন্যান্য দিনগুলোতেও সন্ধ্যা হলেই বড়রা যখন মগরেবের নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন আমরা ছোটদেরকে ঘরের মূল দরোজার কাছে বসে উচ্চস্বরে দরুদ পড়তে হতো। বলা হতো, এতে নাকি ঘরে ফেরেসতারা আসে, আর শয়তান প্রবেশ করার সুযোগ পায় না। নিয়ম মোতাবেক বুট পেঁয়াজু হালিম ছাড়াও বেগুন ফুলকপি ডিম আলু ইত্যাদি দিয়ে তৈরি নানা পদ; কয়েক পদের মিষ্টান্ন ও সুজির তৈরি নাস্তা। কয়েক প্রকারের সেমাই হলো অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ। টেবিলে যেন বাটি রাখার জায়গা হতো না!

আমরা মোট নয় ভাইবোনে ভরা ঘরের মধ্যে সব বয়সের সদস্যই ছিলাম। প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল, কলেজ, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন এমন, আবার পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন এমন, আবার এখনো পড়াশোনা শুরুই করেনি এমন সদস্যও ছিল। ফলে, আমাদের রোজা পালনের ধরন ছিল নানা প্রকারের। আমাদের মধ্যে খুব ছোট যারা সারাদিন অভুক্ত থাকার কষ্ট সহ্য করতে পারবে না তাদেরকে বড়রা শিখিয়ে দিতেন রোজাটা কিভাবে কলা গাছের কাছে জমা রেখে এসে খাওয়া-দাওয়া করা যায়। এটা করা হতো আমাদের ছোটদের মধ্যে বড়দের অনুকরণ করে রোজা রাখার প্রচন্ড আগ্রহটাকে চাঙ্গা রাখার জন্য। #সেহরি খাওয়ার পর ছোটদের কেউ আর #রোজা ছেড়ে দিতে রাজি হতাম না। ক্ষুধায় শুকনো মুখে ঘোরাঘুরি করছে তবু রোজা ভাঙ্গবে না, আগ্রহ এতটাই বেশি! তাই মুরব্বীরা আড়ালে ডেকে এই বুদ্ধিটা শিখিয়ে দিতেন।

পদ্ধতিটা এমন যে কলাগাছের কাছে গিয়ে বাকলের কোন একটা অংশে একটা কামড় দিয়ে বলতে হবেঃ "কলাগাছ ভাই! তোমার কাছে আমার রোজাটা জমা রেখে গেলাম। একটু পরেই এসে নিয়ে যাবো।" বাতাসে কলাপাতা নড়ে উঠাটাই ওর সম্মতি! পুকুর পাড়ের কলা বাগান থেকে বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করে আবার গিয়ে কলাগাছে আরেকটা কামড় দিয়ে রোজাটাকে আমরা ফেরত নিয়ে আসতাম। ব্যাপারটা খানিকটা গোপনে করারই নিয়ম ছিল। কারণ, রোজাদারদের দেখিয়ে কিছু খাওয়া যে গোনাহর কাজ এই কথা কিভাবে যেন আমরা জানতাম। আসলে, বেলা বাড়ার সাথে সাথে যখন ক্ষুধার কামড়ও বাড়তে থাকতো তখন আমাদের কাছে এই পরামর্শটা খুব মনে ধরতো। এতে আবার আমরা ছোটদের রোজার সংখ্যাও বেড়ে যেতো। বন্ধুদের মধ্যে কে কতটা রোজা রাখলো এই নিয়ে হিসেব-নিকেশের সময় এটা বড্ড কাজে আসতো! একদিনে যখন বড়দের একটা রোজাই হয় তখন একদিনেই ছোটদের কারো দুইটা, কারো তিনটা, আর কারোবা চারটা পর্যন্ত রোজা হয়ে যেতো।

