somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-৩৭ | হযরত আবু বকরের খিলাফত (৬৩২-৬৩৪ সাল)

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


খিলাফতের ইতিহাসের প্রথম চারজন খলিফাকে বলা হয় ‘খোলাফায়ে রাশেদীন’। ৬৩২ সাল থেকে ৬৬১ সাল পর্যন্ত তারা খিলাফত পরিচালনা করেছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে উম্মাহ সমাজ আরবের চিরায়ত গোত্রবাদী সমাজকে পেছনে ফেলে এক নতুন রাষ্ট্রবাদী সমাজ বিনির্মাণের পথে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গোত্রবাদের কার্যকারিতা এই সমাজে যথেষ্ট পরিমাণে থেকে গিয়েছিল। তাই খিলাফতে রাশেদার প্রথম বিশ বছর রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে পার হলেও শেষ দশ বছর কেটেছিল গোত্রীয় বিরোধ-বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।

গোত্রীয় বিরোধ, রাজনৈতিক বিদ্রোহ এবং গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে খিলাফতে রাশেদার পতনের পর সমাজে শক্তিশালী একনায়কের আবির্ভাবের পটভূমি সৃষ্টি হয়। এ পটভূমিতেই ৬৬১ সালে ইসলামি খিলাফতের রাজতন্ত্রে উত্তরণ ঘটে। মূলত তখনই মুসলমানদের মধ্যে রোম ও পারস্যের আদলে স্থায়ী রাজতন্ত্রের সূচনা হয়। তখন থেকে সমাজের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় রাষ্ট্রের হাতে এবং সকল গোত্রীয় ক্ষমতার উর্ধ্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলমানদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তখনই।

৬৩২ সাল থেকে ৬৬১ সাল পর্যন্ত যে চারজন খলিফা ক্ষমতায় ছিলেন তারা পুরোপুরি রাষ্ট্রবাদের নিয়মে খিলাফত পরিচালনা করেননি। যদিও তারা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলেছিলেন, তাদের এই রাষ্ট্রবাদ বা হুকুমাত পরিচালিত হয়েছিল অনেকটাই গোত্রীয় নেতৃত্বের নিয়মেই। ৬৬১ সালে হযরত মুয়াবিয়া আরবীয় গোত্রীয় পদ্ধতির বাইরে এসে বাইজেন্টাইন ও পারসীয়দের মতো পূর্ণাঙ্গ রাজতন্ত্রী হুকুমাত প্রবর্তন করেন।

হযরত মুয়াবিয়ার উমাইয়া সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়ের পূর্বে খোলাফায়ে রাশেদীনের যে চারজন খলিফা ক্ষমতায় ছিলেন তারা হলেন হযরত আবু বকর, হযরত উমার, হযরত উসমান এবং হযরত আলী (রা.)। ৬৩২ সালে মহানবীর মৃত্যুর পর উম্মাহর নেতা নির্বাচনের প্রশ্নে উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে হযরত আবু বকর ইসলামের ইতিহাসে প্রথম খলিফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৬৩২ সালের ৮ জুন মদিনার বনু সায়েদা গোত্রের চত্বরে খিলাফতের প্রাথমিক বাইআত গ্রহণের পরদিন হযরত আবু বকর মসজিদে নববীর মিম্বরে বসেন।

সেখানে হযরত উমর হযরত আবু বকরের নেতৃত্বের সমর্থনে এক বক্তব্য প্রদান করেন এবং উপস্থিত লোকজনকে হযরত আবু বকরের কাছে বাইআত গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “তোমরা তাঁর কাছে বাইআত করে তাকে খলীফা বা আমীর হিসেবে গ্রহণ কর।” তখন লোকেরা দ্বিতীয়বার তাঁর হাতে বাইআত করে। এটি ছিল বনু সায়েদা চত্বরের বাইআতের পর সার্বজনীন বাইআত। হযরত আবু বকরের খলিফা হওয়ার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের নিজেদের একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু সময়টি মোটেও হযরত আবু বকর কিংবা ইসলামি খিলাফতর অনুকূলে ছিল না।

মহানবীর সর্বকনিষ্ট স্ত্রী ও হযরত আবু বকরের কন্যা হযরত আয়েশা জানান মহানবীর মৃত্যুর পর আরবরা স্বধর্ম (ইসলাম) ত্যাগ করতে শুরু করে, ইহুদী ও খ্রিষ্টান গোত্রগুলো মাথা তোলতে আরম্ভ করে এবং মুনাফেকী বিস্তার লাভ করে। রাসূলুল্লাহ কে হারানোর দরুন মুসলমানদের অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় শীতের রাতে বর্ষনসিক্ত মেষপালের মতো। আবু বকরের নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই অবস্থা অব্যাহত থাকে। (সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা: ৩৬১)

ইবনে হিশাম বলেন- আবু উবাইদা প্রমুখ বিজ্ঞ লোকেরা আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহর ইনতিকালের সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ মক্কাবাসী ইসলাম ত্যাগ করার মনোভাব গ্রহণ করে। তা দেখে মক্কার তৎকালীন শাসনকর্তা আত্তাব ইবনে উসাইদ ভয়ে আত্মগোপন করেন। এরপর সুহাইল ইবনে আমের মক্কাবাসীদেরকে সমবেত করে ভাষন দেন। তিনি রাসূলুল্লাহর ইনতিকালের কথা জানিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি সংশয় ও বিভ্রান্তির ছাড়বে আমরা তার শিরোচ্ছেদ কবর’। এরপর লোকজন মত পাল্টালো এবং আত্তাব ইবনে উসাইদ আত্মপ্রকাশ করলেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃ: ৩৬০)

হযরত আবু বকর খলিফা হওয়ার পর সাহস ও দৃঢ়তার সাথে জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নেন। আরবদের সামনে মুসলমানদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য তিনি খলিফা হওয়ার পরদিনই সিরিয়া সীমান্তে অভিযানের জন্য ৭০০ সৈন্যের একটি বাহিনী পাঠিয়ে দেন। সিরিয়া ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশ। মহানবীর জীবদ্দশায় ৬২৯ সালে মুসলমানরা দক্ষিণ সিরিয়ায় এক অভিযানে গিয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন। দক্ষিণ সিরিয়ার নাম ছিল মুতা। তাই এ যুদ্ধকে মুতার যুদ্ধ বলা হয়।

মুতার যুদ্ধে মুসলমানদের শোচনীয় পরাজয়ের ফলে সিরিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন যেসব গোত্র আগে মুসলমানদের সাথে যোগ দিয়েছিল তারা মুসলমানদের পক্ষ ছেড়ে দেয়। এসব গোত্রের উপর পুনঃপ্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য এবং মুতার যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য হযরত আবু বকর উসামার নেতৃত্বে ৭০০ সৈন্যের এক বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এ অভিযান সফল হয়েছিল। দেড় মাসের মাথায় উসামা বিজয়ীর বেশে রাজধানী মদিনায় ফিরে আসেন।

হযরত আবু বকরের দু’বছরের শাসনামলের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে রিদ্দার যুদ্ধে। ‘রিদ্দা’ মানে হল স্বধর্মত্যাগী আন্দোলন। মহানবীর মৃত্যুর পরে কেবল মদিনা ছাড়া আরবের সর্বত্র ইসলাম ত্যাগের হিড়িক পড়ে যায় এবং কতিপয় স্বঘোষিত নবীর আবির্ভাব ঘটে। এর ফলে হেজাজ প্রদেশ ছাড়া আরবের অন্যান্য অঞ্চলে মুসলিম কর্তৃত্ব কার্যত বিলুপ্তি লাভ করে এবং ইসলাম ধর্ম কেবল মদিনা নগরীতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। মুসলিম শসনের চি‎হ্ন মুছে ফেলার জন্য ইসলাম বর্জনকারি আরব গোত্রগুলো বদ্ধপরিকর হয়।