রোজার মাসটা আমাদের জন্য বেশ অন্যরকম আনন্দের সময় ছিলো। অনেকক্ষণ খেলাধুলা করেও যেন সময় শেষ হয় না! খেলাধুলা এবং নানা পদের খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি এটা ছিল আমাদের জন্য একপ্রকার প্রশিক্ষণের মাস। নামাজ শেখা, কোরআন শেখা, গল্পের মত করে বড়দের মুখে ইসলামের বিভিন্ন বিধি-নিষেধ এবং ইতিহাস জানার অনেক সময় পাওয়া যেতো। একবার তো ছোটমামার কথা শুনে আমরা থ’! মামা বল্লেন,

: “জানিস! এই যে আমরা এতো হৈ-হুল্লোড় করে রোজা রাখি, এই শব্দটাই কোরআন বা হাদিসের কোথাও নেই? কোরআন-হাদিসের কোথাও ‘রোজা’ শব্দটা নেই, আছে ‘সওম’বা #সিয়াম। যদিও রোজা নাম দিয়ে আমরা #সিয়াম পালনের এবাদতটাই করছি।” ঘাবড়ে যাওয়ার মতো কথা! আমি তো বলেই ফেল্লাম,

: “সর্বনাশ! সারাদিন না খেয়ে খেয়ে যে এতো কষ্ট করলাম, সবই কি তবে বৃথা!” মামা বিজ্ঞের মতো আমাদের সাহস আর সান্তনা দিয়ে বলেন,

: “ঘাবরাস নে! আমাদের এবাদত ঠিকই হচ্ছে, তবে ভিন্ন নামে আর কী!” আমার মনের খুঁতখুঁতে ভাব যে যায় নি, তা শেজভাই ঠিকই বোঝেন। উনিও পন্ডিতের মতো, আমাকে একটা টিপ দিয়ে বল্লেন,

: “বুঝিস না? তোর যেমন দু’টা নাম, একটা ডাকনাম আর অন্যটা ভালোনাম! সেরকম আর কি!” উনার মতো চট করে বুঝা আমার হয়ে ওঠে না! খানিকটা হাবা-ই ছিলাম বলা যায়। মামাকে মিনমিন করে বল্লাম,

: “কোরআন-হাদীসে যা নেই তা এতো যত্ন করে লালন করার দরকার কি? আমরা রোজা না বলে সওম বল্লেই তো পারি! নিশ্চয় আল্লাহ এতেই খুশি হবেন!”

: “একই ধর্ম ইসলাম পৃথিবীর নানা অঞ্চলে নানাভাবে নানা পরিবেশে প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছে। এজন্যেই তোরা দেখবি মূল তওহীদের ব্যাপারটা ঠিক থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে ব্যবহারিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু এতে কোন অসুবিধা নেই। এইসব পার্থক্যের জন্য এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে ঘৃণা করবে না। এসব অমিলকে বিরোধ নয়, বরং সৌন্দর্য হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। উদারতা দিয়ে ইসলাম এসবকে গ্রহণ করে।” মামার কথা শুনে বল্লাম,

: “রোজা শব্দটা তাহলে কীভাবে এলো?” শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
: “আরে! ও বলে কী? আমরা তো জন্ম থেকে এটাই শুনে আসছি! রোজা না বললে কেউ কি বুঝবে?” কেউ একজন বললো এবং সবাই আবারো হেসে উঠলো। মামা কিন্তু আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বল্লেন,

: “তোকে তো মামা আমার তাহলে অনেক দীর্ঘ ইতিহাস শোনাতে হবে! আমার কি এতো সময় হবে?” এবার শেজভাই-ই আবদার করে বসলো,

: “মামা! কিছুটা হলেও বলো না! তা’নাহলে ও তো আমাকে আজ ঘুমাতে দেবে না; খালি প্রশ্ন করবে!” শুনে মামা বল্লেন,

: “হুম। এতো কথা বলে শেষ করা যাবে না। তোদেরকেই বই পড়ে জানতে হবে। তবে, এখন খানিকটা শোনাই।” এবার মামা খুব গুছিয়ে কিছু ইতিহাস বল্লেন। আমরা গল্প শোনার মতো মনোযোগ দিয়ে নিঃশব্দে শুনতে থাকলাম।