এসকল বিদ্রোহী গোত্র এবং স্বঘোষিত নবীদের আন্দোলনকে ইসলামের ইতিহাসে ‘রিদ্ধা’ বা স্বধর্মত্যাগী আন্দোলন বলা হয়। তাই এদের বিরুদ্ধে পরিচালিত মুসলিম অভিযানকে রিদ্দার যুদ্ধ বলা হয়। আরবের স্বঘোষিত নবীদের মধ্যে ইয়েমেনের আসাদ আনসি, মধ্য আরবের ইয়ামামা অঞ্চলের মুসাইলিমা কাযযাব, উত্তর আরবের বনু আসাদ গোত্রের তোলায়হা এবং মধ্য আরবের ইয়ারবু গোত্রের সাজাহ নামক জনৈক খ্রিষ্টান নারী ছিলেন উল্লেখযোগ্য।

ইয়েমেনের আসাদ আনসি মহানবীর জীবদ্দশায়ই নিজেকে নবী দাবী করেছিলেন এবং ইয়েমেন থেকে মুসলিম প্রতিনিধিকে বিতাড়িত করে পুরো ইয়েমেন ও নজরান দখল করেছিলেন। মহানবীর মৃত্যুর আগের দিন তিনিও মারা যান। তবে তাঁর অনুসারীরা মদিনার কর্তৃত্ববিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখে। মধ্য আরবের বনু হানিফা গোত্রের মুসাইলিমা কাযযাব ছিলেন স্বাঘোষিত নবীদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। নবুওয়্যাতের দাবীদার খ্রিষ্টান নারী সাজাহ মুসাইলিমাকে বিয়ে করেছিলেন।

তারা উভয়ে মদিনার ইসলামি খিলাফতের বিরুদ্ধে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। উত্তর আরবের বনু আসাদ গোত্রের তোলায়হা মদিনার বেদুইনদেরকে খিলাফতের বিরোধীতায় প্ররোচিত করেন। কর আদায় কিংবা অন্য কোন ধর্মীয় কাজে সারা আরবে যেসব মুসলমান কর্মচারি বা প্রতিনিধি নিয়োজিত ছিলেন, তারা বিদ্রোহের শিকারে পরিণত হন। এদের অনেকে ইসলাম বর্জনকারি বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। আবার অনেকে পালিয়ে মদিনায় চলে আসেন।

খলিফা আবু বকর তাঁর বেশ কিছু প্রশিক্ষিত সৈন্যকে সিরিয়া সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়ায় মদিনাও অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল। যে কোন মুহুর্তে মদিনায় বিদ্রোহীদের আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দেয়। খলিফা মদিনা নগরী রক্ষার জন্য মদিনার বিভিন্ন প্রবেশপথে প্রহরী নিযুক্ত করেন। হযরত আলী, তালহা ও যুবাইর প্রহরী দলের অধিনায়ক ছিলেন। স্বঘোষিত নবী তোলায়হার প্ররোচনায় বনু আবস ও বনু জুবিয়ান গোত্রদ্বয় মদিনার উপকণ্ঠে আক্রমণ চালায়। তবে জুলকাশা ও রাবাজার যুদ্ধে তারা মুসলিম সৈন্যদের হাতে পরাজিত হয়। ফলে মদিনা নগরী রক্ষা পায়।

খলিফা শীঘ্রই পুরো আরবের স্বধর্মত্যাগী আন্দোলন দমনের জন্য মরিয়া হয়ে মাঠে নামেন। তিনি সমস্ত মুসলমানদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। তাঁর সংগৃহীত সৈন্যদেরকে তিনি ১১টি দলে ভাগ করেন এবং দশটি দলকে দশজন অভিজ্ঞ সেনাপতির নেতৃত্বে আরবের বিভিন্ন অংশে পাঠিয়ে দেন। একটি দলকে খলিফা তাঁর নেতৃত্বে মদিনা রক্ষার জন্য রেখে দেন। বাকী দশটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ, ইকরামা বিন আবু জেহেল, সুরাহবিল, মোজাহির বিন আবি উমাইয়া প্রমুখ।