“বহু পুরাতন কাল থেকেই আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে একটি পৌরাণিক সভ্যতা বিরাজ করছিলো। পৌরাণিক গল্প-ভিত্তিক যে লোকাচার এখানে এতদঞ্চলে প্রচলিত ছিল তাকে সুনির্দিষ্ট কোন ধর্ম বলা যায় না; তবে, হাজার বছরে গড়ে ওঠা এই ধর্মাচারের রূপ ছিলো একেক অঞ্চলে একেক রকম। সমাজগুলোতে চরম বৈষম্যমুলক শ্রেণীভেদ ছিলো, নরবলি ও সহমরণের মতো নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রথা চালু ছিল ধর্মের নামে। জ্ঞান চর্চা ও বিতরণের ব্যবস্থা ছিলো অত্যন্ত সীমিত ও বিদ্বেষমুলক। শুদ্র ও অপরাপর নিন্ম শ্রেণীর মানুষের কোন অধিকার ছিল না জ্ঞানার্জনের। গুরু-শিষ্যের যে নিয়ম চালু ছিলো তাতে একজন গুরু সারা জীবনে মাত্র একজন শিষ্যকেই মন্ত্র শিখিয়ে যেতেন। এই পরিস্থিতিতে ইসলাম এসে এই অঞ্চলের মানুষকে উপহার দিলো সামাজিক সুবিচার এবং জ্ঞান অর্জনের ও জ্ঞান বিতরণের দরোজাকে করে দিলো অবারিত, উম্মুক্ত। সাধারণ মানুষের চরম আগ্রহে তাদের ইসলাম বিষয়ক ও অন্যান্য জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার জন্য দলে দলে যে সকল শিক্ষক-গবেষক ও জ্ঞানী পুরুষরা এসেছিলেন তাদের অধিকাংশই এসেছিলেন মধ্য এশিয়া ও পারস্য (আজকের ইরান) থেকে। পারস্যের ভাষা ছিলো পার্সী এবং লোকেরা ছিলো শিয়া মুসলমান। তাই এখনো এই উপমহাদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় রীতি-নীতি ও আচরণের মধ্যে পার্সী ভাষার অনেক শব্দ এবং শিয়া মুসলমানদের অনেক রীতি ও আচরণ মিলেমিশে আছে। যদিও এই অঞ্চলের সকল মুসলমানই দাবী করে যে তারা ‘সুন্নী মুসলমান’। আমরা যে ‘খোদা’ বলি এই শব্দও কোরআন-হাদিসে নেই, আছে ‘আল্লাহ’। তেমনি ‘নামাজ’ নেই, আছে ‘#সালাত’। এই যে রোজা, নামাজ, খোদা- এ সবই ইরান থেকে আসা! এই সব তোদের জানার জন্যে বল্লাম, কোন বিতন্ডা করার জন্য নয়! বুঝলি?” এই কথা বলে ছোট মামা সাঁই করে বেরিয়ে গেলেন। আমরা কেবল তন্ময় হয়ে বসে রইলাম।

রোজার মাসে আমরা বড়দের পাশাপাশি দাড়িয়ে নামাজ পড়ার সুযোগ পেতাম। যাদের মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হতো তারা মসজিদে যেতো রীতিমতো পাঞ্জাবী-টুপি লাগিয়ে পাক্কা মুসল্লী সেজে । অন্যরা ঘরে আম্মাদের সাথে নামাজে দাঁড়াতো। আব্বা আমার জামায় ও হাতে খানিকটা আতর লাগিয়ে দিতেন। বাড়ীতে ফেরার পরও অনেক্ষণ হাত উল্টে আমি তা শুঁকে শুঁকে দেখতাম। এখোনকার মতো এতো দীর্ঘ তারাবী আমাদের ছোটবেলায় হতে দেখিনি বা শুনিনি। তখোন সব মসজিদেই সুরা #তারাবীহ হতো। কদাচিৎ শোনা যেতো কোন এক মসজিদে খতমে তারাবীহ হচ্ছে। আজকাল তো একটি মসজিদও খুঁজে পাওয়া যায় না যেখানে সুরা তারাবীহ হচ্ছে; সব মসজিদেই খতমে #তারাবীহ! এটি একালের একটি নতুন উদ্ভাবন, সন্দেহ নেই। বৃদ্ধ ও ছোটদের জন্য এটা যে কষ্টকর একথা আজকালকার বড়রা ভাবতে চায় না! আমাদের শৈশবে নামাজের পোষাক পরে দীর্ঘ সময় ঘুরাঘুরি করার মধ্যে অন্যরকম আমেজ ছিল।
সারাদিন বাড়িতে একটা গমগমে অবস্থা, কারণ স্কুল-কলেজ এবং অফিস ছুটি থাকায় আব্বা এবং বড় ভাইয়েরা সবাই বাড়িতেই উপস্থিত থাকতেন।
শেষ রাতে ঘুম ভেঙ্গে উঠে #সেহরি খাওয়ার মধ্যে ছিল আরেক ধরনের আনন্দ ও উত্তেজনা! আমি আর সেজো ভাই একসাথে ঘুমাতাম। আমি ছিলাম খানিকটা ঘুমকাতুরে। কিন্তু সেজো ভাইয়ের ধাক্কাধাক্কিতে আর কানের কাছে 'আম-ভাত ও ঘি-ভাত শেষ হয়ে যাচ্ছে' বারবার বলার কারণে হুড়মুড়িয়ে উঠেই পড়তাম। খাওয়া-দাওয়ার পর আব্বা-আম্মা চাইতেন আমরা শুয়ে পড়ি এবং ঘুমিয়ে যাই। কিন্তু তখন তো আর চোখে ঘুম আসে না! দুই ভাই লেপের ভেতর ঢুকে নিজেদের মধ্যে সে কি হাসাহাসি আর গল্প! মুরুব্বীরা সকলেই ফজরের নামাজ শেষ করে আবার ঘুমিয়ে পড়তেন।

শবে কদরের রাতে রেওয়াজ ছিল ঘরের সবাই রাত জেগে ইবাদত করবে। আমরা পিঠেপিঠি দুই ভাই আম্মার পাশে নামাজ পড়তে দাঁড়াতাম এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নামাজ পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম যেনো। আমাদের অবস্থা দেখে আম্মা হাসতে হাসতে আমাদের জন্য ব্যাপারটাকে আমাদের জন্য আরো সহজ করে দিতেন। আমাদের অত্যন্ত বৃদ্ধা নানি যেভাবে নামাজ পড়েন, বসে বসে বালিশের উপর সেজদা দিয়ে, তিনিও আমাদের জন্য সেই পদ্ধতি অনুসরণের অনুমতি দিতেন। আমরা দুই ভাই মহানন্দে ইয়া বড় দুই বালিশ নিয়ে এসে আম্মার পাশে বসে পড়তাম। নরোম বালিশের উপর আমাদের সিজদা দীর্ঘ হতে হতে একসময় আমরা দু’জনই ঘুমিয়ে পড়তাম। আমাদের জাগানো হতো সেহরির সময়। পরদিন অবশ্য আমরা বন্ধুদের সাথে সারারাত এবাদত করার কত যে গল্প করতাম!