খালিদ বিন ওয়ালিদ গাতফান ও আসাদ গোত্রের নবী তোলায়হাকে পরাজিত করেন। এরপর পরাজিত করেন বনি তানিম গোত্রের উপগোত্র বনি ইয়ারবু সম্প্রদায়কে। এরপর খালিদের বাহিনী এগিয়ে যায় ইকরামা ও সুরাহবিলের বাহিনীর সাহায্যার্থে। তাদের সম্মিলিত বাহিনী ইয়ামামার যুদ্ধে স্বঘোষিত নবী মুসাইলিমাকে পরাজিত করে। যুদ্ধে মুসাইলিমার চল্লিশ হাজার সৈন্যের মধ্যে দশ হাজার সৈন্য নিহত হয় এবং মুসাইলিমা নিজেও নিহত হন।

বেঁচে যাওয়া স্বঘোষিত নবীদের মধ্যে তোলায়হা ও সাজাহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সেনাপতি মোজাহির ইকরামার সাহায্যে হাজারামাউত ও ইয়েমেনের বিরুদ্ধবাদীদেরকে পরাজিত করেন। সেনাপতি আল আলা পারসিকদের সমর্থনপুষ্ঠ বনি বকর গোত্রকে পরাজিত করে বাহরাইনে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। লাকিদ বিন মালিক নামে আম্মানের এক স্বঘোষিত নবীকে পরাজিত করেন সেনাপতি হোজায়ফা ও ইকরামা। তারা আম্মান ও মাহরাবের বিদ্রোহ দমন করেছিলেন।

মদিনার সন্নিকটস্থ বিদ্রোহী বেদুইন গোত্রগুলোকে পরাজিত করেন হযরত আলী, তালহা ও যুবাইর। রিদ্দার যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বীরত্ব দেখিয়ে ছিলেন হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ। হযরত আবু বকরের দৃঢ় সংকল্প ও খালিদের বীরত্ব এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ী করেছিল। রিদ্দার যুদ্ধে বিজয়ের ফলে ইসলাম আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। রিদ্দার যুদ্ধ প্রশমিত হয়ে আসলে খলিফা আবু বকর পারস্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে সংঘর্ষের প্রস্তুতি নেন।

এ দুই সাম্রাজ্য তখনকার ইসলামি খিলাফতকে তিন দিকে ঘিরে রেখেছিল। তবে এ দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে কোন সুসম্পর্ক ছিলনা। পারস্পরিক যুদ্ধে এ দুই সাম্রাজ্যেই দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে বাইজেন্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্য পরস্পরের সাথে বার বার যুদ্ধে জড়িয়েছে। এরই অংশ হিসেবে পারস্য সম্রাট তৃতীয় খসরু ৬০২ সালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে একটি দীর্ঘ যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। ৬১৪ সালে পারসিকরা বাইজেন্টাইনদের হাত থেকে জেরুজালেম অধিকার করে নিয়েছিল।

৬১৯ সাল নাগাদ তারা এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ পশ্চিম অংশ এবং মিশর দখল করতে সক্ষম হয়। তবে শেষ পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস পারসিকদের গতিরোধ করতে সক্ষম হন এবং ৬২৭ সালের মধ্যে পারসিকদেরকে পশ্চাদপাসরণে বাধ্য করেন। যুদ্ধ আরও কয়েক বছর ধরে চলেছিল। যুদ্ধে উভয় পক্ষই প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এ সুযোগে হযরত আবু বকর এ দুই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত আরব অঞ্চলগুলো দখল করার পদক্ষেপ নেন।