শবে কদরের আগে-পরের দিনগুলোতে আমাদের ঈদের কেনাকাটা হতো। তাই অনেক সময় খুব ভালো জামা কাপড়র জন্য শবে কদরের নামাজে আমরা অনেক দোয়া করতাম। তবে, ঈদ এলে নিশ্চিতভাবেই নতুন জামা পাবো, এটা ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় বিষয়। একজোড়া নতুন জুতা-মোজা আর জামা (পাজামা-পাঞ্জাবী অথবা প্যান্ট-শার্ট) প্রত্যেক ছেলের জন্য অবধারিত ছিল। যদিও আমরা ছিলাম অনেকগুলো ভাই-বোন এবং মধ্যবিত্ত পরিবার! অবশ্য মেয়েদের জন্য সাজুগুজু করার অনেকগুলো উপকরণ ছিলো বলে আমরা ছেলেদের মনে হতো ওদের ঈদ-আনন্দটা আমাদের চেয়ে একটু বেশিই! ঈদের জামা-জুতা কিনতে বাজারে যাওয়ার আকর্ষণটা ছিল ভিন্ন রকম। আব্বার সাথে কোন একদিন বাজারে যেতাম এবং জুতা-মোজা আর জামা (শার্ট- প্যান্ট অথবা পাজামা-পাঞ্জাবী যেটাই বরাদ্দ থাকনা কেন) কিনে নিয়ে আসতাম। কাপড় কেনা হলে দর্জির কাছে যাওয়ার সুযোগ পেতাম। কখনো কখনো শার্ট বা প্যান্ট অথবা পাজামা-পাঞ্জাবি রেডিমেড কিনে আনা হতো। সবকিছু নির্ভর করত আব্বার ঈদ-বাজেটের উপর।

আমরা কাপড়গুলোকে অত্যন্ত যত্নের সাথে ইস্তিরি করে ঈদের জন্য রেখে দিতাম। #ঈদের আগে সেটা পরার তো প্রশ্নই উঠে না! এমনকি, অন্যদেরকে দেখানোর কোনো আগ্রহ আমাদের কারো থাকতো না। আমরা বরং প্রত্যেকে নিজের জামাকাপড়কে অন্যদের চোখ থেকে আড়াল করে রাখতাম, যেন ঈদের দিন নতুন জামা দেখানোর আনন্দটুকু অমলিন থাকে।

সাধারণতঃ সকালবেলা আমরা ছোটদের ঘুম থেকে তুলতে বড়দের অনেক কষ্ট হতো! কিন্তু ঈদের দিন সেই চিত্র বদলে যেতো। অনেক আগেই আমাদের ঘুম ভেঙে যেতো, নতুন কাপড় পরার উত্তেজনায় হয়তো! সকাল সকাল গোসল সেরে আমরা সবাই নতুন জামা কাপড় পরে একসাথে ঈদের জামাতে শরিক হওয়ার জন্য আব্বার পিছু পিছু #ঈদগাহের দিকে রওনা হতাম। আমাদের বাড়ির নিকটবর্তী স্কুলের মাঠে ঈদের জামাত হতো। আমার আব্বা ছিলেন এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং সমাজের সম্মানিতদের একজন। তাই আমাদের জন্য প্রথম কাতারে জায়গা রেখে দেয়া হতো। আব্বার সাথে আমরা ঈমামের কাছাকাছি প্রথম কাতারে গিয়ে বসতাম। চতুর্দিকের সব মহল্লার লোকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে নামাজ শুরু হতো। নামাজ শেষ করে দীর্ঘ সময় ধরে খোতবা হতো, এর মধ্যে চাঁদা তোলা হতো এবং সব শেষে মোনাজাত হতো। এরপর সবাই উঠে দাঁড়িয়ে একে অপরের সাথে কোলাকুলি শুরু করে দিতো। অদ্ভুত লোভনীয় এক দৃশ্য! ছোটদের সাথে কোলাকুলি করতে হলে বড়দেরকে ঝুঁকে নিচু হতে হয়! আমাদের সাথে সেটুকু আমোদ কেউ কেউ করতেন। অবশ্য আমরা ছোটরা নিজেদের মধ্যে বেশ কোলাকুলি করতাম। এই জড়াজড়িটা ছিল এক আনন্দের ব্যাপার।

ঈদগাহ থেকে ফিরে বাড়িতে আম্মা এবং পাশের ঘরগুলোতে চাচীদের কার আগে কে সালাম করতে পারে সেটাই ছিল প্রতিযোগিতা! সকলেই জড়িয়ে ধরতেন আর মাথায় হাত রেখে দোয়া করতেন। এরপর ঘরে কিছু মিষ্টিমুখ করে আমরা দল বেঁধে বের হতাম পুরো পাড়ার, এমনকি পার্শ্ববর্তী পাড়াগুলোরও, সবগুলো ঘরে এক এক করে উপস্থিত হয়ে ঈদের সালাম করার জন্য। মুরুব্বীরা হাসিমুখে আমাদের 'ঈদ মোবারক' বলে গ্রহণ করতেন এবং নানা রকমের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। চাকরিজীবী পুরুষ মুরুব্বীরা আমাদের পকেটের ঈদ-সেলামি খুঁজে দিতেন। এটাই ছিলো ছোটদের জন্য অনেক আনন্দের ব্যাপার! আমরা পরে হিসেব করতে বসতাম কার পকেটে কত ঈদ-সেলামী জমা হয়েছে তা দেখার জন্য। তখন ছিল এক আনা দুই আনার যুগ! কেউ আমাদেরকে চার আনার একখানি সিকি দিলে সেটা হতো অনেক বড় পাওয়া। আমাদের মেজ মামা ছিলেন তৎকালীন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের বড় একজন অফিসার। তিনি এলে আমি নিশ্চিতভাবেই জানতাম যে একখানি সিকি আমি পেয়ে যাবো। যদিও আনন্দ হতো অনেক কিন্তু অনেক হাঁটাহাঁটি করে আমরা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম এবং প্রত্যেক বাড়িতেই সেমাই খেয়ে তাদের সন্তুষ্ট করা খুব কষ্টকর হয়ে যেতো। আমার এখনো মনে পড়ে, আমাদের একজন চাচাতো বোন ছিলেন, বয়সে আমাদের চেয়ে অনেক বড়! প্রায় আম্মার সমবয়সী। তাঁর ছোট ছেলে ছিলো আমার সমবয়সী। আমরা তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি আমাদের সেমাই বা পিঠা জাতীয় কোন মিষ্টি খাবার না দিয়ে, ঝাল মাংসসহ গরম ভাত এনে হাজির করতেন। সারাদিন মিষ্টি খাওয়া মুখ আর পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে সেই খাবার যে আমাদের কাছে কতটা স্বাদু লাগতো তা এখন বর্ণনা করে বুঝাতে পারবো না।

ঈদের দিনে আমাদের শেষ গন্তব্য হতো আমাদের নানাবাড়ি। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে কিন্তু কখনো আমরা সেখানে একা একা যাওয়ার অনুমতি পেতাম না। কিন্তু #ঈদের দিন সেই অনুমতি পেতাম। কয়েকজন একসাথে মিলে এবাড়ি-ওবাড়ি, কাছেপিঠে সবগুলো আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি, ঘুরতে ঘুরতে আমরা শেষ পর্যন্ত নানার বাড়িতে পৌঁছাতে প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যেতো। আমাদের সবগুলো খালা এবং মামাদের ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই শেষ বিকেলে বা সন্ধ্যা নাগাদ নানা বাড়িতে এসে উপস্থিত হতো। সেখানে আমরা অনেকগুলো কাজিন অর্থাৎ মামাতো-খালাতো-ফুফাতো ভাই-বোনদের এক জমজমাট আসর বসতো প্রতিটি ঈদুল ফিতরে। বয়স অনুযায়ী ছোট ছোট অনেকগুলো দলে বিভক্ত হয়ে শুরু হয়ে যেত গল্প-গুজব। আমাদের তো গল্প ছিল কার কীভাবে ঈদের দিন কাটলো তা নিয়ে! গল্পে গল্পে আমাদের রাত কাবার হয়ে যেতো প্রায়। আর, ক্লান্ত-শ্রান্ত ছোট ছোট মানুষগুলো কে যে কীভাবে কোথায় ঘুমিয়ে পড়তাম তা আমি আজও মনে করতে পারিনা!

মিরপুর ঢাকা ০৫/০৪/২০২০

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০২০ রাত ১০:৩২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×