৬৩৩ সালে খলিফা আবু বকর মুসলিম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে ১০০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী এবং মুসান্নার নেতৃত্বে ৮০০০ সৈন্যের আরেকটি বাহিনী প্রস্তুত করেন। উভয় বাহিনী পারস্য অধিকৃত অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয়। পারস্য সেনাপতি হরমুজের বাহিনীর সাথে মুসলিম বাহিনীর প্রথম সংঘর্ষ হয় উবাল্লার হাফির নামক স্থানে। এ যুদ্ধ ‘শৃঙ্খলের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে।

মুসলমানদের পরবর্তী সফলতা ছিল ‘মহিলার দুর্গ বিজয়ের’ যুদ্ধ। মুসলমানদের তৃতীয় সফলতা ছিল ওয়ালাজার যুদ্ধ। অন্যদিকে খালিদের বাহিনী হীরা, আনবার, আইনুত তামুর ও দুমা দখল করে। সফল পারস্য অভিযানের পর খলিফা বাইজেন্টাইন অধিকৃত আরব অঞ্চলে অভিযানের প্রস্তুতি নেন। খলিফা আমর ইবনুল আস, সুরাহবিল ইবনে হাসানাহ, ইয়াযীদ ইবনে আবু সুফিয়ান এবং আবু উবাইদাহ ইবনে জাররাহ প্রমুখ সেনাপতির নেতৃত্বে ৩৬০০০ মুসলিম সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীকে সিরিয়ায় পাঠান।

এসব মুসলিম সৈন্যরা প্রথমে ছোটখাটো কয়েকটি যুদ্ধে জয় লাভ করেন। এরপর বাইজেন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস এক লক্ষ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বাধা দিতে এগিয়ে আসেন। খলিফা সাথে সাথে খালিদের বাহিনীকেও হীরা ত্যাগ করে সিরিয়ায় যেতে আদেশ করেন। ৬৩৪ সালের ৩০ জুলাই খালিদের নেতৃত্বে সম্মিলিত মুসলিম বাহিনী আজনাদাইনের রণক্ষেত্রে বাইজেন্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করে। দক্ষিণ সিরিয়া মুসলমানদের দখলে আসে এবং হিরাক্লিয়াস তাঁর রাজধানীতে পালিয়ে যান।

৬৩৪ সালে খলিফা আবু বকর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ হওয়ার পর তিনি তাঁর একজন উত্তরাধিকারী মনোনয়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। খোলাফায়ে রাশেদীনদের মধ্যে একমাত্র হযরত আবু বকরই তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারীর নাম ঘোষণা করেছিলেন। এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে বিবেচ্য। কারণ মহানবী কোন উত্তরাধিকারী রেখে যাননি। হযরত আবু বকরের পরবর্তী তিন খলিফাও তাদের কোন উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে যাননি। এক্ষেত্রে হযরত আবু বকর ছিলেন ব্যতিক্রম। হযরত আবু বকর তাঁর জীবদ্দশায়ই তাঁর উত্তরাধিকারীর নাম ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেন।

অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তিনি তাঁর ঘনিষ্ট সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে হযরত উমারকে তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। হযরত তালহা এ ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি করলে খলিফার অনুরোধে তিনিও প্রস্তাবটি মেনে নেন। এর প্রায় ১৫ দিন পর ৬৩৪ সালে ২৩ আগস্ট হযরত আবু বকর মারা যান। তাঁর খিলাফতের বয়স ছিল মাত্র ২ বছর ৩ মাস। হযরত আবু বকর সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ নামে জনৈক সাহাবা বলেন “তাঁর মতো খলিফা না থাকলে ইসলাম ও ইসলামি রাষ্ট্র কোনটাই রক্ষা পেত না, অনিবার্য ধ্বংসের কবলে পড়ে যেত মুসলিম ধর্ম ও সমাজ”।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

বি.দ্র: রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটে লেখকের সবগুলো বই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে লেখকের নামে সার্চ দিলেই যথেষ্ট।

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:৩৫
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×